প্রশাসন ও জনজীবন : পাঁচটি বিষয় by সামসুল ইসলাম টুকু

এক : থানায় নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলায় প্রশাসক, বিভাগের কমিশনার। তিনটি পদই একেকটি নির্দিষ্ট এলাকার সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচ্য। কিন্তু সবচেয়ে মেধাসম্পন্ন লোকপ্রশাসনে প্রশিক্ষিত এবং ‘সর্বগুণসম্পন্ন’ এই ক্যাডারেরা ওই তিনটি পদবিকে ভিন্ন ভিন্ন করে রেখেছেন কেন, তা জনস্বার্থে জানা জরুরি। তিনটি পদই মূলত নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং পদবিগুলো একই ধারার হওয়া উচিত। যেমন- থানা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিভাগীয় নির্বাহী কর্মকর্তা। আজো ডিসি অফিসকে কালেক্টরেট অফিস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে অর্থে তাদের থানা কালেক্টর, জেলা কালেক্টর ও বিভাগীয় কালেক্টর হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। ‘কমিশনার’ অর্থ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। ডিসি মানে ডিসট্রিক্ট কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার হতে পারে, কিন্তু জেলা প্রশাসক হয় না। ডিসি বরাবর আবেদন করলে ‘জেলা প্রশাসক’ না লিখলে এরা অসন্তুষ্ট হন।
দুই : সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদের এক সভায় ভূমি সচিব তহশিলদার ও এসি ল্যান্ডদের ‘আইনি সুরক্ষা’র দাবি জানিয়েছেন। এতে প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ। ১৮৪৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৬৮ বছরে এদের আইনি সুরক্ষার দাবি ওঠেনি। কিন্তু এখন উঠছে কেন? এর উত্তর হচ্ছে, ভূমি বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি সহযোগিতায় এদের দুর্নীতি সব সীমা অতিক্রম করেছে। দু’বছর আগেও মাত্র ৫০০-৬০০ টাকা দিয়ে খুব দ্রুত জমিজমা খারিজ করে দিতেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন। আর এখন খারিজ করতে তহশিলদারদের হাতে অগ্রিম ৪০০০-৫০০০ টাকা ধরিয়ে না দিলে এরা কথা বলেন না। সাফ বলে দেন, এ টাকা আগেই উপরওয়ালাদের দিতে হবে, অন্যথায় কাজে হাত দেয়া যাবে না। সম্প্রতি হাজার হাজার বিঘা অর্পিত সম্পত্তি একাধিকবার তদন্ত করার ক্ষমতা পেয়ে তারা ভুক্তভোগীদের শুধু আর্থিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ফলে মানুষ ফুঁসে উঠেছে। কখনো কখনো এর প্রকাশ ঘটেছে। তাই তাদের ‘আইনি সুরক্ষা’ জরুরি হয়ে পড়েছে। এরপর হয়তো দাবি উঠবে পিওন ও প্রসেস সারভেয়ারদের আইনি সুরক্ষা। কারণ ঘুষ লেনদেনের সাথে এরাই জড়িত থাকে। এরা জনসাধারণের ঘৃণা কুড়ায়। আর ওই টাকা এরা ‘ব্রাহ্মণ’ এসি ল্যান্ডের হাতে তুলে দিয়ে আসে। এরপর ক্রমেই ওপরের দিকে যায় কুলীন উচ্চবর্গীয়দের কাছে। ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার কৃষিবিদসহ অন্য ক্যাডারের লোকেরা তো আইনি সুরক্ষার দাবি তোলেন না?
তিন : মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন করা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খেয়েছে। মোটরসাইকেল মালিকেরাও পুলিশি অভিযানের তোড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রখর রোদে পুড়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ের ওপর উঠে দু’মাস ধরে এই রেজিস্ট্রেশনের কাজ সম্পন্ন করেন। এক দেড় লাখ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনলেও রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা (যা তুলনামূলকভাবে বেশি) সরকারের ঘরে দিতে অবহেলা করেছেন। গড়িমসি করেছেন প্রায় ৯০ শতাংশ মালিক। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশদের অভিযানের সময় বহুবার ঘুষ দিয়েই উদ্ধার পেতে হয়েছে তাদের। এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে, মোটরসাইকেল বিক্রেতাদের এই দায়িত্ব অর্পণ করা। ক্রেতা এলে এবং দামদর ঠিক হলেই বিক্রেতা প্রথমে ক্রেতার ড্রাইভিং লাইসেন্স নিশ্চিত করবেন। এরপরে রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র সই করে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ক্রেতা বাড়ি ফিরবেন। মোটরসাইকেল বিক্রেতা ফি’র অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেবেন। এতে সময়ের অপচয় হবে না, সরকারকে লোক নিয়োগ করতে হবে না, কাজটি বিক্রেতা তার নিজের স্বার্থেই করবেন, ট্রাফিক পুলিশদের ঘুষ আদায় করাও তখন কমে যাবে।
চার : দেশের আন্তঃনগর ট্রেনগুলো ছাড়াও অন্যান্য ট্রেনেরও এখন আসন খালি থাকে না। বরং অতিরিক্ত ও আসন নম্বরহীন টিকিট বিক্রি করতে দেখা যায় কাউন্টারগুলোতে। দামও নেহাত কম নয়। ট্রেনে লাভ হয়েছে বলে শোনা যায় না। অথচ ভারতসহ দেশে রেল একটি লাভজনক খাত হিসেবে চিহ্নিত। রেল খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন টেকসই হলে সংস্কারের নামে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা অপচয়ের সুযোগ খুবই কম। অন্য দিকে, সড়কপথ উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়, তেমনি সড়ক সংস্কারের নামে প্রতি বছর যে কোটি টাকার অপচয় হয় সে টাকায় গোটা দেশের রেলের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলা আর সংশ্লিষ্ট লোকজনদের প্রচণ্ড আগ্রহ, কারণ সেখান থেকে পকেট ভরার সুযোগ বেশি। প্রয়োজনের বেশি লোকবল ও যাত্রীদের টিকিট না কাটাকে চিহ্নিত করা হয় রেলের অলাভজনক হওয়ার কারণ হিসেবে। বিনা টিকেটে ভ্রমণকারীদের নির্দিষ্ট হারে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। এই জরিমানার শতকরা ৫০ ভাগ পাবেন চেকার এবং বাকি ৫০ ভাগ পাবে সরকার। এতে চেকারেরা বৈধভাবেই বেশি উপার্জন করতে পারবেন। অন্য দিকে বিনা টিকিটের যাত্রীরাও জরিমানা না দিয়ে বরং টিকিট কেটে যাত্রা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
পাঁচ : জমি বেচাকেনা একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত দিন ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থাকবে, তত দিন এ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, তার নাম রেজিস্ট্রি অফিস। প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিতে ভরা। এ দুর্নীতির অন্যতম বাহক মোহরাররা। রেজিস্ট্রির জন্য যেকোনো ব্যক্তি যান না কেন, মোহরাররা তাদের সমিতির চাঁদা, রেজিস্ট্রি অফিসের চাঁদা, স্ট্যাম্পের দাম, অফিসের ফি, সার্টিফাইড কপির দামসহ একটি হিসাব অতি দ্রুত ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে পেশ করে থাকেন। এরপর দলিল লেখা শেষ হলেও দাবি করা অর্থ আদায় না করা পর্যন্ত ওই দলিল রেজিস্ট্রারের টেবিলে যাবে না। ফলে ক্রেতার অবৈধ টাকা দেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সপ্তাহ শেষে ওই অবৈধ টাকা ভাগ বণ্টন হয়। এতে মোহরাররা যে অর্থ পান তার অঙ্ক শুনলে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তারাও চমকে উঠবেন। এই ভয়াবহ দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে রেজিস্ট্রি অফিসের কাজ কম্পিউটারাইজড করতে হবে। বেশ কয়েক বছর আগে এ ব্যাপারে সরকারি ঘোষণাও এসেছিল, কিন্তু কার্যকর হয়নি। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এ প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রেখেছেন। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন না। বর্তমান সরকারের ডিজিটালাইজড করার ক্ষেত্রেও এরা বাধা। এ ব্যাপারে সরকারের দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। রেজিস্ট্রি দুর্নীতিমুক্ত করার পাশাপাশি ওই অফিস থেকেই বিক্রীত জমির খারিজ করার কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এ জন্য আর যেন এসি (ল্যান্ড) ও তহশিলদারদের কাছে যেতে না হয়। এ দাবিটি জনগণের দীর্ঘ দিনের। কত দিন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই পথ রুদ্ধ করে রাখবে?
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.