জনগণের সমর্থন ছাড়া পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয় : মুহাম্মদ নুরুল হুদা by মোকাম্মেল হোসেন
পুলিশের
সাবেক আইজি মুহাম্মদ নুরুল হুদার জন্ম ১৯৪৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
সমাজকল্যাণে মাস্টার্স শেষ করে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার
মাধ্যমে ১৯৭০ সালে তিনি পুলিশ বিভাগে যোগ দেন। সম্প্রতি সমাপ্ত পুলিশ
সপ্তাহ এবং পুলিশ বিভাগের সমস্যা, সম্ভাবনাসহ অন্যান্য বিষয়ে যুগান্তরের
সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি খোলামেলা মত প্রদান করেছেন। সাক্ষাৎকার
নিয়েছেন-
যুগান্তর :
সম্প্রতি শেষ হওয়া পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে জনগণের সেবক হওয়ার
আহ্বান জানিয়ে অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো দাঁড়াতে
বলেছেন। দেশের পুলিশ বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানের মর্যাদা রাখতে সক্ষম
হবে?
মুহাম্মদ নুরুল হুদা : না রাখতে পারার কোনো কারণ দেখি না। পুলিশের যে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য আছে, তার আলোকে বিচার করলে উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল- যে দেশই হোক, জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়; পুলিশ বিভাগ যে আইন-কানুন দ্বারা চলে, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনের প্রথমদিকেই পরিষ্কার করে বলা আছে, পুলিশ বাহিনীকে সফল হতে হলে জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পেতে হবে। এটাই যদি মাপকাঠি হয় সাফল্যের, তাহলে জনগণের জন্য কাজ করা তো অবশ্যই দরকার। স্বাধীন দেশে পুলিশ তো আর অন্য কারও প্রতিনিধি নয়; জনগণের প্রতিনিধি। আমাদের শাসনতন্ত্রে তো বলাই আছে- সব ক্ষমতা জনগণের কাছে আছে। তো জনগণের জন্য কাজ করলে পুলিশের পেশাগত উৎকর্ষসাধনে কোনো বাধা আসে না। এটা বরং ভালো হয় এবং সেখানে জনগণের সমর্থন থাকে। দেশের সমগ্র জনগণের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা তো একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। সমগ্র জনগণের আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি যখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তখন তাদের সমর্থন থাকলেই তো আপনি ভালো করবেন।
যুগান্তর : পুলিশ সপ্তাহে প্যারেডের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা অধিনায়ক হিসেবে প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মু. নু. হুদা : এজন্য সরকার যথেষ্ট বাহবা পেতে পারে। অতীতের দিকে তাকালে দেখব- বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়, সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ সালে প্রথম মহিলা পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়। এটা তারই ধারাবাহিকতা। মাঝখানে একটা সময় ছিল, তখন অদ্ভুত কিছু কারণে মহিলা পুলিশ থাকলেও তাদের দৃশ্যমান করা হতো না। আমরা সে সময়টা পার হয়ে এসেছি। এখন প্রচুর মহিলা পুলিশ আছে এবং মহিলা পুলিশের যে ইন্টারন্যাশনাল বডি আছে, সেখানেও তাদের একটা উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আইইউএন কন্টিনজেন্টে মহিলা পুলিশরা প্রশংসনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশে এখন এডিশনাল আইজি অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদেও মহিলা কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। সেই আলোকে বিচার করলে এবারের প্যারেড কন্টিনজেন্টে একজন মহিলা থাকার বিষয়টি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যুগান্তর : পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত ১৮টি দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল পুলিশের প্রশাসনিক কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। এ দাবি পূরণ হওয়া কতটা জরুরি?
মু. নু. হুদা : এটা তো দাবি করা লাগে না। পুলিশ বাহিনী একটা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বাহিনী। দেশে যেসব প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আইন হচ্ছে শাসনতন্ত্র অর্থাৎ আমাদের সংবিধানে নির্দেশনা দেয়া আছে- কীভাবে কাজ করতে হবে। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু আইন, পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল ও স্থানীয় আইন আছে। অপরাধের ব্যাপারে সাবজেক্টিভ ল’ হচ্ছে বাংলাদেশ পেনাল কোড। আর অ্যাডজেক্টিভ বা প্রসিডিউরাল ল’ হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড। এগুলোকে সাহায্য করার জন্য বিচারিক পর্যায়ে রয়েছে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট। এগুলোর আলোকেই পুলিশকে কাজ করতে হবে। যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে, অবাঞ্ছিত ও বেআইনি হস্তক্ষেপ থেকে থাকে, এটা তো বলেই দেয়া হয়ছে, কীভাবে কাজ করতে হবে? আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে কারও যদি মনে হয়, তিনি অন্যায়ভাবে অ্যাফেক্টেড হচ্ছেন, আর যদি আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তাহলে তাকে প্রটেকশন দেয়ার জন্য সুপিরিয়র অফিসাররা আছেন। বিভাগীয় প্রধান আছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আছে। এছাড়া বিচারিক পর্যায়েও তাকে সুরক্ষা দেয়ার বিধান রয়েছে।
যুগান্তর : পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যত অভিযোগ ওঠে, তার বেশির ভাগই সংঘটিত হয় পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ফলে- এ অভিযোগ কতটা সত্য?
মু. নু. হুদা : এর পক্ষে কোনো পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই। যদি কারও কাছে থাকে, তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে আমার কাছে মনে হয়, এটা এক ধরনের সুইপিং কমেন্ট। এ রকম গুরুতর একটা ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কথা হবে।
যুগান্তর : সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে এ ধরনের কথা বলা হয়।
মু. নু. হুদা : না, স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বললে হবে না। আপনি যখন দেশব্যাপী কোনো বিষয়ে কথা বলবেন, তার একটা ভিত্তি থাকা জরুরি। ভিত্তিটা হচ্ছে পরিসংখ্যান বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে জরিপ হতে পারে। এনজিও, রাইট বডি কিংবা সরকার জরিপ করতে পারে। কোনো থিংক ট্যাংকও করতে পারে। কিন্তু তা না হয়ে শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে এ ধরনের মতামত দেয়া সঙ্গত নয়। রাজনৈতিক ছাড়া কি কারও অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে না? বিভিন্ন গ্রুপের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না? এটা তো সত্য- যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে ক্ষমতা অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
যুগান্তর : গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ বহিনীর জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ ডিভিশন গঠনের দাবি তোলা হয়েছিল, যা পূরণ হয়নি। এ দাবি পূরণ হওয়া উচিত মনে করেন?
মু. নু. হুদা : এর একটা আপাত যৌক্তিকতা আছে। পৃথিবীর বেশকিছু দেশে পুলিশ মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করে। সেখানে প্রফেশনালরা থাকে; অন্যরাও থাকে। তবে বাংলাদেশে আমি মনে করি, এটা আলোচনা করে করা উচিত। যে জন্য আমরা পুলিশ ডিভিশন চাচ্ছি, সেটা যদি অধিকতর জনবল দিয়ে এবং বেশ কয়েকজন সচিব দিয়ে করা যায়, যার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তাহলেও হতে পারে। পুলিশ ডিভিশন হলে সুবিধা হল- পুলিশের পেশাগত কাজকর্ম, তার জনবল ঠিক করা, আর্থিক দিকটি নিরূপণ করা ও অপারেশনাল রিকয়্যারমেন্ট কী হবে, ইত্যাদি বিষয়গুলো সাধারণত যারা প্রফেশনাল, তারাই ভালো বুঝবেন এবং এতে অটোনমিও অনেকখানি থাকে। তবে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক যে কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক যে নির্বাহী, তার নিয়ন্ত্রণেই কাজ করতে হবে। সব জায়গায় এটাই প্রতিষ্ঠিত। ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ফোর্স আছে; তাদের একটা ফান্ড দিয়ে দেয়া হলেও তাকে একটা নিয়ম-কানুনের মধ্যে কাজ করতে হয়। কাজেই এখানে একচ্ছত্রভাবে বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কোনো বিষয় নয়। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের দেশে যেহেতু আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন আছে, এর আলোকে অনেকে তো বলতে পারে- ডিফেন্স মিনিস্ট্রি আছে, তার ওপরে আর্মড ফোর্সেস কেন লাগে? এ বিষয়টি যেহেতু আমাদের চলছে, কাজেই এর নিশ্চয়ই যৌক্তিকতা আছে। আমি বলব- এগুলো হল সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার আগে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে একটা নির্মোহ আলোচনা হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং এর সঙ্গে পাবলিক থিংকট্যাংকও থাকতে পারে। সবার সঙ্গে একটা নির্মোহ আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে অবজারভেশন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীর যে চাহিদা ও প্রয়োজন আছে, সেগুলো পূরণ করার জন্য কয়েকজন সেক্রেটারি এবং মন্ত্রণালয়ের কলেবর বৃদ্ধি করে যদি কাজ করা যায়, সুফল পাওয়া যাবে। এখানে প্রফেশনাল লোকজন বেশি আসা উচিত।
যুগান্তর : পুলিশের ইন্সপেক্টর থেকে আইজিপি পর্যন্ত কোনো ঝুঁকি-ভাতা পান না। পুলিশের সব সদস্যের জন্য ঝুঁকি-ভাতা চালু করা উচিত কি?
মু. নু. হুদা : ঝুঁকি তো চাকরিতে সবারই আছে। তবে মনে হয়, বেশি ঝুঁকি কার- সেই ভিত্তিতে বিচার করলে এখন যে পদ্ধতি বা যে বন্দোবস্ত চালু আছে, সেটা যথেষ্ট যৌক্তিক। একজন ইন্সপেক্টর কিন্তু আগের মতো তত্ত্বাবধানকারী নন, একজন নির্বাহী। কাজেই ইন্সপেক্টর পর্যায়ে নিশ্চয়ই হতে পারে। তবে ওপরেরগুলো হবে কিনা, সেটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। পুলিশের চাকরিতে ঝুঁকি যে আছে, এটা জেনেই তো তারা এসেছেন।
যুগান্তর : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যে ২৯টি ক্যাডার রয়েছে, এগুলোয় কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করার আইন নেই। অথচ পুলিশের অপরাধ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা করতে পারেন। এ আইন বাতিল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মু. নু. হুদা : পুলিশের কোনো কাজ যখন ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তখন সেখানে কোন ক্যাডারের লোকজন কাজ করছে- বিষয়টা আমি এভাবে দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই- তার পরিচয়টা কী? যিনি কাজটা করছেন, তার বিচারিক ক্ষমতা আছে কিনা। ক্ষমতার চেয়েও বড় জিনিস, তার অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা আছে কিনা। তবে পুলিশের ব্যাপারে একটা আলাদা ইন্ডিপেনডেন্ট কমপ্লায়েন্স বডি থাকলেই ভালো- যারা এটা দেখবেন। অন্য কারও নয়, মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করবেন- এমন বডি থাকতে পারে।
যুগান্তর : এবারের পুলিশ সপ্তাহে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ও সময়ক্ষেপণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ খরচের ক্ষমতা আইজিপির ওপর ন্যস্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। এ দাবি যৌক্তিক মনে করেন?
মু. নু. হুদা : যৌক্তিকতা তো অবশ্যই আছে। বর্তমান ব্যবস্থায় আইজিপিকে অন্যান্য বিভাগের সার্বোচ্চ পদের মতোই মর্যাদা দেয়া হয়। আপনি ১৬ কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেছেন এবং দায়িত্ব দিয়েছেন, তার তো আর্থিক ক্ষমতা থাকা উচিত। আর্থিক ক্ষমতা দিলেই তো আর এটার অপব্যবহার হচ্ছে না। তাকে কাজগুলো করতে হবে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্সের মধ্য দিয়েই। অতএব, আইজিপির ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া এবং তাকে অন্যান্য বিভাগের ওপর স্থাপন করা কোনো অযৌক্তিক ব্যাপার নয়। সাধারণত যে ধরনের দায়িত্বশীল ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি আইজিপি হন- সেই আলোকে বিচার করলে এ দাবির যৌক্তিতা আছে। আইজিপির ক্ষমতা অবশ্যই বাড়ানো দরকার, যাতে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। আইজিপির কাজের মধ্যে একটা তাৎক্ষণিকতা আছে। অনেক কিছুর ব্যাপারেই তিনি দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে পারেন না।
যুগান্তর : পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে সচিব পদমর্যাদায় ২টি গ্রেড-১ পদ রয়েছে। পুলিশের জন্য আরও ৩টি গ্রেড-১ পদ সৃষ্টির দাবি জানানো হয়েছে। এ দাবি পূরণ হওয়া উচিত?
মু. নু. হুদা : হ্যাঁ, এটা অবশ্যই পূরণ হওয়া উচিত। এটা এখন ১ লাখ ৭০ হাজার সদস্যের একটি বাহিনী। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একটা অঙ্গ হচ্ছে পুলিশ। অতএব তাকে তো বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। অন্যদিকে পুলিশ ক্যাডারে এখন তুলনামূলকভাবে উন্নতমানের অফিসাররা আসেন। উন্নতমানের অফিসারদের যদি এখানে আকৃষ্ট করতে হয় এবং লিডারশিপটা যদি উন্নত করতে হয়, তাহলে পুলিশের কাজের স্বীকৃতি ও সমতা রাখার জন্য, সর্বোপরি ভালো অফিসারদের আকৃষ্ট করার জন্য এখানে সচিব পর্যায়ের পদ অন্তত ১০টি হওয়া উচিত।
যুগান্তর : পুলিশ বিভাগে আর ৫০ হাজার পদ সৃষ্টির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মু. নু. হুদা : এটা তো দরকার। পুলিশ ও জনসংখ্যায় যে অনুপাত থাকে- কোনো বেঞ্চমার্ক হয় তো ওভাবে নেই, তবে আমরা দেখতে পারি, অন্যান্য জায়গায় কীভাবে আছে? আমাদের দেশ যেহেতু অত্যন্ত জনবহুল। এখানে আপনি ক্যাপিটেল এক্সপেনডিচার তো খুব বেশি করতে পারবেন না। অনেক কাজ, যেগুলো মেশিন করতে পারে না, এর মধ্যে ইন্টেলিজেন্স কালেকশনসহ অন্যান্য কাজ ‘হিউম্যান আই’ দিয়ে করা সম্ভব হয়। তাছাড়া কর্মসংস্থানের দিকটা যদি দেখি, বহুলোকের কর্মসংস্থান তো হচ্ছে। আমাদের দেশে অপরাধ ও শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা মোকাবেলায় অনেক লোক লাগে। যেখানে লাখ লাখ লোকের প্রশ্ন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা যারা রক্ষা করেন, তাদের সংখ্যাটাও সাইজেবল হওয়া দরকার। পুলিশ লোকবল এখনও তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলই বলা যায়। এ প্রেক্ষাপটে বিচার করলে পুলিশের জনবল বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক।
যুগান্তর : প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে কোনোরকম তদবির না শুনতে এবং দলীয় নেতাদের চাপের বিষয়ে সরাসরি তাকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এটা পুলিশের মনোবল বাড়াবে বলে মনে করেন?
মু. নু. হুদা : এটা সদার্থক একটা ইঙ্গিত। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছ থেকে এরকম আশ্বাস পাওয়ায় নিশ্চয়ই পুলিশের মনোবল বাড়বে। তবে পুলিশের যে আইন-কানুন রয়েছে, সেখানে কিন্তু বলাই আছে- ‘উইদাউট ফেয়ার অ্যান্ড ফেভার’ কাজ করার জন্য। আইনে এরকম কোনো বিধান নেই যে, বিশেষ কাউকে খাতির করতে হবে।
যুগান্তর : পুলিশ ও অধীনস্থ বিভাগগুলো নিয়ে একাধিক ডিভিশন গঠন করার ইঙ্গিত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে। ডিভিশন গঠনকে সময়ের দাবি মনে করেন?
মু. নু. হুদা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ পুলিশেরই। ডিভিশনগুলো যদি কাজ ওরিয়েন্টেড ও ফাংশন ওরিয়েন্টেড হয়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। একজন সেক্রেটারি যে কাজগুলো দেখেন, সেটা যদি ভাগ ভাগ হয়ে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সুবিধা হবে। প্রশাসনে দুটি কথা প্রচলিত আছে। একটা হল, ফাংশনাল হোমোজিনিটি অর্থাৎ এক ধরনের কাজ। আরেকটা হল, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কনভেনিয়েন্স। এ দুটো বিষয় চিন্তায় রাখলে অধিকতর ডিভিশন আমার মনে হয় একটা সুফল দেবে।
যুগান্তর : অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হলে কোন কোন বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি?
মু. নু. হুদা : প্রথমে হল নিয়োগ প্রক্রিয়া, যাতে নিরপেক্ষভাবে, কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের শিক্ষিত লোকজন এ বিভাগে আসে- এটা নিশ্চিত করা। এরপর আসবে প্রশিক্ষণের বিষয়। প্রশিক্ষণটা আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। এছাড়া প্রচুর ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট হতে হবে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থাকতে হবে। পুলিশের বড় কাজ দুটি- একটা ক্রাইম প্রিভেনশন অ্যান্ড ডিটেকশন, আরেকটা হচ্ছে অর্ডার মেইনটেন্স। এসব জায়গায় প্রচুর ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট হতে পারে। মনে রাখা দরকার- দুটো জিনিস একসঙ্গে হতে হবে। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। এগুলো একসঙ্গে চললে পুলিশের পেশাগত উন্নতি ও উৎকর্ষ সম্ভব হবে।
যুগান্তর : আইজিপি র্যাংক ব্যাজ প্রসঙ্গে বলুন।
মু. নু. হুদা : আইজিপি র্যাংক ব্যাজ তো আগে ছিল। সামরিক শাসনের আমলে এক সময় উইথড্র করা হয়- যা ঠিক ছিল না। পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। এখানে র্যাংক থাকা তো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এটা পুলিশ বাহিনীর ব্যাপার। এর সঙ্গে অন্য কারও তুলনা করা উচিত নয়। পৃথিবীর অন্য পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, অন্য বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। বাস্তবে, মাঠপর্যায়ে বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আলোকে বিচার করলে পুলিশ একটা সিভিল বাহিনী। তাকে তুলনা করা উচিত আরেকটা সিভিল বাহিনীর সঙ্গে।
যুগান্তর : বিভিন্ন ঘটনায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই কর্মকর্তাকে নির্যাতনের পর মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের আচরণগত ও অপরাধ প্রবণতা চিহ্নিত করতে পুলিশ সুপার, স্ব স্ব ইউনিট ও সংস্থাপ্রধানকে পর্যবেক্ষণ টিম গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা ও পুলিশের আচরণে গুণগত পরিবর্তন আসবে?
মু. নু. হুদা : এটা অতিরিক্ত একটা বন্দোবস্ত। অফিসাররা কী করছেন, তাদের কাজকর্মে বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কিনা, জেলা পর্যায়ে যিনি সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ, তার কাজই হল এটা। এখন নতুন করে কমিটি করলে বাড়তি একটা রেসপনসিবিলিটি তৈরি হবে এবং এর ফলে তারা মনে করবে, এ কাজটা তাদের করতে হবে। মাসওয়ারি বা ত্রৈমাসিক একটা রিপোর্ট দিতে হবে।
যুগান্তর : ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার বিপরীতে ১ লাখ ৭০ হাজার পুলিশ কি যথেষ্ট?
মু. নু. হুদা : এটা যথেষ্ট মনে নাও হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মূলত পুলিশ বাহিনীর টাকাটা আসে রাজস্ব খাত থেকে। দেশের অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু রেভিনিউ তো আশ্চর্যরকমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অর্থনীতি যখন সক্ষম হবে, তখন এ বাহিনীর জন্য খরচ বাড়ানোও সম্ভব হবে। আর একটি বিষয়, পুলিশ বাহিনী যদি কাজের মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণ করতে পারে, তখন জনবল বাড়ানোর দাবি করতে হবে না, সমাজের ভেতর থেকেই একটা চাহিদা আসবে, জনগণ বলবে- আমাদের একটা উন্নত পুলিশ বাহিনী দরকার। এজন্য যে সম্পদ বিনিয়োগ করা দরকার, আমরা তা বিনিয়োগ করতে রাজি আছি।
যুগান্তর : থানার ওসি পদে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগে কতটা সুফল পাওয়া যাবে?
মু. নু. হুদা : কাজটা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। থানার অফিসার-ইনচার্জ পদের সঙ্গে কিন্তু দু’রকমের সম্পর্ক আছে। একটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপার, আরেকটা অপরাধ তদন্তের ব্যাপার। এখন অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে যদি কারও পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকে, তিনি যদি নিচের লেবেল থেকে কাজটা না করে আসনে, তাহলে অসুবিধা হওয়ার কথা। তারপরও এটা চালু হওয়ার পর দেখা যাক, কী দাঁড়ায়? সাধারণত ১২ থেকে ১৫ বছরের অপরাধ তদন্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন থানার অফিসার-ইনচার্জ হন। এ ব্যবস্থায় অপরাধ তদন্তের অভিজ্ঞতাটা তার থাকবে না। সরাসরি নিযুক্ত অফিসাররা ইনচার্জ হলে একটা ব্যত্যয় থেকে যাবে। এটা অতিক্রমের প্রক্রিয়া কী হবে, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে।
যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্যালাপ পোল বিদায়ী বছরের বৈশ্বিক আইনশৃঙ্খলার জরিপে বাংলাদেশ ৭৮ পয়েন্ট পেয়েছে। তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ও অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট ৭৭, ফ্রান্সের ৭৫ এবং ভারতের ৬৭। এটাকে দেশের পুলিশ বাহিনীর অর্জন মনে করা হচ্ছে। মন্তব্য করুন।
মু. নু. হুদা : হ্যাঁ, এটাকে আমি আমাদের পুলিশ বাহিনীর অর্জন বলব। যেহেতু আন্তর্জাতিক একটা সংস্থার মতামত- এটাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। আমাদের দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে পুলিশ বাহিনীর যথেষ্ট অবদান এবং আত্মত্যাগ রয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতি যুক্তিসঙ্গত বলব না, তবে এটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। প্রচুর জনসংখ্যার একটা দেশে, যেখানে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জঙ্গিবাদ দমন- এসব বিবেচনায় রাখলে নিশ্চয়ই সন্তুষ্টির অবকাশ রয়েছে। তবে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হব। তবে রাজনৈতিক নির্বাহী যারা, তাদের প্রজ্ঞার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। মনে রাখতে হবে, দেশে একটা ভালো পুলিশ বাহিনী থাকা সরকারেরই সুনামের বিষয়। সবাই বলবে- সরকার দেশ ভালোভাবে চালাচ্ছে। আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভালো এবং দক্ষ পুলিশ বাহিনী দরকার। দক্ষ ও ভালো পুলিশ বাহিনীর অর্জনগুলো রাজনৈতিক সরকারের অর্জনের পাল্লা ভারি করে- এই বোধটা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ লক্ষণ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
মুহাম্মদ নুরুল হুদা : না রাখতে পারার কোনো কারণ দেখি না। পুলিশের যে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য আছে, তার আলোকে বিচার করলে উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল- যে দেশই হোক, জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছাড়া পুলিশ বাহিনীর পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়; পুলিশ বিভাগ যে আইন-কানুন দ্বারা চলে, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনের প্রথমদিকেই পরিষ্কার করে বলা আছে, পুলিশ বাহিনীকে সফল হতে হলে জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পেতে হবে। এটাই যদি মাপকাঠি হয় সাফল্যের, তাহলে জনগণের জন্য কাজ করা তো অবশ্যই দরকার। স্বাধীন দেশে পুলিশ তো আর অন্য কারও প্রতিনিধি নয়; জনগণের প্রতিনিধি। আমাদের শাসনতন্ত্রে তো বলাই আছে- সব ক্ষমতা জনগণের কাছে আছে। তো জনগণের জন্য কাজ করলে পুলিশের পেশাগত উৎকর্ষসাধনে কোনো বাধা আসে না। এটা বরং ভালো হয় এবং সেখানে জনগণের সমর্থন থাকে। দেশের সমগ্র জনগণের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা তো একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। সমগ্র জনগণের আইনশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি যখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, তখন তাদের সমর্থন থাকলেই তো আপনি ভালো করবেন।
যুগান্তর : পুলিশ সপ্তাহে প্যারেডের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তা অধিনায়ক হিসেবে প্যারেডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মু. নু. হুদা : এজন্য সরকার যথেষ্ট বাহবা পেতে পারে। অতীতের দিকে তাকালে দেখব- বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়, সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ সালে প্রথম মহিলা পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়। এটা তারই ধারাবাহিকতা। মাঝখানে একটা সময় ছিল, তখন অদ্ভুত কিছু কারণে মহিলা পুলিশ থাকলেও তাদের দৃশ্যমান করা হতো না। আমরা সে সময়টা পার হয়ে এসেছি। এখন প্রচুর মহিলা পুলিশ আছে এবং মহিলা পুলিশের যে ইন্টারন্যাশনাল বডি আছে, সেখানেও তাদের একটা উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আইইউএন কন্টিনজেন্টে মহিলা পুলিশরা প্রশংসনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশে এখন এডিশনাল আইজি অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদেও মহিলা কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। সেই আলোকে বিচার করলে এবারের প্যারেড কন্টিনজেন্টে একজন মহিলা থাকার বিষয়টি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
যুগান্তর : পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে উত্থাপিত ১৮টি দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল পুলিশের প্রশাসনিক কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। এ দাবি পূরণ হওয়া কতটা জরুরি?
মু. নু. হুদা : এটা তো দাবি করা লাগে না। পুলিশ বাহিনী একটা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বাহিনী। দেশে যেসব প্রতিষ্ঠিত আইন-কানুন আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আইন হচ্ছে শাসনতন্ত্র অর্থাৎ আমাদের সংবিধানে নির্দেশনা দেয়া আছে- কীভাবে কাজ করতে হবে। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু আইন, পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল ও স্থানীয় আইন আছে। অপরাধের ব্যাপারে সাবজেক্টিভ ল’ হচ্ছে বাংলাদেশ পেনাল কোড। আর অ্যাডজেক্টিভ বা প্রসিডিউরাল ল’ হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড। এগুলোকে সাহায্য করার জন্য বিচারিক পর্যায়ে রয়েছে অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট। এগুলোর আলোকেই পুলিশকে কাজ করতে হবে। যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে, অবাঞ্ছিত ও বেআইনি হস্তক্ষেপ থেকে থাকে, এটা তো বলেই দেয়া হয়ছে, কীভাবে কাজ করতে হবে? আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে কারও যদি মনে হয়, তিনি অন্যায়ভাবে অ্যাফেক্টেড হচ্ছেন, আর যদি আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তাহলে তাকে প্রটেকশন দেয়ার জন্য সুপিরিয়র অফিসাররা আছেন। বিভাগীয় প্রধান আছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আছে। এছাড়া বিচারিক পর্যায়েও তাকে সুরক্ষা দেয়ার বিধান রয়েছে।
যুগান্তর : পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যত অভিযোগ ওঠে, তার বেশির ভাগই সংঘটিত হয় পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ফলে- এ অভিযোগ কতটা সত্য?
মু. নু. হুদা : এর পক্ষে কোনো পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল নই। যদি কারও কাছে থাকে, তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে আমার কাছে মনে হয়, এটা এক ধরনের সুইপিং কমেন্ট। এ রকম গুরুতর একটা ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কথা হবে।
যুগান্তর : সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে এ ধরনের কথা বলা হয়।
মু. নু. হুদা : না, স্থানীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বললে হবে না। আপনি যখন দেশব্যাপী কোনো বিষয়ে কথা বলবেন, তার একটা ভিত্তি থাকা জরুরি। ভিত্তিটা হচ্ছে পরিসংখ্যান বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে জরিপ হতে পারে। এনজিও, রাইট বডি কিংবা সরকার জরিপ করতে পারে। কোনো থিংক ট্যাংকও করতে পারে। কিন্তু তা না হয়ে শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে এ ধরনের মতামত দেয়া সঙ্গত নয়। রাজনৈতিক ছাড়া কি কারও অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে না? বিভিন্ন গ্রুপের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না? এটা তো সত্য- যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানে ক্ষমতা অপব্যবহারের সম্ভাবনা থেকেই যায়।
যুগান্তর : গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও পুলিশ সপ্তাহে পুলিশ বহিনীর জন্য স্বতন্ত্র পুলিশ ডিভিশন গঠনের দাবি তোলা হয়েছিল, যা পূরণ হয়নি। এ দাবি পূরণ হওয়া উচিত মনে করেন?
মু. নু. হুদা : এর একটা আপাত যৌক্তিকতা আছে। পৃথিবীর বেশকিছু দেশে পুলিশ মন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করে। সেখানে প্রফেশনালরা থাকে; অন্যরাও থাকে। তবে বাংলাদেশে আমি মনে করি, এটা আলোচনা করে করা উচিত। যে জন্য আমরা পুলিশ ডিভিশন চাচ্ছি, সেটা যদি অধিকতর জনবল দিয়ে এবং বেশ কয়েকজন সচিব দিয়ে করা যায়, যার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তাহলেও হতে পারে। পুলিশ ডিভিশন হলে সুবিধা হল- পুলিশের পেশাগত কাজকর্ম, তার জনবল ঠিক করা, আর্থিক দিকটি নিরূপণ করা ও অপারেশনাল রিকয়্যারমেন্ট কী হবে, ইত্যাদি বিষয়গুলো সাধারণত যারা প্রফেশনাল, তারাই ভালো বুঝবেন এবং এতে অটোনমিও অনেকখানি থাকে। তবে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক যে কর্তৃত্ব, রাজনৈতিক যে নির্বাহী, তার নিয়ন্ত্রণেই কাজ করতে হবে। সব জায়গায় এটাই প্রতিষ্ঠিত। ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ফোর্স আছে; তাদের একটা ফান্ড দিয়ে দেয়া হলেও তাকে একটা নিয়ম-কানুনের মধ্যে কাজ করতে হয়। কাজেই এখানে একচ্ছত্রভাবে বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কোনো বিষয় নয়। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের দেশে যেহেতু আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন আছে, এর আলোকে অনেকে তো বলতে পারে- ডিফেন্স মিনিস্ট্রি আছে, তার ওপরে আর্মড ফোর্সেস কেন লাগে? এ বিষয়টি যেহেতু আমাদের চলছে, কাজেই এর নিশ্চয়ই যৌক্তিকতা আছে। আমি বলব- এগুলো হল সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তার আগে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে একটা নির্মোহ আলোচনা হওয়া উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং এর সঙ্গে পাবলিক থিংকট্যাংকও থাকতে পারে। সবার সঙ্গে একটা নির্মোহ আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে অবজারভেশন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীর যে চাহিদা ও প্রয়োজন আছে, সেগুলো পূরণ করার জন্য কয়েকজন সেক্রেটারি এবং মন্ত্রণালয়ের কলেবর বৃদ্ধি করে যদি কাজ করা যায়, সুফল পাওয়া যাবে। এখানে প্রফেশনাল লোকজন বেশি আসা উচিত।
যুগান্তর : পুলিশের ইন্সপেক্টর থেকে আইজিপি পর্যন্ত কোনো ঝুঁকি-ভাতা পান না। পুলিশের সব সদস্যের জন্য ঝুঁকি-ভাতা চালু করা উচিত কি?
মু. নু. হুদা : ঝুঁকি তো চাকরিতে সবারই আছে। তবে মনে হয়, বেশি ঝুঁকি কার- সেই ভিত্তিতে বিচার করলে এখন যে পদ্ধতি বা যে বন্দোবস্ত চালু আছে, সেটা যথেষ্ট যৌক্তিক। একজন ইন্সপেক্টর কিন্তু আগের মতো তত্ত্বাবধানকারী নন, একজন নির্বাহী। কাজেই ইন্সপেক্টর পর্যায়ে নিশ্চয়ই হতে পারে। তবে ওপরেরগুলো হবে কিনা, সেটা আলোচনাসাপেক্ষ বিষয়। পুলিশের চাকরিতে ঝুঁকি যে আছে, এটা জেনেই তো তারা এসেছেন।
যুগান্তর : বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যে ২৯টি ক্যাডার রয়েছে, এগুলোয় কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করলে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করার আইন নেই। অথচ পুলিশের অপরাধ অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা করতে পারেন। এ আইন বাতিল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মু. নু. হুদা : পুলিশের কোনো কাজ যখন ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, তখন সেখানে কোন ক্যাডারের লোকজন কাজ করছে- বিষয়টা আমি এভাবে দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই- তার পরিচয়টা কী? যিনি কাজটা করছেন, তার বিচারিক ক্ষমতা আছে কিনা। ক্ষমতার চেয়েও বড় জিনিস, তার অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা আছে কিনা। তবে পুলিশের ব্যাপারে একটা আলাদা ইন্ডিপেনডেন্ট কমপ্লায়েন্স বডি থাকলেই ভালো- যারা এটা দেখবেন। অন্য কারও নয়, মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাবদিহি করবেন- এমন বডি থাকতে পারে।
যুগান্তর : এবারের পুলিশ সপ্তাহে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ও সময়ক্ষেপণের হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ খরচের ক্ষমতা আইজিপির ওপর ন্যস্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। এ দাবি যৌক্তিক মনে করেন?
মু. নু. হুদা : যৌক্তিকতা তো অবশ্যই আছে। বর্তমান ব্যবস্থায় আইজিপিকে অন্যান্য বিভাগের সার্বোচ্চ পদের মতোই মর্যাদা দেয়া হয়। আপনি ১৬ কোটি মানুষের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেছেন এবং দায়িত্ব দিয়েছেন, তার তো আর্থিক ক্ষমতা থাকা উচিত। আর্থিক ক্ষমতা দিলেই তো আর এটার অপব্যবহার হচ্ছে না। তাকে কাজগুলো করতে হবে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্সের মধ্য দিয়েই। অতএব, আইজিপির ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া এবং তাকে অন্যান্য বিভাগের ওপর স্থাপন করা কোনো অযৌক্তিক ব্যাপার নয়। সাধারণত যে ধরনের দায়িত্বশীল ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি আইজিপি হন- সেই আলোকে বিচার করলে এ দাবির যৌক্তিতা আছে। আইজিপির ক্ষমতা অবশ্যই বাড়ানো দরকার, যাতে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। আইজিপির কাজের মধ্যে একটা তাৎক্ষণিকতা আছে। অনেক কিছুর ব্যাপারেই তিনি দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে পারেন না।
যুগান্তর : পুলিশ বাহিনীতে বর্তমানে সচিব পদমর্যাদায় ২টি গ্রেড-১ পদ রয়েছে। পুলিশের জন্য আরও ৩টি গ্রেড-১ পদ সৃষ্টির দাবি জানানো হয়েছে। এ দাবি পূরণ হওয়া উচিত?
মু. নু. হুদা : হ্যাঁ, এটা অবশ্যই পূরণ হওয়া উচিত। এটা এখন ১ লাখ ৭০ হাজার সদস্যের একটি বাহিনী। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একটা অঙ্গ হচ্ছে পুলিশ। অতএব তাকে তো বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। অন্যদিকে পুলিশ ক্যাডারে এখন তুলনামূলকভাবে উন্নতমানের অফিসাররা আসেন। উন্নতমানের অফিসারদের যদি এখানে আকৃষ্ট করতে হয় এবং লিডারশিপটা যদি উন্নত করতে হয়, তাহলে পুলিশের কাজের স্বীকৃতি ও সমতা রাখার জন্য, সর্বোপরি ভালো অফিসারদের আকৃষ্ট করার জন্য এখানে সচিব পর্যায়ের পদ অন্তত ১০টি হওয়া উচিত।
যুগান্তর : পুলিশ বিভাগে আর ৫০ হাজার পদ সৃষ্টির বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মু. নু. হুদা : এটা তো দরকার। পুলিশ ও জনসংখ্যায় যে অনুপাত থাকে- কোনো বেঞ্চমার্ক হয় তো ওভাবে নেই, তবে আমরা দেখতে পারি, অন্যান্য জায়গায় কীভাবে আছে? আমাদের দেশ যেহেতু অত্যন্ত জনবহুল। এখানে আপনি ক্যাপিটেল এক্সপেনডিচার তো খুব বেশি করতে পারবেন না। অনেক কাজ, যেগুলো মেশিন করতে পারে না, এর মধ্যে ইন্টেলিজেন্স কালেকশনসহ অন্যান্য কাজ ‘হিউম্যান আই’ দিয়ে করা সম্ভব হয়। তাছাড়া কর্মসংস্থানের দিকটা যদি দেখি, বহুলোকের কর্মসংস্থান তো হচ্ছে। আমাদের দেশে অপরাধ ও শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা মোকাবেলায় অনেক লোক লাগে। যেখানে লাখ লাখ লোকের প্রশ্ন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা যারা রক্ষা করেন, তাদের সংখ্যাটাও সাইজেবল হওয়া দরকার। পুলিশ লোকবল এখনও তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলই বলা যায়। এ প্রেক্ষাপটে বিচার করলে পুলিশের জনবল বৃদ্ধির বিষয়টি যৌক্তিক।
যুগান্তর : প্রধানমন্ত্রী পুলিশকে কোনোরকম তদবির না শুনতে এবং দলীয় নেতাদের চাপের বিষয়ে সরাসরি তাকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এটা পুলিশের মনোবল বাড়াবে বলে মনে করেন?
মু. নু. হুদা : এটা সদার্থক একটা ইঙ্গিত। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছ থেকে এরকম আশ্বাস পাওয়ায় নিশ্চয়ই পুলিশের মনোবল বাড়বে। তবে পুলিশের যে আইন-কানুন রয়েছে, সেখানে কিন্তু বলাই আছে- ‘উইদাউট ফেয়ার অ্যান্ড ফেভার’ কাজ করার জন্য। আইনে এরকম কোনো বিধান নেই যে, বিশেষ কাউকে খাতির করতে হবে।
যুগান্তর : পুলিশ ও অধীনস্থ বিভাগগুলো নিয়ে একাধিক ডিভিশন গঠন করার ইঙ্গিত সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে। ডিভিশন গঠনকে সময়ের দাবি মনে করেন?
মু. নু. হুদা : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ কাজ পুলিশেরই। ডিভিশনগুলো যদি কাজ ওরিয়েন্টেড ও ফাংশন ওরিয়েন্টেড হয়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। একজন সেক্রেটারি যে কাজগুলো দেখেন, সেটা যদি ভাগ ভাগ হয়ে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সুবিধা হবে। প্রশাসনে দুটি কথা প্রচলিত আছে। একটা হল, ফাংশনাল হোমোজিনিটি অর্থাৎ এক ধরনের কাজ। আরেকটা হল, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কনভেনিয়েন্স। এ দুটো বিষয় চিন্তায় রাখলে অধিকতর ডিভিশন আমার মনে হয় একটা সুফল দেবে।
যুগান্তর : অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পুলিশ বাহিনী গঠন করতে হলে কোন কোন বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি?
মু. নু. হুদা : প্রথমে হল নিয়োগ প্রক্রিয়া, যাতে নিরপেক্ষভাবে, কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের শিক্ষিত লোকজন এ বিভাগে আসে- এটা নিশ্চিত করা। এরপর আসবে প্রশিক্ষণের বিষয়। প্রশিক্ষণটা আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। এছাড়া প্রচুর ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট হতে হবে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থাকতে হবে। পুলিশের বড় কাজ দুটি- একটা ক্রাইম প্রিভেনশন অ্যান্ড ডিটেকশন, আরেকটা হচ্ছে অর্ডার মেইনটেন্স। এসব জায়গায় প্রচুর ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট হতে পারে। মনে রাখা দরকার- দুটো জিনিস একসঙ্গে হতে হবে। অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট। এগুলো একসঙ্গে চললে পুলিশের পেশাগত উন্নতি ও উৎকর্ষ সম্ভব হবে।
যুগান্তর : আইজিপি র্যাংক ব্যাজ প্রসঙ্গে বলুন।
মু. নু. হুদা : আইজিপি র্যাংক ব্যাজ তো আগে ছিল। সামরিক শাসনের আমলে এক সময় উইথড্র করা হয়- যা ঠিক ছিল না। পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। এখানে র্যাংক থাকা তো খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এটা পুলিশ বাহিনীর ব্যাপার। এর সঙ্গে অন্য কারও তুলনা করা উচিত নয়। পৃথিবীর অন্য পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এর তুলনা হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, অন্য বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। বাস্তবে, মাঠপর্যায়ে বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের আলোকে বিচার করলে পুলিশ একটা সিভিল বাহিনী। তাকে তুলনা করা উচিত আরেকটা সিভিল বাহিনীর সঙ্গে।
যুগান্তর : বিভিন্ন ঘটনায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই কর্মকর্তাকে নির্যাতনের পর মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের আচরণগত ও অপরাধ প্রবণতা চিহ্নিত করতে পুলিশ সুপার, স্ব স্ব ইউনিট ও সংস্থাপ্রধানকে পর্যবেক্ষণ টিম গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা ও পুলিশের আচরণে গুণগত পরিবর্তন আসবে?
মু. নু. হুদা : এটা অতিরিক্ত একটা বন্দোবস্ত। অফিসাররা কী করছেন, তাদের কাজকর্মে বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিনা, ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কিনা, জেলা পর্যায়ে যিনি সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ, তার কাজই হল এটা। এখন নতুন করে কমিটি করলে বাড়তি একটা রেসপনসিবিলিটি তৈরি হবে এবং এর ফলে তারা মনে করবে, এ কাজটা তাদের করতে হবে। মাসওয়ারি বা ত্রৈমাসিক একটা রিপোর্ট দিতে হবে।
যুগান্তর : ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার বিপরীতে ১ লাখ ৭০ হাজার পুলিশ কি যথেষ্ট?
মু. নু. হুদা : এটা যথেষ্ট মনে নাও হতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মূলত পুলিশ বাহিনীর টাকাটা আসে রাজস্ব খাত থেকে। দেশের অর্থনীতি উন্নত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু রেভিনিউ তো আশ্চর্যরকমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অর্থনীতি যখন সক্ষম হবে, তখন এ বাহিনীর জন্য খরচ বাড়ানোও সম্ভব হবে। আর একটি বিষয়, পুলিশ বাহিনী যদি কাজের মাধ্যমে নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণ করতে পারে, তখন জনবল বাড়ানোর দাবি করতে হবে না, সমাজের ভেতর থেকেই একটা চাহিদা আসবে, জনগণ বলবে- আমাদের একটা উন্নত পুলিশ বাহিনী দরকার। এজন্য যে সম্পদ বিনিয়োগ করা দরকার, আমরা তা বিনিয়োগ করতে রাজি আছি।
যুগান্তর : থানার ওসি পদে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগে কতটা সুফল পাওয়া যাবে?
মু. নু. হুদা : কাজটা না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। থানার অফিসার-ইনচার্জ পদের সঙ্গে কিন্তু দু’রকমের সম্পর্ক আছে। একটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপার, আরেকটা অপরাধ তদন্তের ব্যাপার। এখন অপরাধ তদন্তের ব্যাপারে যদি কারও পূর্বঅভিজ্ঞতা না থাকে, তিনি যদি নিচের লেবেল থেকে কাজটা না করে আসনে, তাহলে অসুবিধা হওয়ার কথা। তারপরও এটা চালু হওয়ার পর দেখা যাক, কী দাঁড়ায়? সাধারণত ১২ থেকে ১৫ বছরের অপরাধ তদন্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন থানার অফিসার-ইনচার্জ হন। এ ব্যবস্থায় অপরাধ তদন্তের অভিজ্ঞতাটা তার থাকবে না। সরাসরি নিযুক্ত অফিসাররা ইনচার্জ হলে একটা ব্যত্যয় থেকে যাবে। এটা অতিক্রমের প্রক্রিয়া কী হবে, তার ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে।
যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্যালাপ পোল বিদায়ী বছরের বৈশ্বিক আইনশৃঙ্খলার জরিপে বাংলাদেশ ৭৮ পয়েন্ট পেয়েছে। তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ও অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট ৭৭, ফ্রান্সের ৭৫ এবং ভারতের ৬৭। এটাকে দেশের পুলিশ বাহিনীর অর্জন মনে করা হচ্ছে। মন্তব্য করুন।
মু. নু. হুদা : হ্যাঁ, এটাকে আমি আমাদের পুলিশ বাহিনীর অর্জন বলব। যেহেতু আন্তর্জাতিক একটা সংস্থার মতামত- এটাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। আমাদের দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের ভিত শক্ত করতে পুলিশ বাহিনীর যথেষ্ট অবদান এবং আত্মত্যাগ রয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতি যুক্তিসঙ্গত বলব না, তবে এটা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। প্রচুর জনসংখ্যার একটা দেশে, যেখানে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জঙ্গিবাদ দমন- এসব বিবেচনায় রাখলে নিশ্চয়ই সন্তুষ্টির অবকাশ রয়েছে। তবে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হব। তবে রাজনৈতিক নির্বাহী যারা, তাদের প্রজ্ঞার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। মনে রাখতে হবে, দেশে একটা ভালো পুলিশ বাহিনী থাকা সরকারেরই সুনামের বিষয়। সবাই বলবে- সরকার দেশ ভালোভাবে চালাচ্ছে। আমরা সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলি। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভালো এবং দক্ষ পুলিশ বাহিনী দরকার। দক্ষ ও ভালো পুলিশ বাহিনীর অর্জনগুলো রাজনৈতিক সরকারের অর্জনের পাল্লা ভারি করে- এই বোধটা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখনই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এ লক্ষণ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
মু. নু. হুদা : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments