৪৬ বছর পর স্বীকৃতি
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর স্বাধীনতা পদক-২০১৭ পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ন ম নাজমুল আহসান। তাঁর পুরো নাম নুরুন্নবী মোহাম্মদ নাজমুল আহসান সংক্ষেপে ন ম নাজমুল আহসান। জন্ম ১৯৪৯ সালের ২০ জানুয়ারি। পিতা সেকেন্দার আলী তালুকদার ছিলেন হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ এবং মা বেগম নুরজাহান বাংলা সাহিত্যে ও অনূদিত বিশ্বসাহিত্যে অগাধ জ্ঞান রাখতেন। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ীতে নাজমুলের জন্ম। নালিতাবাড়ীর তারাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুল ও তারাগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নাজমুল বিদ্যালয়ে কোনো দিন কোনো পরীক্ষায় বা বিষয়ে দ্বিতীয় হননি। ১৯৬৫ সালে নাজমুল প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেতেন। ক্রিকেট, দাবা—এসব খেলতেও ভালোবাসতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দাবায় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন নাজমুল। নাজমুল ছোটগল্প ও কবিতা লিখতেন। ১৬ বছর বয়সে শেখ নির্দেশ (১৯৬৫ খ্রি.) নাটক লিখে তা পরিচালনা করে বন্ধুদের নিয়ে স্কুলে মঞ্চস্থ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শাখা চালু হলে তিনি শুরু থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, বাগ্মিতা, সততা ও দেশপ্রেমের কারণে খুব অল্প সময়েই তিনি দলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। ১৯৭০ সালে তিনি ছিলেন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে যে ভাষণ দেন, নাজমুল উপস্থিত থেকে সে ভাষণ শোনেন এবং পরদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্র ও নেতাদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেন। ‘তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ২২ বছরের এই তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নালিতাবাড়ীতে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ১৫ দিনের ইউওটিসি ট্রেনিং নিয়েছিলেন। এবার সেই শিক্ষা কাজে লাগল। রাইফেল ধরা ও চালনা তাঁর জানা ছিল। নিজের বাড়িতে বন্দুক ছিল। নালিতাবাড়ীর ন্যূনতম ৮০ জন তরুণকে একত্র করে তিনি তারাগঞ্জ হাইস্কুলে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তান সেনাবাহিনী নালিতাবাড়ী আসার আগে পর্যন্ত এটা চালু ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে ক্যাম্প স্থাপন করে আলবদরদের সহায়তায় অত্যাচার ও লুটপাট চালাতে থাকে। নাজমুল ২৯ মে চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে ভারতের ডালুতে চলে যান।
এরপর যুদ্ধে যোগদান করেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে গঠিত ১১ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন নাজমুল আহসান। তাঁর অধীনে ১২০-১৪০ জন যোদ্ধা ছিলেন। অবশেষে এল সেই ভয়ংকর দিন। শেরপুর শহর তথা সারা দেশের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য শেরপুরের কাটাখালী ব্রিজ ও তিনানীর ফেরি উড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চারদিকে সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরা থাকায় কাজটি ছিল ভয়ংকর। কেউ যখন এই ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ নিতে চাইল না, নাজমুল নিলেন। বললেন, ‘আমি হলাম সেই কমান্ডার যে আগে নিজে জীবন দিব, তোমাদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিব না।’ তাঁর কথায় আশ্বস্ত হয়ে দুটি অপারেশনের মোট ৫৩ জন যোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ৫ জুলাই তাঁরা সন্ধ্যার পর রওনা হন। সফলভাবে দুটি অপারেশন সম্পন্ন হয়। রাত শেষ হয়ে যাওয়ায় দুটি দল একত্র হয়ে রাঙামাটিয়ার খাটুয়াপাড়া গ্রামের শুকুর মাসুদ ও নৈমুদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঠিক দুপুরে যখন হাঁড়িতে টগবগ করে ভাত ফুটছে, তখন সেনাবাহিনী আর আলবদররা সিভিল ড্রেসে এসে তাঁদের আক্রমণ করে। বিপদ টের পেয়ে নাজমুল সবাইকে বিল সাঁতরে পালাতে বললেন। আর নিজে একা দাঁড়িয়ে শত্রুপক্ষকে গুলি করতে করতে জীবন উৎসর্গ করলেন। একই সঙ্গে শহীদ হলেন নাজমুলের চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন ও ভাতিজা ময়মনসিংহ পলিটেকনিক্যালের ছাত্র আলী হোসেন। তাঁদের লাশ রাঙামাটিয়া বিলে ভাসতে থাকল। আর বিলের পানি আরও রাঙা করে সহযোদ্ধারা চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ফিরে গেলেন ভারতে। এরপর দেশ স্বাধীন হলে নাজমুলের সহযোদ্ধারা দেশে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের কাজ চলা অবস্থাতেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাঁকে হত্যা করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের লোকজন নানাভাবে হেনস্তা হতে থাকেন। ১৯৭৭ সালে তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে স্বাধীনতাবিরোধী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদে শহীদের পিতা সেকেন্দার আলী তালুকদার নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তারপর শূন্য হাতে ঘরে ফিরে স্বেচ্ছানির্বাসনের পথ বেছে নেন।
তখন অবস্থা ছিল ‘জো সো চোর সোই সাধী’, যে চোর সেই সাধু আজ (চর্যাপদ)। কিন্তু ইতিহাসের ধারা কেউ পেছনে নিয়ে যেতে পারে না। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান দেওয়ার উদ্যাগ নেয়। মুক্তিযোদ্ধা ন ম নাজমুল আহসান দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সম্মুখসমরে জীবন দিলেও তাঁর সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের পরও কোনো খেতাব পেলেন না বলে পরিবারে ও বন্ধুমহলে আক্ষেপ ছিল বরাবরই। অবশেষে তাঁকে স্বাধীনতা পদক-২০১৭ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৪৬ বছর পর হলেও এই পদকের গৌরব ও সম্মানের গুরুত্ব অনেক। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ নাজমুল আহসান হল নামে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয় এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার হিসেবে তাঁর নামে স্বর্ণপদক চালু করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে স্বর্ণপদক প্রদান কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়। নাজমুলের নিজের এলাকা নালিতাবাড়ীতে তাঁর নামে স্থাপিত হয় নাজমুল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়। ২০১৬ সালে কলেজটি সরকারীকরণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নাজমুলকে নিয়ে দুটি জীবনীগ্রন্থও রচিত হয়েছে।
খালেদা রায়হান: শহীদ ন ম নাজমুল আহসানের বোন, সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
খালেদা রায়হান: শহীদ ন ম নাজমুল আহসানের বোন, সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
No comments