শিক্ষায় বৈষম্য এবং এক শিক্ষকের আক্ষেপ by আমিরুল আলম খান
পল্লীতীর্থ।
খুলনার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রধান শিক্ষক শিবপদ পাল মহাশয়। গিয়েছিলাম
আমার পেশাগত কাজে। আলাপ জমল সে সূত্রেই। হাতে সময় ছিল। তিনি যেন আমার চোখ
খুলে দিলেন চৌকস কিছু কথায়। বললেন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যের কথা।
বললেন দেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোর অব্যবস্থাপনার কথা।
সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আসে সমাজের গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনে। সেখানে ইংরেজি শেখানো হচ্ছে। তাতে চাকরির ভালো সুযোগ আছে তাদের জন্য, ইংরেজি জানার সুবাদে। পাল মশাই বলছিলেন শিক্ষার বর্তমান পদ্ধতির কথা। ‘আগে আমরা শেখাতাম বর্ণানুক্রমিক উপায়ে, এখন বাক্যানুক্রমিক উপায়ে। আমরা এখন যে পদ্ধতিতে পড়াচ্ছি, তাতে শিশুরা শিখছে কম।’ তাঁর মতে, এ পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হয়তো সহজ; কিন্তু বাংলা পাঠদানে এটা ততটা কার্যকর নয়।
আমি তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জবাব দিলেন, ইংরেজি বর্ণের মাত্র দুটি রূপ ক্যাপিটাল ও স্মল। বাংলায় বড় হাত-ছোট হাতের বর্ণ নেই সত্য, কিন্তু বর্ণের বহু রূপ আছে। ইংরেজি বর্ণগুলো পাশাপাশি বসে শব্দ তৈরি হয়। সেখানে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ পাশাপাশি বসে। বাংলায়ও পাশেই বসে, কিন্তু তার নানা রূপ। সাধারণভাবে শব্দের প্রথমে স্বরবর্ণের রূপ অপরিবর্তিত থাকলেও মধ্যে এবং শেষে তার রূপবদল ঘটে। স্বরবর্ণ শুধু পাশেই বসে তা নয়, বর্ণের ওপরে-নিচেও বসে। ব্যঞ্জনবর্ণও যুক্ত হতে পারে পাশে এবং ওপর-নিচে, গায়ে গায়ে। বাংলা স্বরবর্ণের রূপান্তরকে বলি ‘কার চিহ্ন’। আর ব্যঞ্জনবর্ণের যুক্ত হওয়াকে বলি ‘ফলা চিহ্ন’। এই কার চিহ্নে এবং ফলা চিহ্নে স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের রূপ বদলে যায়। বর্ণভেদে যুক্ত হওয়ার ধরন আলাদা হতে পারে। যেমন কৃ (ক+ঋ) এবং হৃ (হ+ঋ)। তিনি বললেন, বাক্যানুক্রমিক শিক্ষার ফলে শিশুরা বাক্য শিখছে, কিন্তু বানান শিখছে না। ফলে তারা লিখতে পারে না। এটা একটা বড় সমস্যা।
পাল মশাই মনে করেন, বাংলা বর্ণমালা খুবই বিজ্ঞানসম্মত। তিনি এই বর্ণমালার জন্য গর্ববোধ করেন। তিনি ব্যঞ্জনবণের্র বর্গওয়ারি আলোচনা করে তা কতখানি বিজ্ঞানানুগ তা ব্যাখ্যা করছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রেসক্রিপশন আমরা অন্ধের মতো অনুকরণ করব কেন? কেন আমরা আমাদের ভাষার বৈশিষ্ট্যগত দিক উপেক্ষা করে বর্ণ, আ-কার, ও-কার, ফলা না শিখিয়ে বাক্যানুক্রমিক পদ্ধতির ব্যর্থ অনুকরণ করব?
এ প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গ্রন্থাগারিক খন্দকার ফজলুর রহমান আমাকে স্বরবর্ণহীন এক চিঠির উল্লেখ করলেন। উনিশ শতকে ঢাকা শহরে পড়তে আসা এক কিশোর স্বর এবং ব্যঞ্জন উভয় বর্ণ শিখেছে বটে, শেখেনি কার চিহ্ন। সে তার বাবার কাছে টাকা চেয়ে কার চিহ্নহীন এই পত্র লেখে, ‘ঢক শহর খরচ বড় বশ টক পঠত ন পঠত ভত মর যয়।’ কার চিহ্ন দিয়ে পড়ে দেখুন কী লিখেছে পুত্র তার বাবাকে: ‘ঢাকা শহরে খরচ বড় বেশি। টাকা পাঠাতে না পাঠাতে ভাত মারা যায়।’
পাল মশাইয়ের সব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। এসব কথা ভাষা-পণ্ডিতদের জানার কথা। তবে তাঁর কথায় যুক্তি আছে বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলা ভাষার যারা বিরুদ্ধাচরণ করে, করে ইংরেজির পক্ষে ওকালতি, পণ্ডিতজনের দায়িত্ব তাদের জবাব দেওয়া।
প্রতিটি ভাষার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিটি ভাষা শিক্ষার আছে আলাদা পদ্ধতিও। বাংলা ভাষা শেখাতে ইংরেজির অন্ধ অনুকরণ তাই বাঞ্ছিত না-ও হতে পারে। কিন্তু এই সহজ সত্যটি হয়তো আমরা বুঝি না। তবে এ কথা তো মানতে হবে যে উনিশ শতকে পাদরি কেরি সাহেবরাই তো আমাদের বাংলা ভাষাকে ‘সভ্য’ বানানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁদের মগজের ইংরেজি বাক্যরীতি তাই বাংলায় শিকড় গেড়েছে! আর এখন উন্নয়নের মহা মাতবররা আমাদের ওপর অহর্নিশ শিক্ষার ওহি নাজেল করে চলেছেন। সরকারি টাকা নিতে ওসব ফরমাশ না শুনলে কি চলে?
শিক্ষায় বৈষম্যের প্রশ্নে পাল মশাই বললেন, কিন্ডারগার্টেন (কেজি) পদ্ধতি আধুনিক, উন্নত। উন্নত দেশে এখন এ পদ্ধতি সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক ও কেজি আলাদা প্রতিষ্ঠান। ধনীর দুলালেরা পাচ্ছে কেজি পদ্ধতিতে শেখার সুযোগ। কিন্তু দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। তাঁর অভিমত, দেশে কেজি পদ্ধতি সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করা উচিত। তাঁর সোজাসাপটা প্রশ্ন, সারা দেশে সবার জন্য একই পদ্ধতি অনুসৃত হবে না কেন? কেন বই ও সিলেবাসের মধ্যে পার্থক্য থাকবে? সূর্যের আলোয় সবার সমান অধিকার। শিক্ষার অধিকারও সবার জন্য সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেন, যারা কেজি স্কুল থেকে পাস করবে, তাদের কেন চাকরির সুযোগ বেশি থাকবে? দক্ষতা কাজ পাওয়ার সুযোগের প্রথম ও প্রধান শর্ত। ভাষাগত দক্ষতা তার শীর্ষে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে আজকের শিশুর ভাষাগত ত্রুটি দূর করা যাচ্ছে না। শিশুরা শিখছে যান্ত্রিকভাবে। আনন্দ পাচ্ছে না। আনন্দ ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব। আমাদের শিশুদের প্রাণের উচ্ছলতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
আমাদের আইনে লেখা নেই যে কেজি স্কুলের ছাত্রের চাকরির আলাদা সুযোগ থাকবে। কিন্তু ইংরেজি জানলে চাকরির সুযোগ সত্যিই বেশি। তাই সুযোগটা পায় ওই ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরাই। কিন্তু ইংরেজি জানার সুযোগ তো সবার জন্য সমান করা হয়নি। তা ছাড়া এই দেশে গরিব, অশিক্ষিত ঘরের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখার সুযোগ কোথায়? অথচ চাকরিটা তো তারই বেশি প্রয়োজন। যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত!
পালবাবু কিছু সমাধানের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, আমাদের পুরো সিলেবাস পর্যালোচনা করা দরকার। পাঠ হতে হবে আনন্দদায়ক। ফরমায়েশি লেখক দিয়ে বই লেখানোর বদলে মৌলিক বই পাঠ্য করা উচিত। সমাজের মানুষকে স্কুলের দেখভালের দায়িত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের নানা অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব (বিভিন্ন জরিপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচন, সপ্তাহে অনাবশ্যক থানা শিক্ষা অফিসারের অফিসে হাজিরা দেওয়া, অফিসারদের বা নেতাদের অভ্যর্থনার নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি) থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁরা শুধু শিক্ষাদানের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। তাঁদের জন্য সম্মানজনক বেতনকাঠামো, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই এগুলো করা সম্ভব।
হয়তো শিবপদ বাবুর সুপারিশে কেউ কান দেবে না। তবু কথাগুলো আমাকে ভাবিয়েছে নানা কারণে। যাঁরা তৃণমূলে কাজ করছেন, সমস্যার গভীরে যাওয়া তাঁদের পক্ষে যতটা সহজ, অন্যের পক্ষে তা নয়। শিবপদ বাবুর কথা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। না হলে যে ক্যানসারে আমাদের ভাষাশিক্ষা আক্রান্ত হচ্ছে, তা একদিন গোটা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেবে।
আমিরুল আলম খান: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
amirulkhan7@gmail.com
সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আসে সমাজের গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনে। সেখানে ইংরেজি শেখানো হচ্ছে। তাতে চাকরির ভালো সুযোগ আছে তাদের জন্য, ইংরেজি জানার সুবাদে। পাল মশাই বলছিলেন শিক্ষার বর্তমান পদ্ধতির কথা। ‘আগে আমরা শেখাতাম বর্ণানুক্রমিক উপায়ে, এখন বাক্যানুক্রমিক উপায়ে। আমরা এখন যে পদ্ধতিতে পড়াচ্ছি, তাতে শিশুরা শিখছে কম।’ তাঁর মতে, এ পদ্ধতিতে ইংরেজি শেখানো হয়তো সহজ; কিন্তু বাংলা পাঠদানে এটা ততটা কার্যকর নয়।
আমি তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি জবাব দিলেন, ইংরেজি বর্ণের মাত্র দুটি রূপ ক্যাপিটাল ও স্মল। বাংলায় বড় হাত-ছোট হাতের বর্ণ নেই সত্য, কিন্তু বর্ণের বহু রূপ আছে। ইংরেজি বর্ণগুলো পাশাপাশি বসে শব্দ তৈরি হয়। সেখানে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ পাশাপাশি বসে। বাংলায়ও পাশেই বসে, কিন্তু তার নানা রূপ। সাধারণভাবে শব্দের প্রথমে স্বরবর্ণের রূপ অপরিবর্তিত থাকলেও মধ্যে এবং শেষে তার রূপবদল ঘটে। স্বরবর্ণ শুধু পাশেই বসে তা নয়, বর্ণের ওপরে-নিচেও বসে। ব্যঞ্জনবর্ণও যুক্ত হতে পারে পাশে এবং ওপর-নিচে, গায়ে গায়ে। বাংলা স্বরবর্ণের রূপান্তরকে বলি ‘কার চিহ্ন’। আর ব্যঞ্জনবর্ণের যুক্ত হওয়াকে বলি ‘ফলা চিহ্ন’। এই কার চিহ্নে এবং ফলা চিহ্নে স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের রূপ বদলে যায়। বর্ণভেদে যুক্ত হওয়ার ধরন আলাদা হতে পারে। যেমন কৃ (ক+ঋ) এবং হৃ (হ+ঋ)। তিনি বললেন, বাক্যানুক্রমিক শিক্ষার ফলে শিশুরা বাক্য শিখছে, কিন্তু বানান শিখছে না। ফলে তারা লিখতে পারে না। এটা একটা বড় সমস্যা।
পাল মশাই মনে করেন, বাংলা বর্ণমালা খুবই বিজ্ঞানসম্মত। তিনি এই বর্ণমালার জন্য গর্ববোধ করেন। তিনি ব্যঞ্জনবণের্র বর্গওয়ারি আলোচনা করে তা কতখানি বিজ্ঞানানুগ তা ব্যাখ্যা করছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রেসক্রিপশন আমরা অন্ধের মতো অনুকরণ করব কেন? কেন আমরা আমাদের ভাষার বৈশিষ্ট্যগত দিক উপেক্ষা করে বর্ণ, আ-কার, ও-কার, ফলা না শিখিয়ে বাক্যানুক্রমিক পদ্ধতির ব্যর্থ অনুকরণ করব?
এ প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক গ্রন্থাগারিক খন্দকার ফজলুর রহমান আমাকে স্বরবর্ণহীন এক চিঠির উল্লেখ করলেন। উনিশ শতকে ঢাকা শহরে পড়তে আসা এক কিশোর স্বর এবং ব্যঞ্জন উভয় বর্ণ শিখেছে বটে, শেখেনি কার চিহ্ন। সে তার বাবার কাছে টাকা চেয়ে কার চিহ্নহীন এই পত্র লেখে, ‘ঢক শহর খরচ বড় বশ টক পঠত ন পঠত ভত মর যয়।’ কার চিহ্ন দিয়ে পড়ে দেখুন কী লিখেছে পুত্র তার বাবাকে: ‘ঢাকা শহরে খরচ বড় বেশি। টাকা পাঠাতে না পাঠাতে ভাত মারা যায়।’
পাল মশাইয়ের সব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। এসব কথা ভাষা-পণ্ডিতদের জানার কথা। তবে তাঁর কথায় যুক্তি আছে বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলা ভাষার যারা বিরুদ্ধাচরণ করে, করে ইংরেজির পক্ষে ওকালতি, পণ্ডিতজনের দায়িত্ব তাদের জবাব দেওয়া।
প্রতিটি ভাষার আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিটি ভাষা শিক্ষার আছে আলাদা পদ্ধতিও। বাংলা ভাষা শেখাতে ইংরেজির অন্ধ অনুকরণ তাই বাঞ্ছিত না-ও হতে পারে। কিন্তু এই সহজ সত্যটি হয়তো আমরা বুঝি না। তবে এ কথা তো মানতে হবে যে উনিশ শতকে পাদরি কেরি সাহেবরাই তো আমাদের বাংলা ভাষাকে ‘সভ্য’ বানানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁদের মগজের ইংরেজি বাক্যরীতি তাই বাংলায় শিকড় গেড়েছে! আর এখন উন্নয়নের মহা মাতবররা আমাদের ওপর অহর্নিশ শিক্ষার ওহি নাজেল করে চলেছেন। সরকারি টাকা নিতে ওসব ফরমাশ না শুনলে কি চলে?
শিক্ষায় বৈষম্যের প্রশ্নে পাল মশাই বললেন, কিন্ডারগার্টেন (কেজি) পদ্ধতি আধুনিক, উন্নত। উন্নত দেশে এখন এ পদ্ধতি সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রাথমিক ও কেজি আলাদা প্রতিষ্ঠান। ধনীর দুলালেরা পাচ্ছে কেজি পদ্ধতিতে শেখার সুযোগ। কিন্তু দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। তাঁর অভিমত, দেশে কেজি পদ্ধতি সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করা উচিত। তাঁর সোজাসাপটা প্রশ্ন, সারা দেশে সবার জন্য একই পদ্ধতি অনুসৃত হবে না কেন? কেন বই ও সিলেবাসের মধ্যে পার্থক্য থাকবে? সূর্যের আলোয় সবার সমান অধিকার। শিক্ষার অধিকারও সবার জন্য সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুললেন, যারা কেজি স্কুল থেকে পাস করবে, তাদের কেন চাকরির সুযোগ বেশি থাকবে? দক্ষতা কাজ পাওয়ার সুযোগের প্রথম ও প্রধান শর্ত। ভাষাগত দক্ষতা তার শীর্ষে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে আজকের শিশুর ভাষাগত ত্রুটি দূর করা যাচ্ছে না। শিশুরা শিখছে যান্ত্রিকভাবে। আনন্দ পাচ্ছে না। আনন্দ ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব। আমাদের শিশুদের প্রাণের উচ্ছলতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
আমাদের আইনে লেখা নেই যে কেজি স্কুলের ছাত্রের চাকরির আলাদা সুযোগ থাকবে। কিন্তু ইংরেজি জানলে চাকরির সুযোগ সত্যিই বেশি। তাই সুযোগটা পায় ওই ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরাই। কিন্তু ইংরেজি জানার সুযোগ তো সবার জন্য সমান করা হয়নি। তা ছাড়া এই দেশে গরিব, অশিক্ষিত ঘরের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখার সুযোগ কোথায়? অথচ চাকরিটা তো তারই বেশি প্রয়োজন। যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, সেই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত!
পালবাবু কিছু সমাধানের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, আমাদের পুরো সিলেবাস পর্যালোচনা করা দরকার। পাঠ হতে হবে আনন্দদায়ক। ফরমায়েশি লেখক দিয়ে বই লেখানোর বদলে মৌলিক বই পাঠ্য করা উচিত। সমাজের মানুষকে স্কুলের দেখভালের দায়িত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের নানা অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব (বিভিন্ন জরিপ, ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচন, সপ্তাহে অনাবশ্যক থানা শিক্ষা অফিসারের অফিসে হাজিরা দেওয়া, অফিসারদের বা নেতাদের অভ্যর্থনার নামে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি) থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাঁরা শুধু শিক্ষাদানের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। তাঁদের জন্য সম্মানজনক বেতনকাঠামো, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন, শুধু সদিচ্ছা থাকলেই এগুলো করা সম্ভব।
হয়তো শিবপদ বাবুর সুপারিশে কেউ কান দেবে না। তবু কথাগুলো আমাকে ভাবিয়েছে নানা কারণে। যাঁরা তৃণমূলে কাজ করছেন, সমস্যার গভীরে যাওয়া তাঁদের পক্ষে যতটা সহজ, অন্যের পক্ষে তা নয়। শিবপদ বাবুর কথা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। না হলে যে ক্যানসারে আমাদের ভাষাশিক্ষা আক্রান্ত হচ্ছে, তা একদিন গোটা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেবে।
আমিরুল আলম খান: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
amirulkhan7@gmail.com
No comments