জুতা শিল্পে নতুন সম্ভাবনা by এম এম মাসুদ
বিশ্বে
চামড়াজাত পণ্য, অর্থাৎ জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ ইত্যাদি বাজারের আকার প্রায়
২২ হাজার কোটি ডলারের। এ বাজারের সিংহভাগ চীনের দখলে। তবে চীনা
কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে
বাংলাদেশের সামনে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির বাজার বাড়ানোর বড় সুযোগ তৈরি
হয়েছে। বিশেষ করে জুতা শিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন এ
খাতের উদ্যোক্তারা। সম্ভাবনা দেখে বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলো পণ্য কেনার
জন্য বাংলাদেশে আসছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি জোরদারের মাধ্যমে বর্তমানে আরো এগিয়ে গেছে দেশের পাদুকা শিল্প। আগামীতে তৈরি পোশাকের সঙ্গে জুতার বাজারও বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে প্রত্যাশা তাদের। তারা জানান, বর্তমানে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ড, আলদো, সিয়ার্স, জেনেসকো, স্টিভ ম্যাডেন, হুগো বস, মেসি’জ, স্যান্ডারগারড, ডায়েচম্যান, এবিসি মার্ট ও এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশ থেকে জুতা কেনা শুরু করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে এ খাতে রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৮ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য মিলিয়ে ১২৩ কোটি ৪০ হাজার ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩.৫ শতাংশ বেশি। পোশাকের পর পণ্য রপ্তানি আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চামড়া খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৪২ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে আছে ৫ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের চামড়া, ১৭ কোটি ডলারের চামড়া পণ্য ও ২০ কোটি ডলারের চামড়ার জুতা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে চামড়ার জুতা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৩.১০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এই খাতের রপ্তানি আয় ৮.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্যবাজার নিয়ে সমপ্রতি একটি বাজার সমীক্ষা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পণ্যবাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকনাভিও। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর বিশ্বে চামড়াজাত পণ্য কেনাবেচা হয়েছে ২১,৭৪৯ কোটি ডলারের।
এদিকে পর্তুগালভিত্তিক জুতা প্রস্তুতকারকদের সংগঠন পর্তুগিজ ফুটওয়্যার, কম্পোনেন্টস, লেদারগুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এপিআইসিসিএপিএস) গত তিন বছরের ফুটওয়্যার ইয়ারবুকে উল্লিখিত উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় শীর্ষ ১০ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। আর শুধু উৎপাদনের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বছরে ২,৩০০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করে চীন। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশটিতে উৎপাদনের পাশাপাশি উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও কমতে শুরু করে। এ সুযোগে বাংলাদেশের উৎপাদকরা নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে গত বছরও জুতা উৎপাদনে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৪ ও ১৫ সালে এ প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৫.৭ ও ১২ শতাংশ। এ তিন বছরে গড়ে ৮.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৪-১৬ সাল, এ তিন বছরের গড় হিসাবে নিলে জুতা উৎপাদনে ২.১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে চীনের। অন্যদিকে উৎপাদন বিবেচনায় শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অষ্টম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি উভয়ই বাড়ছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ২৯ কোটি ৮০ লাখ জোড়া জুতা উৎপাদন করে। ২০১৪ সালে ৩১ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫ সালে ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ও ২০১৬ সালে ৩৭ কোটি ৮০ লাখ জোড়া উৎপাদন করে বাংলাদেশ। এপিআইসিসিএপিএসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত জুতা উৎপাদনে গড় প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল তুরস্কের। এ তিন বছরে দেশটি যথাক্রমে ৩২, ৩৫ ও ৫০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদন করেছে। গড় প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটি উৎপাদন করেছে যথাক্রমে ৭২, ১০০ ও ১১১ কোটি জোড়া জুতা। প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। দেশটি উৎপাদন করে যথাক্রমে ৯১, ১১৪ ও ১১৮ কোটি জোড়া জুতা। একইভাবে তিন বছরে গড়ে ৮.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ আছে চতুর্থ অবস্থানে। উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে পঞ্চম থেকে দশম অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চীন ও থাইল্যান্ড।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা বাজার দখলে কাঙ্ক্ষিত গতি আনতে পারছি না। এগিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে। কারণ এ খাতের সংযোগ শিল্প ইন্ডাস্ট্রি নেই। কারখানার কর্মপরিবেশের মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে থাকলেও রপ্তানিকারক হিসেবে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। তাদের মতে, এ খাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে নীতিসহায়তা ও গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সার্বিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
এপিআইসিসিএপিএসের হিসাবে, রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম। আমদানি বিবেচনায় ৭১তম ও ব্যবহার বিবেচনায় ১২তম অবস্থানে। বাংলাদেশের রপ্তানি করা জুতার ৪২ শতাংশই চামড়াজাত। এ ছাড়া ৩২ শতাংশ বস্ত্রজাত। বাকি ২৬ শতাংশ রাবার ও প্লাস্টিক থেকে তৈরি জুতা।
ব্যবসায়ীরা জানান, এ দেশের চামড়ার অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে কাঁচামাল প্রাপ্তি। কাঁচা চামড়ার চাহিদার পুরোটা দেশেই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে দেশে প্রতি বছর প্রায় বিভিন্ন পশুর ১ কোটি ৬৫ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়।
সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত চামড়াজাত পণ্যের প্রদর্শনীতে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা জানান, চামড়াজাত পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পেছনে ৫টি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো চীন থেকে চামড়াজাত পণ্যের কারখানা সরছে, বাংলাদেশের জুতা ও ব্যাগ তৈরির সক্ষমতা বাড়ছে, এ খাতের মূল কাঁচামাল দেশেই হয়, বাংলাদেশ মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করছে এবং এ দেশের শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা আছে। তবে রপ্তানি বাড়াতে বেশ কিছু সমস্যাও আছে। এগুলো হলো চামড়া প্রক্রিয়াকরণে পরিবেশদূষণ, রপ্তানিতে লিডটাইম বা পণ্য তৈরি করে জাহাজীকরণ করতে সময় বেশি লাগে, এ দেশে পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব, শ্রমিকের দক্ষতায় ঘাটতি এবং কারিগরি জ্ঞানের অভাব।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পাদুকা উৎপাদনকারী অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, বাজার ধরতে আমাদের প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে হলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, সাধারণ জুতা তৈরি করে বাজার ধরা যাবে না। এজন্য বাংলাদেশে পণ্য উন্নয়ন কেন্দ্র বা প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আসছে। তবে তারা সার্বিক মান বা কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন। যে গরুর চামড়া দিয়ে জুতা হচ্ছে, সেই গরুটি কোন ঘাস খেয়েছে, এটাও তারা জানতে চায়।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট চামড়ার ২০-২৫ শতাংশ ব্যবহার করে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার হয়েছে। দেশের চামড়ার আরও ৩০ শতাংশ ব্যবহার করে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করতে পারলে ২০২১ সালে এ খাতে রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলার করা সম্ভব।
চামড়া রপ্তানিকারকরা বলছেন, বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের চামড়া কেনে না। কারণ, এ দেশের ট্যানারিগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণ করার অভিযোগ রয়েছে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরে পরিবেশবান্ধব উপায়ে উৎপাদন শুরু হলে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় বাড়বে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, উৎপাদন প্রবৃদ্ধি জোরদারের মাধ্যমে বর্তমানে আরো এগিয়ে গেছে দেশের পাদুকা শিল্প। আগামীতে তৈরি পোশাকের সঙ্গে জুতার বাজারও বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে প্রত্যাশা তাদের। তারা জানান, বর্তমানে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ড, আলদো, সিয়ার্স, জেনেসকো, স্টিভ ম্যাডেন, হুগো বস, মেসি’জ, স্যান্ডারগারড, ডায়েচম্যান, এবিসি মার্ট ও এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশ থেকে জুতা কেনা শুরু করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে এ খাতে রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৮ কোটি ডলার। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য মিলিয়ে ১২৩ কোটি ৪০ হাজার ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল ১০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩.৫ শতাংশ বেশি। পোশাকের পর পণ্য রপ্তানি আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চামড়া খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৪২ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে আছে ৫ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের চামড়া, ১৭ কোটি ডলারের চামড়া পণ্য ও ২০ কোটি ডলারের চামড়ার জুতা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে চামড়ার জুতা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৩ কোটি ৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৩.১০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এই খাতের রপ্তানি আয় ৮.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।
বৈশ্বিক চামড়াজাত পণ্যবাজার নিয়ে সমপ্রতি একটি বাজার সমীক্ষা করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক পণ্যবাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেকনাভিও। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর বিশ্বে চামড়াজাত পণ্য কেনাবেচা হয়েছে ২১,৭৪৯ কোটি ডলারের।
এদিকে পর্তুগালভিত্তিক জুতা প্রস্তুতকারকদের সংগঠন পর্তুগিজ ফুটওয়্যার, কম্পোনেন্টস, লেদারগুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এপিআইসিসিএপিএস) গত তিন বছরের ফুটওয়্যার ইয়ারবুকে উল্লিখিত উৎপাদন প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় শীর্ষ ১০ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। আর শুধু উৎপাদনের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে।
সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বছরে ২,৩০০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদন হয়। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করে চীন। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে দেশটিতে উৎপাদনের পাশাপাশি উৎপাদন প্রবৃদ্ধিও কমতে শুরু করে। এ সুযোগে বাংলাদেশের উৎপাদকরা নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার ফলে গত বছরও জুতা উৎপাদনে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৪ ও ১৫ সালে এ প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৫.৭ ও ১২ শতাংশ। এ তিন বছরে গড়ে ৮.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৪-১৬ সাল, এ তিন বছরের গড় হিসাবে নিলে জুতা উৎপাদনে ২.১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে চীনের। অন্যদিকে উৎপাদন বিবেচনায় শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অষ্টম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি উভয়ই বাড়ছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ২৯ কোটি ৮০ লাখ জোড়া জুতা উৎপাদন করে। ২০১৪ সালে ৩১ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫ সালে ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ও ২০১৬ সালে ৩৭ কোটি ৮০ লাখ জোড়া উৎপাদন করে বাংলাদেশ। এপিআইসিসিএপিএসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত জুতা উৎপাদনে গড় প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল তুরস্কের। এ তিন বছরে দেশটি যথাক্রমে ৩২, ৩৫ ও ৫০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদন করেছে। গড় প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটি উৎপাদন করেছে যথাক্রমে ৭২, ১০০ ও ১১১ কোটি জোড়া জুতা। প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। দেশটি উৎপাদন করে যথাক্রমে ৯১, ১১৪ ও ১১৮ কোটি জোড়া জুতা। একইভাবে তিন বছরে গড়ে ৮.২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশ আছে চতুর্থ অবস্থানে। উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে পঞ্চম থেকে দশম অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চীন ও থাইল্যান্ড।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা বাজার দখলে কাঙ্ক্ষিত গতি আনতে পারছি না। এগিয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে। কারণ এ খাতের সংযোগ শিল্প ইন্ডাস্ট্রি নেই। কারখানার কর্মপরিবেশের মান ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে থাকলেও রপ্তানিকারক হিসেবে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। তাদের মতে, এ খাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে নীতিসহায়তা ও গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সার্বিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
এপিআইসিসিএপিএসের হিসাবে, রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ২২তম। আমদানি বিবেচনায় ৭১তম ও ব্যবহার বিবেচনায় ১২তম অবস্থানে। বাংলাদেশের রপ্তানি করা জুতার ৪২ শতাংশই চামড়াজাত। এ ছাড়া ৩২ শতাংশ বস্ত্রজাত। বাকি ২৬ শতাংশ রাবার ও প্লাস্টিক থেকে তৈরি জুতা।
ব্যবসায়ীরা জানান, এ দেশের চামড়ার অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে কাঁচামাল প্রাপ্তি। কাঁচা চামড়ার চাহিদার পুরোটা দেশেই পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে দেশে প্রতি বছর প্রায় বিভিন্ন পশুর ১ কোটি ৬৫ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়।
সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত চামড়াজাত পণ্যের প্রদর্শনীতে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক উদ্যোক্তারা জানান, চামড়াজাত পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পেছনে ৫টি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো চীন থেকে চামড়াজাত পণ্যের কারখানা সরছে, বাংলাদেশের জুতা ও ব্যাগ তৈরির সক্ষমতা বাড়ছে, এ খাতের মূল কাঁচামাল দেশেই হয়, বাংলাদেশ মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করছে এবং এ দেশের শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা আছে। তবে রপ্তানি বাড়াতে বেশ কিছু সমস্যাও আছে। এগুলো হলো চামড়া প্রক্রিয়াকরণে পরিবেশদূষণ, রপ্তানিতে লিডটাইম বা পণ্য তৈরি করে জাহাজীকরণ করতে সময় বেশি লাগে, এ দেশে পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব, শ্রমিকের দক্ষতায় ঘাটতি এবং কারিগরি জ্ঞানের অভাব।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পাদুকা উৎপাদনকারী অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, বাজার ধরতে আমাদের প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে হলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, সাধারণ জুতা তৈরি করে বাজার ধরা যাবে না। এজন্য বাংলাদেশে পণ্য উন্নয়ন কেন্দ্র বা প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আসছে। তবে তারা সার্বিক মান বা কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন। যে গরুর চামড়া দিয়ে জুতা হচ্ছে, সেই গরুটি কোন ঘাস খেয়েছে, এটাও তারা জানতে চায়।
লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট চামড়ার ২০-২৫ শতাংশ ব্যবহার করে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার হয়েছে। দেশের চামড়ার আরও ৩০ শতাংশ ব্যবহার করে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করতে পারলে ২০২১ সালে এ খাতে রপ্তানি আয় ৫০০ কোটি ডলার করা সম্ভব।
চামড়া রপ্তানিকারকরা বলছেন, বৈশ্বিক বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের চামড়া কেনে না। কারণ, এ দেশের ট্যানারিগুলোর বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণ করার অভিযোগ রয়েছে। সাভারের চামড়া শিল্পনগরে পরিবেশবান্ধব উপায়ে উৎপাদন শুরু হলে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় বাড়বে।
No comments