এবারের সংগ্রাম উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের সংগ্রাম
জাতীয়
পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী সংসদ
নির্বাচনে উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের স্লোগান নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমার নির্বাচনী স্লোগান হবে- এবারের সংগ্রাম উত্তরাঞ্চলের
উন্নয়নের সংগ্রাম।’ রংপুরে চার দিনের সফর শেষে মঙ্গলবার ঢাকায় যাওয়ার
প্রাক্কালে যুগান্তরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন এরশাদ।
রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালীন উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে কী কী ভূমিকা রেখেছেন- এমন
প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলাম দীর্ঘ ৯
বছর। আমি সে সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের জন্য যে উন্নয়নের
সেতুবন্ধ তৈরি করতে চেয়েছি তার ফল আজ বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু।
দেশব্যাপী যমুনা সেতুর ওপর সারচার্জ আদায়ের মধ্য দিয়ে আমিই প্রথম এ সেতুর
ভিত রচনা করেছিলাম। পরবর্তী সরকার আমলে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু
নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে
উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। আমি মনে
করি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় বিষয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। ভেবেছিলাম,
বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক
উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে; কিন্তু তা হয়নি। এখনও রংপুর, গাইবান্ধা,
লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার মানুষ প্রয়োজন
অনুপাতে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ অঞ্চল থেকে ঢাকা
যেতে ট্রেনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। রংপুরে আমার শাসনামলে দুটি
আন্তঃনগর ট্রেন চালু ছিল। এখন তা বন্ধ। শুধু একটি ট্রেন চালু আছে রংপুর
‘এক্সপ্রেস’, তাও আবার সারা দিনে একবার ঢাকায় যায়। আবার ঢাকা থেকে একবার
রংপুরে আসে। সেখানে বগি সংকট। বগিগুলো পুরনো। লাইট জ্বলে না।
ফ্যান ঘুরে
না। পানি থাকে না। দরজা-জানালা, বসার জায়গা- বেঞ্চ-চেয়ার ভাঙা, জরাজীর্ণ।
সেই ট্রেন রংপুর থেকে ঢাকা পৌঁছতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা। শান্তাহার ঘুরে যেতে
হয়। যদি রংপুর থেকে গাইবান্ধা ও বগুড়া হয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে
ঢাকা যাওয়া যেত, তাহলে রংপুর থেকে ঢাকা যেতে সময় লাগত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা।
মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হতো না। এজন্য প্রয়োজন মতো রেললাইন স্থাপন করা
প্রয়োজন। কিন্তু তা না করায় বঙ্গবন্ধু সেতুর সুবিধা থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে
বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ সময়
দুঃখ করে এরশাদ বলেন, আমি নিজে রেলমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম রংপুরের
মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে অন্তত রংপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াতের জন্য
দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের ব্যবস্থ করেন। তিনি তা শোনেননি। এ সময় সড়কপথের
দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, সড়কপথগুলো কম
প্রশস্ত। তাই প্রায় সময় ঢাকা থেকে উত্তরের জেলাগুলোয় যাত্রী ও মালামাল
পরিবহনে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে। শুধু তাই নয়, প্রায়ই ওই
সড়কে যানজট লেগে থাকে। মানুষের কর্মঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি জ্বালানি
ব্যয় বাড়ছে। এজন্য ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ সড়কগুলো চার লেনে
উন্নীত করা জরুরি। তাহলে এ অঞ্চলের শিক্ষা, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে
ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ‘উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কোনো সরকার পরিকল্পিত
প্রকল্প গ্রহণ ও উন্নয়ন কাজে মনোযোগী না’ উল্লেখ করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
বলেন, ‘আমাদের দেশের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনির পাথর উন্নত। এ পাথর দিয়ে
দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যয় করা গেলে
নির্মাণ ব্যয় সাশ্রয় হবে। কিন্তু আমি জানতে পারলাম, যান্ত্রিক সমস্যার
কারণে দেড় বছর ধরে ওই খনির পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। ফলে ভারত থেকে পাথর
আমদানি করে দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয়
বাড়ছে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি জরুরি।’ প্রধানমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী
এলাকা পীরগঞ্জ। এখানকার কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের মাধ্যমে এলাকাবাসীর
কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেন এরশাদ। তিনি
বলেন, আমাদের রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীরে উন্নতমানের কয়লা খনি রয়েছে। এ
নিয়ে পাকিস্তান আমলে এবং দেশ স্বাধীনের পর বহুবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।
কিন্তু আজও তা উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী
এলাকা পীরগঞ্জ। তাই আমি মনে করি, পীরগঞ্জ থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে রংপুর
অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিকভাবে
পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনমানের উন্নয়ন হবে। তৃণমূল পর্যায়ে
উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম উল্লেখ করে
এরশাদ বলেন, এ কারণে আমি এলজিইডি অধিদফতর প্রবর্তন করেছিলাম। আজ দেশের সব
তৃণমূল পর্যায়ের গ্রামীণ অবকাঠামোসহ পৌর ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সেই
দফতরের ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক সহায়তায় উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। উপজেলা পদ্ধতি,
উপজেলা পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থা চালু করতে অঞ্চলভিত্তিক হাইকোর্টের বেঞ্চ
স্থাপন করেছিলাম। আমি মনে করি, এগুলো পুনরায় চালু করা প্রয়োজন। উপজেলা ও
জেলা পরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে স্থানীয় সরকার
ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বর্তমান সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, বাংলবান্ধা, বুড়িমারী, সোনাহাট, হিলিসহ
উত্তরাঞ্চলের সব স্থল শুল্ক বন্দরের উন্নয়নে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মোগলহাট স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাত্রী পারাপার
করা যেত। সেখানে মোগলহাট ধরলা সেতু এবং সড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ওই স্থল
শুল্ক স্টেশন বন্ধ রয়েছে। তাই এখন রংপুর অঞ্চলের মানুষকে কোচবিহার জেলায়
যেতে হলে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ঘুরে বুড়িমারী সীমান্তপথে যেতে হচ্ছে। ধরলা
সেতু ও সড়ক ঠিক হলে মোগলহাট স্থল শুল্ক স্টেশন চালু করা সম্ভব। ব্রহ্মপুত্র
নদের ওপর বালাসী-বাহাদুরাবাদ এলাকায় সেতু নির্মাণে সরকারের প্রতি আহ্বান
জানিয়ে এরশাদ বলেন, এ সেতুতে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হলে উত্তরের
মানুষের ঢাকায় যাতায়াতে সময় আরও কমে আসবে। এছাড়া রংপুর অঞ্চলে কোনো
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এ অঞ্চলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজী
দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুপাতে অপ্রতুল। তাই কেউ
মানসম্পন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে আগ্রহী হলে সরকারের উচিত
হবে তাকে অনুমতি দেয়া।
No comments