নিজের অস্ত্রেই ট্রাম্প ঘায়েল by মারুফ মল্লিক
মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মহাশয় এতটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বেন বলে ধারণা
করা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এখন রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে দাবি
করতে হচ্ছে, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ এবং ভালো কলেজে পাঠ গ্রহণ করে সুশিক্ষায়
শিক্ষিত। এর আগেও অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের মতো কেউ হেনস্তা হয়েছেন বলে জানা নেই। ট্রাম্পকে নিয়ে
গণমাধ্যমের ক্যারিকেচার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা
এখন নিত্যকার ঘটনা। এর সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে সাংবাদিক মাইকেল উলফের বই
‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি: ইনসাইড দ্য ট্রাম্পস হোয়াইট হাউস’-এর প্রকাশ। উলফের
বই ট্রাম্পের জন্য চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এটি ট্রাম্পের
বিরুদ্ধ মতকে আরও উসকে দেবে। কার্যত ট্রাম্পকে এখন অনেকগুলো ফ্রন্টে খেলতে
হচ্ছে। এর বেশির ভাগই সামরিক ও হেজেমনিক ফ্রন্ট। এর সঙ্গে এখন নিজেকে সুস্থ
প্রমাণ করার বিষয়টিও যুক্ত হলো। শনিবার সকালে মার্কিনরা ঘুম থেকে জেগে
ওঠার আগেই ট্রাম্প টুইট করে দেশবাসীকে জানিয়েছেন, তিনি মানসিকভাবে সুস্থ ও
কাজ করার মতো যোগ্য। নিজেকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলেও দাবি করেছেন
ট্রাম্প। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বলা যায়, বইটিতে
উলফ সরাসরিই ট্রাম্পকে অযোগ্য ও অদক্ষ বলে মন্তব্য করেছেন। ট্রাম্প আর
প্রেসিডেন্ট পদে থাকার যোগ্য নন বলেও মনে করছেন। উলফ দাবি করেছেন,
ট্রাম্পসহ তাঁর আশপাশে থাকা শ দুয়েক লোকের সঙ্গে কথা বলে তিনি বইটি রচনা
করেছেন। এ জন্য তিনি দীর্ঘ ১৮ মাসে সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। যদিও
ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন যে উলফের সঙ্গে কখনোই তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি।
বইটি সত্য ঘটনা অনুসারে লেখা হোক বা কল্পকাহিনিই হোক না কেন, মাইকেল উলফ
সফল। প্রকাশের পরপরই বইটি বেস্ট সেলার হিসেবে তালিকার শীর্ষে উঠে গিয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনেকটা অংশজুড়েই ছিল এ নিয়ে আলোচনা। বইটি যাতে
বিক্রি না হয়, ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সে ধরনের চেষ্টা করা হলেও বইয়ের
দোকানগুলোয় পাঠকেরা বেশ আগ্রহ নিয়েই ক্রয় করেছেন। ওদিকে অনলাইন বিক্রেতা
প্রতিষ্ঠান আমাজন তাদের ওয়েবসাইটে বইটি নিয়ে পাঠকের মন্তব্যগুলো মুছে
দিচ্ছে। আমেরিকার বাইরেও ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য বা দূরপ্রাচ্যের সর্বত্র বইটি
আগ্রহের তৈরি করেছে। উলফ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করছেন, বই
প্রকাশ করে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সব কীর্তিকলাপ তিনি প্রকাশ্যে নিয়ে
এসেছেন। ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’র সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কিন জীবনীকার
মাইকেল ডিএন্টনিও বলেছেন, উলফের বই ট্রাম্পের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের একটি
ধাক্কা দিয়েছে। বইটিতে ট্রাম্পকে নির্বোধ (ইডিয়ট) ও তাঁর আশপাশের লোকজনকে
ভাঁড় (ক্লাউন) হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে বলে ডিঅ্যান্টনিও মন্তব্য
করেছেন। রাজনীতিতে শাসকদের ভাবমূর্তি গঠন বলে একটি বিষয় আছে। যেকোনো শাসকের
একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠনের চেষ্টা করা হয় শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ
থেকে। আবার বিপক্ষ মতবাদের দিক থেকে নেতিবাচক ভাবমূর্তি গঠনেরও চেষ্টা
চলে। ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ সেই দিক থেকে ট্রাম্প চরিত্রের হাস্যকর ও খেলো
দিকগুলো আরও বেশি করে তুলে ধরেছে। আগেই বলেছি, ট্রাম্পকে এখন অনেকগুলা
ফ্রন্টে লড়াই করতে হচ্ছে। সৌদি আরবের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনগুলোর
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি যোগাযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের বিক্ষোভেও
মার্কিনদের নিয়ে কথা হচ্ছে। সম্প্রতি আবার ট্রাম্প পাকিস্তান নিয়েও মন্তব্য
করে আলোচনায় এসেছেন। সিরিয়া ও ইরাক ফ্রন্টেও সুবিধাজনক বিদায় হয়নি
মার্কিনদের। জেরুজালেম প্রশ্নে মার্কিন নীতি সারা বিশ্বেই নিন্দিত হয়েছে।
এমতাবস্থায় হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বিষয়াদি ও তাঁর সম্পর্কে
হোয়াইট হাউস কর্মকর্তাদের বিরূপ মন্তব্যের প্রকাশ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির
জন্য খুব একটা সুখকর হবে না। মার্কিন প্রশাসনকে এখন ঘরে-বাইরে দুই ফ্রন্টেই
লড়তে হবে। মার্কিন জনসাধারণকে বিশ্বাস করাতে হবে, তাদের প্রেসিডেন্ট
মানসিকভাবে সুস্থ। মার্কিন নিওকনজারভেটিভদের (নিওকন) প্রোপাগান্ডার বিপরীতে
এখন যেমন মুসলিমদের বলতে হচ্ছে, ইসলাম মানেই সন্ত্রাস নয়। প্রথমে যদি ধরে
নিই, উলফ আসলেই বইটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন। তিনি হোয়াইট হাউসের
কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েই রচনা করেছেন। আরেকটি হতে পারে, উলফ কল্পিত
চিন্তা থেকে নিছক প্রোপাগান্ডামূলক বই লিখেছেন। যা-ই হোক না কেন, এতে
ক্ষয়িষ্ণু মার্কিন হেজেমনির ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। পাগলাটে, খ্যাপা
ট্রাম্পের ভাবমূর্তিকে আরও হাস্যকর করে তুলবে এই বই।
ট্রাম্প হাস্যস্পদ
ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এখান থেকে ফিরে আসা মার্কিনদের জন্য খুবই কঠিন হবে
নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত। এই বই প্রকাশ করে উলফ
মার্কিন কনজারভেটিভদের অনেক দিনের পুরোনো অস্ত্র নিওকন রিপাবলিকানদের দিকেই
ছুড়েছেন। গত শতকের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন কনজারভেটিভরা প্রতিপক্ষকে
ঘায়েলের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিত। সামরিক
আগ্রাসনের দরকারে বা বিরোধী মতবাদের সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য মার্কিন
প্রশাসনের এই নীতির প্রয়োগ দেখা গিয়েছে অনেকবারই। স্মায়ুযুদ্ধকালে
আফগানিস্তান বা ভিয়েতনাম যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোয় আমরা দেখেছি, নায়ক
র্যাম্বো একাই শত্রুপক্ষকে ধরাশায়ী করছে। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো আর দশটা
যুদ্ধের চলচ্চিত্র বলে মনে হলেও বলার অপেক্ষা রাখে না, ওই সব মুভিতে বাম
ধারার বা মার্কসবাদীদের শত্রু হিসেবে দেখানো হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ওই
সব সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডার অগ্রবর্তী ভূমিকা ছিল। সাংস্কৃতিক
প্রোপাগান্ডা সারা বিশ্বেই কমিউনিজমবিরোধী মনোভাব তৈরিতে ব্যাপক আকারে
ভূমিকা রেখেছিল। এ ক্ষেত্রে বিখ্যাত নিওকনজারভেটিভ স্যামুয়েল হান্টিংটনের
সভ্যতার সংঘাত বিষয় বইয়ের কথাও বলা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন-পরবর্তী মার্কিন
হেজেমনি প্রতিষ্ঠার অগ্রবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হান্টিংটনের বইয়ের গভীর
ভূমিকা আছে। সভ্যতার সংঘাতে আরব ও ইউরোপীয় বা খ্রিষ্টান সভ্যতার সঙ্গে
ইসলামিক সভ্যতার যে সংঘাতের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, আজকের সন্ত্রাসবিরোধী
লড়াইয়ে আমরা তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। মোদ্দা কথা, এসব বুদ্ধিবৃত্তিক ও
সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডার যে নীতি মার্কিন কনজারভেটিভরা প্রয়োগ করত, এখন
তারই প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি নিওকন রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধেও। মাইকেল উলফের বই
তার অন্যতম বড় উদাহরণ। হতে পারে উলফ নিওকনদের এই ধারণা সচেতনভাবে গ্রহণ
করেননি। বা সবার মনযোগ আকর্ষণ ও বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যই বইটি
রচনা করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের বাঁকবদল ও পরিবর্তন খুবই বৈচিত্র্যময়,
স্বয়ংক্রিয় এবং কখনো কখনো নির্মম হয়ে ফিরে আসে। নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের
জন্য যে অস্ত্র আপনি প্রয়োগ করবেন, সেটি আবার আপনার দিকেই যে নিক্ষেপিত হবে
না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।
No comments