সাগরভাসা মানুষ ও আমরা by হাসান ফেরদৌস
বাংলাদেশ
বরাবরই পরিচিত তিন ‘দ’-এর জন্য—দারিদ্র্য, দুর্যোগ ও দুর্নীতি। এখন তার
সঙ্গে যুক্ত হলো সাগরভাসা মানুষ। গত তিন মাসে প্রায় প্রতিদিন বিশ্বের
তথ্যমাধ্যমগুলোয় মাঝসমুদ্রে দিশেহারা রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের
নাম একই নিশ্বাসে উচ্চারণ করা হচ্ছে। নিজেদের উন্নয়নের মডেল প্রমাণে ব্যস্ত
বাংলাদেশ সরকারের জন্য ব্যাপারটা নির্ঘাত অতি বিব্রতকর। এতটাই বিব্রতকর যে
তাঁরা এ নিয়ে কথা বলার বদলে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
মানুষ দেশ ছেড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়ায় কেন?
রোহিঙ্গারা কেন দেশ ছাড়ছে, তা আমরা বুঝি। যে জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থা মিয়ানমার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও তারা সে দেশের নাগরিক নয়। এমনকি সে দেশের জাতীয় জনসংখ্যা গণনায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তার ওপর রয়েছে অভাবনীয় নির্যাতন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যাঁদের আমরা নিতান্তই শান্তিপ্রিয় বলে জানি। কোনো অপরাধ ছাড়াই—শুধু রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে—হাজার হাজার মানুষ কারাগারে পচে মরছে। কেউ কেউ বাংলাদেশে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। অং সান সু চি, শান্তির জন্য যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি পর্যন্ত এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। নোবেল পুরস্কার নিতে স্টকহোমে গেলে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাব না দিয়ে সে প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অবাক কি যে জাতিসংঘের ভাষায় এই রোহিঙ্গারা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায়।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে তার প্রতিবেশীদেরও কেউ টুঁ শব্দটি করে না। তাদের ভয়, মুখ খুললেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এই রোহিঙ্গারা সম্ভবত একসময়, যে ভূখণ্ডে আজকের বাংলাদেশ, সেখান থেকেই আরাকান গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সে অর্থে তারা আমাদের দূরসম্পর্কের হলেও জ্ঞাতি ভাই। কিন্তু নিজেদের সমস্যায় যে নিজে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারা কী করে জ্ঞাতি ভাইবোনদের সাহায্য করবে?
যারা ভুলে গেছে, তাদের মনে করিয়ে দিই, সত্তরের শেষ মাথায় সৌদি আরবের উৎসাহে বাংলাদেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সৌদি আরবের লক্ষ্য ছিল, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে জিহাদি মন্ত্র ছড়ানো, আর বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল কাঁচা টাকা কামানো। সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য সে সময় কক্সবাজারে একাধিক ক্যাম্পও স্থাপন হয়েছিল। অনুমান করি, সেসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুজাহিদরা নদী পেরিয়ে আরাকান রাজ্যে আক্রমণ করে সেখানে ওয়াহাবি মন্ত্র ছড়াবে, এমন একটা বুদ্ধি হয়তো আঁটা হয়েছিল। বর্মি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গেরিলাদের আক্রমণের খবরও আমরা অনেকবারই পত্রপত্রিকায় দেখেছি। এমনকি ইসলামিক রিপাবলিক অব রোহিঙ্গা ল্যান্ড, এই নামে একটি স্বতন্ত্র জিহাদি রাষ্ট্র গঠনের কথাও বলা হয়েছিল সে সময়।
কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। বাংলাদেশ সরকার এই ব্যাপারে কোনো সমর্থন দিতে আগ্রহী নয়। রোহিঙ্গা গেরিলারা কেউ কেউ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত, চোরাচালানিতেও, ফলে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেলেই আমাদের স্বস্তি।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের এক নম্বর পৃষ্ঠপোষক সৌদিদের নিজেদের পয়সায় টান ধরেছে, সে কারণে ওয়াহাবি মন্ত্র ছড়ানোর বদলে তাদের কাছে অনেক জরুরি তেল বিক্রি। বছর চারেক আগে সৌদি আরব চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এক চুক্তি করেছে, যার অধীনে সৌদি তেল যাবে চীনে। মিয়ানমারে নির্মিতব্য শয়ে (Shwe) পাইপলাইন দিয়ে চীনের ইউনান প্রদেশে প্রতিদিন দুই লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করা হবে। অতএব চুলায় যাক রোহিঙ্গারা, তার চেয়ে ডলার গোনা যাক।
ফলে এসব রোহিঙ্গা, যারা সর্ব অর্থে অস্পৃশ্য, তারা দেশের ভেতরে থেকেও মৃত। সমুদ্র পেরিয়ে তারা যদি থাইল্যান্ড কি মালয়েশিয়া বা আরও দূরের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে, তার কারণ বোঝা আমাদের জন্য কঠিন নয়।
কিন্তু মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে যে বাংলাদেশ, তার মানুষেরা দেশ ছাড়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠল কেন? ভিটেমাটি বিক্রি করে, নিজের শেষ কপর্দকটি দিয়ে তারা কেন মাঝসমুদ্রে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পাড়ি দিচ্ছে?
এর উত্তর যে আমরা জানি না, তা নয়। কিন্তু জেনেও চোখ বুজে থেকেছি। একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র দীর্ঘদিন থেকেই এই অঞ্চলে সক্রিয়, তারাই নানা প্রলোভন দিয়ে মানুষ পাচার করছে। একসময় এদের লক্ষ্য ছিল আদম ব্যবসা। বিদেশে গেলেই বিস্তর পয়সা, এমন অলীক গালগপ্প অভাবী মানুষদের মনে গেঁথে দেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। ফলে নিজের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে মানুষ বিদেশে অবৈধ পথে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত ১০ বছরে সে ব্যবসার ধরন বদলে গেছে।
এখন তাদের লক্ষ্য মানুষকে ফুসলিয়ে বিদেশে পাচার, তারপর তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়। হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসা, যার সঙ্গে জড়িত মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সরকারি কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর কোনো কোনো সদস্য যে পাচারকারীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে দু-দশ কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, সে কথা থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারই স্বীকার করেছে।
এই মানব পাচারকারীদের কথা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। বাংলাদেশের পত্রিকায় চট্টগ্রামের এক রেবি ম্যাডামের কথা বেরিয়েছে। একসময়ের দরিদ্র কৃষকের স্ত্রী রেবি—যাঁর আসল নাম রেজিয়া আখতার—শুধু মানব পাচার করে এখন কোটিপতি। পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে, কিন্তু তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। কারণটা নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না। জানা গেছে, এই রেবি ম্যাডামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫০ জনের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অনুমান করি, যে কারণে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা মানব পাচারের কথা জেনেও চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখতেন, বাংলাদেশেও সেই একই কাণ্ড।
নানা পথে মানব পাচারের এই ঘটনা চলছে কয়েক দশক ধরে। সমুদ্রপথে পালাতে গিয়ে বিদেশি টহলদারি যানের হাতে উদ্ধার না হলে এদের কথা আমরা জানতামও না। আর জানলেও তা নিয়ে ‘কিছু করা দরকার’-জাতীয় সরকারি উদ্যোগের কথা সাড়ম্বরে বলা হতো না।
রোহিঙ্গাদের কথা ছেড়ে দিই, নিজের দেশের মানুষের প্রতি এমন অবজ্ঞা কেন আমাদের? একটা কারণ সম্ভবত এই যে মানুষগুলো অতিদরিদ্র এবং সেই হেতু পরিত্যাজ্য। একইভাবে আমরা অগ্রাহ্য করে গিয়েছি বিদেশের জেলে আটক বাংলাদেশিদের কথা। বিদেশ মানে বিলেত-আমেরিকা বা সৌদি আরব নয়, বাড়ির পাশের ভারত। রুটি-রুজির আশায় দেয়াল টপকে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করে ধরা পড়ে তারা এখন জেলে। সঙ্গে থাকা ছেলেমেয়েরাও জেলে। তাদের কথা পত্রপত্রিকায় লেখাও হয়েছে। কই, তাদের ফিরিয়ে আনারও তো কোনো কার্যকর চেষ্টা হয়নি।
ভারতের পত্রপত্রিকাতেই খবর হয়েছে, অনুপ্রবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের জেলে আটক রয়েছে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। ইতিমধ্যে তাদের জেল-সাজা শেষ হয়েছে। কিন্তু ফিরিয়ে আনার কোনো লক্ষণ নেই। তাদের সঙ্গে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়া প্রায় ২০০ ছেলেমেয়ে মা-বাবার সঙ্গে অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর। তাদের ফিরিয়ে আনারও কোনো ব্যবস্থা পাকা হয়নি। এই ২০০ ছেলেমেয়ের একজনও যদি আমাদের ভদ্দর লোকদের কারও সন্তান হতো, তাহলে নির্ঘাত তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হতো। এক সালাহ উদ্দিনকে ফিরিয়ে আনতে পাহাড় লঙ্ঘনের কথা ভাবা হচ্ছে, তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে একটি ছোট বিমান ঢাকার কাছে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ভেঙে পড়ায় বেশ কিছু ভদ্র সন্তান নিহত হয়। এমন একটা বড় ঘটনা মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে অন্য সব ভদ্র সন্তানকে তা জানানোর জন্য সে সময় একাধিক পত্রিকা ‘টেলিগ্রাম’ বের করেছিল। আমি বলছি সেই সময়ের কথা, যখন ইন্টারনেট নামের বস্তুটি অনাবিষ্কৃত ছিল। সত্যি কথা হলো, আমাদের অজ্ঞাতে অথবা আমাদের সজ্ঞান সম্মতিতে, আমরা নিজেরাই একটি শ্রেণিব্যবস্থা নির্মাণ করেছি, যার তাবৎ আয়োজন শুধু তাদের জন্য, যারা সমাজের উঁচুতলায় বসে ছড়ি ঘোরায়।
অবস্থাটা শুধু তখন বদলাবে, যখন এসব গরিব-গুর্বোরা জেগে উঠবে।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
মানুষ দেশ ছেড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পা বাড়ায় কেন?
রোহিঙ্গারা কেন দেশ ছাড়ছে, তা আমরা বুঝি। যে জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থা মিয়ানমার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিক সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও তারা সে দেশের নাগরিক নয়। এমনকি সে দেশের জাতীয় জনসংখ্যা গণনায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। তার ওপর রয়েছে অভাবনীয় নির্যাতন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সে দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যাঁদের আমরা নিতান্তই শান্তিপ্রিয় বলে জানি। কোনো অপরাধ ছাড়াই—শুধু রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে—হাজার হাজার মানুষ কারাগারে পচে মরছে। কেউ কেউ বাংলাদেশে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। অং সান সু চি, শান্তির জন্য যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তিনি পর্যন্ত এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। নোবেল পুরস্কার নিতে স্টকহোমে গেলে তাঁকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাব না দিয়ে সে প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অবাক কি যে জাতিসংঘের ভাষায় এই রোহিঙ্গারা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায়।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে তার প্রতিবেশীদেরও কেউ টুঁ শব্দটি করে না। তাদের ভয়, মুখ খুললেই ঘাড়ে চেপে বসবে। এই রোহিঙ্গারা সম্ভবত একসময়, যে ভূখণ্ডে আজকের বাংলাদেশ, সেখান থেকেই আরাকান গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সে অর্থে তারা আমাদের দূরসম্পর্কের হলেও জ্ঞাতি ভাই। কিন্তু নিজেদের সমস্যায় যে নিজে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারা কী করে জ্ঞাতি ভাইবোনদের সাহায্য করবে?
যারা ভুলে গেছে, তাদের মনে করিয়ে দিই, সত্তরের শেষ মাথায় সৌদি আরবের উৎসাহে বাংলাদেশ কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সৌদি আরবের লক্ষ্য ছিল, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে জিহাদি মন্ত্র ছড়ানো, আর বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল কাঁচা টাকা কামানো। সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য সে সময় কক্সবাজারে একাধিক ক্যাম্পও স্থাপন হয়েছিল। অনুমান করি, সেসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুজাহিদরা নদী পেরিয়ে আরাকান রাজ্যে আক্রমণ করে সেখানে ওয়াহাবি মন্ত্র ছড়াবে, এমন একটা বুদ্ধি হয়তো আঁটা হয়েছিল। বর্মি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গেরিলাদের আক্রমণের খবরও আমরা অনেকবারই পত্রপত্রিকায় দেখেছি। এমনকি ইসলামিক রিপাবলিক অব রোহিঙ্গা ল্যান্ড, এই নামে একটি স্বতন্ত্র জিহাদি রাষ্ট্র গঠনের কথাও বলা হয়েছিল সে সময়।
কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। বাংলাদেশ সরকার এই ব্যাপারে কোনো সমর্থন দিতে আগ্রহী নয়। রোহিঙ্গা গেরিলারা কেউ কেউ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত, চোরাচালানিতেও, ফলে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা গেলেই আমাদের স্বস্তি।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের এক নম্বর পৃষ্ঠপোষক সৌদিদের নিজেদের পয়সায় টান ধরেছে, সে কারণে ওয়াহাবি মন্ত্র ছড়ানোর বদলে তাদের কাছে অনেক জরুরি তেল বিক্রি। বছর চারেক আগে সৌদি আরব চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি এক চুক্তি করেছে, যার অধীনে সৌদি তেল যাবে চীনে। মিয়ানমারে নির্মিতব্য শয়ে (Shwe) পাইপলাইন দিয়ে চীনের ইউনান প্রদেশে প্রতিদিন দুই লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করা হবে। অতএব চুলায় যাক রোহিঙ্গারা, তার চেয়ে ডলার গোনা যাক।
ফলে এসব রোহিঙ্গা, যারা সর্ব অর্থে অস্পৃশ্য, তারা দেশের ভেতরে থেকেও মৃত। সমুদ্র পেরিয়ে তারা যদি থাইল্যান্ড কি মালয়েশিয়া বা আরও দূরের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে, তার কারণ বোঝা আমাদের জন্য কঠিন নয়।
কিন্তু মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে যে বাংলাদেশ, তার মানুষেরা দেশ ছাড়ার জন্য এমন মরিয়া হয়ে উঠল কেন? ভিটেমাটি বিক্রি করে, নিজের শেষ কপর্দকটি দিয়ে তারা কেন মাঝসমুদ্রে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে পাড়ি দিচ্ছে?
এর উত্তর যে আমরা জানি না, তা নয়। কিন্তু জেনেও চোখ বুজে থেকেছি। একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী চক্র দীর্ঘদিন থেকেই এই অঞ্চলে সক্রিয়, তারাই নানা প্রলোভন দিয়ে মানুষ পাচার করছে। একসময় এদের লক্ষ্য ছিল আদম ব্যবসা। বিদেশে গেলেই বিস্তর পয়সা, এমন অলীক গালগপ্প অভাবী মানুষদের মনে গেঁথে দেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। ফলে নিজের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে মানুষ বিদেশে অবৈধ পথে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছে। গত ১০ বছরে সে ব্যবসার ধরন বদলে গেছে।
এখন তাদের লক্ষ্য মানুষকে ফুসলিয়ে বিদেশে পাচার, তারপর তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়। হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসা, যার সঙ্গে জড়িত মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সরকারি কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর কোনো কোনো সদস্য যে পাচারকারীদের রক্ষাকর্তা হিসেবে দু-দশ কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন, সে কথা থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারই স্বীকার করেছে।
এই মানব পাচারকারীদের কথা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। বাংলাদেশের পত্রিকায় চট্টগ্রামের এক রেবি ম্যাডামের কথা বেরিয়েছে। একসময়ের দরিদ্র কৃষকের স্ত্রী রেবি—যাঁর আসল নাম রেজিয়া আখতার—শুধু মানব পাচার করে এখন কোটিপতি। পুলিশের খাতায় নাম উঠেছে, কিন্তু তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। কারণটা নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না। জানা গেছে, এই রেবি ম্যাডামের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৫০ জনের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অনুমান করি, যে কারণে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা মানব পাচারের কথা জেনেও চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখতেন, বাংলাদেশেও সেই একই কাণ্ড।
নানা পথে মানব পাচারের এই ঘটনা চলছে কয়েক দশক ধরে। সমুদ্রপথে পালাতে গিয়ে বিদেশি টহলদারি যানের হাতে উদ্ধার না হলে এদের কথা আমরা জানতামও না। আর জানলেও তা নিয়ে ‘কিছু করা দরকার’-জাতীয় সরকারি উদ্যোগের কথা সাড়ম্বরে বলা হতো না।
রোহিঙ্গাদের কথা ছেড়ে দিই, নিজের দেশের মানুষের প্রতি এমন অবজ্ঞা কেন আমাদের? একটা কারণ সম্ভবত এই যে মানুষগুলো অতিদরিদ্র এবং সেই হেতু পরিত্যাজ্য। একইভাবে আমরা অগ্রাহ্য করে গিয়েছি বিদেশের জেলে আটক বাংলাদেশিদের কথা। বিদেশ মানে বিলেত-আমেরিকা বা সৌদি আরব নয়, বাড়ির পাশের ভারত। রুটি-রুজির আশায় দেয়াল টপকে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করে ধরা পড়ে তারা এখন জেলে। সঙ্গে থাকা ছেলেমেয়েরাও জেলে। তাদের কথা পত্রপত্রিকায় লেখাও হয়েছে। কই, তাদের ফিরিয়ে আনারও তো কোনো কার্যকর চেষ্টা হয়নি।
ভারতের পত্রপত্রিকাতেই খবর হয়েছে, অনুপ্রবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের জেলে আটক রয়েছে প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। ইতিমধ্যে তাদের জেল-সাজা শেষ হয়েছে। কিন্তু ফিরিয়ে আনার কোনো লক্ষণ নেই। তাদের সঙ্গে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়া প্রায় ২০০ ছেলেমেয়ে মা-বাবার সঙ্গে অন্তরীণ অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর। তাদের ফিরিয়ে আনারও কোনো ব্যবস্থা পাকা হয়নি। এই ২০০ ছেলেমেয়ের একজনও যদি আমাদের ভদ্দর লোকদের কারও সন্তান হতো, তাহলে নির্ঘাত তা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হতো। এক সালাহ উদ্দিনকে ফিরিয়ে আনতে পাহাড় লঙ্ঘনের কথা ভাবা হচ্ছে, তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
মনে পড়ছে, অনেক বছর আগে একটি ছোট বিমান ঢাকার কাছে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ভেঙে পড়ায় বেশ কিছু ভদ্র সন্তান নিহত হয়। এমন একটা বড় ঘটনা মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে অন্য সব ভদ্র সন্তানকে তা জানানোর জন্য সে সময় একাধিক পত্রিকা ‘টেলিগ্রাম’ বের করেছিল। আমি বলছি সেই সময়ের কথা, যখন ইন্টারনেট নামের বস্তুটি অনাবিষ্কৃত ছিল। সত্যি কথা হলো, আমাদের অজ্ঞাতে অথবা আমাদের সজ্ঞান সম্মতিতে, আমরা নিজেরাই একটি শ্রেণিব্যবস্থা নির্মাণ করেছি, যার তাবৎ আয়োজন শুধু তাদের জন্য, যারা সমাজের উঁচুতলায় বসে ছড়ি ঘোরায়।
অবস্থাটা শুধু তখন বদলাবে, যখন এসব গরিব-গুর্বোরা জেগে উঠবে।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments