রবীন্দ্রনাথ, ভাবনাবলয়
প্রথমে কয়েকটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। এক, কেন পড়ব রবীন্দ্রনাথ? আসলে এটা আরও বড় একটা প্রশ্নের অঙ্গ- কেন পড়ব সাহিত্য, কেন দেখব ছবি, কেন শুনব গান ইত্যাদি ইত্যাদি। খেয়েদেয়ে এত কাজ থাকতে কেন যাব শিল্পের কাছে আশ্রয় চাইতে? অবশ্যই এর একটা উত্তর হবে বিনোদনের জন্য, মজা, সুখ বা আনন্দ পাব বলে, যে জন্য আমরা দেখি সিনেমা, নাটক, সিরিয়াল, ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ, রিং-এর মধ্যে আমেরিকান ফ্রিস্টাইল কুস্তি; যেমন শুনি জলসা। এই উত্তরগুলো দিতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আর একটা প্রশ্ন লাফিয়ে সামনে চলে আসে- শুধু তাই কি? শুধুই তাই? আমরা জানি এর মধ্যে কতগুলো ‘শুধুই’ বিনোদন। তার সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যকে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য থেকে শুধু বিনোদনের মৃগয়া করতে চাও তুমি, আর কোনো বড় সন্ধান তোমার নেই? শুধু এক শারীরিক উত্তেজনা আর তার প্রশমন- যার অনেকটাই জৈবিক? আমি জানি, এ প্রশ্নের উত্থাপনমাত্র পাঠকেরা হইহই করে বলে উঠবেন, বলবেন- না, শিল্প-সাহিত্যের কাছ থেকে শুধুই বিনোদন চাই না।
বিনোদন থাকে তো ঠিক আছে, কিন্তু আরও কিছু কিছু লক্ষ্য আছে আমাদের। সে লক্ষ্যগুলো কী তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন, সবাই যে পরিষ্কার বুঝি তাও নয়। তবু ধরা যাক, পৃথিবী আর এই বিশ্বচরাচরকে জানা, আর আমি যে এই বিরাট অস্তিত্বের একটা অংশ তা উপলব্ধি করা; বিশ্বব্যাপী মানুষকে জানা, বোঝা যে আমরা ওই অন্তহীন সত্তার অংশ; শিল্পে তুলে ধরা মানুষের বিপুল সুখ-দুঃখ, বিস্ময়, উল্লাস, ঘৃণা, ভয়, স্বপ্ন সংগ্রামের মধ্যে, অন্তত মনে মনে, অংশ নেয়া। সব মানুষের মধ্যে যে গহনতম মানুষ, ‘যার কোনো পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে’, তার শরিক হওয়া। মানুষের ক্রমবিস্তারমান শুভংকর প্রজ্ঞাকে একটু ছুঁয়ে দেখা, বোঝার চেষ্টা করা যে, (এই লেখকের মতে) পৃথিবীতে কুড়িয়ে পাওয়া একটিমাত্র জীবনে, বাঁচার মানে কী, কীভাবে বাঁচা (বা মরা) ‘মানুষের’ উচিত। আরও নিশ্চয়ই অনেক লক্ষ্য আছে, রবীন্দ্রনাথেরই কথা ‘উপরের লক্ষ্য’ আর ‘তলাকার লক্ষ্য’- অন্যেরা তা যোগ করবেন। এর পরের যে কথা সেটা প্রথম প্রশ্নটাকে জড়িয়ে। সে কথা এই লেখকের ব্যক্তিগত। রবন্দ্রীনাথ কী পড়ব সে কথা বলার আমি কোন বাহাদুর? তার মন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা সব পণ্ডিতরা কী করতে আছেন? আচ্ছা, আমি কি রবীন্দ্রনাথকে সব পড়েছি? পড়লে কীভাবে পড়েছি? তার সব শব্দ আর শব্দের মধ্যবর্তী ফাঁক সমান সতর্কতা দিয়ে অনুধাবন করেছি, সব ছত্র আর দুই ছত্রের মধ্যবর্তী শূন্যতা, সাদা মার্জিনে বলা কথাগুলো সবটুকু পড়তে পেরেছি? অক্ষর-পরিক্রমা করা আর ‘পড়া’ কি এক কথা? গল্প-উপন্যাস পড়া, গদ্য পড়া, কবিতা পড়া আর গান পড়া কি এক কথা? প্রতিটি সংরূপ আর শৈলী যেমন করে পড়তে হয় তা পড়ার ক্ষমতা কি আমার জন্মেছে এই আশির চৌকাঠে দাঁড়িয়েও? নিজের বুকে এত সব প্রশ্নের তীর বিঁধিয়ে রেখে কি পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়? যায় না। তবু নিজের এই সন্ধানটার কথাই বলি। কিছুটা ব্যক্তিগত কথা এসে যাবে, পাঠককে তা সহ্য করতে হবে, হয়তো অনেক পাঠক তার মধ্যে নিজের সন্ধানেরও সমাপতন খুঁজে পাবেন।
বৃত্তের পর বৃত্ত, মানুষের কেন্দ্র থেকে
এমন মনে পড়ে না যে, আমাদের কেউ বলছেন রবীন্দ্রনাথ এইভাবে পড়, ওইভাবে পড়। স্কুলপাঠ্যে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ দিয়ে তার পাঠ্য শুরু, তার পরে, ওই পাঠ্যবইয়ে যেমন থাকে- হয়তো ‘মুকুট’-এর একটা দৃশ্য, ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘পোস্টমাস্টার’- বিচ্ছিন্ন, এবড়ো-খেবড়ো পড়া সব- তার পর আস্তে আস্তে বাংলা সাহিত্যে পড়তে এসে নানা রবীন্দ্রনাথের বেশি করে মুখোমুখি হতে হল। নানা রবীন্দ্রনাথই বটে। তখনও কি বুঝেছি যে, রবীন্দ্রনাথ আদৌ ‘নানা’ নন, একাধিক নন, হয়তো একটি বহুমহলা বাড়ির নানা প্রকোষ্ঠ, কিন্তু আদপে একটিই প্রাসাদ, একটিই রবীন্দ্রনাথ- কতগুলো মূল মানসিক সত্যের উৎস, সেগুলোই বহু বিচিত্র রূপ পেয়েছে তার লেখায়। হ্যাঁ, ওই ‘বিচিত্রের নর্মবাঁশিখানী’ তার হাতে ছিল, তাতে জেগে উঠেছে বহু স্বর, বহু সুর, বহু মূর্ছনা, কিন্তু সে সবের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন একজনই মাত্র স্রষ্টা। নানা পথ ধরে সেই একজনে পৌঁছানো খুব একটা অসম্ভব নয়। কাজেই উপনিষদীয় অস্পষ্টতার ঝুঁকি নিয়েও বলি, বিচিত্র থেকে একের দিকে যাও- এই হওয়া উচিত আমাদের রবীন্দ্র পাঠপরিভ্রমণের মূল লক্ষ্য। আমি রবীন্দ্রনাথকে অনেকগুলো বৃত্তের একটি মাত্র কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করতে দেখি- অনেকগুলো দিগন্তের একটি মৌলিক দর্শন-ভূমি। কেন্দ্র এক, বৃত্ত অনেকগুলো। দিগন্তের ওপারে আরও দিগন্ত। দিগন্ত মানে বেড়া নয়, তা যত এগোই তত সরে সরে যায়। এই কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব-পরিক্রমা শুরু হবে। এমন নয় যে, তিনি কোনো রচনাতে একটিমাত্র বৃত্তে বন্ধ থাকবেন, সেখান থেকে অন্য বৃত্তে তার অবাধ যাতায়াত চলবে না। কিন্তু তবু বৃত্তগুলোর কথা মনে রাখলে তাকে বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। প্রথমত বৃত্তটা মানুষের বৃত্ত। মানুষের অস্তিত্বের মূল কথা ভালোবাসা, তাতেই মানুষের বৃদ্ধি, মানুষের চরিতার্থতা। কোন মানুষ? সেই এক মানুষ যাতে নারী-পুরুষের ভেদ নেই, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানে ভেদ নেই, গরিব-বড়লোক কিংবা উঁচু-জাত, নীচু-জাতে ভেদ নেই, চীনা-জাপানি কিংবা কালো আফ্রিকান আর সাদা ইউরোপ-আমেরিকানে ভেদ নেই। ওগুলো সব বাইরের পরিচয়, বাইরের আবরণ। আমাদের মতে, রবীন্দ্রনাথ যে বৃহৎ মানবসংসারের ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে ঢুকে পড়ার প্রথম সিংদরজা তার ছোটগল্প, মূলত ‘গুগ্পগুচ্ছ’-এ যা সংকলিত হয়েছে। আমাদের এই রচনার আরম্ভের মধ্যে আর-একটা নিহিত প্রশ্ন এই ছিল যে, কোন পাঠকের সঙ্গে আমরা কথা বলব। তার যে উত্তর আমরা স্থির করেছি তা হল, মাধ্যমিক, অন্তত উচ্চমাধ্যমিকের বেড়া পেরিয়েছেন যে পাঠক (পাঠিকারাও আছেন এই পুংলিঙ্গ বিশেষ্যে),
বৃত্তের পর বৃত্ত, মানুষের কেন্দ্র থেকে
এমন মনে পড়ে না যে, আমাদের কেউ বলছেন রবীন্দ্রনাথ এইভাবে পড়, ওইভাবে পড়। স্কুলপাঠ্যে ‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ’ দিয়ে তার পাঠ্য শুরু, তার পরে, ওই পাঠ্যবইয়ে যেমন থাকে- হয়তো ‘মুকুট’-এর একটা দৃশ্য, ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘পোস্টমাস্টার’- বিচ্ছিন্ন, এবড়ো-খেবড়ো পড়া সব- তার পর আস্তে আস্তে বাংলা সাহিত্যে পড়তে এসে নানা রবীন্দ্রনাথের বেশি করে মুখোমুখি হতে হল। নানা রবীন্দ্রনাথই বটে। তখনও কি বুঝেছি যে, রবীন্দ্রনাথ আদৌ ‘নানা’ নন, একাধিক নন, হয়তো একটি বহুমহলা বাড়ির নানা প্রকোষ্ঠ, কিন্তু আদপে একটিই প্রাসাদ, একটিই রবীন্দ্রনাথ- কতগুলো মূল মানসিক সত্যের উৎস, সেগুলোই বহু বিচিত্র রূপ পেয়েছে তার লেখায়। হ্যাঁ, ওই ‘বিচিত্রের নর্মবাঁশিখানী’ তার হাতে ছিল, তাতে জেগে উঠেছে বহু স্বর, বহু সুর, বহু মূর্ছনা, কিন্তু সে সবের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন একজনই মাত্র স্রষ্টা। নানা পথ ধরে সেই একজনে পৌঁছানো খুব একটা অসম্ভব নয়। কাজেই উপনিষদীয় অস্পষ্টতার ঝুঁকি নিয়েও বলি, বিচিত্র থেকে একের দিকে যাও- এই হওয়া উচিত আমাদের রবীন্দ্র পাঠপরিভ্রমণের মূল লক্ষ্য। আমি রবীন্দ্রনাথকে অনেকগুলো বৃত্তের একটি মাত্র কেন্দ্র হিসেবে অবস্থান করতে দেখি- অনেকগুলো দিগন্তের একটি মৌলিক দর্শন-ভূমি। কেন্দ্র এক, বৃত্ত অনেকগুলো। দিগন্তের ওপারে আরও দিগন্ত। দিগন্ত মানে বেড়া নয়, তা যত এগোই তত সরে সরে যায়। এই কেন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব-পরিক্রমা শুরু হবে। এমন নয় যে, তিনি কোনো রচনাতে একটিমাত্র বৃত্তে বন্ধ থাকবেন, সেখান থেকে অন্য বৃত্তে তার অবাধ যাতায়াত চলবে না। কিন্তু তবু বৃত্তগুলোর কথা মনে রাখলে তাকে বুঝতে আমাদের সুবিধে হবে। প্রথমত বৃত্তটা মানুষের বৃত্ত। মানুষের অস্তিত্বের মূল কথা ভালোবাসা, তাতেই মানুষের বৃদ্ধি, মানুষের চরিতার্থতা। কোন মানুষ? সেই এক মানুষ যাতে নারী-পুরুষের ভেদ নেই, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টানে ভেদ নেই, গরিব-বড়লোক কিংবা উঁচু-জাত, নীচু-জাতে ভেদ নেই, চীনা-জাপানি কিংবা কালো আফ্রিকান আর সাদা ইউরোপ-আমেরিকানে ভেদ নেই। ওগুলো সব বাইরের পরিচয়, বাইরের আবরণ। আমাদের মতে, রবীন্দ্রনাথ যে বৃহৎ মানবসংসারের ছবি এঁকেছেন, তার মধ্যে ঢুকে পড়ার প্রথম সিংদরজা তার ছোটগল্প, মূলত ‘গুগ্পগুচ্ছ’-এ যা সংকলিত হয়েছে। আমাদের এই রচনার আরম্ভের মধ্যে আর-একটা নিহিত প্রশ্ন এই ছিল যে, কোন পাঠকের সঙ্গে আমরা কথা বলব। তার যে উত্তর আমরা স্থির করেছি তা হল, মাধ্যমিক, অন্তত উচ্চমাধ্যমিকের বেড়া পেরিয়েছেন যে পাঠক (পাঠিকারাও আছেন এই পুংলিঙ্গ বিশেষ্যে),
এবং তার পরবর্তী বিস্তীর্ণ আয়ুষ্কালের মধ্যে আছেন যারা, যারা রোববারের পাতার প্রবন্ধ পড়তে উৎসাহী হবেন, সেই অস্পষ্ট, আদর্শায়িত পাঠকই আমাদের লক্ষ্য হবে। তারা শুরু করুন ওই অত্যাশ্চর্য মানবিক বইটি দিয়ে। তার পর যাবেন উপন্যাসে, যাবেন ‘গোরা’য়, যে বইয়ে তার মানবসত্যের শেষ কথাটি উচ্চারিত হয়েছে। যাবেন ‘চল্ডালিকা’য়। অথচ আমাদের জীবনে ঐতিহাসিকভাবে এমনটা তো ঘটে না কখনওই। আমরা আগে হয়তো গান শুনি রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু তার অনেকটাই কেবল শোনা, আমরা নিজেদের উদ্যোগে গানের কাছে পরে যাই। এ বিষয়ে আমাদের সক্রিয়তা শুরু হয় কবিতা দিয়ে- কোনো বইয়ের কবিতা নয়, ছিন্নবিচ্ছিন্ন কবিতা কিংবা ‘সঞ্চয়িতা’য় গ্রন্থবদ্ধ কিছু কবিতা দিয়ে।সব কবিতা একসঙ্গে পাড়ি না, কিছু বাছাই কবিতার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যাই, আবৃত্তির জন্য মুখস্থ করি। বেশ কয়েক বছর আগে তো অরুণকুমার বসু সম্পাদনা করে ‘সঞ্চয়িতা-২’ ও প্রকাশ করেছেন বাংলা অ্যাকাদেমি থেকে। গান তো কবিতা পড়ার আগে থেকেই শুনি, তার সঙ্গেও আমাদের আলাপ অনেক আগে হয়ে যায়, হয়তো যখন লিখতে পড়তে শিখি না, তখন থেকেই। তবে গানের ব্যাপারে বাঙালি ছেলেদের আর মেয়েদের সংক্রমণের তফাৎ হয়। মেয়েদের, যে সামাজিক কারণেই হোক, শৈশব পেরোতে না পেরোতে গান শেখা শুরু করতে হয়, ছেলেদের ক্ষেত্রে খুব কম ক্ষেত্রেই এই আরোপণ ঘটে। যাই হোক, আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিগুলো কোন সময়ক্রম ধরে আসে সে কথা আজ বলতে বসিনি আমরা। রবীন্দ্র-রহস্যের উন্মোচনে আমরা কোন পাঠক্রম ধরে এগোব, সেই কথার পশ্চাদ্ধাবন করছি আমরা। তাই গান বা কবিতার কথায় পরে আসছি, আগে গল্পের কথা বলি। যে মানববৃত্তের কথা বলছিলাম আমরা, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প হল তার প্রধান পরিক্রমণ-পথ। উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমদিকে রাজারাজড়া আর পরে কলকাতার সচ্ছল মধ্যবিত্ত মানুষের কথা বলেছেন। মানুষ হিসেবে তারা তুচ্ছ নয়, তাদের উল্লাস বা আর্তি কম মানবিক নয়। কিন্তু ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের মানববৈচিত্র্য, লিঙ্গ, শ্রেণী, নগর, গ্রাম, বিশ্বাস, সংস্কার, সম্প্রদায়, ইতিহাস, রূপকথা, লৌকিক, অলৌকিক, রূপক-সমস্ত কিছুতে যেমন বিস্তারিত, উপন্যাসে তেমন নয়। আমাদের মতে, মানববৃত্তের নানা আখ্যানে রবীন্দ্রনাথের মূল কথা হল ‘ভালোবাসো’। কিন্তু বাস্তবে তা কখনওই ঘটে না, বাস্তব নানা ধরনের প্রেমহীনতার দ্বারা বহুভাবে আক্রান্ত হয়- সেখানে ভুল-বোঝাবুঝি, উদাসীনতা, দূরত্ব, বিচ্ছেদ, হিংসা- এমনকি মৃত্যুও ঘটে, আর তার মধ্য থেকেই হাসি-কান্না-বিস্ময়-বেদনা-সুখ ও সন্তাপের নানা প্রবল বৃত্তান্ত তৈরি হয়। এই নানা সংকটের মূলে কখনও অর্থনীতি, কখনও রাজনীতি, কখনও সম্প্রদায় আর জাতপাতের ক্ষমতা, কখনও ব্যক্তির নিজস্ব দ্বিধা, লৌকিক বা অতিলৌকিক (!) বিশ্বাস (‘জীবিত ও মৃত’তে যেমন) হাজির থাকে। কখনও কোনো এক গভীরতর উপলব্ধি সংকটের নিরসন ঘটায়, যেমন কলকাতার ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্ত বাবু আর কাবুলিওয়ালা যে একই অভিভাজ্য মনুষ্যত্বের ভাগীদার- তা প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার কবিতায় যেমন আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানির বাইরের পরিচ্ছদ মুছে যায়। ‘গোরা’তে চরঘোষ্পুরের নাপিত বলে, ‘ওরা বলে আল্লা, আমরা বলি হরি, কোনো তফাৎ নাই।’ আমরা এমন বলি না যে, রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে বা উপন্যাসেই কেবল মানুষের কথা আছে। কবিতাতেও এসেছে অজস্র মানুষ, পুরাণের মানুষ, ইতিহাসের মানুষ, দুই বিঘা জমি হারানো মানুষ, আধবুড়ো হিন্দুস্থানির মতো কিংবা গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দেয়া মানুষ। নাটকে, নৃত্যনাট্যগুলোতেও আছে ওই মানুষের কথা। শ্যামা-বজ সেন যদি নীতিপ্রহারে জর্জরিত হয়ে থাকে তো ‘চন্ডালিকার’র প্রকৃতি সমাজ-প্রহারে আর্ত এক মানুষ। চিঠিপত্রে, প্রবন্ধেও আছে অজস্র মানুষের কথা, কখনও বাস্তব, কখনও আদর্শায়িত, অর্মূত মানবতা। উচ্চবর্ণ আর নিন্মবর্ণের, স্পৃশ্য আর অন্ত্যজের বিভাজন, জাতির উপর জাতির আগ্রাসন, সাম্রাজ্য আর উপনিবেশ- এ সবই তো মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ প্রেমহীনতারই নানা কদর্য সংস্করণ, ‘আত্মশক্তি’ আর Nationalism-এ তো সেই জাতিসত্তার দ্বারা বিচ্ছিন্ন আর প্রভুত্বকারী আর প্রভুত্বপিষ্ট মানুষের কথাই বলেন। যেমন ‘রক্তকরবী’তে দেখি সম্পদলোভীর নিরঙ্কুশ দাপট, মানুষের মনুষ্যত্বকে নিষ্কাশন করে তাকে জড়পিণ্ডে পরিণত করার খেলা, যে নিষ্ঠুর প্রতাপ শেষে নিজের কাছেই পরাস্ত হয়। মানুষের বৃত্তকে পেরিয়ে যাই প্রাণবৃত্তে, যেখানে মানবেতর প্রাণীদের উপস্থিতি। যে প্রাণীকে আমরা ভালোবাসায় বাঁধি, তার গায় যদি আঘাত লাগে, তাতে বিশ্ববিধানের কোনো একটা বিপর্যয় ঘটে, মানুষের পৃথিবীকেও তা ক্লিষ্ট করে। ‘বিসর্জন’-এ ওই কথাই বলেন রবীন্দ্রনাথ, কিংবা ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পে, শরৎচন্দ্র যেমন বলেন তার ‘মহেশ’-এ, এবং ‘রামের সুমতি’র কার্তিক-গণেশ উপাখ্যানে। লেভি স্ত্রোস নামের ফরাসি নৃবিজ্ঞানী ‘প্রকৃতি’ আর ‘সংস্কৃতি’- এ দুয়ের তফাৎ সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করেছেন, কিন্তু তিনিও জানেন না যে, মানুষ মূলত প্রাকৃতিক জীবন হয়েও সে যা ছুঁয়েছে তাইই সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। সে ভালোবাসা দিয়ে ছুঁয়েছে প্রাণীজগৎকে, ফলে ওই জগৎ মানবতারই এক বিস্তার হয়ে উঠেছে। যেখানে ভালোবাসা নেই, আছে নিছক প্রয়োজনের হুকুমনামা- প্রাণী যেখানে মানুষের খাদ্য বা শ্রমদাস- সেখানেও কখনও কখনও মানবতা উপচে পড়ে যে প্রাণীদের মনুষ্যবৃত্তে নিয়ে আসে, তারও দৃষ্টান্ত ওই সব আখ্যানে প্রচুর।
নিসর্গবৃত্ত
নিসর্গবৃত্ত প্রাণবৃত্তেরই অংশ, হয়তো এক প্রান্তিক অংশ। যদিও তার মানুষ বা প্রাণীর মতো স্থানান্তরের চলন নেই। নিসর্গ মাটি থেকে আকাশের দিকে নিজেকে বিস্তার করে, কখনও মাটিতে ঘাস হয়ে, কখনও ডালপালা সবুজ পাতায় ছেয়ে, ফুল ফুটিয়ে, ফল ফলিয়ে, পাতা ঝরিয়ে, উজ্জ্বল নতুন পাতাকে আমন্ত্রণ করে। তার এক নাম প্রকৃতি হলেও মানুষ তাকেও নিজের সংস্কৃতিতে গ্রাস করেছে, নানা প্রয়োজনে তাকে ব্যবহারে লাগিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, পৃথিবীর অনেক কবির চেয়ে অনেক বেশি করে, নিসর্গকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করেছেন প্রাণের যোগে, অনুভবের যোগে। ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘ঘর ও বাহির’ ইত্যাদি অধ্যায়ে তার প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়ের নানা ধাপ তিনি নিজেই খুব গুছিয়ে হাজির করেছেন। তার ‘সহজ-পাঠ’ এক হিসেবে মানবপাঠ আর প্রকৃতিপাঠকে পাশাপাশি নির্মাণ করেছে। তার ‘গীতবিতানে’-এর গানগুলো আমাদের সেই বৃত্তে কত সহজে পৌঁছে দেয়। এ নিসর্গ খাদ্য নয়, গৃহনির্মাণ বা গৃহসজ্জার উপকরণ নয়, এ নিসর্গ মানুষের নিছক জৈবিকতা থেকে মুক্তির এক উদার, আনন্দময় অবকাশ। বলা বাহুল্য, কোনো একটি বই বা রচনায় রবীন্দ্রনাথ বা মানুষের সঙ্গে নিসর্গের এই হৃদ্য আদান-প্রদানের নথি নিবন্ধ নেই, তা ছড়িয়ে আছে নানা রচনায় আর গানে। ‘গীতবিতান’-এর ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ের ২৮৩টি গান শুধু নয়, যার মধ্যে বর্ষার জন্য বরাদ্দ ১১৫টি, বসন্তের ৯৬টি- প্রেম আর পূজার গানেও প্রকৃতি এসে সামনে বা পেছনে দাঁড়ায়, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ বা ‘গোধূলি-গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’তে যেমন। পদ্মা, আকাশ, শস্যক্ষেত, বৃক্ষলতা আর নানা সলাশ্রয়-নিষিক্ত প্রকৃতি ছড়িয়ে থাকে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ছত্রে ছত্রে, ছোটগল্প আর উপন্যাসের নানা বর্ণনায়। আমরা অর্জুনের পাখির চোখ দেখার মতো প্রকৃতিকে আলাদা করে দেখতে বলি না। রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে বিষয় পড়তে বলি না। বলি যে, দেখুন তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নিজেকে যোগ করছেন,
নিসর্গবৃত্ত
নিসর্গবৃত্ত প্রাণবৃত্তেরই অংশ, হয়তো এক প্রান্তিক অংশ। যদিও তার মানুষ বা প্রাণীর মতো স্থানান্তরের চলন নেই। নিসর্গ মাটি থেকে আকাশের দিকে নিজেকে বিস্তার করে, কখনও মাটিতে ঘাস হয়ে, কখনও ডালপালা সবুজ পাতায় ছেয়ে, ফুল ফুটিয়ে, ফল ফলিয়ে, পাতা ঝরিয়ে, উজ্জ্বল নতুন পাতাকে আমন্ত্রণ করে। তার এক নাম প্রকৃতি হলেও মানুষ তাকেও নিজের সংস্কৃতিতে গ্রাস করেছে, নানা প্রয়োজনে তাকে ব্যবহারে লাগিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, পৃথিবীর অনেক কবির চেয়ে অনেক বেশি করে, নিসর্গকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করেছেন প্রাণের যোগে, অনুভবের যোগে। ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘ঘর ও বাহির’ ইত্যাদি অধ্যায়ে তার প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়ের নানা ধাপ তিনি নিজেই খুব গুছিয়ে হাজির করেছেন। তার ‘সহজ-পাঠ’ এক হিসেবে মানবপাঠ আর প্রকৃতিপাঠকে পাশাপাশি নির্মাণ করেছে। তার ‘গীতবিতানে’-এর গানগুলো আমাদের সেই বৃত্তে কত সহজে পৌঁছে দেয়। এ নিসর্গ খাদ্য নয়, গৃহনির্মাণ বা গৃহসজ্জার উপকরণ নয়, এ নিসর্গ মানুষের নিছক জৈবিকতা থেকে মুক্তির এক উদার, আনন্দময় অবকাশ। বলা বাহুল্য, কোনো একটি বই বা রচনায় রবীন্দ্রনাথ বা মানুষের সঙ্গে নিসর্গের এই হৃদ্য আদান-প্রদানের নথি নিবন্ধ নেই, তা ছড়িয়ে আছে নানা রচনায় আর গানে। ‘গীতবিতান’-এর ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ের ২৮৩টি গান শুধু নয়, যার মধ্যে বর্ষার জন্য বরাদ্দ ১১৫টি, বসন্তের ৯৬টি- প্রেম আর পূজার গানেও প্রকৃতি এসে সামনে বা পেছনে দাঁড়ায়, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ বা ‘গোধূলি-গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’তে যেমন। পদ্মা, আকাশ, শস্যক্ষেত, বৃক্ষলতা আর নানা সলাশ্রয়-নিষিক্ত প্রকৃতি ছড়িয়ে থাকে ‘ছিন্নপত্রাবলী’র ছত্রে ছত্রে, ছোটগল্প আর উপন্যাসের নানা বর্ণনায়। আমরা অর্জুনের পাখির চোখ দেখার মতো প্রকৃতিকে আলাদা করে দেখতে বলি না। রবীন্দ্রনাথ পড়তে গিয়ে বিষয় পড়তে বলি না। বলি যে, দেখুন তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নিজেকে যোগ করছেন,
কীভাবে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে যুক্ত করছেন। মানুষের পৃথিবী, প্রাণীর পৃথিবী আর নিসর্গ যে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং গভীরভাবে পরস্পরের মধ্যে অনুবদ্ধ- এই বোধ রবীন্দ্রনাথের মতো করে খুব কম স্রষ্টা নির্মাণ করেছেন আমাদের জন্য। অবশ্যই নিসর্গের মধ্যে আছে জড়-নিসর্গ- পাহাড়, নদী, আকাশ ও নক্ষত্ররাজি, গ্রহ ও উপগ্রহের মালা, যার মধ্যে চাঁদ মানুষের কল্পনার মধ্যে নানাভাবে প্রবেশ করে- কখনও রূপক হয়ে, উপমা হয়ে, কখনও বাস্তবে, তার কলার হ্রাসবৃদ্ধি, জ্যোৎস্না আর অমাবস্যা নিয়ে। ‘বিশ্বভরা প্রাণের সঙ্গেই ওই ‘আকাশভরা সূর্যতারা’কে স্মরণ করেন রবীন্দ্রনাথ। কেউ কারও থেকে দূর নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, এক বিপুল সমগ্রের মধ্যে সব স্থাপিত, মানুষের জীবন এগুলোকে নানাভাবে গ্রহণ করেই সত্যিকার মানবজীবন হয়ে ওঠে। ‘শিক্ষা’তে রবীন্দ্রনাথ যে বলেন, ‘একা মানুষের অসহায়’- এ কথাটাকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, গোষ্ঠীসত্তা হিসেবে একা মানুষ যেমন অসহায় তেমনই অসম্পূর্ণ। মানুষের সভ্যতা, বিশেষ করে পশ্চিমের সংগ্রহলোলুপ সভ্যতা মানুষকে ‘শ্রেষ্ঠ’ জীব বলে ভিন্ন প্রাণিজগৎ আর নিসর্গের তার সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের এক দর্শন খাড়া করেছে, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষ পৃথিবীর সব সম্পদ লুটপাট করে নিজেদেরই সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আজকের সভ্যতার এই সংকটে রবীন্দ্রনাথ এমন এক কণ্ঠস্বর, যা আমাদের স্রোতের বিরুদ্ধে যেতে বলে, এমন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে, যা নিলে আমাদের মঙ্গল হবে। তার এই সঙ্গতির দর্শন, নিসর্গ-লুণ্ঠন থেকে সংযত হওয়ার দর্শন- পৃথিবীর সচেতন মানুষদের ক্রমশ আকৃষ্ট করেছে।
কল্পনাবৃত্ত, সৃজনবৃত্ত
এতক্ষণ তো বললাম মানুষকে যা ঘিরে আছে তাদের কথা- মানুষ, প্রাণী, নিসর্গ আর জড়জগৎ। তারা আছে বাস্তবে, কিন্তু তাদের সঙ্গে মানুষের মানুষিক আদান-প্রদান হয় বলেই তো আমরা মানুষের শিল্পের মধ্যে এসে পৌঁছে যাই। মানুষের মন বা মস্তিষ্ক তার কল্পনার আশ্রয়, কল্পনার এই অদম্য শক্তি ও বিস্তার সম্ভবত অন্য প্রাণীর নেই। অন্য প্রাণী বর্তমানকে নিয়ে বড় বেশি বিব্রত, মানুষের কল্পনা স্থান আর কালকে ছাড়িয়ে যায়, অতীতে আর ভবিষ্যতে তা যেমন অনায়াসে মুহূর্তমাত্র ছোটাছুটি করে, তেমনই এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এমনকি যে দেশ বিশ্বলোকের ভূতোলে কোথাও নেই (যেমন, এই লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসে, স্বর্গ বা নরক বা পাতালপুরী), সেখানেও তা যেতে চায় এই কল্পনার ঠ্যালাতেই, সব মানুষ নয়, কোনো কোনো মানুষ স্থায়ী সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যায়। সে কল্পনা দিয়ে তার চারপাশের মানব ও বস্তুবিশ্বকে দেখে, তাদের সঙ্গে অনুভবের দ্বারা যুক্ত হয়, আর তখন সে সাহিত্য রচনা করে ছবি আঁকে, গান আর সুর তৈরি করে, মূর্তি বানায়, নাচে, নাটক করে, চলচ্চিত্র বানায়। যা দেখে শুধু তাই নিয়েই নয় তার শিল্প, যা কল্পনা করে, যা পৃথিবীর কোথাও কোনোদিন ছিল না বা হয়তো হবে না- তা নিয়েও তার শিল্প। অবশ্য পরে ধনবাদী সভ্যতায় এই শিল্পের একটা বাণিজ্যিক দামও তৈরি হয়ে গেছে, বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচনায় তা প্রাসঙ্গিক নয়। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেন বিশ্বজগতের ওপর মানুষের মনের কারখানার সচলতা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আর প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা তার শিল্পের দুটি বড় ভাগ দেখতে পাই, একটা ধর্মমুক্ত বা সেক্যুলার, আর একটি ধর্মস্পৃষ্ট বা নন-সেক্যুলার। দুটো যে সব সময় সমান্তরালভাবে পাশাপাশি চলেছে তা নয়। তার ধর্মমুক্ত শিল্প সারাজীবন রচিত হয়েছে, কিন্তু তার ঈশ্বর, যে ঈশ্বর প্রচলিত কোনো ধর্মের ঈশ্বরের সঙ্গে পুরো সমীকরণে মেলে না, তিনি তার সঙ্গে হয়তো প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত যেভাবে ছিলেন, তার পর সেভাবে ছিলেন না। জীবনের শেষ বক্তৃতা ‘সভ্যতার সংকট’-এ তার যে কথা ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ তা আমাদের খানিকটা সচকিত করে তোলে এই কারণে যে, ওই বাক্যে ‘মানুষের’ কথাটার জায়গায় অনায়াসে ‘ঈশ্বরের’ বসাতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনি বসাননি। এ নিশ্চয়ই তার সজ্ঞান নির্বাচন, সজ্ঞান প্রত্যাহার।
কল্পনাবৃত্ত, সৃজনবৃত্ত
এতক্ষণ তো বললাম মানুষকে যা ঘিরে আছে তাদের কথা- মানুষ, প্রাণী, নিসর্গ আর জড়জগৎ। তারা আছে বাস্তবে, কিন্তু তাদের সঙ্গে মানুষের মানুষিক আদান-প্রদান হয় বলেই তো আমরা মানুষের শিল্পের মধ্যে এসে পৌঁছে যাই। মানুষের মন বা মস্তিষ্ক তার কল্পনার আশ্রয়, কল্পনার এই অদম্য শক্তি ও বিস্তার সম্ভবত অন্য প্রাণীর নেই। অন্য প্রাণী বর্তমানকে নিয়ে বড় বেশি বিব্রত, মানুষের কল্পনা স্থান আর কালকে ছাড়িয়ে যায়, অতীতে আর ভবিষ্যতে তা যেমন অনায়াসে মুহূর্তমাত্র ছোটাছুটি করে, তেমনই এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এমনকি যে দেশ বিশ্বলোকের ভূতোলে কোথাও নেই (যেমন, এই লেখকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসে, স্বর্গ বা নরক বা পাতালপুরী), সেখানেও তা যেতে চায় এই কল্পনার ঠ্যালাতেই, সব মানুষ নয়, কোনো কোনো মানুষ স্থায়ী সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যায়। সে কল্পনা দিয়ে তার চারপাশের মানব ও বস্তুবিশ্বকে দেখে, তাদের সঙ্গে অনুভবের দ্বারা যুক্ত হয়, আর তখন সে সাহিত্য রচনা করে ছবি আঁকে, গান আর সুর তৈরি করে, মূর্তি বানায়, নাচে, নাটক করে, চলচ্চিত্র বানায়। যা দেখে শুধু তাই নিয়েই নয় তার শিল্প, যা কল্পনা করে, যা পৃথিবীর কোথাও কোনোদিন ছিল না বা হয়তো হবে না- তা নিয়েও তার শিল্প। অবশ্য পরে ধনবাদী সভ্যতায় এই শিল্পের একটা বাণিজ্যিক দামও তৈরি হয়ে গেছে, বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচনায় তা প্রাসঙ্গিক নয়। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেন বিশ্বজগতের ওপর মানুষের মনের কারখানার সচলতা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আর প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা তার শিল্পের দুটি বড় ভাগ দেখতে পাই, একটা ধর্মমুক্ত বা সেক্যুলার, আর একটি ধর্মস্পৃষ্ট বা নন-সেক্যুলার। দুটো যে সব সময় সমান্তরালভাবে পাশাপাশি চলেছে তা নয়। তার ধর্মমুক্ত শিল্প সারাজীবন রচিত হয়েছে, কিন্তু তার ঈশ্বর, যে ঈশ্বর প্রচলিত কোনো ধর্মের ঈশ্বরের সঙ্গে পুরো সমীকরণে মেলে না, তিনি তার সঙ্গে হয়তো প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত যেভাবে ছিলেন, তার পর সেভাবে ছিলেন না। জীবনের শেষ বক্তৃতা ‘সভ্যতার সংকট’-এ তার যে কথা ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ তা আমাদের খানিকটা সচকিত করে তোলে এই কারণে যে, ওই বাক্যে ‘মানুষের’ কথাটার জায়গায় অনায়াসে ‘ঈশ্বরের’ বসাতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তিনি বসাননি। এ নিশ্চয়ই তার সজ্ঞান নির্বাচন, সজ্ঞান প্রত্যাহার।
বক্তৃতার শেষে যে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাও তো মানুষের, ‘মহামানবের’ আবির্ভাবের প্রত্যাশা। তবু যারা তার ঈশ্বরকে খুঁজবেন, তার এক অনুপম কল্পনাকে, তাদের জন্য যথেষ্ট রসদ আছে রবীন্দ্রনাথের প্রথম মহাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী রচনায়। ব্রাহ্মধর্মের কপিবুক সূত্র অনুযায়ী উপনিষদীয় ‘পিতা’-ঈশ্বর (পিতা নো’সি, পিতা নো বোধি- তুমি আমাদের পিতা। তোমায় পিতা বলে যেন জানি, তোমায় নত হয়ে যেন মানি) থেকে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর প্রভু হয়েছেন, নাথ হয়েছেন, কখনও মাতা হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি করেই যেন বন্ধু হয়েছেন, তাকে সিংহাসনের আসন থেকে নেমে আসতে হয়েছে, ভক্ত না থাকলে সেই ত্রিভুবনেশ্বরের ‘প্রেম হতো যে মিছে’। তাই তার অনিবার্য পরিণাম ‘পরানসখা, বন্ধু’র সত্তায়। ‘গীতবিতান’-এর পূজার গানগুলোতে রবীন্দ্রনাথের গৃহীত ও সংশোধিত এই ঈশ্বরের নানা অভিমুখ আমরা পাব- যারা বিশ্বাসের ওই খণ্ডকে গ্রহণ করেন, রবীন্দ্রনাথে তাদের জন্য একটি বৃহৎ পরিসর নিশ্চয়ই আছে, যদিও সব সময় সমানভাবে নেই। মানুষের কল্পনা আর কল্পনাতাড়িত সৃজনের এই যুগলবন্দিই হল মানুষের শিল্প। এই শিল্পকে নিয়েও রবীন্দ্রনাথের অনেক কথা আছে- সাহিত্য শুধু নয়, অন্যান্য শিল্পকলা নিয়েও। সেসব পাঠ হয়তো বিশেষজ্ঞের পাঠ। কিন্তু সাধারণ রবীন্দ্রজিজ্ঞাসুকেও রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখতেই হবে। বিদেশি উইলিয়াম আর্চার রবীন্দ্রনাথকে ‘দ্য ফার্স্ট মডার্ন পেইন্টার অব ইন্ডিয়া’ বলেছেন, শুধু এই অহংকারের তাপ উপভোগের জন্য নয়। ছবি দেখতে হবে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রচলিত চিত্রকলার ব্যাকরণ ভেঙেছেন, আর নিজেকে, অর্থাৎ আমাদের চেনা রবীন্দ্রনাথকেও একই সঙ্গে নির্মমভাবে ভাংচুর করেছেন, তৈরি করেছেন বেপরোয়া আর আক্রমণাত্মক এক শৈলী- তাও দেখার জন্য। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে রবীন্দ্রনাথের একটি আত্মপ্রতিকৃতি আছে- সেই ছবিটি দেখলে আমাদের সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠে। একটা মুখের মধ্যে যে এত তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা ধরে দেয়া যায়, তা কে ভাবতে পেরেছিল? এই রবীন্দ্রনাথ কি আরেক রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ কি তাহলে পুরোপুরি অখণ্ড, সংহত-শান্ত ও আনন্দস্বরূপ একবদ্ধ জন নন?
পবিত্র সরকার : রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
No comments