মেহেরপুরে গম নিয়ে আ.লীগে গন্ডগোল by তুহিন আরন্য
সরকারিভাবে গম কেনা বন্ধ থাকায় মেহেরপুরের গাংনী সরকারি খাদ্যগুদামের সামনে খোলা আকাশের নিচে স্তুপ করে রাখা হয়েছে সরকারি দলের নেতাদের সরবরাহ করা গম। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো |
মেহেরপুর
জেলায় সরকারের সংগ্রহ অভিযান চললেও কৃষক তাঁদের উৎপাদিত গম গুদামে দিতে
পারেননি। তবে গুদামে গম গেছে তাঁদের নামেই। আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয়
একাংশ দাবি করেছে, কৃষকদের বদলে দলের কয়েকজন নেতা গম সরবরাহ করে আট কোটি
টাকার মতো আয় করছেন। এঁরা সামান্য টাকা দিয়ে বা প্রভাব খাটিয়ে কৃষকদের
কার্ড নিয়ে তাঁদের নামেই গুদামে গম দিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে গাংনীতে গম সরবরাহ নিয়ে স্থানীয় সাংসদ মকবুল হোসেন এবং দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলি এবং দলীয় অফিস ও সাংসদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে গম ক্রয় বন্ধ আছে এক মাস ধরে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাংনী খাদ্যগুদামের বাইরে গমের স্তূপ পড়ে আছে। রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে তা নষ্ট হচ্ছে। সরবরাহকারীদের পাহারাদার তোজাম আলী, পল্টু হোসেনসহ কয়েকজন প্রথম আলোকে জানান, স্তূপকৃত গমের মধ্যে গাংনী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুজিরুল ইসলামের ২০০ টন, পৌর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের ১০০ টন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেকের ২৭ টন গম রয়েছে।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, মেহেরপুর সদরে (সদর ও মুজিবনগর) সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন এবং গাংনী উপজেলায় ৩ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন গম কেনার জন্য বরাদ্দ এসেছে। প্রতি কেজি গমের সরবরাহমূল্য ধরা হয়েছে ২৮ টাকা। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে এই গম কেনার কথা। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুনের মধ্যে গম সংগ্রহ করার কথা।
তিন খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা গেছে, ১৬ জুন পর্যন্ত মেহেরপুর সদরে ৬২১ জন কৃষকের নামে ১ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন গম সরবরাহ হয়েছে। আমঝুপিতে ৫৫৩ কৃষকের নামে ১ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন এবং গাংনীতে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২২০ কৃষকের নামে ৬২৮ মেট্রিক টন গম সরবরাহ করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্র জানান, জেলায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ২০০ কৃষি প্রণোদনা সহায়তাপ্রাপ্ত কৃষক রয়েছেন। কেবল তাঁরাই সরকারি মূল্যে সরাসরি খাদ্যগুদামে গম বিক্রির সুযোগ পাওয়ার কথা। একজন কৃষক তিন টন গম দিতে পারবেন। এর মধ্যে দেড় হাজার কার্ডধারী কৃষকের নামে গুদামে গম সরবরাহ হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ দাবি করেছে, সরকারিভাবে গম সংগ্রহ অভিযান শুরুর আগেই কৃষক তাঁর উৎপাদিত গম খোলা এবং পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন দলের কিছু নেতা বাজার থেকে ১২-১৪ টাকা কেজি দরে নিম্নমানের গম কিনে কৃষকের কার্ড সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে ২৮ টাকা কেজি দরে গুদামে সরবরাহ করছেন। এতে তাঁরা প্রায় আট কোটি টাকার মতো লাভ করছেন।
সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের গমচাষি মসলেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কৃষি বিভাগের তালিকাভুক্ত চাষি। এবার ৩৫ বিঘা জমিতে গম চাষ করেছিলেন। কোনো বছরই সরকারি গুদামে সরাসরি গম বিক্রির সুযোগ পাননি তিনি। তাই গম তোলার পরপর মার্চ মাসের শেষের দিকে সব খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।
একই কথা বললেন ওই গ্রামের হায়াত আলী। তিনি জানান, তাঁর ১৩ বিঘা জমিতে গম ছিল। তিনিও দুই মাস আগে গম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখানকার কৃষকের ঘরে কোনো গম নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বারাদী গ্রামের কৃষক তাহাজুদ্দিন আহমেদ তিন টন গম সরবরাহ করেছেন বলে সরকারি খাদ্যগুদামের রেজিস্টারে লেখা আছে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সরকারি গুদামে কোনো গম দিইনি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গমচাষি বলেন, একজন প্রভাবশালী নেতা মুঠোফোনে কৃষক কার্ড চাইলে তিনি গিয়ে দিয়ে এসেছেন। এর জন্য তিনি ৫০০ টাকা পেয়েছেন। তাঁর পরিচিত কার্ডধারী আরও কয়েকজন কৃষকও একইভাবে ওই নেতাকে কার্ড দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার অভিযোগ, মেহেরপুর পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামিউল বশিরার স্বামী আনারুল ইসলাম ১০ টন, মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের মেম্বার খোকন মণ্ডল ৮ মেট্রিক টন গম সরবরাহ করছেন। কিন্তু এঁরা কেউই কৃষক নন। তাঁরা ২০০-৫০০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করে গুদামে গম দিচ্ছেন। অভিযুক্তদের দাবি, তাঁরা কোনো গম গুদামে দেননি। গমের স্লিপ দিয়েছেন কৃষককে।
জেলা যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদুল আনাম বলেন, কৃষকের গম নিয়ে কতিপয় নেতা কোটি টাকার দুর্নীতি করছেন। এর প্রতিবাদে জেলা যুবলীগ ৯ মে শহরে মিছিল করেছিল।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মান্নান জানান, গম নিয়ে মেহেরপুর ও গাংনীতে চার কোটি টাকা করে আট কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন দলের কতিপয় নেতা। তিনি গম নিয়ে চলমান এ দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেন।
সদরে গম ক্রয়ে দুর্নীতির পেছনে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসকে দায়ী করে দলের একাংশ।
জবাবে আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস বলেন, মেহেরপুরে স্বচ্ছতার সঙ্গেই কৃষকের কাছ থেকে গম নেওয়া হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত কিছু নেতা এই নিয়ে অভিযোগ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছেন। তিনি জানান, কৃষক বাছাইয়ের কাজ করছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা।
জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গম কৃষক না নেতারা দিচ্ছেন, কীভাবে দিচ্ছেন—সবই আপনারা জানেন। খাদ্যগুদামের কর্মীরা কৃষক-কার্ড দেখে গম নিচ্ছে। সেই কার্ডের মালিককে তা খোঁজার এখতিয়ার তাদের নেই।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি চেয়ারে বসে অনেক কথাই বলা যায় না। যত দিন নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হবে, তত দিন কৃষকের জন্য সরকারের নেওয়া কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।’
গম সরবরাহ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে রেষারেষির সূত্রপাত সম্পর্কে গাংনীর একাধিক গম ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের নেতা জানান, গত সাত বছর স্থানীয় সাংসদ মকবুল হোসেনের পক্ষে গাংনী যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুজিরুল ইসলাম গম সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক এবং স্থানীয় মহিলা সাংসদ সেলিনা আক্তার বানু ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে কর্মীদের গম সরবরাহে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন। সাংসদের পাশাপাশি আবদুল খালেকও গমের স্লিপ দিতে শুরু করেন। খালেকের পক্ষে সিন্ডিকেট প্রধান হন গাংনী পৌর যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক (বর্তমানে কারাবন্দী) ভেন্ডার আশরাফুল ইসলাম।
একপর্যায়ে ১৮ এপ্রিল দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই দিন সাংসদ-সমর্থক গাংনী বামুন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হবিবুর রহমান ওরফে হবিসহ কয়েকজন গাংনী খাদ্য পরিদর্শক জামাত আলীকে মারধর করেন। ওই ঘটনায় হবিসহ দুজনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়। ওই দিন থেকেই গাংনীতে গম সংগ্রহ অভিযান বন্ধ আছে।
এ ব্যাপারে সাংসদ মকবুল হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘গম কৃষকই দেয়। মুজিরুল মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। এবার দলের নতুন জেলা সেক্রেটারি হয়েছেন গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারি আবদুল খালেক। তিনি শুধু গমের দায়িত্ব নয়, এখন এমপির দায়িত্ব ও ক্ষমতাটাও কেড়ে নিতে চান। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মহিলা এমপি।’ সাংসদের প্রশ্ন, ‘খালেক গমের স্লিপ দেয় কীভাবে? সেই স্লিপে গম ক্রয় হয় কীভাবে?’ তিনি বলেন, এ কারণে গম ক্রয় বন্ধ আছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরই ক্রয় অভিযান শুরু করবেন বলেও জানান সাংসদ।
সাংসদের অভিযোগের জবাবে আবদুল খালেক বলেন, ‘আমি গমের স্লিপ দিয়েছি কৃষককে। এখন গম ক্রয় বন্ধ হলেও আগের সিন্ডিকেটের একচ্ছত্র অবস্থা ভাঙা গেছে। এটা একটা জয়।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এত দিন এমপি মকবুল গুদামে গম দিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসা হাতছাড়া হওয়ায় এখন তিনি প্রলাপ বকছেন।’ খালেক বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেট বা নেতার মাধ্যমে নয়, গাংনীতে গম সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে নিতে হবে।
জেলা গম ক্রয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহেরপুরে কৃষকের গম নেতারা দিচ্ছেন—এ অভিযোগ অনেকটাই সত্য। প্রশাসন চেষ্টা করেছিল কিছুটা স্বচ্ছতা আনার। কিন্তু সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এখন কৃষকের ঘরে গম নেই। ফলে, যে গম সরকারি গুদামে ঢুকছে, তা কৃষকের নয়। কৃষকের জন্য সরকারের নেওয়া উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে বলা যায়।’
ইতিমধ্যে গাংনীতে গম সরবরাহ নিয়ে স্থানীয় সাংসদ মকবুল হোসেন এবং দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, গুলি এবং দলীয় অফিস ও সাংসদের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে গম ক্রয় বন্ধ আছে এক মাস ধরে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাংনী খাদ্যগুদামের বাইরে গমের স্তূপ পড়ে আছে। রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে তা নষ্ট হচ্ছে। সরবরাহকারীদের পাহারাদার তোজাম আলী, পল্টু হোসেনসহ কয়েকজন প্রথম আলোকে জানান, স্তূপকৃত গমের মধ্যে গাংনী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুজিরুল ইসলামের ২০০ টন, পৌর আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের ১০০ টন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেকের ২৭ টন গম রয়েছে।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, মেহেরপুর সদরে (সদর ও মুজিবনগর) সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টন এবং গাংনী উপজেলায় ৩ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন গম কেনার জন্য বরাদ্দ এসেছে। প্রতি কেজি গমের সরবরাহমূল্য ধরা হয়েছে ২৮ টাকা। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে এই গম কেনার কথা। গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুনের মধ্যে গম সংগ্রহ করার কথা।
তিন খাদ্যগুদাম সূত্রে জানা গেছে, ১৬ জুন পর্যন্ত মেহেরপুর সদরে ৬২১ জন কৃষকের নামে ১ হাজার ৮৪৫ মেট্রিক টন গম সরবরাহ হয়েছে। আমঝুপিতে ৫৫৩ কৃষকের নামে ১ হাজার ২১৪ মেট্রিক টন এবং গাংনীতে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২২০ কৃষকের নামে ৬২৮ মেট্রিক টন গম সরবরাহ করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অফিস সূত্র জানান, জেলায় ১ লাখ ৪৬ হাজার ২০০ কৃষি প্রণোদনা সহায়তাপ্রাপ্ত কৃষক রয়েছেন। কেবল তাঁরাই সরকারি মূল্যে সরাসরি খাদ্যগুদামে গম বিক্রির সুযোগ পাওয়ার কথা। একজন কৃষক তিন টন গম দিতে পারবেন। এর মধ্যে দেড় হাজার কার্ডধারী কৃষকের নামে গুদামে গম সরবরাহ হয়েছে।
স্থানীয় কৃষক ও আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশ দাবি করেছে, সরকারিভাবে গম সংগ্রহ অভিযান শুরুর আগেই কৃষক তাঁর উৎপাদিত গম খোলা এবং পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন দলের কিছু নেতা বাজার থেকে ১২-১৪ টাকা কেজি দরে নিম্নমানের গম কিনে কৃষকের কার্ড সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে ২৮ টাকা কেজি দরে গুদামে সরবরাহ করছেন। এতে তাঁরা প্রায় আট কোটি টাকার মতো লাভ করছেন।
সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের গমচাষি মসলেম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কৃষি বিভাগের তালিকাভুক্ত চাষি। এবার ৩৫ বিঘা জমিতে গম চাষ করেছিলেন। কোনো বছরই সরকারি গুদামে সরাসরি গম বিক্রির সুযোগ পাননি তিনি। তাই গম তোলার পরপর মার্চ মাসের শেষের দিকে সব খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।
একই কথা বললেন ওই গ্রামের হায়াত আলী। তিনি জানান, তাঁর ১৩ বিঘা জমিতে গম ছিল। তিনিও দুই মাস আগে গম বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখানকার কৃষকের ঘরে কোনো গম নেই বলে দাবি করেন তিনি।
বারাদী গ্রামের কৃষক তাহাজুদ্দিন আহমেদ তিন টন গম সরবরাহ করেছেন বলে সরকারি খাদ্যগুদামের রেজিস্টারে লেখা আছে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সরকারি গুদামে কোনো গম দিইনি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গমচাষি বলেন, একজন প্রভাবশালী নেতা মুঠোফোনে কৃষক কার্ড চাইলে তিনি গিয়ে দিয়ে এসেছেন। এর জন্য তিনি ৫০০ টাকা পেয়েছেন। তাঁর পরিচিত কার্ডধারী আরও কয়েকজন কৃষকও একইভাবে ওই নেতাকে কার্ড দিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার অভিযোগ, মেহেরপুর পৌর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামিউল বশিরার স্বামী আনারুল ইসলাম ১০ টন, মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের মেম্বার খোকন মণ্ডল ৮ মেট্রিক টন গম সরবরাহ করছেন। কিন্তু এঁরা কেউই কৃষক নন। তাঁরা ২০০-৫০০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের কাছ থেকে কার্ড সংগ্রহ করে গুদামে গম দিচ্ছেন। অভিযুক্তদের দাবি, তাঁরা কোনো গম গুদামে দেননি। গমের স্লিপ দিয়েছেন কৃষককে।
জেলা যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদুল আনাম বলেন, কৃষকের গম নিয়ে কতিপয় নেতা কোটি টাকার দুর্নীতি করছেন। এর প্রতিবাদে জেলা যুবলীগ ৯ মে শহরে মিছিল করেছিল।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মান্নান জানান, গম নিয়ে মেহেরপুর ও গাংনীতে চার কোটি টাকা করে আট কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন দলের কতিপয় নেতা। তিনি গম নিয়ে চলমান এ দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেন।
সদরে গম ক্রয়ে দুর্নীতির পেছনে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাসকে দায়ী করে দলের একাংশ।
জবাবে আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস বলেন, মেহেরপুরে স্বচ্ছতার সঙ্গেই কৃষকের কাছ থেকে গম নেওয়া হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত কিছু নেতা এই নিয়ে অভিযোগ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা করছেন। তিনি জানান, কৃষক বাছাইয়ের কাজ করছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা।
জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গম কৃষক না নেতারা দিচ্ছেন, কীভাবে দিচ্ছেন—সবই আপনারা জানেন। খাদ্যগুদামের কর্মীরা কৃষক-কার্ড দেখে গম নিচ্ছে। সেই কার্ডের মালিককে তা খোঁজার এখতিয়ার তাদের নেই।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি চেয়ারে বসে অনেক কথাই বলা যায় না। যত দিন নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হবে, তত দিন কৃষকের জন্য সরকারের নেওয়া কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।’
গম সরবরাহ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে রেষারেষির সূত্রপাত সম্পর্কে গাংনীর একাধিক গম ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের নেতা জানান, গত সাত বছর স্থানীয় সাংসদ মকবুল হোসেনের পক্ষে গাংনী যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুজিরুল ইসলাম গম সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক এবং স্থানীয় মহিলা সাংসদ সেলিনা আক্তার বানু ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে কর্মীদের গম সরবরাহে অংশ নেওয়ার নির্দেশ দেন। সাংসদের পাশাপাশি আবদুল খালেকও গমের স্লিপ দিতে শুরু করেন। খালেকের পক্ষে সিন্ডিকেট প্রধান হন গাংনী পৌর যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক (বর্তমানে কারাবন্দী) ভেন্ডার আশরাফুল ইসলাম।
একপর্যায়ে ১৮ এপ্রিল দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই দিন সাংসদ-সমর্থক গাংনী বামুন্দী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হবিবুর রহমান ওরফে হবিসহ কয়েকজন গাংনী খাদ্য পরিদর্শক জামাত আলীকে মারধর করেন। ওই ঘটনায় হবিসহ দুজনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়। ওই দিন থেকেই গাংনীতে গম সংগ্রহ অভিযান বন্ধ আছে।
এ ব্যাপারে সাংসদ মকবুল হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘গম কৃষকই দেয়। মুজিরুল মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। এবার দলের নতুন জেলা সেক্রেটারি হয়েছেন গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সেক্রেটারি আবদুল খালেক। তিনি শুধু গমের দায়িত্ব নয়, এখন এমপির দায়িত্ব ও ক্ষমতাটাও কেড়ে নিতে চান। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মহিলা এমপি।’ সাংসদের প্রশ্ন, ‘খালেক গমের স্লিপ দেয় কীভাবে? সেই স্লিপে গম ক্রয় হয় কীভাবে?’ তিনি বলেন, এ কারণে গম ক্রয় বন্ধ আছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরই ক্রয় অভিযান শুরু করবেন বলেও জানান সাংসদ।
সাংসদের অভিযোগের জবাবে আবদুল খালেক বলেন, ‘আমি গমের স্লিপ দিয়েছি কৃষককে। এখন গম ক্রয় বন্ধ হলেও আগের সিন্ডিকেটের একচ্ছত্র অবস্থা ভাঙা গেছে। এটা একটা জয়।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এত দিন এমপি মকবুল গুদামে গম দিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসা হাতছাড়া হওয়ায় এখন তিনি প্রলাপ বকছেন।’ খালেক বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেট বা নেতার মাধ্যমে নয়, গাংনীতে গম সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে নিতে হবে।
জেলা গম ক্রয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেহেরপুরে কৃষকের গম নেতারা দিচ্ছেন—এ অভিযোগ অনেকটাই সত্য। প্রশাসন চেষ্টা করেছিল কিছুটা স্বচ্ছতা আনার। কিন্তু সম্ভব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘এখন কৃষকের ঘরে গম নেই। ফলে, যে গম সরকারি গুদামে ঢুকছে, তা কৃষকের নয়। কৃষকের জন্য সরকারের নেওয়া উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে বলা যায়।’
No comments