নির্মোহ ইতিহাস রচনা কতটা কঠিন by ড. মাহবুব উল্লাহ
প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেছেন,
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের কাছাকাছি হয়ে গেছে। এখনও আমরা একেক জনের
গল্প নিয়ে বই পাচ্ছি, যারা ওই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। বাংলাদেশের
‘ডেফিনিটিভ’ ইতিহাস নিয়ে একটি বই পাচ্ছি না। যেটি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে
দিতে পারি, যাতে তারা বুঝতে পারে আমরা কোথা থেকে এসেছি। এটা আমারও
ব্যর্থতা।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩১ জানুয়ারি ২০১৬)। গত ৩০ জানুয়ারি
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর
পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘দ্য স্ট্রাগল ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা
অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রফেসর রেহমান সোবহান। তার লেখা নতুন বই
‘আনট্রাঙ্কুইল রিকালেকশনস- দ্য ইয়ারস অব ফুলফিলমেন্ট’ নিয়ে ওই অনুষ্ঠানের
আয়োজন করা হয়। প্রফেসর রেহমান সোবহানের এ মন্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের ইতিহাসের ওপর গবেষণাধর্মী এবং সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ না হওয়া
আমাদের সবার জন্য খুবই বেদনার বিষয়। স্বাধীনতার পরবর্তী বিগত প্রায়
অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের ইতিহাসবিদরা বাংলাদেশের ডেফিনিটিভ ইতিহাস রচনায় হাত
না দেয়ার ফলে ইতিহাস এখন রাজনীতির ডামাডোলে পড়ে নতুন প্রজন্মের জন্য
বিভ্রান্তির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত ইতিহাস
বিকৃতির অভিযোগ আসছে। যদি ডেফিনিটিভ কোনো ইতিহাস না থাকে, তাহলে কি বিকৃতি
করা হল? রাজনৈতিক নেতারা দলীয় অবস্থান থেকে ইতিহাস সম্পর্কে মনের মাধুরী
মিশিয়ে অনেক কথাই বলতে পারেন এবং এসব কথায় কথা বাড়তে পারে, উত্তেজনা সৃষ্টি
হতে পারে, কিন্তু তা আর যাই হোক ইতিহাস নয়। বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক
ব্যবহার নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন- যা অত্যন্ত যথার্থ। কিন্তু
ইতিহাসের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল মানুষের পক্ষ থেকে
তেমন কোনো আপত্তি না ওঠার ব্যাপারটি খুবই হতাশাজনক।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির ইতিহাস নেই।’ এটি ছিল তার খেদের কথা। প্রফেসর রেহমান সোবহান যখন বলেন, বাংলাদেশের ডেফিনিটিভ ইতিহাস নিয়ে একটা বই পাচ্ছি না- তখনও একই ধরনের খেদ বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। তিনি আরও কবুল করে নিয়েছেন, তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দেয়ার মতো কিছু তিনিও সৃষ্টি করতে পারেননি। এটাকে সাফ নিজের ব্যর্থতা বলে স্বীকার করেছেন। চেষ্টা করলে তিনিও হয়তো একটি পিরিয়ডের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের অধ্যায় তুলে ধরতে পারতেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশ কয়েকজন বেশ কটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলোর বেশিরভাগই স্মৃতিকথানির্ভর। যেগুলো সম্পর্কে রেহমান সোবহান বলেছেন, এখনও আমরা একেক জনের গল্প নিয়ে বই পাচ্ছি, যারা ওই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্মৃতিকথাগুলো নিঃসন্দেহে মূল্যবান। তবে সমস্যা হল, স্মৃতি আমাদের অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। অনেকদিন পর অতীতের কথা লিখতে বসে দিন, তারিখ এবং প্রেক্ষাপট ঝাপসা হয়ে আসে। ফলে বিভ্রান্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। যদি কোনো লেখক ডায়েরি লিখতে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলে তার স্মৃতিকথা মামুলি স্মৃতিকথার চেয়েও মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশ সংগ্রামের নেতাদের মধ্যে একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদই ডায়েরি লিখতেন। নিঃসন্দেহে তার ডায়েরি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। যারা স্মৃতিকথা লিখেছেন তাদের কাজগুলোকে কোনোক্রমেই মূল্যহীন বলা যায় না। তবে সমস্যা হল, এ ধরনের স্মৃতিকথায় লেখকের নিজের ভূমিকা অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি করে দেখানোর প্রয়াস থাকে। ফলে ইতিহাসের সত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পেশাদার ইতিহাসবিদরা স্মৃতিকথাগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন ঘটনাবলীর প্রামাণ্যকরণের জন্য। বাংলাদেশে এ কাজটি হয়নি বললেই চলে।
পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে, কমিউনিস্ট দেশগুলোয় অফিসিয়াল হিস্ট্রি বা সরকারি ইতিহাস রচনার ঐতিহ্য আছে। এসব ইতিহাসের সমস্যা হল এটি সরকারি অবস্থানের বাইরে যেতে পারে না। ফলে এ ধরনের ইতিহাসে তথ্য বিকৃতির আশংকা থাকে। যোসেফ স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) ইতিহাস রচনা করা হয়। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রশ্চেভ স্ট্যালিনের নিন্দা ভাষণ করেন। তিনি বলেছিলেন, স্ট্যালিন আইভান দি টেরিবলের চেয়েও অত্যাচারী ছিলেন। ক্রুশ্চেভের ভাষণের পরর্তীকালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির যে সরকারি ইতিহাস প্রকাশ করা হয়, সেটি ছিল স্ট্যালিনের আমলে রচিত ইতিহাস থেকে বেশ ভিন্ন। সময়ের ব্যবধানে একই রাষ্ট্রের, সরকার প্রকাশিত ইতিহাস ভিন্ন হয়ে গেল। উপমহাদেশের স্ট্যালিনপন্থী কমিউনিস্টরা স্ট্যালিন পরবর্তীকালে প্রকাশিত ইতিহাসকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। তাদের দৃষ্টিতে এ ইতিহাস ছিল সংশোধনবাদী বিকৃতিতে ভরপুর অর্থাৎ ইতিহাস আইডিয়োলজির ভিক্টিম হয়ে গেল। সত্যিকারের ইতিহাস আইডিয়োলজির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। আবার এ কথাও সত্য, সম্পূর্ণভাবে আইডিয়োলজিমুক্ত হয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। ইতিহাস রচনার জন্য হিস্টোরিওগ্রাফি বা ইতিহাসবিদ্যাকে ভালো করে রপ্ত করতে হয়। ইতিহাস রচনায় ব্যবহৃত হিস্টোরিওগ্রাফি একটি নয়, একাধিক। সুতরাং অনুসৃত হিস্টোরিওগ্রাফির কারণে ইতিহাসের মেজাজ ভিন্ন হয়ে যায়। প্রতিবেশী ভারতে কংগ্রসে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করেছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেক নামকরা ইতিহাসবিদই কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজমের হিস্টোরিওগ্রাফি অনুসরণ করেছেন। এদের মধ্যে জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপাণ চন্দ্র অন্যতম। এর বিপরীতে গত কয়েক দশক ধরে ভারতের একটি ভিন্নপন্থী ইতিহাস চর্চার স্কুল গড়ে উঠেছে। এরা সাবালটার্ন স্কুল বা নিুবর্গের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব পরিসরে সাবালটার্নদের অনেক অনুসারী তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ইতিহাস বিদ্যায় এ মতবাদের প্রাণপুরুষ হিসেবে খ্যাত। কিন্তু হিস্টোরিওগ্রাফি যাই হোক কোনো ইতিহাসবিদই ঘটনার সত্যতাকে বিকৃত করতে পারে না। তাদের ব্যাখ্যায় ভিন্নতা থাকতে পারে না। গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেছিলেন। বলা হয়, সোমনাথ থেকে অনেক মূল্যবান রত্নরাজি সুলতান মাহমুদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। ব্রিটিশ আমলে স্কুলের ইতিহাস বইতে সুলতান মাহমুদকে একজন প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মুসলমান সুলতান হিসেবে তুলে ধরা হতো। এটা ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দূরত্ব সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার ‘সোমনাথ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেই গ্রন্থে রমিলা থাপার দেখিয়েছেন, সুলতান মাহমুদ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে বিদ্বিষ্ট ছিলেন না। সোমনাথের মূল রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি স্থানীয় ছোটখাটো অনেক রাজার সমর্থন পেয়েছিলেন। এরাও ছিল হিন্দু। সুতরাং বিষয়টি সাম্প্রদায়িক ছিল না, ছিল রাজনৈতিক। এভাবে আমরা সোমনাথ মন্দির আক্রমণের ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা পেলাম। কালের প্রবাহে নতুন তথ্য ও ঘটনাবলী উন্মোচিত হয়ে ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধি করে তোলে। সুতরাং ইতিহাস কোনো স্থির চিত্র নয়। যারা ইতিহাসকে স্থিরচিত্রে পরিণত করতে চান তারা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করছেন না।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার কাজটি হবে মূলত সমসাময়িক ইতিহাস রচনার কাজ। সমসাময়িক ইতিহাস খুবই দাহ্য একটি বিষয়। কারণ সমসাময়িক ইতিহাসের বহু কুশীলব জীবিত থাকেন, অথবা তাদের অতি সন্নিকটবর্তী প্রজন্ম জীবিত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ কাজ করে। কিন্তু আবেগে আচ্ছন্ন অবস্থায় নির্মোহ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। এ কারণেই বাংলাদেশে আমরা আবেগ আপ্লুত হয়ে অনেককেই ইতিহাসের নামে বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখি। যার ভিত্তিতে কোনো ডেফিনিটিভ ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের উপাদানস্বরূপ দুটি দলিল সংকলন আমরা দেখতে পাই। এর একটি হল বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত পনেরো খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র। দ্বিতীয়টি হল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্।’ এর বাইরে দলিলপত্রের সন্ধান করতে হলে আমাদের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্কাইভগুলো অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। দেখতে হবে বিভিন্ন দেশের অবমুক্তকৃত দলিল-দস্তাবেজ এবং যেসব দলিল এখনও অবমুক্ত হয়নি সেগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যেতে পারে উইকিলিকস থেকে আর কী জানা যায়! বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার জন্য মুজিবনগর সরকারের দলিল-দস্তাবেজ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দলিলপত্রও মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজে লাগবে। ’৭১-পূর্ববর্তী সময়ে যারা স্বাধীন পূর্ব বাংলা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেছেন বা কাজ করেছেন তাদের তথ্যগুলোও আমাদের ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান। এগুলো বাদ দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস রচিত হতে পারে না। লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউস একসময় প্রবাসে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পক্ষে জনমত ও মনোভাব গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। সেসব তথ্যও সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এককথায় বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার কাজটি বহু শ্রম, সাধনা ও অধ্যবসারের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। ইতিহাসকে রাজনীতির ফুটবলে পরিণত করার প্রয়াস খুবই দুঃখজনক এবং তা জাতির জন্য কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক নয়। এখন যা ঘটছে সেটি হল সমসাময়িক ইতিহাস নিয়ে আবেগ উত্তেজনার ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশায় মানুষের দৃষ্টিশক্তি সংকুচিত হয়ে যায়। সমসাময়িক ইতিহাসের বিপদ সম্পর্কে রজনি পাম দত্ত তার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণ ‘প্রবলেমস অব কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি’ গ্রন্থে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন। এ মুহূর্তে যারা বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কোনো গবেষণা করবেন তাদের জন্য এ গ্রন্থটি দিকনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করতে পারে।
যদি কোনো জলাশয়ে পানি কর্দমাক্ত হয়ে ঘোলা হয়ে যায় সেই জলাশয়ের গভীরে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু সময় পার হলে পানির কাদা তলানি হিসেবে জমে গেলে সেই স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে গভীরের অনেক কিছুই দেখা যায়। সুতরাং অপেক্ষা করতে হবে। পানির কাদাগুলো থিতু হওয়ার জন্য কবি লিখেছিলেন, ‘গোষ্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত আকাশ।’ শরতের দৃষ্টির পর গরুর পালগুলো যখন হেঁটে যায় তখন তাদের ক্ষুরাঘাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্তের সৃষ্টি হয়। সেই গর্তে জমা পানি প্রথম দিকে ঘোলাটেই থাকে। তারপর থিতু হয়ে স্বচ্ছ হয়ে যায়। গরুর ক্ষুরাঘাতে সৃষ্টি গর্তের স্বচ্ছ পানিতে অনন্ত আকাশও বিম্বিত হয়। ইতিহাস কখনও ঘোলাটে পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে ইতিহাস বিকৃতির কথা বলে হাঁক-ডাক দেয়াটাও নিরর্থক। ইতিহাস কারও চোখ রাঙানি বা ধমকে রচিত হতে পারে না। প্রকৃত ইতিহাসের জন্য আমাদের সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যখন কর্দমাক্ত পানি স্বচ্ছ পানিতে পরিণত হয়।
স্মৃতিকথা হোক বা অন্য যা কিছু হোক, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে যে কটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। তবে সেসব বইয়ের মূল লক্ষ্য হল ’৭১-এর যুদ্ধটিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো। ভারতের জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকালীন আমি অনেক ভারতীয় স্কলারদের বলতে শুনেছি, ’৭১-এর যুদ্ধ করেছে ভাতরীয় সৈনিকরা। তোমরা বাংলাদেশীরা আমরা না দাঁড়ালে পাকিস্তানিদের কিছুই করতে পারতে না। অন্যদিকে পাকিস্তানি লেখকদের, যাদের অধিকাংশই ’৭১-এর সামরিক কর্মকর্তা তাদের অভিমত হল গোটা যুদ্ধটাই ভারতের সৃষ্টি। এভাবে স্পষ্টত দেখা যায় ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশী জনযোদ্ধাদের কোনো আসন নেই। অথচ প্রকৃত ঘটনা হল লাখ লাখ জনযোদ্ধার অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ ছাড়া এবং কোটি কোটি বাংলাদেশীর সক্রিয় সমর্থন ছাড়া অন্য কোনো শক্তির ক্ষমতা ছিল না বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে। ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান ছিল আমাদের শত্র“পক্ষ এবং ভারত ছিল সহায়কের ভূমিকায়। কিন্তু ইতিহাসের নির্ধারণকারী ভূমিকাটি পালন করেছে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন, ‘বাঙালির ইতিহাস নেই।’ এটি ছিল তার খেদের কথা। প্রফেসর রেহমান সোবহান যখন বলেন, বাংলাদেশের ডেফিনিটিভ ইতিহাস নিয়ে একটা বই পাচ্ছি না- তখনও একই ধরনের খেদ বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। তিনি আরও কবুল করে নিয়েছেন, তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দেয়ার মতো কিছু তিনিও সৃষ্টি করতে পারেননি। এটাকে সাফ নিজের ব্যর্থতা বলে স্বীকার করেছেন। চেষ্টা করলে তিনিও হয়তো একটি পিরিয়ডের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের অধ্যায় তুলে ধরতে পারতেন। বিশেষ করে ১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপিত হওয়ার পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশ কয়েকজন বেশ কটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলোর বেশিরভাগই স্মৃতিকথানির্ভর। যেগুলো সম্পর্কে রেহমান সোবহান বলেছেন, এখনও আমরা একেক জনের গল্প নিয়ে বই পাচ্ছি, যারা ওই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। স্মৃতিকথাগুলো নিঃসন্দেহে মূল্যবান। তবে সমস্যা হল, স্মৃতি আমাদের অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। অনেকদিন পর অতীতের কথা লিখতে বসে দিন, তারিখ এবং প্রেক্ষাপট ঝাপসা হয়ে আসে। ফলে বিভ্রান্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। যদি কোনো লেখক ডায়েরি লিখতে অভ্যস্ত থাকেন, তাহলে তার স্মৃতিকথা মামুলি স্মৃতিকথার চেয়েও মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশ সংগ্রামের নেতাদের মধ্যে একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদই ডায়েরি লিখতেন। নিঃসন্দেহে তার ডায়েরি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান। যারা স্মৃতিকথা লিখেছেন তাদের কাজগুলোকে কোনোক্রমেই মূল্যহীন বলা যায় না। তবে সমস্যা হল, এ ধরনের স্মৃতিকথায় লেখকের নিজের ভূমিকা অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি করে দেখানোর প্রয়াস থাকে। ফলে ইতিহাসের সত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পেশাদার ইতিহাসবিদরা স্মৃতিকথাগুলোকে ব্যবহার করতে পারেন ঘটনাবলীর প্রামাণ্যকরণের জন্য। বাংলাদেশে এ কাজটি হয়নি বললেই চলে।
পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষ করে, কমিউনিস্ট দেশগুলোয় অফিসিয়াল হিস্ট্রি বা সরকারি ইতিহাস রচনার ঐতিহ্য আছে। এসব ইতিহাসের সমস্যা হল এটি সরকারি অবস্থানের বাইরে যেতে পারে না। ফলে এ ধরনের ইতিহাসে তথ্য বিকৃতির আশংকা থাকে। যোসেফ স্ট্যালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) ইতিহাস রচনা করা হয়। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রশ্চেভ স্ট্যালিনের নিন্দা ভাষণ করেন। তিনি বলেছিলেন, স্ট্যালিন আইভান দি টেরিবলের চেয়েও অত্যাচারী ছিলেন। ক্রুশ্চেভের ভাষণের পরর্তীকালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির যে সরকারি ইতিহাস প্রকাশ করা হয়, সেটি ছিল স্ট্যালিনের আমলে রচিত ইতিহাস থেকে বেশ ভিন্ন। সময়ের ব্যবধানে একই রাষ্ট্রের, সরকার প্রকাশিত ইতিহাস ভিন্ন হয়ে গেল। উপমহাদেশের স্ট্যালিনপন্থী কমিউনিস্টরা স্ট্যালিন পরবর্তীকালে প্রকাশিত ইতিহাসকে কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। তাদের দৃষ্টিতে এ ইতিহাস ছিল সংশোধনবাদী বিকৃতিতে ভরপুর অর্থাৎ ইতিহাস আইডিয়োলজির ভিক্টিম হয়ে গেল। সত্যিকারের ইতিহাস আইডিয়োলজির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। আবার এ কথাও সত্য, সম্পূর্ণভাবে আইডিয়োলজিমুক্ত হয়ে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। ইতিহাস রচনার জন্য হিস্টোরিওগ্রাফি বা ইতিহাসবিদ্যাকে ভালো করে রপ্ত করতে হয়। ইতিহাস রচনায় ব্যবহৃত হিস্টোরিওগ্রাফি একটি নয়, একাধিক। সুতরাং অনুসৃত হিস্টোরিওগ্রাফির কারণে ইতিহাসের মেজাজ ভিন্ন হয়ে যায়। প্রতিবেশী ভারতে কংগ্রসে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করেছে। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেক নামকরা ইতিহাসবিদই কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল। তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজমের হিস্টোরিওগ্রাফি অনুসরণ করেছেন। এদের মধ্যে জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপাণ চন্দ্র অন্যতম। এর বিপরীতে গত কয়েক দশক ধরে ভারতের একটি ভিন্নপন্থী ইতিহাস চর্চার স্কুল গড়ে উঠেছে। এরা সাবালটার্ন স্কুল বা নিুবর্গের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। বিশ্ব পরিসরে সাবালটার্নদের অনেক অনুসারী তৈরি হয়েছে। অধ্যাপক রণজিৎ গুহ ইতিহাস বিদ্যায় এ মতবাদের প্রাণপুরুষ হিসেবে খ্যাত। কিন্তু হিস্টোরিওগ্রাফি যাই হোক কোনো ইতিহাসবিদই ঘটনার সত্যতাকে বিকৃত করতে পারে না। তাদের ব্যাখ্যায় ভিন্নতা থাকতে পারে না। গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেছিলেন। বলা হয়, সোমনাথ থেকে অনেক মূল্যবান রত্নরাজি সুলতান মাহমুদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যান। ব্রিটিশ আমলে স্কুলের ইতিহাস বইতে সুলতান মাহমুদকে একজন প্রচণ্ড হিন্দুবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মুসলমান সুলতান হিসেবে তুলে ধরা হতো। এটা ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দূরত্ব সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর আগে প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার ‘সোমনাথ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেই গ্রন্থে রমিলা থাপার দেখিয়েছেন, সুলতান মাহমুদ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে বিদ্বিষ্ট ছিলেন না। সোমনাথের মূল রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি স্থানীয় ছোটখাটো অনেক রাজার সমর্থন পেয়েছিলেন। এরাও ছিল হিন্দু। সুতরাং বিষয়টি সাম্প্রদায়িক ছিল না, ছিল রাজনৈতিক। এভাবে আমরা সোমনাথ মন্দির আক্রমণের ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা পেলাম। কালের প্রবাহে নতুন তথ্য ও ঘটনাবলী উন্মোচিত হয়ে ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধি করে তোলে। সুতরাং ইতিহাস কোনো স্থির চিত্র নয়। যারা ইতিহাসকে স্থিরচিত্রে পরিণত করতে চান তারা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করছেন না।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার কাজটি হবে মূলত সমসাময়িক ইতিহাস রচনার কাজ। সমসাময়িক ইতিহাস খুবই দাহ্য একটি বিষয়। কারণ সমসাময়িক ইতিহাসের বহু কুশীলব জীবিত থাকেন, অথবা তাদের অতি সন্নিকটবর্তী প্রজন্ম জীবিত থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে প্রচণ্ড আবেগ কাজ করে। কিন্তু আবেগে আচ্ছন্ন অবস্থায় নির্মোহ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। এ কারণেই বাংলাদেশে আমরা আবেগ আপ্লুত হয়ে অনেককেই ইতিহাসের নামে বিতর্কে লিপ্ত হতে দেখি। যার ভিত্তিতে কোনো ডেফিনিটিভ ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসের উপাদানস্বরূপ দুটি দলিল সংকলন আমরা দেখতে পাই। এর একটি হল বাংলাদেশ সরকার প্রকাশিত পনেরো খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র। দ্বিতীয়টি হল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস্।’ এর বাইরে দলিলপত্রের সন্ধান করতে হলে আমাদের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্কাইভগুলো অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। দেখতে হবে বিভিন্ন দেশের অবমুক্তকৃত দলিল-দস্তাবেজ এবং যেসব দলিল এখনও অবমুক্ত হয়নি সেগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যেতে পারে উইকিলিকস থেকে আর কী জানা যায়! বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার জন্য মুজিবনগর সরকারের দলিল-দস্তাবেজ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দলিলপত্রও মূল্যবান উপাদান হিসেবে কাজে লাগবে। ’৭১-পূর্ববর্তী সময়ে যারা স্বাধীন পূর্ব বাংলা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেছেন বা কাজ করেছেন তাদের তথ্যগুলোও আমাদের ইতিহাস রচনার অন্যতম উপাদান। এগুলো বাদ দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস রচিত হতে পারে না। লন্ডনের ইস্ট পাকিস্তান হাউস একসময় প্রবাসে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পক্ষে জনমত ও মনোভাব গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। সেসব তথ্যও সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এককথায় বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার কাজটি বহু শ্রম, সাধনা ও অধ্যবসারের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। ইতিহাসকে রাজনীতির ফুটবলে পরিণত করার প্রয়াস খুবই দুঃখজনক এবং তা জাতির জন্য কোনোক্রমেই মঙ্গলজনক নয়। এখন যা ঘটছে সেটি হল সমসাময়িক ইতিহাস নিয়ে আবেগ উত্তেজনার ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশায় মানুষের দৃষ্টিশক্তি সংকুচিত হয়ে যায়। সমসাময়িক ইতিহাসের বিপদ সম্পর্কে রজনি পাম দত্ত তার মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণ ‘প্রবলেমস অব কনটেম্পোরারি হিস্ট্রি’ গ্রন্থে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন। এ মুহূর্তে যারা বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কোনো গবেষণা করবেন তাদের জন্য এ গ্রন্থটি দিকনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করতে পারে।
যদি কোনো জলাশয়ে পানি কর্দমাক্ত হয়ে ঘোলা হয়ে যায় সেই জলাশয়ের গভীরে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু সময় পার হলে পানির কাদা তলানি হিসেবে জমে গেলে সেই স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে গভীরের অনেক কিছুই দেখা যায়। সুতরাং অপেক্ষা করতে হবে। পানির কাদাগুলো থিতু হওয়ার জন্য কবি লিখেছিলেন, ‘গোষ্পদে বিম্বিত যথা অনন্ত আকাশ।’ শরতের দৃষ্টির পর গরুর পালগুলো যখন হেঁটে যায় তখন তাদের ক্ষুরাঘাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্তের সৃষ্টি হয়। সেই গর্তে জমা পানি প্রথম দিকে ঘোলাটেই থাকে। তারপর থিতু হয়ে স্বচ্ছ হয়ে যায়। গরুর ক্ষুরাঘাতে সৃষ্টি গর্তের স্বচ্ছ পানিতে অনন্ত আকাশও বিম্বিত হয়। ইতিহাস কখনও ঘোলাটে পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে ইতিহাস বিকৃতির কথা বলে হাঁক-ডাক দেয়াটাও নিরর্থক। ইতিহাস কারও চোখ রাঙানি বা ধমকে রচিত হতে পারে না। প্রকৃত ইতিহাসের জন্য আমাদের সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যখন কর্দমাক্ত পানি স্বচ্ছ পানিতে পরিণত হয়।
স্মৃতিকথা হোক বা অন্য যা কিছু হোক, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে যে কটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। তবে সেসব বইয়ের মূল লক্ষ্য হল ’৭১-এর যুদ্ধটিকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো। ভারতের জওহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকালীন আমি অনেক ভারতীয় স্কলারদের বলতে শুনেছি, ’৭১-এর যুদ্ধ করেছে ভাতরীয় সৈনিকরা। তোমরা বাংলাদেশীরা আমরা না দাঁড়ালে পাকিস্তানিদের কিছুই করতে পারতে না। অন্যদিকে পাকিস্তানি লেখকদের, যাদের অধিকাংশই ’৭১-এর সামরিক কর্মকর্তা তাদের অভিমত হল গোটা যুদ্ধটাই ভারতের সৃষ্টি। এভাবে স্পষ্টত দেখা যায় ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশী জনযোদ্ধাদের কোনো আসন নেই। অথচ প্রকৃত ঘটনা হল লাখ লাখ জনযোদ্ধার অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ ছাড়া এবং কোটি কোটি বাংলাদেশীর সক্রিয় সমর্থন ছাড়া অন্য কোনো শক্তির ক্ষমতা ছিল না বাংলাদেশের ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণ করে। ’৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান ছিল আমাদের শত্র“পক্ষ এবং ভারত ছিল সহায়কের ভূমিকায়। কিন্তু ইতিহাসের নির্ধারণকারী ভূমিকাটি পালন করেছে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
No comments