গণতন্ত্র নানা দিক থেকে আক্রান্ত by হায়দার আকবর খান রনো
ইদানীং
উন্নয়ন বনাম গণতন্ত্রের বিতর্কটি মাঝেমধ্যে জমে উঠছে। অথবা প্রশ্নটি
এভাবেও উত্থাপিত হচ্ছে, উন্নয়ন আগে, না গণতন্ত্র আগে। যেন একটা আরেকটার
বিকল্প। আসলে এ রকম প্রশ্নই অবান্তর। বরং কদিন আগে (গত ৩০ জানুয়ারি) প্রথম
আলোর সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে কবি সোহরাব হাসান যে প্রশ্নটি
উত্থাপন করেছেন, সেইটাই যথেষ্ট সংগত প্রশ্ন। তিনি প্রশ্ন আকারে যে কথাটি
বলেছেন, তা হলো, ‘মধ্য আয়ের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশে তো “নিম্নমানের”
নির্বাচন হতে পারে না। যে জাতি তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উদীয়মান অর্থনৈতিক
শক্তিতে উন্নীত হতে পারে, সেই জাতি একটি ভালো নির্বাচন কেন করতে পারবে না?’
এটা বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ভালো নির্বাচন আমরা খুব কমই পেয়েছি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আমলে (১৯৯১-৯৬) মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পরিণামে সরকার বদল ও সংবিধানে পরিবর্তন এসেছিল। তারপর সব আমলেই মাগুরার মতন বা তার চেয়েও বেশি ত্রুটিপূর্ণ, অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে কারচুপিতে ভরপুর নির্বাচন হয়ে এসেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সে প্রসঙ্গ না হয় নাই-বা তুললাম। কিন্তু তারপর যে উপজেলা, ঢাকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সর্বশেষ পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোকে আর যা-ই হোক, নির্বাচন বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন তো আছেই। পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই কিশোরগঞ্জের এক দলীয় সভায় সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাজিতপুরের নির্বাচন প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সরাসরি কারচুপির কথাটা না বললেও নির্বাচন যে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, সে ইঙ্গিত তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে কিছু কিছু বিষয় আমি মেনে নিতে পারি না।...যদি আমরা বাজিতপুরে পরাজিত হতাম, তাহলে কি আমাদের সরকারকে উচ্ছেদ করে দিত?’
প্রশ্নটা আমারও। এটা একটা মানসিকতার প্রকাশমাত্র। সবকিছু দখল করতে হবে, বৈধ অথবা অবৈধভাবে, যেভাবেই হোক না কেন। রাজনৈতিক পদ, নির্বাচিত পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার, জমি, সম্পদ এবং যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা—সবকিছুই। সৈয়দ আশরাফ স্পষ্টভাষী এবং এই বিকৃত মানসিকতার ঊর্ধ্বে। তাই এমন কথা তিনি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছেন।
এরূপ দখলি মানসিকতা কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই তৈরি হয়। নির্বাচনে যদি কেন্দ্র দখল হয়ে থাকে এবং যাদের দ্বারা এই দখলি কাজ সম্পন্ন হয়, তারা শুধু কেন্দ্র দখল করেই নিশ্চুপ থাকবে না। তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তারা আরও কিছু দখল করতে চাইবে। যে তরুণ মাস্তানগোষ্ঠীকে এই কাজে ব্যবহার করা হবে, তারা এরপর চাইবে জমি দখল, সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী দখল পর্যন্ত। এই কাজে প্রশাসন ও পুলিশকে যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই প্রশাসন ও পুলিশও একপর্যায়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। যেহেতু তাদের হাতে ক্ষমতা থাকে, অতএব ক্ষমতার অপব্যবহারও করবে দ্বিধাহীন চিত্তে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। বরং এটাই জগতের স্বাভাবিক ধর্ম।
আমরা শাসক দলগুলোর নিম্নপর্যায়ের নেতা, উপনেতা ও মাস্তানদের উৎপাত দেখেছি। পাশাপাশি প্রশাসন ও পুলিশ-র্যাবের কিছু সদস্যের অপকর্মও দেখছি। এই দুই অংশের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে। সরকারদলীয় লোকেরা অপকর্ম করলে থানায় মামলা হয় না। আবার কখনো কখনো তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও তৈরি হয়। গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকায় পুলিশের মহাপরিদর্শকের সভাপতিত্বে যেসব জেলার পুলিশ সুপারদের সভা হয়েছিল, তার কিছু কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। জানা গেছে, একাধিক পুলিশ সুপার অভিযোগ করেছেন, ‘মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এসে নানা তদবির করেন। বিশেষ করে টেন্ডার নিয়ে বেশি ঘাপলা। আরও আছে খাসজমি দখল।...মাঝেমধ্যে ভয়ে ওই নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না।’
কয়েকজন সাংসদ ও স্থানীয় নেতার কথা আমরা জানি, যাঁরা বড় বড় অপরাধ করলেও পুলিশ কিছুই করতে পারে না। সন্ত্রাসী লালন, জমি দখল, মাস্তানিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি তাঁরা করেন পুলিশের সামনেই অথবা পুলিশের সহায়তায়। হয়তো পুলিশ বাধ্য হয়েই তাঁদের অপকর্মে সাহায্য করে অথবা চোখ বুজে থাকে। কিন্তু এর বিনিময়ে পুলিশের অসৎ সদস্যরাও কি কিছু আদায় করে নেবেন না? ৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোতে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ‘সংস্কার নিয়ে পুলিশের জবানবন্দি’ শিরোনামে এক চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আড্ডার বিবরণ দিয়েছেন। সেই অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক সরল স্বীকারোক্তি করেছেন। তার মধ্যে একজন বলেছেন, ‘এই যে নির্বাচন হলো, আমরা কিন্তু করে দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবেদন সেভাবে এল না।’ তারপর সাংবাদিক ও লেখক মিজানুর রহমান খান বলছেন, ‘তাঁদের এই কথায় ইঙ্গিত আছে যে সেলফ সেন্সরশিপ বেড়ে গেছে।’
তাই সব খবর সংবাদপত্রে আসে না। শাসক দলের নিচের তলার নেতা ও মাস্তানদের খবরও যেমন আসে না, তেমনি আসে না পুলিশের সব অপকর্মের খবর। তবু লোকমুখে অনেক কিছুই জানাজানি হয়। দেশে বস্তুত আইনের শাসন নেই। যা আছে তা হলো একেকটি ছোট ছোট এলাকায় একেক প্রভাবশালী ব্যক্তির শাসন এবং অবশ্যই তা পুলিশের সহযোগিতায়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত বছর আগস্ট মাসে একবার বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।’ এই কথায় মনে হতে পারে যে পুলিশ বুঝি বড় নিরুপায়, বড় অসহায়। কথাটা এক অর্থে সত্য। কিন্তু পুরো সত্য নয়। কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাহায্য করার বিনিময়ে তারা নিজেরাও অনেক সুবিধা আদায় করে নেয়, ঠিক যেমন উপরতলার রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ হয়ে নির্বাচনে মাস্তানি করার বিনিময়ে ছোট স্তরের মাস্তানরা অন্যত্র নানা ধরনের সুযোগ আদায় করে নেয়, যার মধ্যে টেন্ডার বাক্স দখল থেকে জমি দখল পর্যন্ত পড়ে।
তাই দেখি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানই আবার একই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন যে ‘পুলিশের স্পর্ধা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে পুলিশের কজন সদস্য ও তাদের সোর্সের দ্বারা আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী চা-দোকানদার বাবুল মাতবরকে দেখতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। সম্প্রতি কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের সন্ত্রাসী কাজ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারী এভাবে পুলিশি সন্ত্রাসের কবলে পড়ে নির্যাতিত হয়েছেন। এভাবে পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও নির্যাতন করার কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আসলে এসব কিছুই নতুন নয়। সাধারণ মানুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশকে বন্ধু হিসেবে দেখেনি, বরং ভয়ের চোখে দেখে এসেছে।
অন্যদিকে, জনপ্রতিনিধি বলে যাঁদের পরিচিতি ছিল, ‘নিম্নমানের নির্বাচন’ ও ‘আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে’ সাধারণ মানুষ তাঁদের অধিকাংশকে আর আপনজন বলে ভাবে না। কী করেই-বা ভাববে? যেমন ধরা যাক, গাইবান্ধার যে ‘নির্বাচিত’ সাংসদ ১২ বছরের বালককে পায়ে গুলি করেও সহজেই জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন, দল কর্তৃক বহিষ্কৃতও হন না, বহাল তবিয়তে সাংসদও থেকে যান, তাঁকে জনগণ কী চোখে দেখবে? তিনি ‘অসীম ক্ষমতার’ প্রতীক। জনগণ ভয় করবে, কিন্তু আপনজন মনে করে কাছে ঘেঁষবে না। পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মিলে তৃণমূলে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকছে না।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র আরেক দিক দিয়েও আক্রান্ত হচ্ছে। সেটা হচ্ছে জঙ্গি মৌলবাদ। এরা অন্ধকারের সরীসৃপের মতো। কখন, কোনো দিকে, কাকে ছোবল দেবে জানা নেই। এ বড় ভয়ংকর অবস্থা। গত বছরই চারজন লেখক ও একজন প্রকাশক এদের চাপাতির ঘায়ে রক্তাক্ত হয়ে নিহত হয়েছেন। এদের হাতে নিহত হয়েছেন বিদেশি নাগরিক, মন্দিরে উপস্থিত হিন্দু নাগরিক, শিয়া ধর্মাবলম্বী মানুষ এবং আরও অনেকে। শুধু যে এই কয়েকজন নিহত হয়েছেন তাই নয়, ওরা যে পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চাই নিহত হতে চলেছে। এরা চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিস্ট। কোনো যুক্তি মানে না। কোনো তর্কে বা আলোচনায় আসে না। এরা অন্ধকারের প্রাণী এবং খুবই ভয়ংকর।
এদের কাজ ইসলাম ধর্মবিরোধী এবং গণতন্ত্রবিরোধী। এদের গুলি, বোমা, চাপাতি ও হত্যা দ্বারা যেকোনো দিন বাংলাদেশে তাদের লক্ষ্য (সেটা কী তাও ভালো করে জানা যায় না) অর্জিত হবে না, সেটাও তারা বোঝে না। তবে তারা যেটা করতে পেরেছে, তা হলো এই জঙ্গিবাদী তৎপরতা দেখিয়ে সরকারকে অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী করে তুলেছে। অন্যদিকে, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় জামায়াতি ভাবাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। ফলে সরকারের বিরোধীপক্ষে থাকলেও বিএনপিকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে কেউ মনে করছে না। দুঃখজনকভাবে এটাও সত্য যে সরকারও নানাভাবে মৌলবাদী ভাবাদর্শের কাছে কিছুটা আপস করে চলেছে। এই প্রসঙ্গে সোহরাব হাসানের আরেকটি লেখা থেকে (দীপনদের আমরা কী করে ভুলে যাই?’ প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা অসংগত হবে না।
‘জঙ্গি হামলার জন্য এত দিন আমরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ওপর সব দোষ চাপিয়েছি। কিন্তু সাত বছর ধরে তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই ক্ষমতায়। তারপরও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী এত আস্ফালন কীভাবে দেখায়?...তাহলে কি ক্ষমতাসীনদেরই কেউ সেই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছেন?’
এ বড় কঠিন প্রশ্ন! দুই কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এটুকু বলা যায় যে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও মৌলবাদী সন্ত্রাস—এই দুইয়ের বাইরেই প্রকৃত গণতন্ত্রী-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সন্ধান করতে হবে। সেই শক্তি এখনো রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। কিন্তু এ ছাড়া ভরসার জায়গাই-বা আর কোথায়?
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
এটা বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ভালো নির্বাচন আমরা খুব কমই পেয়েছি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি আমলে (১৯৯১-৯৬) মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পরিণামে সরকার বদল ও সংবিধানে পরিবর্তন এসেছিল। তারপর সব আমলেই মাগুরার মতন বা তার চেয়েও বেশি ত্রুটিপূর্ণ, অথবা আরও স্পষ্ট করে বললে কারচুপিতে ভরপুর নির্বাচন হয়ে এসেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সে প্রসঙ্গ না হয় নাই-বা তুললাম। কিন্তু তারপর যে উপজেলা, ঢাকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সর্বশেষ পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোকে আর যা-ই হোক, নির্বাচন বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন তো আছেই। পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই কিশোরগঞ্জের এক দলীয় সভায় সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাজিতপুরের নির্বাচন প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সরাসরি কারচুপির কথাটা না বললেও নির্বাচন যে ত্রুটিপূর্ণ ছিল, সে ইঙ্গিত তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে কিছু কিছু বিষয় আমি মেনে নিতে পারি না।...যদি আমরা বাজিতপুরে পরাজিত হতাম, তাহলে কি আমাদের সরকারকে উচ্ছেদ করে দিত?’
প্রশ্নটা আমারও। এটা একটা মানসিকতার প্রকাশমাত্র। সবকিছু দখল করতে হবে, বৈধ অথবা অবৈধভাবে, যেভাবেই হোক না কেন। রাজনৈতিক পদ, নির্বাচিত পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার, জমি, সম্পদ এবং যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা—সবকিছুই। সৈয়দ আশরাফ স্পষ্টভাষী এবং এই বিকৃত মানসিকতার ঊর্ধ্বে। তাই এমন কথা তিনি স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে পেরেছেন।
এরূপ দখলি মানসিকতা কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই তৈরি হয়। নির্বাচনে যদি কেন্দ্র দখল হয়ে থাকে এবং যাদের দ্বারা এই দখলি কাজ সম্পন্ন হয়, তারা শুধু কেন্দ্র দখল করেই নিশ্চুপ থাকবে না। তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তারা আরও কিছু দখল করতে চাইবে। যে তরুণ মাস্তানগোষ্ঠীকে এই কাজে ব্যবহার করা হবে, তারা এরপর চাইবে জমি দখল, সম্পত্তি দখল, টেন্ডার বাক্স দখল এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী দখল পর্যন্ত। এই কাজে প্রশাসন ও পুলিশকে যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই প্রশাসন ও পুলিশও একপর্যায়ে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। যেহেতু তাদের হাতে ক্ষমতা থাকে, অতএব ক্ষমতার অপব্যবহারও করবে দ্বিধাহীন চিত্তে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। বরং এটাই জগতের স্বাভাবিক ধর্ম।
আমরা শাসক দলগুলোর নিম্নপর্যায়ের নেতা, উপনেতা ও মাস্তানদের উৎপাত দেখেছি। পাশাপাশি প্রশাসন ও পুলিশ-র্যাবের কিছু সদস্যের অপকর্মও দেখছি। এই দুই অংশের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে। সরকারদলীয় লোকেরা অপকর্ম করলে থানায় মামলা হয় না। আবার কখনো কখনো তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও তৈরি হয়। গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকায় পুলিশের মহাপরিদর্শকের সভাপতিত্বে যেসব জেলার পুলিশ সুপারদের সভা হয়েছিল, তার কিছু কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। জানা গেছে, একাধিক পুলিশ সুপার অভিযোগ করেছেন, ‘মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এসে নানা তদবির করেন। বিশেষ করে টেন্ডার নিয়ে বেশি ঘাপলা। আরও আছে খাসজমি দখল।...মাঝেমধ্যে ভয়ে ওই নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না।’
কয়েকজন সাংসদ ও স্থানীয় নেতার কথা আমরা জানি, যাঁরা বড় বড় অপরাধ করলেও পুলিশ কিছুই করতে পারে না। সন্ত্রাসী লালন, জমি দখল, মাস্তানিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি তাঁরা করেন পুলিশের সামনেই অথবা পুলিশের সহায়তায়। হয়তো পুলিশ বাধ্য হয়েই তাঁদের অপকর্মে সাহায্য করে অথবা চোখ বুজে থাকে। কিন্তু এর বিনিময়ে পুলিশের অসৎ সদস্যরাও কি কিছু আদায় করে নেবেন না? ৫ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোতে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ‘সংস্কার নিয়ে পুলিশের জবানবন্দি’ শিরোনামে এক চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আড্ডার বিবরণ দিয়েছেন। সেই অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক সরল স্বীকারোক্তি করেছেন। তার মধ্যে একজন বলেছেন, ‘এই যে নির্বাচন হলো, আমরা কিন্তু করে দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবেদন সেভাবে এল না।’ তারপর সাংবাদিক ও লেখক মিজানুর রহমান খান বলছেন, ‘তাঁদের এই কথায় ইঙ্গিত আছে যে সেলফ সেন্সরশিপ বেড়ে গেছে।’
তাই সব খবর সংবাদপত্রে আসে না। শাসক দলের নিচের তলার নেতা ও মাস্তানদের খবরও যেমন আসে না, তেমনি আসে না পুলিশের সব অপকর্মের খবর। তবু লোকমুখে অনেক কিছুই জানাজানি হয়। দেশে বস্তুত আইনের শাসন নেই। যা আছে তা হলো একেকটি ছোট ছোট এলাকায় একেক প্রভাবশালী ব্যক্তির শাসন এবং অবশ্যই তা পুলিশের সহযোগিতায়। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত বছর আগস্ট মাসে একবার বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলে আইন তাকে স্পর্শ করে না।’ এই কথায় মনে হতে পারে যে পুলিশ বুঝি বড় নিরুপায়, বড় অসহায়। কথাটা এক অর্থে সত্য। কিন্তু পুরো সত্য নয়। কারণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাহায্য করার বিনিময়ে তারা নিজেরাও অনেক সুবিধা আদায় করে নেয়, ঠিক যেমন উপরতলার রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ হয়ে নির্বাচনে মাস্তানি করার বিনিময়ে ছোট স্তরের মাস্তানরা অন্যত্র নানা ধরনের সুযোগ আদায় করে নেয়, যার মধ্যে টেন্ডার বাক্স দখল থেকে জমি দখল পর্যন্ত পড়ে।
তাই দেখি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানই আবার একই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন যে ‘পুলিশের স্পর্ধা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে পুলিশের কজন সদস্য ও তাদের সোর্সের দ্বারা আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী চা-দোকানদার বাবুল মাতবরকে দেখতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। সম্প্রতি কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের সন্ত্রাসী কাজ প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারী এভাবে পুলিশি সন্ত্রাসের কবলে পড়ে নির্যাতিত হয়েছেন। এভাবে পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও নির্যাতন করার কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আসলে এসব কিছুই নতুন নয়। সাধারণ মানুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশকে বন্ধু হিসেবে দেখেনি, বরং ভয়ের চোখে দেখে এসেছে।
অন্যদিকে, জনপ্রতিনিধি বলে যাঁদের পরিচিতি ছিল, ‘নিম্নমানের নির্বাচন’ ও ‘আইনের শাসনের অনুপস্থিতিতে’ সাধারণ মানুষ তাঁদের অধিকাংশকে আর আপনজন বলে ভাবে না। কী করেই-বা ভাববে? যেমন ধরা যাক, গাইবান্ধার যে ‘নির্বাচিত’ সাংসদ ১২ বছরের বালককে পায়ে গুলি করেও সহজেই জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন, দল কর্তৃক বহিষ্কৃতও হন না, বহাল তবিয়তে সাংসদও থেকে যান, তাঁকে জনগণ কী চোখে দেখবে? তিনি ‘অসীম ক্ষমতার’ প্রতীক। জনগণ ভয় করবে, কিন্তু আপনজন মনে করে কাছে ঘেঁষবে না। পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মিলে তৃণমূলে যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাতে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকছে না।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র আরেক দিক দিয়েও আক্রান্ত হচ্ছে। সেটা হচ্ছে জঙ্গি মৌলবাদ। এরা অন্ধকারের সরীসৃপের মতো। কখন, কোনো দিকে, কাকে ছোবল দেবে জানা নেই। এ বড় ভয়ংকর অবস্থা। গত বছরই চারজন লেখক ও একজন প্রকাশক এদের চাপাতির ঘায়ে রক্তাক্ত হয়ে নিহত হয়েছেন। এদের হাতে নিহত হয়েছেন বিদেশি নাগরিক, মন্দিরে উপস্থিত হিন্দু নাগরিক, শিয়া ধর্মাবলম্বী মানুষ এবং আরও অনেকে। শুধু যে এই কয়েকজন নিহত হয়েছেন তাই নয়, ওরা যে পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চাই নিহত হতে চলেছে। এরা চরিত্রগতভাবে ফ্যাসিস্ট। কোনো যুক্তি মানে না। কোনো তর্কে বা আলোচনায় আসে না। এরা অন্ধকারের প্রাণী এবং খুবই ভয়ংকর।
এদের কাজ ইসলাম ধর্মবিরোধী এবং গণতন্ত্রবিরোধী। এদের গুলি, বোমা, চাপাতি ও হত্যা দ্বারা যেকোনো দিন বাংলাদেশে তাদের লক্ষ্য (সেটা কী তাও ভালো করে জানা যায় না) অর্জিত হবে না, সেটাও তারা বোঝে না। তবে তারা যেটা করতে পেরেছে, তা হলো এই জঙ্গিবাদী তৎপরতা দেখিয়ে সরকারকে অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী করে তুলেছে। অন্যদিকে, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি মৌলবাদী জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে প্রায় জামায়াতি ভাবাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করছে। ফলে সরকারের বিরোধীপক্ষে থাকলেও বিএনপিকে গণতান্ত্রিক শক্তি বলে কেউ মনে করছে না। দুঃখজনকভাবে এটাও সত্য যে সরকারও নানাভাবে মৌলবাদী ভাবাদর্শের কাছে কিছুটা আপস করে চলেছে। এই প্রসঙ্গে সোহরাব হাসানের আরেকটি লেখা থেকে (দীপনদের আমরা কী করে ভুলে যাই?’ প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা অসংগত হবে না।
‘জঙ্গি হামলার জন্য এত দিন আমরা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ওপর সব দোষ চাপিয়েছি। কিন্তু সাত বছর ধরে তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিই ক্ষমতায়। তারপরও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী এত আস্ফালন কীভাবে দেখায়?...তাহলে কি ক্ষমতাসীনদেরই কেউ সেই অন্ধকারের শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছেন?’
এ বড় কঠিন প্রশ্ন! দুই কথায় উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এটুকু বলা যায় যে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও মৌলবাদী সন্ত্রাস—এই দুইয়ের বাইরেই প্রকৃত গণতন্ত্রী-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সন্ধান করতে হবে। সেই শক্তি এখনো রাজনৈতিকভাবে দুর্বল। কিন্তু এ ছাড়া ভরসার জায়গাই-বা আর কোথায়?
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments