মুখ দেখে নয় জরিপের ভিত্তিতে মনোনয়ন
নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতে দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি সংসদ সদস্যদের সতর্ক করে বলেন, যারা জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে পেরেছেন, তারাই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। জনবিচ্ছিন্ন কাউকেই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে না। গত নির্বাচনে অনেককে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী করে আনলেও এবার কারও দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। এবার জরিপ অনুযায়ী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। রোববার রাতে জাতীয় সংসদ ভবনের নবম তলায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ প্রধান আরও বলেন, অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি বলে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে কিংবা নির্বাচনকে সহজভাবে নিলে চলবে না। আগামী নির্বাচন কঠিন হবে।
সরকারের সব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সারা গ্রাম-বাংলায় তুলে ধরে জনগণের মন জয় করুন। মনে রাখবেন, সবার কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট আমার কাছে রয়েছে। আমি প্রতি ৬ মাস পর জরিপ করাচ্ছি। যারা এলাকায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তারা মনোনয়ন পাবেন না। এখনও সময় আছে, নির্বাচনী এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা বাড়ান, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলুন। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের গত আট বছরের ব্যাপক সাফল্যগুলো তুলে ধরুন। মনে রাখবেন, দিন শেষে কিন্তু জনগণের কাছেই যেতে হবে। সরকারের জনকল্যাণমুখী কাজগুলো দেশবাসীর সামনে তুলে ধরুন। পাশাপাশি কর্মীদের মূল্যায়ন করুন। দলের মধ্যে কোন্দল-দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, দলের মধ্যে কোনো বিভেদ-অনৈক্য বরদাস্ত করা হবে না। সারা দেশের তিনশ’ আসনের জরিপ রিপোর্ট ও প্রকৃত চিত্র আমার কাছে আছে। আরও জরিপ চালাব। নির্বাচনী এলাকায় কার কী অবস্থা, জনসমর্থন কার কেমন, আর কারা জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন- সব রিপোর্ট আমার কাছে রয়েছে। তাই সবাই সাবধান হয়ে যান, নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করুন। দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কাউকেই ক্ষমা করা হবে না। তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদীয় দলের সভায় স্বতন্ত্র ১১ সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমবারের মতো বৈঠকে অংশ নেন। আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া স্বতন্ত্র এমপিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। এখন থেকে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করুন। দলের নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করলে কিন্তু আপনারা আগামীতেও মনোনয়ন পাবেন না। যার যার এলাকায় নেতাকর্র্মীদের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে, তা দ্রুত সমাধান করে দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলুন। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে এখন থেকেই সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামুন।
এ সময় ১১ এমপিকে বৈঠকে পরিচয় করিয়ে দেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সম্পাদক নূর-ই আলম চৌধুরী লিটন সাংবাদিকদের বলেন, স্বতন্ত্র এমপিরা আমাদের দলেরই লোক। সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে তাদের আনুষ্ঠানিক যোগদানের প্রয়োজন পড়ে না। তবে বৈঠক থেকে আমরা স্বতন্ত্র এমপিদের আওয়ামী লীগ দলের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছি। সূত্র জানায়, ১৬ স্বতন্ত্র এমপির মধ্যে ৫ জন অংশ নেননি। তারা হলেন- ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, মকবুল হোসেন, রহীম উল্লাহ ও উষাতন তালুকদার। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে বৈঠকে বক্তব্য দেন সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। তিনি বলেন, একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে গত নির্বাচনে আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হই। আগামী নির্বাচনে আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে নেব। বৈঠক সূত্র জানায়, এ সময় হারুনকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দলে যোগ দিয়েছেন; আমার কাছে খবর আছে, আপনি এলাকার অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। এখন এলাকায় গিয়ে দ্রুত তা তুলে নেবেন। বৈঠকে অংশ নেয়া স্বতন্ত্র এমপিরা হলেন- আবুল কালাম আজাদ (গাইবান্ধা-৪০), ছলিম উদ্দীন তরফদার (নওগাঁ-৩), রেজাউল হক চৌধুরী (কুষ্টিয়া-১), তাহজীব আলম সিদ্দিকী (ঝিনাইদহ-২), স্বপন ভট্টাচার্য্য (যশোর-৫), হাজী মো. সেলিম (ঢাকা-৭), কামরুল আশরাফ খান (নরসিংদী-২), সিরাজুল ইসলাম মোল্লা (নরসংিদী-৩), আবদুল মতিন (মৌলভীবাজার-২), ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন (কুমিল্লা-৩) এবং মোহাম্মদ ফখরুল (কুমিল্লা-৪)। বৈঠক সূত্র জানায়, রাত ৮টা থেকে পৌনে ১০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকের পুরোটাই ছিল নির্বাচনী তৎপরতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী বারবার এমপিদের সরকারের উন্নয়ন-সাফল্যেগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরার নির্দেশ দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বেশ ক’জন এমপির পরীক্ষাও নেন। তিনি বেশ কয়েকজন এমপির কাছ থেকে জানতে চান, সরকার কতজন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দিয়েছে? কতজনকে ভিজিএফ কার্ড দেয়া হচ্ছে? কতজনকে অসহায়-বিধবা ভাতা দেয়া হচ্ছে, কতটি কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছে- ইত্যাদি।
এ সময় বেশিরভাগ এমপিই প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন। তখন প্রধানমন্ত্রী এমপিদের আরও বেশি পড়াশোনা করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, আমরা এত আর্থ-সামাজিক বিপ্লব ও উন্নয়ন করেছি। এমপিরাই যদি এসব বিষয়ে অজ্ঞ হোন, তবে আমরা জনগণকে কীভাবে অবহিত করব। জানা যায়, বৈঠকে ড. হাছান মাহমুদ, আতিউর রহমান আতিক, তারানা হালিম, মোতাহার হোসেন, ইউসুফ হারুন, জুনাইদ আহমেদ পলক, সাধন চন্দ্র মজুমদার, ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না প্রমুখ সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী কৌশলসহ নিজ নিজ এলাকার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। এমপিদের জন্য থোক বরাদ্দ বৃদ্ধি, এমপিদের এলাকার সমস্যা সমাধানে মন্ত্রীদের সহযোগিতার হাত বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, অনেক মন্ত্রীই কথা দিয়ে কথা রাখেন না। এমপিরা নিজের এলাকার সমস্যা নিয়ে গেলে অনেক মন্ত্রীই বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে হুইপ আতিকুর রহমান আতিক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এমপি হাবিবে মিল্লাত বলেন, মন্ত্রীরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না। এলাকার উন্নয়ন করার শপথ করে তা পালন করেন না।
No comments