বন্যার পরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কী করে সামলাচ্ছে?
দূর ক্রমশ সুদূর হচ্ছে
সাঘাটা, ফুলছুরি, মোল্লারচর, কামারজানি, গাইবান্ধা যেতে উড়োজাহাজে কেউ সৈয়দপুর যায় না; কিন্তু এখন সারা দেশেই রাস্তাঘাটের এমন হাল হয়েছে যে সে কথা যত কম বলা যায়, ততই টাই-পরা মন্ত্রীর মঙ্গল। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার পিকআপচালক হারুন আকন্দ নিরুপায় হয়ে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছে। সেটা দেখে সহকর্মী নেত্রকোনানিবাসী জামিল খানের বিস্ময় লাগলেও অবাক বা অজ্ঞান হওয়ার কিছু নেই। ইদানীং ১৭-১৮ ঘণ্টার আগে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা পৌঁছানো ভাগ্যের ব্যাপার—দোষ নন্দ ঘোষ বন্যার। (আধুনিক ফ্যাশন মেনে জলবায়ু পরিবর্তনকেও কি দায়ী করা যায়? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমানোর কালচারে এখন ডুবে থাকাই যেন আমাদের খাসলতে পরিণত হয়েছে)। তবে উড়োজাহাজের টিকিট থাকলেই যে সৈয়দপুর পৌঁছানো যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো। পোপ আসবেন, তাই রানওয়ে বন্ধ—বিমানবন্দরে ফ্লাইটবন্দী মানুষের থিকথিকে ভিড়; এটাও কি বিগত বন্যার দোষ? তিনি কখন আসবেন, কবে আসবেন, ছয় মাস আগে থেকেই সবার জানা ছিল, তারপরও এই অব্যবস্থা কেন? মাথার সবটাই কি বন্ধক! না পচন ধরেছে মগজে-চিন্তায়-ব্যবস্থাপনায়-গভর্নেন্সে?
জল সরে না, জমিতে জো আসে না!
রাধাগোবিন্দপুর এখন আর বিল-জলের নামা জমি নয়; বিলের বুক চিরে (নাকি ছিঁড়ে) এখন কাবিখার (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে তৈরি) রাস্তা। ইমারত, চালকল, চাতাল, ইটভাটা সেই পথের দুধারে উন্নয়নের ঘণ্টা বাজিয়ে মাতোয়ারা করে রাখছে। সেসব বাজনায় কান ঝালাপালা হলেও সফুলের (নাম বোধ সাইফুলই হবে, কিন্তু নিশ্চত করল তিনবার নাম তার সফুল) মাতোয়ারা হওয়ার ফুরসত নেই। কাকডাকা ভোরে সে ভাই-বোন-দুলাভাই নিয়ে বর্গা/আধি নেওয়া জমির আটকে থাকা জল ছাঁকতে কাদাজলে একসা। অন্য বছর এত দিনে জালা (ধানের চারা) গজিয়ে তিন-চার ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায়; এবার বন্যার পানি আটকে আছে জন্মের মতো। পানি সরে না; কাবিখাতে তৈরি উন্নয়নের এক জটিল সড়ক আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাথায়-বগলে না-কালভার্ট না-ব্রিজ তৈরির প্রচেষ্টার এই ফলাফল, জানাল সফুল। পানি সরার জন্য তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করে এখন তারা এক অন্যায্য যুদ্ধের মুখোমুখি। বাড়ির ঘটি-বাটি-বদনা-গামলা দিয়ে পানি ছাঁকতে নেমেছে সবাই। সময় বয়ে যায়, সময় গেলে ধান-সাধন কিছুই হবে না। কী মনে হলো, ফোন দিলাম মৌলভীবাজারের সহকর্মীকে। বলেন, ‘গতকাল কভার করেছি, ইংরেজি পেপার পড়েন।’ হাকালুকির কৃষকদের মাথায় হাত—পানি সরছে না, বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। কবে পানি সরবে, কবে বীজতলা বানাবে আর কবেইবা চারা রুইবে? কোরবানপুর, উত্তর সাদিপুর, মউরগৌরী, সারশাকান্দি আর বারদলের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষক জানে না কোন ত্রাণকর্তা তাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। এসব নেহাতই ভুলভাল ব্যবস্থাপনার নতিজা। বাঁধ না হয় ইঁদুরে কেটেছিল, পানি নামাতে দুই কোদাল মাটি কাটতে বা মেশিন লাগাতে বাধা কই? বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন মানে কী? কৃষককে আবার কৃষিতে ফিরিয়ে আনা, না তাকে খেদিয়ে ইটভাটার ইতর জীবনে পাচার করা? বেশি ঢল নামলে, বেশি পানি এলে নানা কায়দায় নয়া বেকায়দার তৈরি অবকাঠামোর দোয়া-বদদোয়ায় জল যে আটকে যাবে, তা কি অজানা কোনো কথা? এলান হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ কৃষি পুনর্বাসনের মকসুদে কৃষকপ্রতি ৫ কেজি বীজ, ২০ কেজি সার (কী সার কে জানে) আর নগদ এক হাজার টাকা বিতরণ করবে। জমিতে জো না এলে, পানি না সরলে কৃষক এসব দিয়ে কী করবে? তা ছাড়া এসব সাহায্যে ভাগচাষি (আদি খাতক) ভূমিহীনদের কোনো হিস্যা নেই। পাবে জমি যার, বন্যার সাহায্য হবে তার। যে কৃষক আগাম শ্রম বেচে, চরম সুদে টাকা নিয়ে দিনরাত খেটে ধান বুনে বন্যায় মরেছে, সে পাবে না কিছুই। তবে জমির পানি নিকাশের ব্যবস্থা করলে ওই প্রান্তিক মানুষটারও অল্পবিস্তর উপকার হতো বৈকি।
বিল এখন পগার, আধি এখন অগ্রিম
গাইবান্ধার সফুলের পরিকল্পনা কি চকের বাকি অংশগুলো নিয়ে? এখন যেটার কাজ ধরেছে, সেটা নিচু জমির মধ্যে কম নিচু একটা খণ্ড আরকি। আরও বড় দুটি খণ্ড আছে আধি বা বর্গা নেওয়া—সেখানে এখনো থই থই পানি। ‘ও, আপনি পগারের কথা বলছেন?’ আগে যখন জখম হয়নি, এই বিল তখন থাকত বড় বড় মাছ আর এটা তো এখন পগার (নালা বা ড্রেন)। আহা, রাধাগোবিন্দপুরের বিলটার যদি জবান থাকত, সে যদি বলতে পারত? কী আর করত! পগার হওয়ার বেদনা নিয়ে কি বুদ্ধিমানদের কাছে ধরনা দিত একটা মানববন্ধনের জন্য? স্পনসরের মার্কাওয়ালা গেঞ্জি পরে শাহবাগে দাঁড়াতেও এখন পয়সা লাগে—হা মুক্তি, হা স্বাধীনতা! আধি বোধ হয় আর রাখতে পারবে না সফুলরা। এখন সবাই অগ্রিম চায়; ফসল উঠলে তিন ভাগ কেউ আর নিতে চায় না। বলে, তুমি বরং বন্ধক নাও; বিঘাপ্রতি লাখ টাকা। আমি খাজনা কেটে যেদিন টাকা ফেরত দেব, সেদিন থেকে আবার হিসাব। লাখ টাকা কোথায় পাবে সফুলরা? সফুল তাই রঙের কাজ শিখছে, সে হবে পেইনটার সুফল। ‘যাবার বেলায় রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও গো তুমি’; পেইন্টার সফুলের পেইনটা যদি আমাদের জাঁদরেলরা একটু বুঝতে পারত!
গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাঘাটা, ফুলছুরি, মোল্লারচর, কামারজানি, গাইবান্ধা যেতে উড়োজাহাজে কেউ সৈয়দপুর যায় না; কিন্তু এখন সারা দেশেই রাস্তাঘাটের এমন হাল হয়েছে যে সে কথা যত কম বলা যায়, ততই টাই-পরা মন্ত্রীর মঙ্গল। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার পিকআপচালক হারুন আকন্দ নিরুপায় হয়ে ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছে। সেটা দেখে সহকর্মী নেত্রকোনানিবাসী জামিল খানের বিস্ময় লাগলেও অবাক বা অজ্ঞান হওয়ার কিছু নেই। ইদানীং ১৭-১৮ ঘণ্টার আগে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা পৌঁছানো ভাগ্যের ব্যাপার—দোষ নন্দ ঘোষ বন্যার। (আধুনিক ফ্যাশন মেনে জলবায়ু পরিবর্তনকেও কি দায়ী করা যায়? উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমানোর কালচারে এখন ডুবে থাকাই যেন আমাদের খাসলতে পরিণত হয়েছে)। তবে উড়োজাহাজের টিকিট থাকলেই যে সৈয়দপুর পৌঁছানো যায় না, তা আবারও প্রমাণিত হলো। পোপ আসবেন, তাই রানওয়ে বন্ধ—বিমানবন্দরে ফ্লাইটবন্দী মানুষের থিকথিকে ভিড়; এটাও কি বিগত বন্যার দোষ? তিনি কখন আসবেন, কবে আসবেন, ছয় মাস আগে থেকেই সবার জানা ছিল, তারপরও এই অব্যবস্থা কেন? মাথার সবটাই কি বন্ধক! না পচন ধরেছে মগজে-চিন্তায়-ব্যবস্থাপনায়-গভর্নেন্সে?
জল সরে না, জমিতে জো আসে না!
রাধাগোবিন্দপুর এখন আর বিল-জলের নামা জমি নয়; বিলের বুক চিরে (নাকি ছিঁড়ে) এখন কাবিখার (কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে তৈরি) রাস্তা। ইমারত, চালকল, চাতাল, ইটভাটা সেই পথের দুধারে উন্নয়নের ঘণ্টা বাজিয়ে মাতোয়ারা করে রাখছে। সেসব বাজনায় কান ঝালাপালা হলেও সফুলের (নাম বোধ সাইফুলই হবে, কিন্তু নিশ্চত করল তিনবার নাম তার সফুল) মাতোয়ারা হওয়ার ফুরসত নেই। কাকডাকা ভোরে সে ভাই-বোন-দুলাভাই নিয়ে বর্গা/আধি নেওয়া জমির আটকে থাকা জল ছাঁকতে কাদাজলে একসা। অন্য বছর এত দিনে জালা (ধানের চারা) গজিয়ে তিন-চার ইঞ্চি লম্বা হয়ে যায়; এবার বন্যার পানি আটকে আছে জন্মের মতো। পানি সরে না; কাবিখাতে তৈরি উন্নয়নের এক জটিল সড়ক আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাথায়-বগলে না-কালভার্ট না-ব্রিজ তৈরির প্রচেষ্টার এই ফলাফল, জানাল সফুল। পানি সরার জন্য তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করে এখন তারা এক অন্যায্য যুদ্ধের মুখোমুখি। বাড়ির ঘটি-বাটি-বদনা-গামলা দিয়ে পানি ছাঁকতে নেমেছে সবাই। সময় বয়ে যায়, সময় গেলে ধান-সাধন কিছুই হবে না। কী মনে হলো, ফোন দিলাম মৌলভীবাজারের সহকর্মীকে। বলেন, ‘গতকাল কভার করেছি, ইংরেজি পেপার পড়েন।’ হাকালুকির কৃষকদের মাথায় হাত—পানি সরছে না, বীজতলা তৈরি করতে পারছে না। কবে পানি সরবে, কবে বীজতলা বানাবে আর কবেইবা চারা রুইবে? কোরবানপুর, উত্তর সাদিপুর, মউরগৌরী, সারশাকান্দি আর বারদলের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষক জানে না কোন ত্রাণকর্তা তাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। এসব নেহাতই ভুলভাল ব্যবস্থাপনার নতিজা। বাঁধ না হয় ইঁদুরে কেটেছিল, পানি নামাতে দুই কোদাল মাটি কাটতে বা মেশিন লাগাতে বাধা কই? বন্যাপরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন মানে কী? কৃষককে আবার কৃষিতে ফিরিয়ে আনা, না তাকে খেদিয়ে ইটভাটার ইতর জীবনে পাচার করা? বেশি ঢল নামলে, বেশি পানি এলে নানা কায়দায় নয়া বেকায়দার তৈরি অবকাঠামোর দোয়া-বদদোয়ায় জল যে আটকে যাবে, তা কি অজানা কোনো কথা? এলান হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ কৃষি পুনর্বাসনের মকসুদে কৃষকপ্রতি ৫ কেজি বীজ, ২০ কেজি সার (কী সার কে জানে) আর নগদ এক হাজার টাকা বিতরণ করবে। জমিতে জো না এলে, পানি না সরলে কৃষক এসব দিয়ে কী করবে? তা ছাড়া এসব সাহায্যে ভাগচাষি (আদি খাতক) ভূমিহীনদের কোনো হিস্যা নেই। পাবে জমি যার, বন্যার সাহায্য হবে তার। যে কৃষক আগাম শ্রম বেচে, চরম সুদে টাকা নিয়ে দিনরাত খেটে ধান বুনে বন্যায় মরেছে, সে পাবে না কিছুই। তবে জমির পানি নিকাশের ব্যবস্থা করলে ওই প্রান্তিক মানুষটারও অল্পবিস্তর উপকার হতো বৈকি।
বিল এখন পগার, আধি এখন অগ্রিম
গাইবান্ধার সফুলের পরিকল্পনা কি চকের বাকি অংশগুলো নিয়ে? এখন যেটার কাজ ধরেছে, সেটা নিচু জমির মধ্যে কম নিচু একটা খণ্ড আরকি। আরও বড় দুটি খণ্ড আছে আধি বা বর্গা নেওয়া—সেখানে এখনো থই থই পানি। ‘ও, আপনি পগারের কথা বলছেন?’ আগে যখন জখম হয়নি, এই বিল তখন থাকত বড় বড় মাছ আর এটা তো এখন পগার (নালা বা ড্রেন)। আহা, রাধাগোবিন্দপুরের বিলটার যদি জবান থাকত, সে যদি বলতে পারত? কী আর করত! পগার হওয়ার বেদনা নিয়ে কি বুদ্ধিমানদের কাছে ধরনা দিত একটা মানববন্ধনের জন্য? স্পনসরের মার্কাওয়ালা গেঞ্জি পরে শাহবাগে দাঁড়াতেও এখন পয়সা লাগে—হা মুক্তি, হা স্বাধীনতা! আধি বোধ হয় আর রাখতে পারবে না সফুলরা। এখন সবাই অগ্রিম চায়; ফসল উঠলে তিন ভাগ কেউ আর নিতে চায় না। বলে, তুমি বরং বন্ধক নাও; বিঘাপ্রতি লাখ টাকা। আমি খাজনা কেটে যেদিন টাকা ফেরত দেব, সেদিন থেকে আবার হিসাব। লাখ টাকা কোথায় পাবে সফুলরা? সফুল তাই রঙের কাজ শিখছে, সে হবে পেইনটার সুফল। ‘যাবার বেলায় রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও গো তুমি’; পেইন্টার সফুলের পেইনটা যদি আমাদের জাঁদরেলরা একটু বুঝতে পারত!
গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments