বাংলাদেশী চিকিৎসকদের অভাবনীয় উদ্ভাবন
লিভার
সিরোসিস অথবা অন্য কোনো কারণে লিভার অকার্যকর (ফেইলিউর) হলে সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তির মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত- এমন ধারণা বদলে যেতে আর বেশি দিন বাকি নেই।
বাংলাদেশের একদল চিকিৎসক সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এসব
রোগের চিকিৎসা শুরু করেছেন। এরই মধ্যে তিনজন রোগীর ওপর এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে
প্রাথমিক সাফল্যও পেয়েছেন তারা। লিভার (যকৃৎ) ফেউলিউর রোগীদের নতুন
পদ্ধতির এ চিকিৎসা শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব
(স্বপ্নীল) ও তার দল। তাকে সব ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করছেন
জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশী লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। এ
প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. মামুন যুগান্তরকে বলেন, গ্র্যানুলোসাইট কলোনি
স্টিমুলেটিং ফ্যাক্টর (জিসিএসএফ) এমন একটি ওষুধ যা ব্যবহার করা হলে রক্তে
স্টেম সেলের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব। এসব স্টেম
সেল প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে পুনর্জাত করতে
সাহায্য করে। লিভার ফেইলিউরের এ ধরনের চিকিৎসা বহুল প্রচলিত না হলেও
একেবারে নতুন নয়। নয়াদিল্লির ইন্সটিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি
সাইন্সেস ও স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালে এ ধরনের চিকিৎসা হয়ে থাকে। এ চিকিৎসার
ক্ষেত্রে তার দল একধাপ এগিয়ে। তারা রক্ত থেকে জিসিএসএফ প্রয়োগের ফলে বেড়ে
যাওয়া স্টেম সেলগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে আলাদা করে নেন। তারপর ক্যাথল্যাবে
এনজিওগ্রামের মাধ্যমে স্টেম সেলগুলো রোগীর শরীরে সরাসরি হেপাটিক আর্টারি
দিয়ে লিভারে প্রবেশ করানো হয়। এভাবে স্টেম সেল ছেকে নিয়ে আবারও শরীরে
প্রয়োগ করা বা অটোলোগাস ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে হায়দরাবাদের এশিয়ান
ইন্সটিটিউট অব গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিতেও স্টেম সেল থেরাপি করা হয়ে থাকে। তবে
ডা. মামুনের চিকিৎসা পদ্ধতির নতুনত্ব হচ্ছে, তারা ক্যাথ ল্যাবে
এনজিওগ্রামের মাধ্যমে সরাসরি লিভারে স্টেম সেল থেরাপি করছেন, তা পৃথিবীতে
প্রথম।
তার উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিতে স্টেম সেলগুলো আক্রান্ত অর্গান অর্থাৎ
লিভারের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রয়োগ করা যায়। ফলে এ পদ্ধতিতে রোগী দ্রুত সুস্থ
হয়ে উঠবে। আর এর সাফল্যও অনেক বেশি বলে জানান ডা. মামুন। ছয় মাসের বেশি সময়
ধরে দেশে এ চিকিৎসা ব্যবস্থা শুরু করেত নানা ধরনের কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত
থেকেছে এ চিকিৎসক দল। এক্ষেত্রে একজন রোগীর চিকিৎসা কাজ সম্পন্ন করতে
বিভিন্ন হাসপাতালের সহযোগিতা নিতে হয়েছে তাদের। লিভার ফেইলিউরে আক্রান্ত
চারজন রোগীর ওপর উদ্ভাবিত এ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন তারা। ডা. মামুন
জানান, চিকিৎসা গ্রহীতাদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন উপজেলা
চেয়ারম্যান আর দুইজন গৃহিণী। তাদের মধ্যে দুজন হেপাটাইটিস-বি জনিত লিভার
সিরোসিস ও একজন হেপাটাইটিস-সি জনিত লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। আরেক জন
ফ্যাটিলিভার জনিত লিভার ফেইলিউরের রোগী। চিকিৎসা শুরুর এক মাস পর একজন
রোগীর লিভার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। তার লিভার মানবদেহের জন্য অপরিহার্য
অ্যালবোমিন তৈরি করতে পারছে। এমনকি তার শরীরে যে পানি জমেছিল তাও শুকিয়ে
গেছে। বাকি দুই রোগীর চিকিৎসার এক মাস পূর্ণ না হলেও তাদের অনুরূপ সাড়া
পাওয়া যাচ্ছে। আর অন্যজনের ওপর কয়েক দিন আগে এ নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ
করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্টেম সেল হচ্ছে প্রাণিদেহের এমন কোষ, যা
দেহের ২২০ ধরনের কোষের যে কোনো একটিতে নিজেকে পরিবর্তিত করতে পারে। আবার
তারা নিজেকে কোনো পরিবর্তন না করে শুধু কোষ বিভাজনের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন
স্টেম সেল তৈরি করতে পারে। স্টেম সেলের এ বৈশিষ্ট্য দুটির জন্য এদের
গবেষণাগারে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এ কোষ
বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাধ্যমে মানবদেহের
বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে তৈরি হয়েছে তা যেমন জানা যায়, তেমনি একটি নির্দিষ্ট
ওষুধের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়াও
স্টেম সেল ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে (যেমন- রেটিনা, পেশি,
স্পাইনাল কর্ড) প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। ডা. মামুন আল মাহতাব বলেন,
আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার ৭ থেকে ৮ ভাগ মানুষ অনিরাময়যোগ্য লিভার রোগে
আক্রান্ত। এর মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিসের মতো একিউট কন্ডিশন কিংবা লিভার
সিরোসিসের মতো ক্রনিক ব্যাধি- এ দুই ধরনের রোগের ক্ষেত্রেই রোগীদের লিভার
ফেইলিউর দেখা দিতে পারে। একবার এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে বাঁচার সম্ভাবনা
ক্ষীণ। বিশেষ করে লিভার ফেইলিউরে মৃত্যুর ঝুঁকি একিউট ও ক্রনিক লিভার রোগের
ক্ষেত্রে একেক রকম। একিউট লিভার ফেইলিউরে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি ৬০ শতাংশ,
ক্রনিক ফেইলিউরের ক্ষেত্রেও তা পঞ্চাশের ওপরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব
লিভার রোগীর চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে। তিনি আরও জানান,
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি লোক হেপাটাইটিস-বি, সি কিংবা ফ্যাটি
লিভারের মতো জটিল লিভার রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’-এর
মতো একিউট হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর প্রকোপও উল্লেখযোগ্য। প্রকাশিত
তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার লোক লিভার ফেইলিউরে
মারা যান। নতুন স্টেম সেল থেরাপি ভবিষ্যতে অনেক অসহায় রোগীকে মৃত্যুর
দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বর্তমানে
লিভার ফেইলিউর রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতি, যা
করতে ব্যয় হয় ৩০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা। অথচ স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে
লিভার চিকিৎসার নতুন এ পদ্ধতিতে মাত্র ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় চিকিৎসা
করা সম্ভব। তাছাড়া নেই লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতো ঝুঁকি আর ডোনার খোঁজার
ঝামেলা। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে এক থেকে দুদিন হাসপাতালে অবস্থান করে মূল
চিকিৎসা সম্পন্ন করা সম্ভব। জানতে চাইলে বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক
কামরুল হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, ডা. মামুন ও তার দলের উদ্ভাবিত এ
চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে আমি অবগত। সাধারণত লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত
রোগীদের মৃত্যুর দিন গোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু চিকিৎসকদের
ওই দলটি স্টেম সেল চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেসব রোগীর চিকিৎসা শুরু করেছেন, তাদের
শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এ চিকিৎসক দলটি সামান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে
যে বড় অর্জনের দিকে যাচ্ছে, তা দেশের জন্য অত্যন্ত সম্মানের। এদেশে লিভার
ফেইলিউরের চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি শুধু প্রথমবারের মতো চালু করার জন্যই
নয়, বরং লিভারে তা প্রয়োগের অভিনবত্বের জন্যও এদেশের এ কৃতী চিকিৎসক দল
প্রশংসার দাবিদার। ডা. মামুনের নেতৃত্বের ওই চিকিৎসক দলে কাজ করছেন
বিএসএমএমইউ’র লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ মোহাম্মদ নূর-এ-আলম
(ডিউ), ঢাকা মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল আলম,
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফয়েজ
আহমদ খন্দকার, আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের লিভার বিভাগের সহকারী
অধ্যাপক ডা. আবদুর রহিম ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ
ডা. আহমেদ লুৎফুল মুবিন। প্রসঙ্গত, ডা. আকবর ও ডা. মামুন যৌথভাবে গবেষণা
করে ‘ন্যাসভ্যাক’ নামে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের একটি নতুন ওষুধ আবিস্কার
করেন, যা এরই মধ্যে কিউবায় নিবন্ধিত হয়েছে। স্টেম সেল নিয়ে ডা. আকবরের
রয়েছে জাপানে গবেষণার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মেডিকেল
জার্নালগুলোয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকাশনা। ডা. মামুন এবং ডা. আকবর
দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়েই কাজ করছেন। কয়েক বছর ধরে তারা ক্রনিক এবং একিউট অন
ক্রনিক লিভার ফেইলিউরের রোগীদের জিসিএসএফ ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করে
উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাচ্ছেন। এ দুই বাংলাদেশী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ক্রনিক লিভার
ফেইলিউরে জিসিএসএফ ব্যবহার করে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত গত বছর জাপানে এশীয়
প্রশান্ত মহাসাগরীয় লিভার অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপন করে
প্রশংসিত হন। অন্যদিকে একিউট অন ক্রনিক লিভার ফেইলিউরে তাদের জিসিএসএফ
ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বর্তমানে একটি শীর্ষস্থানীয় লিভার জার্নালে প্রকাশের
অপেক্ষায় রয়েছে। উল্লেখ্য, এ দুটি কাজই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডের অনুমোদনক্রমে পরিচালিত হয়েছে।
No comments