ভাষার শুদ্ধ রূপ টিকিয়ে রাখতে হলে শোনানোর রূপ শুদ্ধ হতে হবে by মাহফুজ উল্লাহ
বিষয়টি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস
সম্পর্কিত বিষয় নয়। এটি ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবহার সম্পর্কিত ভাবনার
বহিঃপ্রকাশ। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষার মর্যাদা নতুন গুরুত্ব নিয়ে আসে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কারণে একুশে ফেব্রুয়ারি
আন্তর্জাতিকতাও লাভ করেছে। কিন্তু আগামীর পদযাত্রায় বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও
মর্যাদা যে ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সে বিষয়টি অনেকেই গুরুত্ব সহকারে
বিবেচনা করেন না। আর এ ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই যেভাবে
সম্পৃক্ত হয়ে আছে সে কথা নাই বা তুললাম। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য
পূর্ববাংলার বাংলা ভাষাভাষীরা প্রবল আবেগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোটের লড়াইয়ে
অংশগ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার মাত্র দু’বছরের মাথায় সে আবেগ ধূলিসাৎ হয়ে
যায়। আর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে জনগণের সপক্ষে যে সর্বগ্রাসী ও সফল আন্দোলন
বাংলাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করল তা অতুলনীয়। অবশ্য এ আন্দোলনকে শুধু
ভাষার আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করলে ভ্রান্তির অবকাশ থেকে যাবে। এ আন্দোলন
বাহ্যত ভাষার আন্দোলন হলেও এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কয়েকটি বিষয় ভাস্বর হয়ে
ওঠে যা মূলত ছিল রাজনৈতিক। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ভাষার মর্যাদা জাতিগত
অধিকারের বা জাতীয় প্রশ্নের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বামপন্থী রাজনৈতিক
দলগুলো শক্তিশালী হলেও এবং ভাষা আন্দোলনের সাফল্যের ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি
হিসেবে কাজ করলেও, পরবর্তী সময়ে তারা শ্রেণী প্রশ্নকে বুঝতে পারলেও জাতীয়
প্রশ্নকে বুঝতে পারেননি। ভারতেও এক সময় ভাষা নিয়ে প্রচুর আন্দোলন হয়েছে।
হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে ভারতের ভিন্ন ভাষাভাষীরা ভাষার অধিকারের প্রশ্নে
রাজপথে নেমেছিলেন। কিন্তু সে আন্দোলন কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্বল করতে পারেনি
এবং ভিন্ন ভাষাভাষীরা নিজেদের কোনো আলাদা রাষ্ট্রও গড়ে তুলতে পারেননি।
সম্ভবত, ভাষা সেখানে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক বোঝার ভারে ন্যুব্জ হয়ে
গেছে।
ফেব্রুয়ারি মাস এখন আর বাংলাদেশে আন্দোলনের মাস হিসেবে চিহ্নিত হয় না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বইমেলাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের ফলে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের যে একটি আলাদা গুরুত্ব ছিল সে কথাটি এখন প্রায় বিস্মৃত। বাংলা ফাল্গুন মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে ফেব্রুয়ারির উৎসব আরও রঙিন হয়ে উঠেছে। ফাগুনের উৎসবের রঙ নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলে ফেব্রুয়ারিকে।
একুশের শিক্ষাকে বিপথগামী করে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে প্রমিত বাংলা বলে আর কিছু থাকবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে বাংলা ভাষা এখন ভিন্ন চেহারা নিতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনে ভাষার নতুন চেহারা।
বিদ্বজ্জনরা প্রশ্ন তুলতে পারেন ভাষার চারিত্রিক স্থায়িত্ব নিয়ে, বিশেষ করে এমন একটি ভাষা যেখানে বিদেশী শব্দের উপস্থিতি প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। নতুন করে গবেষণা করলে দেখা যাবে এ সংখ্যা হয়তো ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে এবং একই ঘটনা ঘটেছে ইংরেজি ভাষার বাংলাদেশী ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
বাংলা ভাষায় কি কোনো শুদ্ধ উচ্চারণ ও বানান রীতি আছে? পথ চলতে বা ঘরে বসে যারা এফএম রেডিও শোনেন তাদের আঁতকে ওঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শব্দের উচ্চারণ কেমন করে এ জায়গায় পৌঁছেছে তা ওইসব রেডিও কেন্দ্রের সক্রিয় আরজে বা রেডিও জকিরাই বলতে পারবে। বাংলাদেশের এলাকাগুলোর বিভিন্ন নামের যে একটি নিয়মিত উচ্চারণ পরিচিতি আছে সেটি পর্যন্ত এ আরজেরা জানেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত ইংরেজি মাথায় রেখে এলাকার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে তারা বিকৃতিটা ঘটিয়ে ফেলেন। আর অন্যান্য উচ্চারণের কথা না হয় বাদই দিলাম। এসব নিয়ে কিন্তু মাথা ঘামান না বা প্রশ্ন উত্থাপন করেন না। অথচ পাকিস্তানি আমলে যখন রোমান হরফে বাংলা লেখার বা আরবি ও ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছিল তখন তাকে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশকে বিপথগামী করার ষড়যন্ত্র হিসেবে। প্রতিবাদের মুখে সে উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল ভারতের পশ্চিম বাংলার গল্প-উপন্যাসে যে পরিমাণ ফার্সি, আরবি ও উর্দু শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তা উল্লেখ করার মতো।
বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের অবশ্য এ বিপথগামী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাই বলে ভাষা অপরিবর্তনীয় এমন অবস্থানও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু উচ্চারণের নাটুকেপনা দিয়ে ভাষাকে যে বিপথগামী করা হচ্ছে সেটাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একই কথা, বাংলা বানান রীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলা একাডেমি বাংলা বানান রীতিকে প্রমিত করার চেষ্টা করেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি- কী পাঠ্যপুস্তকে অথবা টেলিভিশনের স্ক্রল বা স্টিকারের ক্ষেত্রে। অথচ বাজারে বাংলা একাডেমির বানান অভিধানের চাহিদা ব্যাপক।
ভাষার পরিবর্তন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এ পরিবর্তন ঘটে বিদেশী ভাষার অনুপ্রবেশের কারণে। কিন্তু এর ফলে ভাষার মূল চেহারাটা পাল্টে যায় না। অবশ্য মোবাইল ফোনের এসএমএস যা ক্ষুদে বার্তা হিসেবে যে ভাষা পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা হঠাৎ করে পড়তে গেলে হোঁচট খেতে হবে। কিন্তু তরুণরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ ক্ষুদে বার্তা পাঠাতে ও পড়তে পারেন। এ বাস্তবতার কারণেই এক দশক পর ভাষার চেহারাটা কী দাঁড়াবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।
জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে ভাষার একটা সম্পর্ক আছে। সব আরবি ভাষাভাষী একই ধরনের আরবিতে কথা বলেন না, যেমনটা ঘটে বাংলাদেশের বাংলা ও ভারতীয় বাংলার ক্ষেত্রে। আবার স্পেনের অধিবাসীরা যে স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করেন তার কথ্য রূপ অনেকটা বদলে গেছে দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে। আর পশ্চিম ভারতীয় ও ক্যারিবীয় রাষ্ট্রগুলোর ইংরেজি নিয়ে আলোচনা না করাই শ্রেয়। ওই ইংরেজি পুরোপুরি বুঝতে হলে বেশ কিছুদিন চেষ্টা করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা কেন এভাবে বদলাচ্ছে? এটা কি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, না সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে উদ্ভূত? বাংলাদেশের মানুষ শোবার ঘরে যে ভাষায় কথা বলেন, বসার ঘরে সে ভাষায় কথা বলেন না। বসার ঘরে যে ভাষায় কথা বলেন, অফিসে সহকর্মী বা বসের সঙ্গে সে ভাষায় কথা বলেন না। আবার ভালোবাসা শব্দটি দিয়ে যত রকমের ভালোবাসার কথা বলা যায় তাতে অন্য শব্দের প্রয়োজন হয় না।
বাঙালি মাত্রেই বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে কতখানি অহংকারী হতে পারে দেশের সংবিধানই তার প্রমাণ। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি।’ এ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে মানতে হলে এদেশে যে প্রায় ত্রিশটির মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে তারাও কি বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হবে? এখানেই সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর মাতব্বরি, যা জাতিগত নির্যাতনকে বৈধতা দেয়। এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাংলাদেশীরা এখন নিজেদের ভাষা সংরক্ষণ এবং সে ভাষায় লেখাপড়া করার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বৃহত্তর আক্রমণের মুখে তারা কি কাক্সিক্ষত মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন? ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর জবাব, না। বাংলাদেশের এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি যে ধরনের আগ্রাসনের শিকার, বাংলাদেশীদের বাংলাও আজ সে ধরনের আগ্রাসনের শিকার। এ আগ্রাসন ঠেকানোর শক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক শক্তির নেই।
একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। এ ছড়ানোর দুটি পূর্বশর্ত আছে : মানসম্পন্ন সৃষ্টি এবং প্রমিত বাংলার অনুসরণ। অবশ্য ভাষার প্রমিত রূপ অনুসরণ না করেও যে বিত্তবান লেখক হওয়া যায় তার প্রমাণ ভারতীয় লেখক শোভা দে। হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে হিংলিশ লিখে তিনি বিত্ত ও খ্যাতির মালিক হয়েছেন। ভাষা যদি সংস্কৃতির অন্যতম বাহন হয়, তাহলে এদেশের সংস্কৃতিতে অতি সুকৌশলে যে অনুপ্রবেশ ঘটছে, তা ভাষাকে বদলে দেবে সন্দেহ নেই।
এ দেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রতিবাদের সাহস যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত ভাষার শুদ্ধ রূপকে ধারণ করার চেষ্টা। সে শুদ্ধ রূপকে টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে শোনানোর যে ভাষা তা শুদ্ধ হতে হবে। চোখের সামনে যে ভাষা ফুটে ওঠে বা যে ভাষা শোনাকে প্রভাবিত করে, তা হতে হবে প্রমিত বাংলা, এদেশীয় কোনো আঞ্চলিক উচ্চারণ বা বানানের বহিঃপ্রকাশ নয়।
মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক
ফেব্রুয়ারি মাস এখন আর বাংলাদেশে আন্দোলনের মাস হিসেবে চিহ্নিত হয় না। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বইমেলাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের ফলে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের যে একটি আলাদা গুরুত্ব ছিল সে কথাটি এখন প্রায় বিস্মৃত। বাংলা ফাল্গুন মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে ফেব্রুয়ারির উৎসব আরও রঙিন হয়ে উঠেছে। ফাগুনের উৎসবের রঙ নতুন রঙে রাঙিয়ে তোলে ফেব্রুয়ারিকে।
একুশের শিক্ষাকে বিপথগামী করে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে প্রমিত বাংলা বলে আর কিছু থাকবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বিভিন্ন ধরনের গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে বাংলা ভাষা এখন ভিন্ন চেহারা নিতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনে ভাষার নতুন চেহারা।
বিদ্বজ্জনরা প্রশ্ন তুলতে পারেন ভাষার চারিত্রিক স্থায়িত্ব নিয়ে, বিশেষ করে এমন একটি ভাষা যেখানে বিদেশী শব্দের উপস্থিতি প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। নতুন করে গবেষণা করলে দেখা যাবে এ সংখ্যা হয়তো ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে এবং একই ঘটনা ঘটেছে ইংরেজি ভাষার বাংলাদেশী ব্যবহারের ক্ষেত্রে।
বাংলা ভাষায় কি কোনো শুদ্ধ উচ্চারণ ও বানান রীতি আছে? পথ চলতে বা ঘরে বসে যারা এফএম রেডিও শোনেন তাদের আঁতকে ওঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শব্দের উচ্চারণ কেমন করে এ জায়গায় পৌঁছেছে তা ওইসব রেডিও কেন্দ্রের সক্রিয় আরজে বা রেডিও জকিরাই বলতে পারবে। বাংলাদেশের এলাকাগুলোর বিভিন্ন নামের যে একটি নিয়মিত উচ্চারণ পরিচিতি আছে সেটি পর্যন্ত এ আরজেরা জানেন বলে মনে হয় না। সম্ভবত ইংরেজি মাথায় রেখে এলাকার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে তারা বিকৃতিটা ঘটিয়ে ফেলেন। আর অন্যান্য উচ্চারণের কথা না হয় বাদই দিলাম। এসব নিয়ে কিন্তু মাথা ঘামান না বা প্রশ্ন উত্থাপন করেন না। অথচ পাকিস্তানি আমলে যখন রোমান হরফে বাংলা লেখার বা আরবি ও ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছিল তখন তাকে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশকে বিপথগামী করার ষড়যন্ত্র হিসেবে। প্রতিবাদের মুখে সে উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকাল ভারতের পশ্চিম বাংলার গল্প-উপন্যাসে যে পরিমাণ ফার্সি, আরবি ও উর্দু শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তা উল্লেখ করার মতো।
বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষীদের অবশ্য এ বিপথগামী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তাই বলে ভাষা অপরিবর্তনীয় এমন অবস্থানও গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু উচ্চারণের নাটুকেপনা দিয়ে ভাষাকে যে বিপথগামী করা হচ্ছে সেটাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একই কথা, বাংলা বানান রীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলা একাডেমি বাংলা বানান রীতিকে প্রমিত করার চেষ্টা করেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি- কী পাঠ্যপুস্তকে অথবা টেলিভিশনের স্ক্রল বা স্টিকারের ক্ষেত্রে। অথচ বাজারে বাংলা একাডেমির বানান অভিধানের চাহিদা ব্যাপক।
ভাষার পরিবর্তন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এ পরিবর্তন ঘটে বিদেশী ভাষার অনুপ্রবেশের কারণে। কিন্তু এর ফলে ভাষার মূল চেহারাটা পাল্টে যায় না। অবশ্য মোবাইল ফোনের এসএমএস যা ক্ষুদে বার্তা হিসেবে যে ভাষা পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তা হঠাৎ করে পড়তে গেলে হোঁচট খেতে হবে। কিন্তু তরুণরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ ক্ষুদে বার্তা পাঠাতে ও পড়তে পারেন। এ বাস্তবতার কারণেই এক দশক পর ভাষার চেহারাটা কী দাঁড়াবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।
জাতিগত পরিচয়ের সঙ্গে ভাষার একটা সম্পর্ক আছে। সব আরবি ভাষাভাষী একই ধরনের আরবিতে কথা বলেন না, যেমনটা ঘটে বাংলাদেশের বাংলা ও ভারতীয় বাংলার ক্ষেত্রে। আবার স্পেনের অধিবাসীরা যে স্প্যানিশ ভাষা ব্যবহার করেন তার কথ্য রূপ অনেকটা বদলে গেছে দক্ষিণ আমেরিকার স্প্যানিশ ভাষাভাষী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে। আর পশ্চিম ভারতীয় ও ক্যারিবীয় রাষ্ট্রগুলোর ইংরেজি নিয়ে আলোচনা না করাই শ্রেয়। ওই ইংরেজি পুরোপুরি বুঝতে হলে বেশ কিছুদিন চেষ্টা করতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাংলা কেন এভাবে বদলাচ্ছে? এটা কি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, না সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে উদ্ভূত? বাংলাদেশের মানুষ শোবার ঘরে যে ভাষায় কথা বলেন, বসার ঘরে সে ভাষায় কথা বলেন না। বসার ঘরে যে ভাষায় কথা বলেন, অফিসে সহকর্মী বা বসের সঙ্গে সে ভাষায় কথা বলেন না। আবার ভালোবাসা শব্দটি দিয়ে যত রকমের ভালোবাসার কথা বলা যায় তাতে অন্য শব্দের প্রয়োজন হয় না।
বাঙালি মাত্রেই বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে কতখানি অহংকারী হতে পারে দেশের সংবিধানই তার প্রমাণ। সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি।’ এ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে মানতে হলে এদেশে যে প্রায় ত্রিশটির মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে তারাও কি বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হবে? এখানেই সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর মাতব্বরি, যা জাতিগত নির্যাতনকে বৈধতা দেয়। এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাংলাদেশীরা এখন নিজেদের ভাষা সংরক্ষণ এবং সে ভাষায় লেখাপড়া করার ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বৃহত্তর আক্রমণের মুখে তারা কি কাক্সিক্ষত মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকতে পারবেন? ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর জবাব, না। বাংলাদেশের এ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি যে ধরনের আগ্রাসনের শিকার, বাংলাদেশীদের বাংলাও আজ সে ধরনের আগ্রাসনের শিকার। এ আগ্রাসন ঠেকানোর শক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক শক্তির নেই।
একুশের বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। এ ছড়ানোর দুটি পূর্বশর্ত আছে : মানসম্পন্ন সৃষ্টি এবং প্রমিত বাংলার অনুসরণ। অবশ্য ভাষার প্রমিত রূপ অনুসরণ না করেও যে বিত্তবান লেখক হওয়া যায় তার প্রমাণ ভারতীয় লেখক শোভা দে। হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে হিংলিশ লিখে তিনি বিত্ত ও খ্যাতির মালিক হয়েছেন। ভাষা যদি সংস্কৃতির অন্যতম বাহন হয়, তাহলে এদেশের সংস্কৃতিতে অতি সুকৌশলে যে অনুপ্রবেশ ঘটছে, তা ভাষাকে বদলে দেবে সন্দেহ নেই।
এ দেশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রতিবাদের সাহস যেমন জড়িত, তেমনি জড়িত ভাষার শুদ্ধ রূপকে ধারণ করার চেষ্টা। সে শুদ্ধ রূপকে টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে শোনানোর যে ভাষা তা শুদ্ধ হতে হবে। চোখের সামনে যে ভাষা ফুটে ওঠে বা যে ভাষা শোনাকে প্রভাবিত করে, তা হতে হবে প্রমিত বাংলা, এদেশীয় কোনো আঞ্চলিক উচ্চারণ বা বানানের বহিঃপ্রকাশ নয়।
মাহফুজ উল্লাহ : সাংবাদিক
No comments