‘হোয়েন টু রব আ ব্যাংক’ by শওকত হোসেন
স্টিভেন
ডি লেভিট মার্কিন অর্থনীতিবিদ আর স্টিফেন জে ডুবনার সাংবাদিক। একজন
অর্থনীতি জানেন, আরেকজন পারেন লিখতে। দুজনে মিলে বের করলেন বই—ফ্রিকোনমিকস।
অর্থনীতির বই মানেই যাঁরা রসকষহীন কিছু একটা মনে করতেন, তাঁদের ধারণা আমূল
পালটে দিলেন এই দুজন। তাঁরা সবশেষ যে বইটি বের করেছেন, আমার আগ্রহ সেটি
নিয়েই। নাম হোয়েন টু রব আ ব্যাংক।
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়ার শেলডন ন্যাশনাল ব্যাংকে অভিনব এক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা পাওয়া গেল বইটিতে। ব্যাংকটির মালিক উইলিয়াম গেইজার। তাঁরই মেয়ে বার্নি গেইজার কাজ করতেন ক্যাশ বিভাগে। ১৯৬১ সালের এক সকালে গ্রেপ্তার হলেন বার্নি। অভিযোগ ২০ লাখ ডলার আত্মসাতের। ৩৭ বছর ধরে তিনি এই অর্থ সরিয়েছেন। বার্নির নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে আছে। কারণ, এর আগে আমানতের অর্থের বিমা করার বাধ্যবাধকতা ছিল না। এ ঘটনার পর আইন বদলাতে হয়।
তবে স্টিভেন লেভিট ও স্টিফেন ডুবনার ঘটনাটি তুলে এনেছেন অন্য কারণে। বার্নি গেইজার ব্যাংকে চাকরি করার সময় কখনো ছুটি নেননি। হিসাবের দুটি খাতা ছিল তাঁর। বার্নির ভয় ছিল, ছুটি নিলে অন্য যিনি তাঁর জায়গায় কাজ করবেন, সব ধরে ফেলবেন। তাই বছরের পর বছর বিনা ছুটিতে কাজ করে গেছেন। বদলি হলে হয়তো আত্মসাতের সুযোগটা পেতেন না বার্নি। মজার ব্যাপার হলো, পাঁচ বছর জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পর বার্নিকে ব্যাংক নজরদারি করার কাজে নিয়োজিত করেছিল সরকার। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ফাঁকফোকর তাঁর চেয়ে আর বেশি কে জানবে?
বার্নি গেইজারের অর্থ আত্মসাৎকে তাহলে আমরা ডাকাতি বলছি কেন? বলছি, কারণ কোনো কোনো আত্মসাৎকে ডাকাতির পর্যায়েই ফেলা যায়। এই তো সেদিন (৩ ফেব্রুয়ারি) আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, ‘বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতি হয়েছে আর সোনালী ব্যাংকে হয়েছে ডাকাতি।’ অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে একমাত্র সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (শেরাটন) শাখা থেকেই আত্মসাৎ হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই শাখার ব্যবস্থাপক পদে এ কে এম আজিজুর রহমান নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের জায়গায় ছিলেন টানা পাঁচ বছর। একে তো আমরা ডাকাতি বলতেই পারি।
একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়েও ব্যাংক ডাকাতদের দেখা যায়। আল পাচিনোর ভক্তরা নিশ্চয়ই ১৯৭৫ সালের সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র ডগ ডে আফটারনুন দেখেছেন। প্রথমবারের মতো ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে দেখল ভুল সময়ে এসেছে তারা। তখন দিনের নগদ জমা প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া শেষ, ক্যাশে আছে মাত্র ১ হাজার ১০০ ডলার। গল্পের শেষটা তো আরও মর্মান্তিক। আল পাচিনোর প্রতি সহানুভূতিটাই থেকে যায় সিনেমাটির শেষে।
স্টিভেন ডি লেভিট আর স্টিফেন জে ডুবনারও একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন ব্যাংক ডাকাতদের। ২০০৯ সালের ব্যাংক ডাকাতির কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই। ওই বছর ছিল অর্থনীতিতে মন্দা। অথচ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংক ডাকাতির সংখ্যা ছিল কম। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে লেভিট ও ডুবনার বলছেন, হতে পারে ব্যাংক ডাকাতেরা খুব ভালো করেই জানে ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার কথা।
তবে ব্যাংক ডাকাতদের যে অর্থনীতি জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, এমন কথাও কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা বলছেন। তিন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ সাসেক্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্যারি রেইলি এবং সারে ইউনিভার্সিটির নেইল রিকম্যান ও রবার্ট উইট ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, অপরাধও একধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মুনাফা আছে, লোকসান আছে, ঝুঁকি আছে এবং এর রিটার্ন বা প্রাপ্তিও আছে। এ কাজেও উপকরণ ব্যবহার করতে হয়, শ্রম দিতে হয়, পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় এবং এর একটি ব্যয়ও আছে।
ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে অনেকেরই একটি রোমান্টিক ধারণা আছে। দু-তিনজনের একটি দল নিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে কোটি কোটি অর্থ বস্তায় ভরে দে ছুট। তারপর সারা জীবন বসে বসে খাও। কিন্তু এই তিন অর্থনীতিবিদ বলছেন, বিষয়টি আসলে সে রকম নয়। তাঁরা মোট ব্যাংক ডাকাতির সংখ্যা, ডাকাতি করা অর্থের পরিমাণ ও ধরা পড়ার হার বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতির ক্ষেত্রে একেকজনের গড় আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭০৬ পাউন্ড। এই অর্থ দিয়ে সারা জীবন বসে বসে খাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। ব্রিটেনে সে সময় যাঁদের পূর্ণ কাজ ছিল, তাঁদের গড় আয় ছিল বছরে ২৬ হাজার পাউন্ড। সুতরাং, একবার ব্যাংক ডাকাতির অর্থ দিয়ে বড়জোর ছয় মাস কাটানো যেত। এরপরেই নামতে হবে আবার ব্যাংক ডাকাতিতে। একাধিকবার ব্যাংক ডাকাতি মানেই ধরা পড়ার আশঙ্কাও বেশি। তিন অর্থনীতিবিদ গবেষণার সবশেষে বলেছেন, ‘ব্যাংক ডাকাতি খুবই খারাপ ধারণা। একটি ব্যাংক ডাকাতি থেকে যে প্রাপ্তি, তা থেকে খুব খোলামেলাভাবেই বলা যায়, রাবিশ (দ্য রিটার্ন অন অ্যান এভারেজ ব্যাংক রবারি ইজ, ফ্রাঙ্কলি, রাবিশ)।’
আমরা জানি, আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রায়ই ‘রাবিশ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই যে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হওয়ার কথা এখন বলছেন, তিন বছর আগেও তিনি একে রাবিশ বলেছিলেন। ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দুষ্টু প্রতিষ্ঠান হল-মার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। হল-মার্কের এমডি জেলে রয়েছে, তার শাস্তি হবেই। বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ব্যাংকাররা হইচই শুরু করেছেন। তাঁদের কথাবার্তা বোগাস ও রাবিশ। সারা পৃথিবীতে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি হয়। বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে এটা তেমন ভয়ংকর কিছু নয়।’
ওই তিন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ব্যাংক ডাকাতিকে যতই নিরুৎসাহিত করুন না কেন, বাংলাদেশে কিন্তু এর উল্টোটা। এখানে ঝুঁকি অনেক কম, লাভ বেশি। বাংলাদেশে ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনি’ মূলত ব্যাংক ডাকাতিরই গল্প। সেই জিয়া-এরশাদের জামানা থেকে শুরু, এখনো চলছে। ধরন পাল্টেছে মাত্র। শুরুতে ছিল ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া। এখন পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা আছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যাংক আর ফেরত পাবে না বলেই ধরা যায়। তাহলে এটা ব্যাংক ডাকাতি না তো কী!
তবে ‘ব্যাংক ডাকাতি’র ধরনও পাল্টেছে। নতুন প্রবণতা হচ্ছে ব্যাংকের মালিক বা প্রতিনিধি সেজে অন্যকে অর্থ আত্মসাতের অবাধ সুযোগ দিয়ে নিজেও লাভবান হওয়া। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এরই উদাহরণ। এ জন্য অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে উপকরণ, শ্রম বা পুঁজি নিয়োগেরও তেমন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের। আর এই সম্পর্কের জোরেই সরকারি ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক হয়ে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এখানে ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বেশ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কোনো ঝুঁকি নেই। ধরা পড়ার প্রশ্নও নেই। খুব বেশি হইচই হলে শেষ ভরসা দুদক তো ‘দায়মুক্তি’র সার্টিফিকেট নিয়ে বসেই আছে।
তাহলে বিখ্যাত সেই গল্পটা বলি। দুজন মিলে ঠিক করল ব্যাংক ডাকাতি করবে। একজন অভিজ্ঞ ডাকাত, আরেকজন নতুন, শিক্ষানবিশ। এক সকালে তারা একটা বন্দুক নিয়ে চলে গেল ব্যাংকে। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘কেউ নড়বেন না। যে যেখানে আছেন, সেখানেই শুয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন, টাকার বিমা আছে, টাকার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু জীবনটা আপনার।’—এ হচ্ছে মন বদলের ধারণা। অর্থাৎ, প্রথাগত চিন্তাভাবনা বদলে দাও, ভালো কাজে দেবে।
এক নারী একটু অন্যভাবে বসে ছিলেন। সহজেই চোখ যায় সেদিকে। অভিজ্ঞ ডাকাতটা তাকে বলল, ‘শালীন হয়ে বসুন। মনে রাখবেন, এটি ডাকাতি, ধর্ষণ না।’—এর নাম হচ্ছে পেশার প্রতি একনিষ্ঠ থাকা। প্রশিক্ষণ যেখানে, তাতেই মনোনিবেশ করা উচিত।
এরপর তারা সব টাকা ব্যাগে ভরল। এবার শিক্ষানবিশ ডাকাতটা বলল, ‘ওস্তাদ, গুনে দেখি কত পেলাম।’ অভিজ্ঞ ডাকাত ধমক দিয়ে বলল, ‘দূর বোকা, এত টাকা কী করে গুনব! তারচেয়ে টিভি খুলে বসে থাকো, জানতেই পারবে কত টাকা পেলাম।’—এর নাম হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আজকাল কাগুজে দক্ষতার চেয়ে অভিজ্ঞতাই বেশি দামি।
ডাকাত দুজন চলে যাওয়ার পর ব্যাংকের এক সহকারী এবার ম্যানেজারকে বলল, ‘স্যার, দ্রুত পুলিশকে খবর দেন।’ ম্যানেজার মৃদু হেসে বলল, ‘আরে অপেক্ষা করুন। আগে ডাকাতির সমপরিমাণ পাঁচ কোটি টাকা দ্রুত সরিয়ে ফেলুন।’—এর নাম হচ্ছে স্রোতের পক্ষে হাঁটা। বিপরীত পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা।
ওই রাতে সংবাদে বলা হলো, ১০ কোটি টাকা ডাকাতি হয়েছে। শুনে দুই ডাকাত বারবার গুনেও পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ পেল না। এবার প্রচণ্ড রাগ হলো তাঁদের। শিক্ষানবিশ ডাকাতটা বলল, ‘এটা কী হলো? আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা ডাকাতি করলাম। আর ওই ব্যাংক ম্যানেজার বসে বসেই তুড়ি মেরে পাঁচ কোটি টাকা আয় করে ফেলল! তাহলে চোর-ডাকাত হওয়ার চেয়ে শিক্ষিত হয়ে ব্যাংক ম্যানেজার হওয়াই তো ভালো।’—এর নাম হচ্ছে জ্ঞানই শক্তিই, শিক্ষাই সবচেয়ে মূল্যবান।
ব্যাংকের ওই ব্যবস্থাপক এবার খানিকটা হেসে ভাবল, ‘যাক, ব্যাংকের এই পদে আসতে দুই কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপরেও তিন কোটি টাকা লাভ।’—এর নাম হচ্ছে সুযোগের সদ্ব্যবহার।
তাহলে কে বড় ডাকাত?
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়ার শেলডন ন্যাশনাল ব্যাংকে অভিনব এক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা পাওয়া গেল বইটিতে। ব্যাংকটির মালিক উইলিয়াম গেইজার। তাঁরই মেয়ে বার্নি গেইজার কাজ করতেন ক্যাশ বিভাগে। ১৯৬১ সালের এক সকালে গ্রেপ্তার হলেন বার্নি। অভিযোগ ২০ লাখ ডলার আত্মসাতের। ৩৭ বছর ধরে তিনি এই অর্থ সরিয়েছেন। বার্নির নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে আছে। কারণ, এর আগে আমানতের অর্থের বিমা করার বাধ্যবাধকতা ছিল না। এ ঘটনার পর আইন বদলাতে হয়।
তবে স্টিভেন লেভিট ও স্টিফেন ডুবনার ঘটনাটি তুলে এনেছেন অন্য কারণে। বার্নি গেইজার ব্যাংকে চাকরি করার সময় কখনো ছুটি নেননি। হিসাবের দুটি খাতা ছিল তাঁর। বার্নির ভয় ছিল, ছুটি নিলে অন্য যিনি তাঁর জায়গায় কাজ করবেন, সব ধরে ফেলবেন। তাই বছরের পর বছর বিনা ছুটিতে কাজ করে গেছেন। বদলি হলে হয়তো আত্মসাতের সুযোগটা পেতেন না বার্নি। মজার ব্যাপার হলো, পাঁচ বছর জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পর বার্নিকে ব্যাংক নজরদারি করার কাজে নিয়োজিত করেছিল সরকার। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ফাঁকফোকর তাঁর চেয়ে আর বেশি কে জানবে?
বার্নি গেইজারের অর্থ আত্মসাৎকে তাহলে আমরা ডাকাতি বলছি কেন? বলছি, কারণ কোনো কোনো আত্মসাৎকে ডাকাতির পর্যায়েই ফেলা যায়। এই তো সেদিন (৩ ফেব্রুয়ারি) আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, ‘বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতি হয়েছে আর সোনালী ব্যাংকে হয়েছে ডাকাতি।’ অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মধ্যে একমাত্র সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (শেরাটন) শাখা থেকেই আত্মসাৎ হয়েছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এই শাখার ব্যবস্থাপক পদে এ কে এম আজিজুর রহমান নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের জায়গায় ছিলেন টানা পাঁচ বছর। একে তো আমরা ডাকাতি বলতেই পারি।
একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়েও ব্যাংক ডাকাতদের দেখা যায়। আল পাচিনোর ভক্তরা নিশ্চয়ই ১৯৭৫ সালের সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র ডগ ডে আফটারনুন দেখেছেন। প্রথমবারের মতো ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে দেখল ভুল সময়ে এসেছে তারা। তখন দিনের নগদ জমা প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া শেষ, ক্যাশে আছে মাত্র ১ হাজার ১০০ ডলার। গল্পের শেষটা তো আরও মর্মান্তিক। আল পাচিনোর প্রতি সহানুভূতিটাই থেকে যায় সিনেমাটির শেষে।
স্টিভেন ডি লেভিট আর স্টিফেন জে ডুবনারও একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন ব্যাংক ডাকাতদের। ২০০৯ সালের ব্যাংক ডাকাতির কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই। ওই বছর ছিল অর্থনীতিতে মন্দা। অথচ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংক ডাকাতির সংখ্যা ছিল কম। এ তথ্য বিশ্লেষণ করে লেভিট ও ডুবনার বলছেন, হতে পারে ব্যাংক ডাকাতেরা খুব ভালো করেই জানে ব্যাংকগুলোর দুরবস্থার কথা।
তবে ব্যাংক ডাকাতদের যে অর্থনীতি জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, এমন কথাও কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা বলছেন। তিন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ সাসেক্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্যারি রেইলি এবং সারে ইউনিভার্সিটির নেইল রিকম্যান ও রবার্ট উইট ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, অপরাধও একধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মুনাফা আছে, লোকসান আছে, ঝুঁকি আছে এবং এর রিটার্ন বা প্রাপ্তিও আছে। এ কাজেও উপকরণ ব্যবহার করতে হয়, শ্রম দিতে হয়, পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় এবং এর একটি ব্যয়ও আছে।
ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে অনেকেরই একটি রোমান্টিক ধারণা আছে। দু-তিনজনের একটি দল নিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে কোটি কোটি অর্থ বস্তায় ভরে দে ছুট। তারপর সারা জীবন বসে বসে খাও। কিন্তু এই তিন অর্থনীতিবিদ বলছেন, বিষয়টি আসলে সে রকম নয়। তাঁরা মোট ব্যাংক ডাকাতির সংখ্যা, ডাকাতি করা অর্থের পরিমাণ ও ধরা পড়ার হার বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে সংঘটিত ব্যাংক ডাকাতির ক্ষেত্রে একেকজনের গড় আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭০৬ পাউন্ড। এই অর্থ দিয়ে সারা জীবন বসে বসে খাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। ব্রিটেনে সে সময় যাঁদের পূর্ণ কাজ ছিল, তাঁদের গড় আয় ছিল বছরে ২৬ হাজার পাউন্ড। সুতরাং, একবার ব্যাংক ডাকাতির অর্থ দিয়ে বড়জোর ছয় মাস কাটানো যেত। এরপরেই নামতে হবে আবার ব্যাংক ডাকাতিতে। একাধিকবার ব্যাংক ডাকাতি মানেই ধরা পড়ার আশঙ্কাও বেশি। তিন অর্থনীতিবিদ গবেষণার সবশেষে বলেছেন, ‘ব্যাংক ডাকাতি খুবই খারাপ ধারণা। একটি ব্যাংক ডাকাতি থেকে যে প্রাপ্তি, তা থেকে খুব খোলামেলাভাবেই বলা যায়, রাবিশ (দ্য রিটার্ন অন অ্যান এভারেজ ব্যাংক রবারি ইজ, ফ্রাঙ্কলি, রাবিশ)।’
আমরা জানি, আমাদের অর্থমন্ত্রী প্রায়ই ‘রাবিশ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। এই যে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হওয়ার কথা এখন বলছেন, তিন বছর আগেও তিনি একে রাবিশ বলেছিলেন। ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দুষ্টু প্রতিষ্ঠান হল-মার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে। হল-মার্কের এমডি জেলে রয়েছে, তার শাস্তি হবেই। বিষয়টি নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও ব্যাংকাররা হইচই শুরু করেছেন। তাঁদের কথাবার্তা বোগাস ও রাবিশ। সারা পৃথিবীতে ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি হয়। বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে এটা তেমন ভয়ংকর কিছু নয়।’
ওই তিন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ব্যাংক ডাকাতিকে যতই নিরুৎসাহিত করুন না কেন, বাংলাদেশে কিন্তু এর উল্টোটা। এখানে ঝুঁকি অনেক কম, লাভ বেশি। বাংলাদেশে ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনি’ মূলত ব্যাংক ডাকাতিরই গল্প। সেই জিয়া-এরশাদের জামানা থেকে শুরু, এখনো চলছে। ধরন পাল্টেছে মাত্র। শুরুতে ছিল ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে মেরে দেওয়া। এখন পর্যন্ত দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে অবলোপন করা আছে আরও প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ ব্যাংক আর ফেরত পাবে না বলেই ধরা যায়। তাহলে এটা ব্যাংক ডাকাতি না তো কী!
তবে ‘ব্যাংক ডাকাতি’র ধরনও পাল্টেছে। নতুন প্রবণতা হচ্ছে ব্যাংকের মালিক বা প্রতিনিধি সেজে অন্যকে অর্থ আত্মসাতের অবাধ সুযোগ দিয়ে নিজেও লাভবান হওয়া। হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি এরই উদাহরণ। এ জন্য অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে উপকরণ, শ্রম বা পুঁজি নিয়োগেরও তেমন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের। আর এই সম্পর্কের জোরেই সরকারি ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও পরিচালক হয়ে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় এখানে ‘ব্যাংক ডাকাতি’ বেশ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। কোনো ঝুঁকি নেই। ধরা পড়ার প্রশ্নও নেই। খুব বেশি হইচই হলে শেষ ভরসা দুদক তো ‘দায়মুক্তি’র সার্টিফিকেট নিয়ে বসেই আছে।
তাহলে বিখ্যাত সেই গল্পটা বলি। দুজন মিলে ঠিক করল ব্যাংক ডাকাতি করবে। একজন অভিজ্ঞ ডাকাত, আরেকজন নতুন, শিক্ষানবিশ। এক সকালে তারা একটা বন্দুক নিয়ে চলে গেল ব্যাংকে। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘কেউ নড়বেন না। যে যেখানে আছেন, সেখানেই শুয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন, টাকার বিমা আছে, টাকার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু জীবনটা আপনার।’—এ হচ্ছে মন বদলের ধারণা। অর্থাৎ, প্রথাগত চিন্তাভাবনা বদলে দাও, ভালো কাজে দেবে।
এক নারী একটু অন্যভাবে বসে ছিলেন। সহজেই চোখ যায় সেদিকে। অভিজ্ঞ ডাকাতটা তাকে বলল, ‘শালীন হয়ে বসুন। মনে রাখবেন, এটি ডাকাতি, ধর্ষণ না।’—এর নাম হচ্ছে পেশার প্রতি একনিষ্ঠ থাকা। প্রশিক্ষণ যেখানে, তাতেই মনোনিবেশ করা উচিত।
এরপর তারা সব টাকা ব্যাগে ভরল। এবার শিক্ষানবিশ ডাকাতটা বলল, ‘ওস্তাদ, গুনে দেখি কত পেলাম।’ অভিজ্ঞ ডাকাত ধমক দিয়ে বলল, ‘দূর বোকা, এত টাকা কী করে গুনব! তারচেয়ে টিভি খুলে বসে থাকো, জানতেই পারবে কত টাকা পেলাম।’—এর নাম হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আজকাল কাগুজে দক্ষতার চেয়ে অভিজ্ঞতাই বেশি দামি।
ডাকাত দুজন চলে যাওয়ার পর ব্যাংকের এক সহকারী এবার ম্যানেজারকে বলল, ‘স্যার, দ্রুত পুলিশকে খবর দেন।’ ম্যানেজার মৃদু হেসে বলল, ‘আরে অপেক্ষা করুন। আগে ডাকাতির সমপরিমাণ পাঁচ কোটি টাকা দ্রুত সরিয়ে ফেলুন।’—এর নাম হচ্ছে স্রোতের পক্ষে হাঁটা। বিপরীত পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা।
ওই রাতে সংবাদে বলা হলো, ১০ কোটি টাকা ডাকাতি হয়েছে। শুনে দুই ডাকাত বারবার গুনেও পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ পেল না। এবার প্রচণ্ড রাগ হলো তাঁদের। শিক্ষানবিশ ডাকাতটা বলল, ‘এটা কী হলো? আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাঁচ কোটি টাকা ডাকাতি করলাম। আর ওই ব্যাংক ম্যানেজার বসে বসেই তুড়ি মেরে পাঁচ কোটি টাকা আয় করে ফেলল! তাহলে চোর-ডাকাত হওয়ার চেয়ে শিক্ষিত হয়ে ব্যাংক ম্যানেজার হওয়াই তো ভালো।’—এর নাম হচ্ছে জ্ঞানই শক্তিই, শিক্ষাই সবচেয়ে মূল্যবান।
ব্যাংকের ওই ব্যবস্থাপক এবার খানিকটা হেসে ভাবল, ‘যাক, ব্যাংকের এই পদে আসতে দুই কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তারপরেও তিন কোটি টাকা লাভ।’—এর নাম হচ্ছে সুযোগের সদ্ব্যবহার।
তাহলে কে বড় ডাকাত?
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
No comments