সরকারি স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি ব্যয় ১১ শ’ কোটি টাকা
সরকারি
মাধ্যমিক স্কুলে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) স্থাপনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে
সরকার। এ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ১১৬ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ে দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬৩টি স্কুলে এই এসকেলেটর স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে
মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর। প্রতি জোড়া এসকেলেটরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮৫
লাখ টাকা। এ দিকে দেশের শিক্ষার মান, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখন
অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এসকেলেটর নামক বিলাসী প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে
প্রশ্ন তুলেছে খোদ সরকারের পরিকল্পনা কমিশন। একই সাথে এ ধরনের অদ্ভুত
প্রস্তাবকে বিশাল আকারের লুটপাটের পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন
বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেখানে দেশের বেশির ভাগ সরকারি, আধা সরকারি ও
বেসরকারি স্কুলের অবকাঠামো খুবই দুর্বল, ভবন ও ক্লাস রুমের সঙ্কট,
বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতির সঙ্কট, টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী, লাইব্রেরি,
ল্যাব ও কম্পিউটার কক্ষ নেই বললেই চলে; সেখানে এসকেলেটরের মতো ব্যয়বহুল
যান্ত্রিক সিঁড়ি স্থাপন শুধু গরিবের ঘোড়া রোগই নয়, বিপজ্জনকও বটে। সরকারি
স্কুল ভবনগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রেও যথোপযুক্ত নিয়মনীতি ও উপকরণের ব্যবহারের
বিষয়টিও যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এসকেলেটরের ভার
এসব ভবনের ছাদ ও মেঝে বহন করতে গিয়ে বিপর্যয়ের মুখে পতিত হওয়ার আশঙ্কাও
রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সহজ লভ্যতা ও নিয়মিত মেইনটেইন্যান্সের
প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়েও যথেষ্ট কথা রয়েছে। সর্বোপরি যাদের জন্য এ এসকেলেটর
স্থাপনের প্রস্তাব এসেছে, গ্রামগঞ্জের সেসব কোমলমতি শিশু এগুলো ব্যবহারে
সুফল ভোগ করবে নাকি বিশ্বের কয়েকটি উন্নত দেশের মতো স্কুল শিক্ষার্থীরা এ
যন্ত্র ব্যবহার করতে গিয়ে পা আটকে অথবা হঠাৎ চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক কারণে
বন্ধ হয়ে গেলে মর্মান্তিক মৃত্যুসহ আহতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে; তা
নিয়েও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রামের শিশুরা এসব চলন্ত সিঁড়ির সাথে
পা মেলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাশের দেশসহ
অধিকাংশ উন্নত দেশেই স্কুলপর্যায়ে এ ধরনের এসকেলেটরের ব্যবহার নেই। আর
দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ই দোতলার বেশি নয়। কাজেই দোতলায় ওঠানামার জন্য
এসকেলেটরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অধিদফতরের প্রস্তাবনা
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সারা দেশে ৩৩৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর
মধ্যে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য
প্রকল্প নেয়া আছে। যার ব্যয় চার হাজার ৬৪০ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। ছয়
মাসের ব্যবধানে এই ব্যয় এক হাজার ৫২৫ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ
বাড়িয়ে ছয় হাজার ১৬৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। নতুন করে ১৬৩টি
বিদ্যালয়ে এসকেলেটর স্থাপনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। এই এসকেলেটরের জন্য
প্রতিটি বিদ্যালয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এ দিকে মাধ্যমিক
শিক্ষা অধিদফতরের এসকেলেটর স্থাপনের প্রস্তাবের বিপক্ষে আপত্তি উত্থাপন
করেছে পরিকল্পনা কমিশন। তারা মন্তব্য করেছেন, এক হাজার ১১৬ কোটি টাকার
বিশাল ব্যয়ে এ ধরনের বিলাসিতার কোনো প্রয়োজন নেই।
তাদের পর্যবেক্ষণে বলা
হয়েছে, এই সিঁড়ি স্থাপন করা হলে এটি ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা নানা ধরনের
দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। পাশের কোনো দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ে
মাল্টিস্টোরিড এসকেলেটর আছে বলে জানা নেইÑ এমন মন্তব্য করেছে প্রকল্প
মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রেও জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা
গেছে, এসকেলেটর স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের যুক্তি
হলো, এর মাধ্যমে এক সাথে অনেক শিক্ষার্থী ওঠানামা করতে পারবে। বহুতল ভবনে
তাদের ওঠানামার পরিশ্রম কমে যাবে। অন্য দিকে পিইসি বলছে, এমনিতেই
স্কুলগুলোতে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে, তার ওপর এসকেলেটর স্থাপনের জন্য অনেক
জায়গা প্রয়োজন। এসকেলেটর স্থাপন করতে গেলে প্রতিটি ভবনের মাঝের ও নিচের
ফ্লোর ভাঙতে হবে, যা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এগুলো করতে গেলে একটি বড় সময়ের জন্য
স্কুল বন্ধ দিতে হবে; যাতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তা ছাড়া
স্কুল শুরু ও ছুটির সময় শত শত শিক্ষার্থী একসাথে ওঠানামা করতে গেলে তা
সময়সাপেক্ষ হবে। ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
এসকেলেটর কোনো কারণে আটকে গেলে কোমলমতি শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করলে
দুর্ঘটনা অনিবার্য। এতে শিশুদের মাঝে ভীতিসহ নেতিবাচক মানসিক প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থীরা এসকেলেটর ব্যবহার
করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হতাহত হয়েছে এমন বেশ কিছু উদাহরণও রয়েছে বলে
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ম্যানহাটন মাল্টিপ্লেক্স থিয়েটারে ২০০৫ সালের ১৩
জানুয়ারি মুভি দেখতে গিয়ে সিনেপ্লেক্সের এসকেলেটরে পা আটকে ব্রুকলিন
স্কুলের ৩০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। তাদের শরীরে কেটে যায় ও
আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অন্য দিকে পূর্ব চীনে নানজিংয়ে একটি জাদুঘর পরিদর্শন করতে
গিয়ে প্রাথমিক স্কুলের ১৬ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। গত ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর এ
ঘটনাটি ঘটে চীনের জিয়ানংসু প্রদেশে হংকং ইয়াং স্কয়ারে। দ্য পিপলস ডেইলি
অনলাইনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। ৪০ জন শিক্ষার্থী এসকেলেটরে ওঠে। সেখানে
পাঁচজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়। পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসকেলেটর
বা লিফট সচল রাখার জন্য সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত
করতে হবে। এগুলো চালু হওয়ার পর কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তা গণপূর্ত
অধিদফতর বা সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দ্রুততার সাথে মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া
সম্ভব হবে কি না? এ ছাড়া আর্থিক সংশ্লেষ ও মফস্বল শহরে এর ব্যবহার নিশ্চিত
করার জন্য পেশাদার দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন। তবে শিক্ষার্থীদের শারীরিক
বৃদ্ধিসহ শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এসকেলেটর বা লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি
দিয়ে ওঠানামা খুবই কার্যকর। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,
মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের চলাফেরার জন্য এসকেলেটর ব্যবহার
কারিগরি দিক দিয়ে উপযোগ্য কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ননা শিক্ষার্থীদের
চলাফেরার জন্য এসকেলেটর ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এসকেলেটর ব্যবহারের
সুবিধা থাকলেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে কিছুটা উত্তেজনা কাজ করতে
পারে। ফলে তারা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে এসকেলেটরে ওঠানামা করার বিষয়টি মেনে
চলতে না পারলে বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হবে। এ ছাড়াও শিক্ষা প্রকৌশল
অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী পিইসিকে জানান, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত
করা হয়নি। এসকেলেটর স্থাপনের সাথে জড়িত নিরাপত্তা পদক্ষেপ ও কারিগরি
ঝুঁকিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক দিক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা প্রয়োজন
ছিল বলে পিইসি মতামত দিয়েছে। এসকেলেটর স্থাপন প্রকল্পের ব্যাপারে সুজনের
সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের কোনো
যৌক্তিকতা আমি দেখছি না। যেখানে স্কুলগুলোতে এখনো অর্থসঙ্কট রয়েছে, সেখানে এ
এসকেলেটর সিঁড়ি বসানো অর্থহীন। আমাদের প্রয়োজন শিক্ষার মান উন্নয়নে অর্থ
বরাদ্দ দেয়া। কিন্তু এ এসকেলেটর সিঁড়ি দিয়ে শিক্ষার মানে কী উন্নয়ন হবে?
বিশ্বব্যাংকে ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ধরনের
প্রকল্প প্রস্তাবনা হাস্যকর মনে হচ্ছে। এ প্রকল্পের আর্থিক সুবিধাটা কী হবে
সেটি ভেবে দেখতে হবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে এখনো শিক্ষা সুবিধায় অনেক
সঙ্কট রয়েছে, সেখানে এ ধরনের একটা প্রকল্প অযৌক্তিক। তিনি বলেন, বিদ্যালয়
পর্যায়ে বিদেশের কোথাও আমি এসকেলেটর ব্যবহার দেখিনি। এটি বিমানবন্দর,
শপিংমলসহ যেখানে লোকসমাগম অনেক বেশি থাকে, সেখানে ব্যবহার করা হয়। এ
প্রকল্প মানে অর্থের অপচয়। এসকেলেটর দিয়ে না হবে শিক্ষা, না হবে স্বাস্থ্য।
No comments