সুবিধা পাবেন সব বিনিয়োগকারী
অবশেষে বিনিয়োগ বাড়াতে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ আইন আলোর মুখ দেখছে। এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উঠছে আজ। এ আইনের অধীনে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সহজ করতে ‘এক ছাতার’ নিচে ১৬ ধরনের সেবা দেয়া হবে। এজন্য উদ্যোক্তাদের আলাদাভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় সেবা পেতে অন্য কোনো সংস্থায় যেতে হবে না। উদ্যোক্তা (দেশি ও বিদেশি) দেশের যে কোনো অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে এ আইনের সব সুবিধা পাবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ আইনের অধীনে উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সংযোগ নিশ্চিত করা হবে। এরই মধ্যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল চূড়ান্ত হয়েছে। ২৪-২৬ মাস পর সেখান থেকে গ্যাস পাওয়া যাবে। ফলে ২০১৯ সালের পর গ্যাসের সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, একটি শিল্প করতে ২ থেকে ৩ বছর সময় প্রয়োজন হয়। তাই গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তাসহ আজই যে কোনো উদ্যোক্তা শিল্পকারখানা স্থাপন শুরু করতে পারেন। পাশাপাশি কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচগুণ বেড়েছে।
এতে করে অন্তত শিল্পকারখানায় বিদ্যুতের দুষ্প্রাপ্যতা এখন আর নেই। বিদ্যুতের জন্য কোনো শিল্পকারখানা হচ্ছে না- এমনটি এখন শোনা যায় না। শিল্পের জন্য জমি পাওয়ার নানা জটিলতা ও স্বল্পতার প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার সারা দেশে একশ’ ইকোনমিক জোন করেছে। ফলে কোথায় কী সুবিধা ব্যবহার করে বিনিয়োগ করতে পারবেন, সে সিদ্ধান্ত খুব সহজেই নিতে পারবেন যে কোনো উদ্যোক্তা। ইকোনমিক জোনের বাইরে এ সংকট কীভাবে নিরসন হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এজন্য কিছু অঞ্চল ও এলাকাকে শিল্প জোনিং করা হবে। সেখানে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারবেন। সরকারকে এ ধরনের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইকোনমিক জোনের বাইরে বিনিয়োগের জন্য পায়রা বন্দর থেকে বেনাপোল হয়ে সিলেট তামাবিল পর্যন্ত এ রাস্তার উভয় পাশ ইকোনমিক করিডোর হিসেবে ঘোষণা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। এটি হলে ভারত-মিয়ানমার ও চীনের কুরমিং পর্যন্ত সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে দেশের উদ্যোক্তারা সুবিধা পাবেন। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তা তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানান, আইনটি কীভাবে অনুমোদন হবে, তা তারা পুরোপুরি জানতে চান। এর আগে তারা কোনো মন্তব্য করতে চান না। কেননা প্রথমদিকে তারা শুনেছেন শুধু সরকারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে সার্ভিস দিতে এ আইনটি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তাই হলে বৃহত্তর ব্যবসায়ী সমাজ তা কখনও মেনে নেবে না। কারণ এটা করা হলে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ সুবিধাবাদী কিছু লোকের লাভ হবে। তাই তারা মনে করেন, সত্যিকারার্থে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে যার শিল্প করার সক্ষমতা আছে তাকে দ্রুত শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎসহ যেসব সাপোর্ট দেয়া প্রয়োজন,
তা সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। তারা বলেন, পৃথিবীতে যেসব দেশ শিল্পবিপ্লব করে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে তারা এমন নীতি ও আইন করেছে। এ প্রসঙ্গে বিডার নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল রোববার যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো উদ্যোক্তা দেশে যে কোনো অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে এ আইনের সব সুবিধা পাবেন। এটি কার্যকর হলে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ব্যবসায়ীদের ঘুরতে হবে না। দেশের ভেতর ব্যবসা করতে উদ্যোক্তারা সহজ অনুভব করবেন। তিনি বলেন, এ আইনে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিনিয়োগ ক্ষেত্র আরও সহজ হবে। যারা এখান থেকে সার্ভিস নেবেন, তা হবে হয়রানিমুক্ত। জানা গেছে, এর আগে ওয়ান স্টপ সার্ভিস (একক সেবা কেন্দ্র) আইনের খসড়ার ওপর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং শেষে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নেয়া হয়। সর্বশেষ মতামত নেয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের। মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদনের পর বিল আকারে আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা হবে। এ আইন পাস হওয়ার পর বিনিয়োগের জন্য একটি দফতর থেকে ১৬ ধরনের সেবা মিলবে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি নির্বাচনের অনুমতি, অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা, বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার অনুমোদন, সার্টিফিকেট অব অরিজিন বা উৎস দেশের সনদ, মূলধন ও লভ্যাংশ ফেরত নেয়ার অনুমোদন, রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট ভিসা, কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট, নির্মাণের অনুমোদন, হাইটেক পার্কের ভূমি নির্বাচনের অনুমতি, প্লট বরাদ্দ বা ইজারা, পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ, যে কোনো প্রকারের আইনগত দলিল এবং এছাড়া সরকার ঘোষিত অন্য কোনো সেবাও দেয়া হবে। এছাড়া বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে যারাই দেশের যেখানে বিনিয়োগ করবেন তারাও একই সুবিধা পাবেন। জানা গেছে, প্রথমেই হল ব্যবসা শুরু করার পদ্ধতি। সরকারি হিসাবে নিবন্ধন, লাইসেন্স, ব্যাংক হিসাব খোলা,
টিআইএন ও ভ্যাট নিবন্ধনসহ ব্যবসা শুরুর ৯টি কাজ শেষ করতে সময় লাগে ১৯ দিনেরও বেশি। খসড়ায় এ সময় কমিয়ে করা হয়েছে ৭ দিন। বিনিয়োগের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে রাজউক থেকে নির্মাণ কাজের অনুমতি। বর্তমানে একটি বিল্ডিংয়ের অনুমতি নিতে ২৭৮ দিন সময় লাগে। নতুন নিয়মে ৬০ দিনের মধ্যে রাজউক অনুমোদন দেবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করলে সংযোগ পেতে ৪০৪ দিন সময় লাগে। এখন থেকে এটি ২৮ কার্যদিবসের মধ্যে পাওয়া যাবে। পাশাপাশি দু’দিনে জমি নিবন্ধন ও নামজারির ব্যবস্থা থাকছে। বিনিয়োগের জন্য নানা ধরনের সেবা পেতে ১৮ মন্ত্রণালয়ের ২৬টি বিভাগে যেতে হয় ব্যবসায়ীদের। এ আইনে সব বিভাগের সেবা সমন্বয়ের দায়িত্ব থাকছে বিডা’র কাছে। বিনিয়োগের আরেক সমস্যা হচ্ছে ২১ ধরনের কর প্রদান। তা পরিশোধের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। নতুন সেবায় কর পরিশোধ পদ্ধতি সহজ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সিআইবিতে (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) ঋণ গ্রহীতাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য থাকে না। পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়ার উদ্যোগ রাখা হয়েছে আইনে। খসড়া ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, এখনকার কোনো আইনে যা-ই বলা হোক না কেন, কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীনে কাজের ক্ষেত্রে অবহেলা করলে এবং সে কারণে বিনিয়োগকারীর কোনো আবেদন নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি করা না গেলে তা ‘কার্য অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য হবে। তবে ‘সরল’ বিশ্বাসে কোনো কিছু করা হয়েছে বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না। জানা গেছে, সেবা প্রদানকারী ১৬টি সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ আইনে। এগুলো হল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, নিরাপত্তা ও বহির্গমন অনুবিভাগ, যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয়, গ্যাস সরবরাহের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি, পূর্ত নির্মাণকাজের অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ অধিদফতর, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, পণ্যসংক্রান্ত অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট ওয়াসা, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, বাংলাদেশ প্রাইভেট এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি এবং আমদানি-রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। আইনের খসড়ায় উল্লেখ আছে, এ আইনের অধীনে কোনো সেবা, ছাড়পত্র, লাইসেন্স অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্যসব আইন অকার্যকর হবে। শুধু ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন সেখানে কার্যকর বলে গণ্য হবে। জানা গেছে, বিশ্বের কোন দেশে কত সহজে ব্যবসা করা যায়, প্রতিবছর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ওই রিপোর্টকে ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট বলা হয়। আর বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। এর মূল কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কার্যকর সংস্কারের অভাব। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। আর এ সংকট কাটিয়ে উঠতে বিনিয়োগকারীকে এক ছাদের নিচে সব সেবা দিতে চূড়ান্ত হয়েছে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনের খসড়া। প্রথম ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) গভর্নিং বোর্ডের দ্বিতীয় সভায়। সংস্থাটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে এ ধরনের একটি আইন করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও তাগিদ এসেছে। জাপান ও চীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। জাপানের বড় বিনিয়োগকারীরা এবং চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য চীন সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান মনে করে যে, আইন ছাড়া বাংলাদেশে জাপান ও চীনা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট করা কঠিন হবে। এর আগে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে বিনিয়োগকারীরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন করার তাগিদ দিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে আইনটির প্রেক্ষাপট সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে। বেজার প্রস্তাব ছিল- আইনটি শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের জন্য করা হবে। নাম হবে ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস (ওয়ান স্টপ সার্ভিসেস) অ্যাক্ট-২০১৬’। তবে পরে তা সবার জন্য করার সিদ্ধান্ত হয়। এতে আপাতত বেজা, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরে প্রয়োজনে অন্য আরও সংস্থাকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গত, আজারবাইজানে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করার পর সেখানে ব্যবসা শুরুর প্রয়োজনীয় ধাপ সংখ্যা, ব্যয় ও সময় অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এতে করে দেশটিতে প্রথম ছয় মাসের মাথায় ব্যবসায়ের নিবন্ধন ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়, যাতে ৩২ হাজার ব্যবসার নিবন্ধন হয়। বাংলাদেশ এ পথ অনুসরণ করে বিনিয়োগের বন্ধ্যত্ব ঘুচাতে চায়। সেজন্য বিলম্বে হলেও এ ধরনের আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে কী, তা এখন দেখার বিষয়।
No comments