সেই সব হতভাগ্যের উপকথা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বই
ও পত্রপত্রিকা পড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানা যায়। তবে পথ চলতে গিয়ে
চোখে দেখে ও কানে শুনে আমরা যা জানি, তার মূল্যও বই পড়া বিদ্যার চেয়ে কম
নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্ধুকে যে সাড়ে তেইশ শ কোটি ডলার জমা পড়েছে, তার মধ্যে সাড়ে বারো শ কোটি পাঠিয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। ওই অর্থ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা পাঠাননি, সরকারি কর্মকর্তারা পাঠাননি, সংসদ সদস্যরাও পাঠাননি, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখকেরাও পাঠাননি। পাঠিয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা পরিবার-পরিজন ফেলে বিদেশ-বিভুঁইতে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রিয়াল-দিনার রোজগার করেন। সেই হতভাগ্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? কেমন ব্যবহার তাঁরা পান রাষ্ট্রের বেতন-ভাতাভোগী লোকদের থেকে? সেই ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
আমি কলকাতা যাচ্ছিলাম বইমেলায়। সেখানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আমার একটি প্রবন্ধ পাঠ করার আমন্ত্রণ। যানজটের কবলে না পড়ায় যথাসময়ের অনেক আগেই গিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন সেরে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে গিয়ে বসি। পুলিশ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যথেষ্ট খাতির করেন। এর মধ্যে সৌদি এয়ারলাইনসের যাত্রীদের নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হওয়ার ডাক আসে। দুই-তিন শ মানুষ হুড়মুড় করে সেদিকে ধাবিত হয়। কিছুসংখ্যক কলকাতার যাত্রী ছাড়া বসার জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। চুপচাপ বসে আছি। মিনিট ২০-২৫ পরে একজন যাত্রী, অতি মলিন তাঁর বস্ত্র, নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মনে হলো মানুষটি মৃত, অদৃশ্য কেউ তাঁকে দুই পাশ থেকে ধরে খাড়া করে রেখেছে। তাঁর হাতে পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস। বোর্ডিং পাস নয়, যেন ফাঁসির আসামির মৃত্যুর পরোয়ানা। মরে গিয়ে বেঁচে থাকা লোকটি বললেন, ‘আমারে যাইতে দিল না, আমার প্লেন নাকি আগামীকাইল বিকালে। এহন আমি কী করুম?’
এ দেশে কোনো ব্যাপারেই অবাক হওয়া ঠিক না, তবু অবাক হয়ে বললাম, ‘সে কী কথা? দেখি আপনার বোর্ডিং পাস?’
বোর্ডিং পাস নেড়েচেড়ে দেখি সবই ঠিকঠাক। তবু কেন যেতে পারলেন না, তা জানতে তাঁকে কর্মকর্তাদের কাছে যেতে বলি। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়। তিনি কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবে শ্রমিকের কাজ করছেন। মাস দুয়েকের ছুটিতে এসেছিলেন। আগামীকাল তাঁর কাজে যোগ দেওয়ার শেষ তারিখ। কাল নয়টায় কাজে যোগ না দিলে তাঁর চাকরি থাকবে না। অথচ বিমানবন্দর কর্মকর্তারা তাঁকে প্লেনে ওঠার আগে সাফ জানিয়ে দিলেন, এ প্লেনটি তাঁর জন্য নয়, তাঁর প্লেন আগামীকাল সন্ধ্যায়।
কর্মকর্তাদের কাছে কী শুনে তিনি যখন ফিরে এলেন, তখন মনে হলো, তিনি দ্বিতীয়বার মারা গেছেন। তাঁকে বসতে বলি এবং অর্থহীন সান্ত্বনা দিই। তিনি বললেন, অফিসার তাঁকে বলেছেন, যেহেতু ইমিগ্রেশন হয়ে গেছে সুতরাং আর কিছুই করার নেই, আগামীকাল প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত তাঁকে বাংলার মাটিতেই থাকতে হবে এবং সে মাটিও মুরাদনগর নয়, এই বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জের চত্বর।
তিনি জানালেন, তাঁর কাছে বাংলাদেশের কোনো টাকা নেই। বললেন, ‘আমি এই দুই দিন খামু কী? আর কাইল কামে যোগ না দিলে চাকরি থাকব কি না ঠিক নাই।’
বললাম, ‘আপনার বাংলাদেশি টাকা থাক বা না থাক, আপনি বিমানবন্দরের মধ্যে দুটি দিন আটকা থাকবেন কেন? আমি আপনাকে সামান্য কিছু টাকা খাবার কিনতে দিতে পারি, কিন্তু কী অপরাধে আপনি এখানে এক রাত এক দিন পচবেন?’
তাঁকে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে যাই। তিনি আমাকে খুব সম্মান দিলেন। আমাকে ও ওই যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বোর্ডিং পাস যাঁরা ইস্যু করেছেন, তাঁদের কাছে গেলেন। অনেক তর্কবিতর্ক হলো। প্রথম দোষটি করেছেন যাত্রীর স্থানীয় দালাল। তিনিই তাঁকে এই ফ্লাইটের কাগজপত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন। মুরাদনগর থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি ঢাকা এসেছেন। তারা তাঁকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় দোষটি করেছে এয়ারলাইনসের লোকেরা। ইমিগ্রেশনের কোনো দোষ নেই। আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করি তাঁকে বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিতে। শেষ পর্যন্ত একটা ফয়সালা হলো, যাত্রী বিমানবন্দরের বাইরে যেতে পারবেন। কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে থাকবেন এবং কাল এসে তাঁর জন্য নির্ধারিত প্লেনে উঠবেন। কিন্তু কেন এই বিড়ম্বনা? এর জন্য কী শাস্তি প্রাপ্য চাকরির দালালদের, কী শাস্তি এয়ারলাইনসের লোকদের?
প্রবাসী শ্রমিকদের বিড়ম্বনার দ্বিতীয় ঘটনাটিতেও আমি জড়িয়ে পড়ি। তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম ঢাকাগামী টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের জন্য। অনেক বাংলাদেশি ছিলেন। এমন সময় দেখি বিমানবন্দর কর্মচারীদের পাহারায় মলিন বস্ত্র পরা জনা সাতেক বঙ্গসন্তানের একটি দল। সবার বয়সই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। বাড়ি গোপালগঞ্জ-শরীয়তপুরের দিকে। সবারই ভেতরে কান্না, কিন্তু চোখে পানি নেই। দুঃখ ও হতাশার আগুনে সে পানি শুকিয়ে গেছে।
আমাকে চিনতে পেরে তরুণেরা ঘিরে ধরলেন। বললেন তাঁদের করুণ কাহিনি। স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। অনেকে শুধু নামটা সই করতে পারেন। তাঁদের গন্তব্য স্পেনে। প্রথম বিমানযাত্রা। স্থাবর-অস্থাবর অনেক কিছু বিক্রি করে বিদেশে চাকরির লোভে তাঁরা যাত্রা করেছেন। লাখ দু-আড়াই টাকা প্রত্যেকের থেকে নিয়ে দালালেরা একটি টিকিট ধরিয়ে দিয়েছে। ওই দিন সকালের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে তাঁরা মহা আনন্দে উড়োজাহাজে ওঠেন এবং ফুর্তিতে গল্পগুজব করতে করতে অপরাহ্ণে ইস্তাম্বুল পৌঁছান। সন্ধ্যায় তাঁদের মাদ্রিদগামী ফ্লাইট। কোনো বাঙালির সহযোগিতায় তাঁরা বোর্ডিং পাস নিতে যখন কাউন্টারে যান, তখন তাঁদের মাথায় বাজ পড়ে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে পৃথিবীর আর কোনো বিমানবন্দর অথবা আরশের কোনো ঠিকানায় যাওয়ার তাঁদের জন্য কোনো টিকিট বুকিং বা কনফারমেশন নেই। সুতরাং তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পরবর্তী ফ্লাইটে বঙ্গসন্তানদের বাংলার মাটিতে ফিরে যেতে হবে। তাঁদের পাকড়াও করে ঢাকাগামী ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস দিয়ে সিকিউরিটি চেকের লাইনে নিয়ে এসেছে।
ঢাকা বিমানবন্দরে যেটুকু হোক প্রভাব খাটাতে পারি, অন্য দেশে কে পোঁছে। তবু কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা জানতে গেলাম। তাঁরা বেশি বাক্য ব্যয় করার পাত্র নন। যে ব্যাখ্যা দিলেন তার সোজা অর্থ, আমাদের ভাষায় বলতে গেলে দাঁড়ায়, বাটপারের পাল্লায় পড়ে ওই লোকগুলো আমাদের বিমানে এসেছেন, শুধু ইস্তাম্বুল পর্যন্তই তাঁদের টিকিট কাটা আছে। এখন তাঁরা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।
এখন দেশে ফিরে তাঁরা কী করবেন? তাঁরা আমার সহযোগিতা চান। আমার কী সাধ্য যে আমি তাঁদের সাহায্য করি? তাঁদের করুণ মুখ দেখে ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হই। ঢাকায় নেমে তাঁদের আদম ব্যাপারীর অফিসে ফোন করি। তাদের অফিস বনানী। আমার ফোন পেয়ে একজন খেঁকিয়ে ওঠে। তার দাবি, তারা ঠিকই নিয়োগপত্র ও টিকিট করে দিয়েছে। তাদের আর কিছু করার নেই। ওই লোকগুলো যদি যেতে না পারেন তাঁদের গন্তব্যে, সে দোষ তাঁদের।
রাতের ফ্লাইটে ভ্রমণে ঘুমাতে না পেরে আমিও ক্লান্ত ছিলাম। মেজাজ ভালো ছিল না। আদম ব্যাপারীকে বললাম, এঁদের থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আপনি আপনার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন। আপনাকে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। আমি এই লোকগুলোকে নিয়ে প্রেসক্লাবে যাচ্ছি, সেখানে তাঁদের বসিয়ে রেখে আমি মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের অফিসে যাব। যা করার সাংবাদিকেরা ও পুলিশই করবে। আপনি আমাকে এই ফোন নম্বরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানান আপনার কিছু করণীয় আছে কি না!
তিন মিনিটের মধ্যেই ফোন আসে। তিনি বলেন, ‘ঝামেলায় ফ্যালাইলেন। হেগো আমাগো অফিসে পাঠাইয়া দেন।’
দিন দুই অশেষ কষ্ট ভোগের পর ওই শ্রমিকেরা আবার গিয়ে প্লেনে উঠতে পারেন এবং ধারণা করি, তাঁরা সহিসালামতে যেখানে যাওয়ার, সেখানে যেতে পেরেছেন।
কিন্তু কেন অমন হলো? কেন মানুষগুলোর অমন ভোগান্তি? কার দোষে এমনটি হলো?
কেউ বলবেন দোষ ওই লোকগুলোর। কেউ বলবেন রিক্রুটিং এজেন্সির। কেউ বলবেন এয়ারলাইনসের। কেউ সমস্ত দোষ এক ধাক্কায় সরকারের দিকে ঠেলে দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করে দেবেন।
আমি বলব, আসল দোষ বাংলার মানুষের কপালের। এই কপালে হাতুড়ি ঠুকলেও তা ভালো করা যাবে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা বলে গেছেন, কপালগুণে গোপাল মেলে। কপালগুণেই আমাদের শ্রমিকেরা এ-জাতীয় রিক্রুটিং এজেন্ট পান। আমাদের সব সরকারই আমরা পেয়ে থাকি কপালের গুণেই। আমাদের কর্মকর্তারাও আমাদের কপালেরই ফল। কপালগুণেই আমরা পেয়েছি একটা এয়ারলাইনস। কপালের গুণেই আছে আমাদের এক বা একাধিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দর কোনো তামাশার জায়গা নয়। গাবতলী বা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল আর দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এক রকম হতে পারে না। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল আর বিমানবন্দর এক জিনিস নয়। কোনো দেশের জাতীয় এয়ারলাইনস আর আল হিকমত সিটিং সার্ভিস বাস কোম্পানি এক জিনিস নয়। যে দেশের এক কোটির মতো শ্রমিক বিদেশে যাতায়াত করেন, তাঁদের এয়ারলাইনস লোকসানে চলে কেন? কেন তেমন বিধান নেই যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের আসা-যাওয়ায় অন্তত একবার বিমানে ভ্রমণ বাধ্যতামূলক? অন্য দেশের বিমান কোম্পানি চুটিয়ে ব্যবসা করবে আর আমাদের বিমান লোকসান দেবে ও দুর্নীতি করবে? কোনো দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাঁরা কর্মরত, তাঁরা সমগ্র দেশের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের আচার-আচরণ, চালচলন দেখে বিদেশিরা বুঝতে পারেন, এই দেশের মানুষের স্বভাবচরিত্র এ রকম। আমি পৃথিবীর যে পঁচিশ-ত্রিশটি বিমানবন্দরে গেছি, সেগুলোর সঙ্গে আমাদেরটির পার্থক্য প্রচুর।
আমাদের বিদেশগামী শ্রমিকেরা অনেকেই নিরক্ষর অথবা সামান্যই লেখাপড়া জানেন। যাতায়াতের সময় বিমানবন্দরে তাঁরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, তার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা আমাদের বিমানবন্দরে নেই। শিক্ষিত বেকারে গিজগিজ করছে দেশ। বিদেশগামী শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রতি বেলায় কয়েকজন যুবক-যুবতীকে কি নিয়োগ দেওয়া যায় না? তাতে বেকারত্বও দূর হয়, প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশারও লাঘব হয়।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানো এবং অবৈধ অভিবাসী পাচার প্রভৃতি নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টির দিকে অবিলম্বে নজর না দিলে শুধু ভাবমূর্তির ক্ষতি নয়, অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্ধুকে যে সাড়ে তেইশ শ কোটি ডলার জমা পড়েছে, তার মধ্যে সাড়ে বারো শ কোটি পাঠিয়েছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। ওই অর্থ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা পাঠাননি, সরকারি কর্মকর্তারা পাঠাননি, সংসদ সদস্যরাও পাঠাননি, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখকেরাও পাঠাননি। পাঠিয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা পরিবার-পরিজন ফেলে বিদেশ-বিভুঁইতে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রিয়াল-দিনার রোজগার করেন। সেই হতভাগ্যদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? কেমন ব্যবহার তাঁরা পান রাষ্ট্রের বেতন-ভাতাভোগী লোকদের থেকে? সেই ভাগ্যহীনদের সম্পর্কে দুটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই।
আমি কলকাতা যাচ্ছিলাম বইমেলায়। সেখানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আমার একটি প্রবন্ধ পাঠ করার আমন্ত্রণ। যানজটের কবলে না পড়ায় যথাসময়ের অনেক আগেই গিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাই। বোর্ডিং পাস ও ইমিগ্রেশন সেরে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জে গিয়ে বসি। পুলিশ ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যথেষ্ট খাতির করেন। এর মধ্যে সৌদি এয়ারলাইনসের যাত্রীদের নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হওয়ার ডাক আসে। দুই-তিন শ মানুষ হুড়মুড় করে সেদিকে ধাবিত হয়। কিছুসংখ্যক কলকাতার যাত্রী ছাড়া বসার জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। চুপচাপ বসে আছি। মিনিট ২০-২৫ পরে একজন যাত্রী, অতি মলিন তাঁর বস্ত্র, নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মনে হলো মানুষটি মৃত, অদৃশ্য কেউ তাঁকে দুই পাশ থেকে ধরে খাড়া করে রেখেছে। তাঁর হাতে পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস। বোর্ডিং পাস নয়, যেন ফাঁসির আসামির মৃত্যুর পরোয়ানা। মরে গিয়ে বেঁচে থাকা লোকটি বললেন, ‘আমারে যাইতে দিল না, আমার প্লেন নাকি আগামীকাইল বিকালে। এহন আমি কী করুম?’
এ দেশে কোনো ব্যাপারেই অবাক হওয়া ঠিক না, তবু অবাক হয়ে বললাম, ‘সে কী কথা? দেখি আপনার বোর্ডিং পাস?’
বোর্ডিং পাস নেড়েচেড়ে দেখি সবই ঠিকঠাক। তবু কেন যেতে পারলেন না, তা জানতে তাঁকে কর্মকর্তাদের কাছে যেতে বলি। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়। তিনি কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবে শ্রমিকের কাজ করছেন। মাস দুয়েকের ছুটিতে এসেছিলেন। আগামীকাল তাঁর কাজে যোগ দেওয়ার শেষ তারিখ। কাল নয়টায় কাজে যোগ না দিলে তাঁর চাকরি থাকবে না। অথচ বিমানবন্দর কর্মকর্তারা তাঁকে প্লেনে ওঠার আগে সাফ জানিয়ে দিলেন, এ প্লেনটি তাঁর জন্য নয়, তাঁর প্লেন আগামীকাল সন্ধ্যায়।
কর্মকর্তাদের কাছে কী শুনে তিনি যখন ফিরে এলেন, তখন মনে হলো, তিনি দ্বিতীয়বার মারা গেছেন। তাঁকে বসতে বলি এবং অর্থহীন সান্ত্বনা দিই। তিনি বললেন, অফিসার তাঁকে বলেছেন, যেহেতু ইমিগ্রেশন হয়ে গেছে সুতরাং আর কিছুই করার নেই, আগামীকাল প্লেনে ওঠার আগ পর্যন্ত তাঁকে বাংলার মাটিতেই থাকতে হবে এবং সে মাটিও মুরাদনগর নয়, এই বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জের চত্বর।
তিনি জানালেন, তাঁর কাছে বাংলাদেশের কোনো টাকা নেই। বললেন, ‘আমি এই দুই দিন খামু কী? আর কাইল কামে যোগ না দিলে চাকরি থাকব কি না ঠিক নাই।’
বললাম, ‘আপনার বাংলাদেশি টাকা থাক বা না থাক, আপনি বিমানবন্দরের মধ্যে দুটি দিন আটকা থাকবেন কেন? আমি আপনাকে সামান্য কিছু টাকা খাবার কিনতে দিতে পারি, কিন্তু কী অপরাধে আপনি এখানে এক রাত এক দিন পচবেন?’
তাঁকে নিয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে যাই। তিনি আমাকে খুব সম্মান দিলেন। আমাকে ও ওই যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বোর্ডিং পাস যাঁরা ইস্যু করেছেন, তাঁদের কাছে গেলেন। অনেক তর্কবিতর্ক হলো। প্রথম দোষটি করেছেন যাত্রীর স্থানীয় দালাল। তিনিই তাঁকে এই ফ্লাইটের কাগজপত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন। মুরাদনগর থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি ঢাকা এসেছেন। তারা তাঁকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় দোষটি করেছে এয়ারলাইনসের লোকেরা। ইমিগ্রেশনের কোনো দোষ নেই। আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করি তাঁকে বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিতে। শেষ পর্যন্ত একটা ফয়সালা হলো, যাত্রী বিমানবন্দরের বাইরে যেতে পারবেন। কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে থাকবেন এবং কাল এসে তাঁর জন্য নির্ধারিত প্লেনে উঠবেন। কিন্তু কেন এই বিড়ম্বনা? এর জন্য কী শাস্তি প্রাপ্য চাকরির দালালদের, কী শাস্তি এয়ারলাইনসের লোকদের?
প্রবাসী শ্রমিকদের বিড়ম্বনার দ্বিতীয় ঘটনাটিতেও আমি জড়িয়ে পড়ি। তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম ঢাকাগামী টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের জন্য। অনেক বাংলাদেশি ছিলেন। এমন সময় দেখি বিমানবন্দর কর্মচারীদের পাহারায় মলিন বস্ত্র পরা জনা সাতেক বঙ্গসন্তানের একটি দল। সবার বয়সই ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। বাড়ি গোপালগঞ্জ-শরীয়তপুরের দিকে। সবারই ভেতরে কান্না, কিন্তু চোখে পানি নেই। দুঃখ ও হতাশার আগুনে সে পানি শুকিয়ে গেছে।
আমাকে চিনতে পেরে তরুণেরা ঘিরে ধরলেন। বললেন তাঁদের করুণ কাহিনি। স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ার সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি। অনেকে শুধু নামটা সই করতে পারেন। তাঁদের গন্তব্য স্পেনে। প্রথম বিমানযাত্রা। স্থাবর-অস্থাবর অনেক কিছু বিক্রি করে বিদেশে চাকরির লোভে তাঁরা যাত্রা করেছেন। লাখ দু-আড়াই টাকা প্রত্যেকের থেকে নিয়ে দালালেরা একটি টিকিট ধরিয়ে দিয়েছে। ওই দিন সকালের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে তাঁরা মহা আনন্দে উড়োজাহাজে ওঠেন এবং ফুর্তিতে গল্পগুজব করতে করতে অপরাহ্ণে ইস্তাম্বুল পৌঁছান। সন্ধ্যায় তাঁদের মাদ্রিদগামী ফ্লাইট। কোনো বাঙালির সহযোগিতায় তাঁরা বোর্ডিং পাস নিতে যখন কাউন্টারে যান, তখন তাঁদের মাথায় বাজ পড়ে। ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকে পৃথিবীর আর কোনো বিমানবন্দর অথবা আরশের কোনো ঠিকানায় যাওয়ার তাঁদের জন্য কোনো টিকিট বুকিং বা কনফারমেশন নেই। সুতরাং তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, পরবর্তী ফ্লাইটে বঙ্গসন্তানদের বাংলার মাটিতে ফিরে যেতে হবে। তাঁদের পাকড়াও করে ঢাকাগামী ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস দিয়ে সিকিউরিটি চেকের লাইনে নিয়ে এসেছে।
ঢাকা বিমানবন্দরে যেটুকু হোক প্রভাব খাটাতে পারি, অন্য দেশে কে পোঁছে। তবু কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা জানতে গেলাম। তাঁরা বেশি বাক্য ব্যয় করার পাত্র নন। যে ব্যাখ্যা দিলেন তার সোজা অর্থ, আমাদের ভাষায় বলতে গেলে দাঁড়ায়, বাটপারের পাল্লায় পড়ে ওই লোকগুলো আমাদের বিমানে এসেছেন, শুধু ইস্তাম্বুল পর্যন্তই তাঁদের টিকিট কাটা আছে। এখন তাঁরা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।
এখন দেশে ফিরে তাঁরা কী করবেন? তাঁরা আমার সহযোগিতা চান। আমার কী সাধ্য যে আমি তাঁদের সাহায্য করি? তাঁদের করুণ মুখ দেখে ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হই। ঢাকায় নেমে তাঁদের আদম ব্যাপারীর অফিসে ফোন করি। তাদের অফিস বনানী। আমার ফোন পেয়ে একজন খেঁকিয়ে ওঠে। তার দাবি, তারা ঠিকই নিয়োগপত্র ও টিকিট করে দিয়েছে। তাদের আর কিছু করার নেই। ওই লোকগুলো যদি যেতে না পারেন তাঁদের গন্তব্যে, সে দোষ তাঁদের।
রাতের ফ্লাইটে ভ্রমণে ঘুমাতে না পেরে আমিও ক্লান্ত ছিলাম। মেজাজ ভালো ছিল না। আদম ব্যাপারীকে বললাম, এঁদের থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আপনি আপনার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন। আপনাকে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। আমি এই লোকগুলোকে নিয়ে প্রেসক্লাবে যাচ্ছি, সেখানে তাঁদের বসিয়ে রেখে আমি মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের অফিসে যাব। যা করার সাংবাদিকেরা ও পুলিশই করবে। আপনি আমাকে এই ফোন নম্বরে পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানান আপনার কিছু করণীয় আছে কি না!
তিন মিনিটের মধ্যেই ফোন আসে। তিনি বলেন, ‘ঝামেলায় ফ্যালাইলেন। হেগো আমাগো অফিসে পাঠাইয়া দেন।’
দিন দুই অশেষ কষ্ট ভোগের পর ওই শ্রমিকেরা আবার গিয়ে প্লেনে উঠতে পারেন এবং ধারণা করি, তাঁরা সহিসালামতে যেখানে যাওয়ার, সেখানে যেতে পেরেছেন।
কিন্তু কেন অমন হলো? কেন মানুষগুলোর অমন ভোগান্তি? কার দোষে এমনটি হলো?
কেউ বলবেন দোষ ওই লোকগুলোর। কেউ বলবেন রিক্রুটিং এজেন্সির। কেউ বলবেন এয়ারলাইনসের। কেউ সমস্ত দোষ এক ধাক্কায় সরকারের দিকে ঠেলে দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করে দেবেন।
আমি বলব, আসল দোষ বাংলার মানুষের কপালের। এই কপালে হাতুড়ি ঠুকলেও তা ভালো করা যাবে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা বলে গেছেন, কপালগুণে গোপাল মেলে। কপালগুণেই আমাদের শ্রমিকেরা এ-জাতীয় রিক্রুটিং এজেন্ট পান। আমাদের সব সরকারই আমরা পেয়ে থাকি কপালের গুণেই। আমাদের কর্মকর্তারাও আমাদের কপালেরই ফল। কপালগুণেই আমরা পেয়েছি একটা এয়ারলাইনস। কপালের গুণেই আছে আমাদের এক বা একাধিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিমানবন্দর কোনো তামাশার জায়গা নয়। গাবতলী বা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল আর দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এক রকম হতে পারে না। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল আর বিমানবন্দর এক জিনিস নয়। কোনো দেশের জাতীয় এয়ারলাইনস আর আল হিকমত সিটিং সার্ভিস বাস কোম্পানি এক জিনিস নয়। যে দেশের এক কোটির মতো শ্রমিক বিদেশে যাতায়াত করেন, তাঁদের এয়ারলাইনস লোকসানে চলে কেন? কেন তেমন বিধান নেই যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের আসা-যাওয়ায় অন্তত একবার বিমানে ভ্রমণ বাধ্যতামূলক? অন্য দেশের বিমান কোম্পানি চুটিয়ে ব্যবসা করবে আর আমাদের বিমান লোকসান দেবে ও দুর্নীতি করবে? কোনো দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাঁরা কর্মরত, তাঁরা সমগ্র দেশের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁদের আচার-আচরণ, চালচলন দেখে বিদেশিরা বুঝতে পারেন, এই দেশের মানুষের স্বভাবচরিত্র এ রকম। আমি পৃথিবীর যে পঁচিশ-ত্রিশটি বিমানবন্দরে গেছি, সেগুলোর সঙ্গে আমাদেরটির পার্থক্য প্রচুর।
আমাদের বিদেশগামী শ্রমিকেরা অনেকেই নিরক্ষর অথবা সামান্যই লেখাপড়া জানেন। যাতায়াতের সময় বিমানবন্দরে তাঁরা যাতে অসুবিধায় না পড়েন, তার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা আমাদের বিমানবন্দরে নেই। শিক্ষিত বেকারে গিজগিজ করছে দেশ। বিদেশগামী শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার জন্য প্রতি বেলায় কয়েকজন যুবক-যুবতীকে কি নিয়োগ দেওয়া যায় না? তাতে বেকারত্বও দূর হয়, প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশারও লাঘব হয়।
বিদেশে শ্রমিক পাঠানো এবং অবৈধ অভিবাসী পাচার প্রভৃতি নিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে। বিষয়টির দিকে অবিলম্বে নজর না দিলে শুধু ভাবমূর্তির ক্ষতি নয়, অর্থনীতিরও ক্ষতি হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments