ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ
বাংলাদেশে
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের যে ক’টি অসুখ দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তি ও মাঝে মধ্যে
মৃত্যুর ঝুঁকিতে পতিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ।
ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হৃদরোগও
তাই। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারেই
অন্তত একজন ডায়াবেটিসের রোগী থাকবে। ডায়াবেটিস দেহের প্রতিটি সিস্টেমকেই
(তন্ত্রকেই) ক্ষতিগ্রস্ত করে। দীর্ঘ দিনের ডায়াবেটিসে চোখ, কিডনি,
হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র, ত্বক, সন্ধি বা জয়েন্ট, প্রজননতন্ত্রসহ দেহের
প্রতিটি তন্ত্রই তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারাবে, রোগাক্রান্ত হবে। এর
মধ্যে হৃদরোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা দু’টিই মারাত্মক। ডায়াবেটিস রোগীরা
অধিকহারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়। আমাদের নিচের আলোচনা থেকে তা
অনেকটা পরিষ্কার হবে। যাদের ডায়াবেটিস টাইপ-২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে
ভোগার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক
স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ
সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ-২
ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭ শতাংশ রক্তে লিপিডের
অস্বাভাবিকতা ও ৮০ শতাংশ দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভোগেন। এসব রোগ একই সূত্রে
বাঁধা এমনো মতামত দেয়া হয়। এরূপ চক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে। যেখানে
অতিরিক্ত দৈহিক ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ, রক্তনালীতে
লিপিড জমাকরণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি একসাথে বিরাজ করে। মেটাবলিক সিনড্রোম
ইনসুলিনের কার্যকারিতার প্রতিবন্ধকতার সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে এখনো এটা
পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি যে, মেটাবলিক সিনড্রোম ইনসুলিনের কার্যকারিতার
প্রতিবন্ধকতার জন্য হচ্ছে না-কি অতিরিক্ত অস্বাভাবিক লিপিডের জন্য হচ্ছে
অথবা দু’টির সমন্বিত ফলাফল। কম বয়সী ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মেটাবলিক
সিনড্রোম খুব একটা দেখা যায় না। আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা বাড়তে থাকে। এর
সীমানা রেখা হলো ৬০ বছর বয়স। যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ বছর বয়সী মানুষের ৪০% থেকে
৪৫% মেটাবলিক সিনড্রোমে ভুগতে দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের ৬৫% মারা যায়
হৃদরোগ ও স্ট্রোকে। প্রতি তিনজন ডায়াবেটিস রোগীর দুইজন হৃদরোগে মারা যায়।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীরা অ-ডায়াবেটিসদের তুলনার দুই থেকে
চার গুণ বেশি হারে হৃদরোগে ভুগছে। মধ্যবয়সীদের বেলাতেও অনুপাত প্রায় একই
রকম। মহিলাদের হৃদরোগ কম হওয়ার কারণ হলো তাদের যৌন হরমোন ইস্ট্রোজেন তাদের
জন্য প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে।
কিন্তু যেসব মহিলা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা এ
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে চলে আসেন এবং অধিকহারে হৃদরোগে ভোগেন।
ডায়াবেটিসে আরো একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে; ডায়াবেটিস রোগীরা অনেক হার্ট
অ্যাটাকের তীব্র ব্যথা অনুভব করতে পারে না। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে
যায় বা আদৌ শুরু করা হয় না। ফলে তারা মারাত্মক জটিলতায় ভুগেন বা অধিকহারে
মৃত্যুবরণ করেন। ডায়াবেটিস রোগীদের সামান্য একটু বেশি হারে রক্তের গ্লুকোজ
বজায় রাখতে পারলেই যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের
এইচবিএ১সি (HbA1C) ১ শতাংশ কমানো গেলেও ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট মৃত্যুহার ২১
শতাংশ কমবে এবং হার্ট অ্যাটাক কমবে ১৪ শতাংশ। ডায়াবেটিসে রক্তচাপ তার
সমবয়সী অন্য মানুষের চেয়ে কম রাখতে হবে। তাদের জন্য আদর্শ রক্তচাপ হলো
<১২০/৭০ মিলিমিটার পারদ। রক্তচাপ কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাখতে পারলে
ডায়াবেটিসজনিত কিডনির জটিলতা অনেকটাই কমানো যেতে পারে। একইসাথে স্ট্রোক,
ডায়াবেটিসে মৃত্যু, হার্ট ফেইলুর ও অন্ধত্বের হারও কমবে। জরিপে দেখা গেছে,
ডায়াবেটিস রোগীর রক্তচাপ ১০ মিলিমিটার পারদ কমানো গেলে ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট
মৃত্যুহার ১৫ শতাংশ কমবে, হার্ট অ্যাটাক কমবে ১১ শতাংশ। ব্যাপক হারে
রক্তের লিপিড কমানোর চিকিৎসা করা উপকারী। ৪০ বছরের বেশি বয়সী ডায়াবেটিস
রোগীর রক্তের লিপিডের পরিমাণ না দেখেই লিপিড কমানোর ওষুধ দেয়া ভালো। এ
ক্ষেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি যথেষ্ট কমবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুবিধ
চিকিৎসাব্যবস্থা আছে। ওষুধ ছাড়া শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক শ্রম বা
ব্যায়াম হলো এর প্রাথমিক স্তর। কারো কারো বেলায় এর সাথে মুখে খাবার ওষুধ
প্রয়োজন হতে পারে। কারো আবার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। তবে সবক্ষেত্রেই
জীবনযাত্রার সহায়ক পরিবর্তন আবশ্যক। জীবনযাপনে শৃঙ্খলা, পরিমিত ও প্রয়োজনীয়
পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত এবং সঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ, দৈহিক ওজন
নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ও পরিমিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম করা ইত্যাদি
বিষয় সঠিকভাবে মেনে চলতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও এর জটিলতা কমানো
সম্ভব।
No comments