প্রকাশ্যে পিছিয়ে থাকলেও ভেতরে প্রস্তুতি বিএনপির
আগামী
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রকাশ্যে গণসংযোগে আওয়ামী লীগের চেয়ে
বিএনপি অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন দলটির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী ও
সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ
নেতারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলা সফর করে সাধারণ জনগণের কাছে ভোট চাইতে শুরু
করেছেন। প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো জেলায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে নির্বাচনী
জনসভা। এটি নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। সে
ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে বিএনপির তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। তবে এ বিষয়টি মানতে
নারাজ বিএনপির হাইকমান্ড। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, প্রকাশ্যে
নির্বাচনী সভা-সমাবেশ করা না হলেও তারা নির্বাচনী প্রস্তুতিতে পিছিয়ে নেই।
ভেতরে ভেতরে তারা নির্বাচনী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তিনশ’ আসনে প্রার্থী
বাছাইয়ে কাজ চলছে। ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে চলছে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ।
কৌশলগত কারণে আপাতত সভা-সমাবেশ করা হচ্ছে না। তবে শিগগিরই জেলা সফরে নামার
পরিকল্পনা করছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতারা।
সরকারবিরোধী জনমত তৈরির পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে
গণসংযোগের অংশ হিসেবেই এ সফর করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তার আগে নানা
ইস্যুতে সরকারবিরোধী জনমত সৃষ্টি করতে জনসংযোগ-লিফলেট ও পোস্টারিং শুরু
করেছে দলটি। ১৯ দফা দাবি সংবলিত পোস্টার সারা দেশে লাগানো শুরু হয়েছে।
আপাতত সভা-সমাবেশের বিকল্প চিন্তা থেকেই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে মনে
করেন তারা। সাধারণ জনগণ এবং বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা মনে করেন,
নির্বাচনের প্রায় পৌনে ২ বছর বাকি থাকলেও ক্ষমতাসীনরা এখন থেকেই জনগণের
কাছে যেতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বিএনপি অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। বিগত আন্দোলনে
সাংগঠনিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত দলটি। তৃণমূলকে শক্তিশালী করে জনগণকে
নির্বাচনমুখী করা দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মাঠ ধানের শীষের পক্ষে আনতে হলে
তাদের অনেক কিছু করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় ক্ষমতাসীনদের চেয়ে অনেক
ক্ষেত্রেই পিছিয়ে তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি বিশেষ করে দলটির চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়ার আগেভাগেই নির্বাচনী প্রচারে নামা উচিত। কিন্তু বাস্তবে তেমন
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাদের মতে, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর মতোই কৌশলী
হতে পারে বিএনপি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ উদ্বোধন করার ফাঁকেই
তিনি নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। খালেদা জিয়াও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট
ইস্যুতে জনসভার মধ্য দিয়ে প্রচার চালাতে পারেন। জানতে চাইলে বিএনপির
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি একটি উদারপন্থী দেশের
সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এ দলটি সব সময়ই নির্বাচনের জন্য
প্রস্তুত। আগামী নির্বাচনেও আমাদের প্রস্তুতি আছে।
তবে সে নির্বাচন হতে হবে
নির্দলীয় সরকারের অধীনে এবং সব দলের অংশগ্রহণে। এমন পরিবেশ নিশ্চিত হওয়ার
পরই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারে নামব। তিনি বলেন, নির্বাচনের
জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের
কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিতে হবে, তাদের সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে, নরমাল
যে অ্যাকটিভিটিস সেটা করতে দিতে হবে। তা না হলে নির্বাচনটা অর্থহীন হয়ে
দাঁড়াবে। কিন্তু সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, আমাদের পোস্টার লাগাতেও বাধা
দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী প্রচার প্রসঙ্গে তিনি
বলেন, একটি দল এবং তার সভাপতি তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ করে অর্থাৎ
রাষ্ট্রের পয়সায় তিনি হেলিকপ্টারে প্রত্যেকটি জনসভাতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে
ব্যবহার করে জনসভা এবং ক্যাম্পেইন করছেন। অন্যদিকে সব বিরোধী দলকে তারা
(সরকার) ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছেন। আমাদের (বিএনপি) একটা জনসভা করার অনুমতি
দেয়া হয় না। এমনকি কোনো মিটিং-মিছিল করতে দেয়া হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ
এখনও ঠিক হয়নি, আগেভাগেই প্রধানমন্ত্রী ভোট চাইছেন। আর বিরোধী দলকে কোনো
সুযোগই দিচ্ছেন না, উল্টো যা বলার তাই বলছেন। এটা আমাদের দেশেই সম্ভব। তিনি
বলেন, নির্বাচনের একটা দিনক্ষণ চূড়ান্ত হবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারে
নামবে- এটাই হওয়া উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী জনসভা করে
যাচ্ছেন উল্টো বিরোধী দলকে জনসভা করার জন্য অনুমতি দরকার হবে, এটা তো
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হতে পারে না। এমাজউদ্দীন বলেন, নির্বাচনের আরও অনেক
দেরি। এই মুহূর্তে ইশতেহার তৈরি, প্রার্থী বাছাই, সংগঠন গোছানোসহ রয়েছে
নানা প্রক্রিয়া। বিএনপি হয়তো সেই কাজটিই করছে। তাই এসব না করে আগেভাগে
প্রচারে নেমে যাওয়াকে অনেকে স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে। তাই সবকিছু
গুছিয়েই আনুষ্ঠানিক প্রচারে নামা উচিত। বিএনপি হয়তো সেই পরিকল্পনা নিয়েই
এগোচ্ছে। বিএনপির একাধিক নীতি-নির্ধারক মনে করেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা
জিয়া এ মুহূর্তে নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে জনসভা করতে চাইলে সরকার
নানাভাবে বাধা দিতে পারে। নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসতে পারে নানা হয়রানি ও
নির্যাতন। যা আগামী নির্বাচনের জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে। কারণ এমনিতেই দলটি
সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প পদ্ধতিতে
মাঠে নামছে বিএনপি। রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করলেই প্রশাসনের বাধার সম্মুখীন
হতে হয়। তাই দলটির দাবি-দাওয়া ও সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্যগুলো জনগণের কাছে
তুলে ধরার বিকল্প মাধ্যম হিসেবে জনসংযোগ-লিফলেট ও পোস্টারিং শুরু করা
হয়েছে।
১৯ দফা দাবি সংবলিত পোস্টার সারা দেশে লাগানো হচ্ছে। এর আগে গ্যাসের
মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানীতে লিফলেট বিতরণ করা হয়। শান্তিপূর্ণ ওই
কর্মসূচি ইতিবাচকভাবে নেন সবাই। ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজপথে
নেমে নিরপেক্ষ সরকারের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হওয়াই তাদের মূল
টার্গেট। পাশাপাশি এসব জনসম্পৃক্ত ইস্যুতে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা সম্ভব
হচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনকে
কেন্দ্র করেই মূলত এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। জানতে চাইলে বিএনপির
প্রচার সেলের সমন্ব^য়ক ও প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বলেন,
দলের বার্তা এবং জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে পোস্টারের মাধ্যমে সাধারণ
মানুষকে সচেতন করা হয়। বর্তমান সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, ব্যর্থতা
পোস্টারে তুলে ধরে জনগণকে এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো
হচ্ছে। এর মানে আগামী নির্বাচনে যাতে জনগণ বতর্মান সরকারকে ব্যালটের
মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেন। দলের এসব কর্মকাণ্ডকে আন্দোলনের কৌশল বা
নির্বাচনী গণসংযোগও বলা যায়। রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল
হক মিলন যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের প্রচার তো দূরে থাক, আমাদের কোনো
কর্মকাণ্ডই করতে দেয়া হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ১৯ দফা
সম্পর্কিত বিএনপির কেন্দ্র থেকে পাঠানো পোস্টার লাগাতে গেলেও বাধা দেয়া
হচ্ছে। এমনকি কার্যালয়ের ভেতরে পুলিশ তাদের অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও
ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলে এসব বাধা
নেতাকর্মীরা পাত্তাই দেবেন না। তাই, সবার আগে প্রয়োজন নির্বাচনকালীন
নিরপেক্ষ একটি সরকার।
No comments