নির্বাচনই শান্তির নতুন বাতাবরণ by সৈয়দ আবদাল আহমদ
বাংলাদেশে
এ মুহূর্তে একটি নির্বাচনই বসন্ত এনে দিতে পারে। বন্ধ করতে পারে
অবরোধ-হরতাল, পেট্রলবোমা, গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সব বিভীষিকা।
একটি নির্বাচনই সঙ্কট সুরাহা করে বইয়ে দিতে পারে শান্তির নতুন বাতাবরণ।
এমন একটি নির্বাচন কতদূর? না, এমন নির্বাচনের গন্তব্য সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তেও এক চিলতে আলো দেখা যাচ্ছে না। তবে এক নিমিষে আলো ছড়িয়ে দিতে পারেন রাজনীতির দুই নেত্রী। শুধু প্রয়োজন দু’জনের আন্তরিকতা। এই একটি বিষয়ে প্রয়োজন দু’জনের এককণ্ঠ, ঐকমত্য। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বলতে পারেনÑ আসুন নির্বাচন হবে, সংলাপে বসি। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যদি বলতে পারেনÑ ঠিক আছে, অবরোধ হরতাল আর হবে না। তাহলেই আর কোনো সমস্যা থাকে না।
শেখ হাসিনা তার অবস্থানে এখনো অনড়। তিনি কিছুতেই সংলাপ চান না। খালেদা জিয়া অবশ্য তার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। সঙ্কটের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান হোক, তা তিনি চাচ্ছেন। ১৩ মার্চ গুলশান কার্যালয়ে তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করেন তাতে সে ইঙ্গিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন তার সংবাদ সম্মেলনে নতুন কিছু নেই। সেটা ঠিক নয়। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কঠোর অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছেন। ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে তার আপত্তি নেই। তেমনি বর্তমান দশম সংসদকে তথাকথিত বললেও সেই সংসদে একতরফা পঞ্চদশ সংশোধনী সরকার বাতিলও করে দিতে পারে এবং ১৯৯৬ সালের মতো নতুন সংবিধান সংশোধন বিলও আনতে পারে বলে তিনি মত দিয়েছেন। চলমান অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু না বললেও ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে উদযাপনের আশাও তিনি করেছেন।
খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, আজকের সঙ্কট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সঙ্কট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাক্সিত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। উপায় হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি পথ দেখিয়েছেন। বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই সঙ্কটের সুরাহা হবে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যদি কোনো আলোচনা করতে না চায়, তাহলে তারা এককভাবেও সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারে। আর তা হচ্ছে তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন এখন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে তা একতরফাভাবে ওই সংসদে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে আর সঙ্কট থাকবে না। শেখ হাসিনা সরকারের জন্য উদার হওয়ার অনেকটা সুযোগ এসেছে। সরকার জেদ পরিহার করে উদারতা দেখাতে পারলে সত্যিই বিপদ কেটে যায়।
বিষয়টি এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আলোচনা কি আকাশে হবে? খুনির সাথে কোনো আলোচনা হতে পারে না। একই দিন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, শান্তির পরিবেশ এলে আলোচনা হলেও হতে পারে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি মনে করেন সঙ্কট আর থাকা উচিত নয়, তাহলে সহজেই বিষয়টির সুরাহা হবে। কারণ শুধু খালেদা জিয়াই নন, গোটা জাতিই মনে করে সঙ্কট সমাধানের চাবিকাঠি শেখ হাসিনার হাতে। তার ইচ্ছার ওপরই সমাধান নির্ভর করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টা সমাধান করলেই হয়।
শেখ হাসিনা তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেছেন। তার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। ইচ্ছা করলেই তিনি সঙ্কটের সমাধানে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। এমন একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন, যাতে দেশে আর কখনো রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি না হয়। এমন একটি জাতীয় সনদ তিনি তৈরির উদ্যোগ নিতে পারেন, যার মধ্যে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে। পাঁচ বছর পর পর ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’Ñ সেøাগানের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটবে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এগিয়ে যাবে।
বর্তমান সঙ্কট যে কারণে
দেশের বর্তমান সঙ্কটের মূলে রয়েছে গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন। জনগণের ভোটের অধিকারকে এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। নির্লজ্জ প্রহসনের অংশ হিসেবে এ নির্বাচনে ভোট ছাড়াই সংসদের ১৫৩টি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। বাকি ১৪৭টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। সেদিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোয় কুকুর-বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য দৈনিক পত্রিকায় প্রধান ছবি হিসেবে ছাপা হয়েছে। প্রচণ্ড সহিংসতাপূর্ণ এ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে নিহত হয়েছেন ১২৩ জন। আর ভোটের দিন সংহিসতায় মারা গেছেন ১৯ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায়নি। ৫৯টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। দেশের জনগণ কোনোভাবেই সেই ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন নির্বাচন মেনে নেয়নি। নির্বাচনে শাসক দলের আজ্ঞাবহ কয়েকটি দল ছাড়া দেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে এবং অর্ধেকের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা দিয়ে এক বিচিত্র সংসদ গঠিত হয়। এ সংসদের বিরোধী দলের সদস্যরা একসাথে বিরোধী দলেও আছে, আবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও আছে।
বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ‘সংবিধানের বাধ্যবাধতার কারণে এটা একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সবার সাথে আলোচনা করে আবার পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন করা হবে।’ অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রধানমন্ত্রীর মতেই ছিল অপূর্ণাঙ্গ, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘ফলাফল শূন্য খেলায় নেমেছেন রাজনীতিকরা’ শীর্ষক তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। সেই রাজনৈতিক সমস্যার উৎস থেকে শাসকগোষ্ঠী দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে বলেই মনে হয়। এক বছর ধরে শাসকেরা নির্বাচনের আগে ভোটারদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে। ওই নির্বাচনের আগে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, জানুয়ারির ওই নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য তারা গ্রহণযোগ্যমূলক মধ্যবর্তী একটি নির্বাচন দেবে। ওই নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সবাই পূর্ণাঙ্গভাবে ওয়াকিবহাল। ... ... আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে নেতৃত্বদানকারী একটি দল। তাদের ঐতিহাসিক রীতির সাথে এ ঘটনা মিলানো যায় না। পরিষ্কার নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার যে প্রবণতা তা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেই। আওয়ামী লীগ যদি তার নিজেকে পিছলে পড়ে যেতে পারে এমন একটি পাহাড়ের ঢালে নিয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র নিজে বিপন্ন হবে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে তাই সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট অর্জনের মাধ্যমে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান করতে এগিয়ে যেতে হবে।’
সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশ
ভুয়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সঙ্কট বর্তমানে দেশকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশ এক প্রকার অচল হয়ে আছে। এক দিকে চলছে প্রতিরোধ আন্দোলন, অবরোধ-হরতাল, অন্য দিকে সরকারি বাহিনীর বন্দুকের গুলিতে সহিংসতায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত আর দগ্ধ মানুষের সারি, সরকারি সব বাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রয়োগ। চলমান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের দমনের নামে সরকারি বাহিনী সরাসরি বুকে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। হত্যার পর সেই পুরনো পন্থায় বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহতের হয়েছে বলে মিথ্যা কল্পকাহিনীর প্রচার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছে বেপরোয়াভাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবেই রাজনৈতিক কর্মীদের গাড়ির নিচে চাপা দিয়ে কিংবা সারা শরীরে অসংখ্য গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তিকে গণপিটুনিতে মৃত বলে দেখানো হচ্ছে। ১৪ মার্চ অবরোধের ৬৮তম দিনে সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ১২১ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ার ‘গণপিটুনি’ তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৩৭ জন (প্রথম আলো)। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া হিসাবেই চলমান সঙ্কটে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এই ভয়াবহ সঙ্কট সমাধানের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
সংলাপ কেন প্রয়োজন
সরকার সমস্যার মূলে না গিয়ে বলপ্রয়োগ করে সমাধান চাচ্ছে। কিন্তু বলপ্রয়োগ কখনই সমস্যার সমাধান নয়। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের সর্বমহল থেকে তাই সঙ্কট সমাধানে দুই রাজনৈতিক পক্ষকে দ্রুত সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাতই করা হচ্ছে না। সরকার একটি ন্যায্য রাজনৈতিক আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ প্রয়াসই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অস্ত্রের ভাষা যে রাজনীতির ভাষা হতে পারে না, সে কথা কিছুতেই তারা বুঝতে চাচ্ছে না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গোটা জাতি তাই চিন্তিত। মানুষের মুক্তি মিলছে না আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে। চার দিকের দমবন্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষের এই শঙ্কা ও দমবন্ধ অবস্থা এবং বিরাজমান ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থা। তারা চরম বৈরী অবস্থান থেকে সরে এসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে উভয়পক্ষকে সঙ্কট নিরসনে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘে বড় বড় বিশ্ব সমস্যার সাথে প্রথম যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের ঘটনায় জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে প্রথমে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন উদ্বেগ জানায়। এরপর জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন বিবৃতির মাধ্যমে উদ্বেগ জানিয়ে দুই পক্ষকে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। উদ্বিগ্ন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সরকারের সাথে সমন্বয়ের জন্য সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়েই তারানকো দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালের সাথে বৈঠক করেন। একই সাথে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সঙ্কট সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠিও দেন। সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সম্প্রতি ওয়াশিংটনে গেলে তার সাথেও বৈঠক করে আবারো সংলাপের আহ্বান জানান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিকের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রায় প্রতিদিনই উঠছে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়েও উঠে আসছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের ঘটনায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও বৈঠক করেন। তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সহযোগিতারও প্রস্তাব করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট বাংলাদেশের অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে শুধু বিবৃতিই দেয়নি, ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেও গেছে। ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেডার নেতৃত্বে তিন সদস্যের এই প্রতিনিধিদল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, মানবাধিকার কমিশন, আইনমন্ত্রী, স্পিকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে ২৬টি বৈঠকে মিলিত হয়। সফর শেষে এক বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানায় ইইউ। বিবৃতিতে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইইউ রাজনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। সুস্পষ্টভাবে বলেছে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে হতে পারে না। বিবৃতিতে বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের তাগিদ
আওয়ামী লীগ বলয়ের বাইরের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে নাগরিক সমাজের উদ্যোগটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শিরোনামে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশনে একটি গোলটেবিল হয়। এই গোলটেবিলে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অংশ নেন। দেশের অবস্থা বর্ণনা করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে শেষ করে দিতে চাইছে। এ গোলটেবিল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনকে সংলাপের শুভ উদ্যোগ নিতে আকুতি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য তাদের কাছে একটি প্রস্তাবও পাঠানো হয়। তারা সংলাপের আহ্বানের পাশাপাশি একটি জাতীয় সনদ তৈরির জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেন। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আরেকটি গোলটেবিল আলোচনা থেকে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠায় সংলাপের আহ্বান জানান। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বরাবরে চিঠি পাঠিয়েও বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে সহযোগিতা কামনা করেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী চলমান সঙ্কট নিরসনে দুই নেত্রী এবং দুই পক্ষকে সংলাপে বসাতে প্রতীকী গণ-অনশন করেন দলের কার্যালয়ে। তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে সংলাপ করতেই হবে। দেশে আজ যা কিছু হচ্ছে তার জন্য দায়ী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন করতে হবে। সে কথা তিনি ভুলে গেছেন। ফলে যে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সংলাপ ছাড়া উত্তরণের উপায় নেই।
গণফোরাম সভাপতি ডক্টর কামাল হোসেন একাধিকবার বলেছেন, সঙ্ঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ২৮ জানুয়ারি থেকে মতিঝিলে দলের অফিসের সামনে ফুটপাথে রাত দিন অবস্থান করছেন দুই নেত্রীর সংলাপের দাবিতে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেফতার হওয়ার আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান করে বলেছেন, সঙ্কট উত্তরণের জন্যই সংলাপ। সংলাপের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে প্রধানমন্ত্রী এক সময় কথা বলারও সুযোগ পাবেন না। টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও বিশিষ্টজনেরা প্রতিদিনই সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের একটি বক্তব্য এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সংলাপ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চের পরও পাকিস্তানিদের সাথে সংলাপে বসতে পারেন, তাহলে আপনি কেন পারবেন না।’
তোপের মুখে সংলাপ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতারা এখন পর্যন্ত সংলাপের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দেখিয়ে আসছেন। যারাই সংলাপের আহ্বান বা পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা তোপের মুখে পড়ছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস-এর সাথে তুলনা করে তাদের সাথে কোনো সংলাপ বা আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। অবরোধের ৩১ দিন পর অনুষ্ঠিত সরকারি দলের ওই বৈঠক শেষে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ সিদ্ধান্ত জানান। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আইএস ও খালেদা জিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তিনি ‘খুনি’ ও ‘দানব’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংলাপের প্রস্তাব অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি এম ইমাম বলেন, নাগরিক সমাজের একমাত্র শামসুল হুদা ছাড়া অন্য সবার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। তাদের নিশ্চয়ই এজেন্ডা আছে। আততায়ীর সাথে কিসের সংলাপ? ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের সাথে সংলাপ হতে পারে না।
দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে হাত মেলান
একগুঁয়েমি দেখালে চলবে না। দেশের কথা ভাবতে হবে। মানুষের কথা ভাবতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। জনগণের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। জনগণকে পাশ কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলবাজ কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করে হয়তো সাময়িক ক্ষমতায় থাকা যাবে। কিন্তু এক সময় তা বুমেরাং হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ ৬৫ বছরের একটি পুরনো রাজনৈতিক দল। রাজনীতিতে বিএনপিরও হয়েছে ৩৭ বছর। রাজনীতির মাঠে একে অপরকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। শত্রুতার বশবর্তী হয়ে নয়। একে অপরকে নির্মূল করে দেয়ার বর্তমান মানসিকতা এখনই পরিহার করতে হবে। উভয়েরই উচিত জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনে কাজ করা। দেশ ও জনগণের স্বার্থে আর বিরোধ না বাড়িয়ে একে অপরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিন।
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
এমন একটি নির্বাচন কতদূর? না, এমন নির্বাচনের গন্তব্য সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তেও এক চিলতে আলো দেখা যাচ্ছে না। তবে এক নিমিষে আলো ছড়িয়ে দিতে পারেন রাজনীতির দুই নেত্রী। শুধু প্রয়োজন দু’জনের আন্তরিকতা। এই একটি বিষয়ে প্রয়োজন দু’জনের এককণ্ঠ, ঐকমত্য। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি বলতে পারেনÑ আসুন নির্বাচন হবে, সংলাপে বসি। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যদি বলতে পারেনÑ ঠিক আছে, অবরোধ হরতাল আর হবে না। তাহলেই আর কোনো সমস্যা থাকে না।
শেখ হাসিনা তার অবস্থানে এখনো অনড়। তিনি কিছুতেই সংলাপ চান না। খালেদা জিয়া অবশ্য তার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। সঙ্কটের গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান হোক, তা তিনি চাচ্ছেন। ১৩ মার্চ গুলশান কার্যালয়ে তিনি যে সংবাদ সম্মেলন করেন তাতে সে ইঙ্গিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন তার সংবাদ সম্মেলনে নতুন কিছু নেই। সেটা ঠিক নয়। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কঠোর অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তন করেছেন। ‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে তার আপত্তি নেই। তেমনি বর্তমান দশম সংসদকে তথাকথিত বললেও সেই সংসদে একতরফা পঞ্চদশ সংশোধনী সরকার বাতিলও করে দিতে পারে এবং ১৯৯৬ সালের মতো নতুন সংবিধান সংশোধন বিলও আনতে পারে বলে তিনি মত দিয়েছেন। চলমান অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহারের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কিছু না বললেও ২৬ মার্চ বাংলাদেশের ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস ঐক্যবদ্ধভাবে উদযাপনের আশাও তিনি করেছেন।
খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, আজকের সঙ্কট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সঙ্কট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাক্সিত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে। উপায় হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি পথ দেখিয়েছেন। বলেছেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই সঙ্কটের সুরাহা হবে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা যদি কোনো আলোচনা করতে না চায়, তাহলে তারা এককভাবেও সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারে। আর তা হচ্ছে তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন এখন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে তা একতরফাভাবে ওই সংসদে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে আর সঙ্কট থাকবে না। শেখ হাসিনা সরকারের জন্য উদার হওয়ার অনেকটা সুযোগ এসেছে। সরকার জেদ পরিহার করে উদারতা দেখাতে পারলে সত্যিই বিপদ কেটে যায়।
বিষয়টি এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আলোচনা কি আকাশে হবে? খুনির সাথে কোনো আলোচনা হতে পারে না। একই দিন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, শান্তির পরিবেশ এলে আলোচনা হলেও হতে পারে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি মনে করেন সঙ্কট আর থাকা উচিত নয়, তাহলে সহজেই বিষয়টির সুরাহা হবে। কারণ শুধু খালেদা জিয়াই নন, গোটা জাতিই মনে করে সঙ্কট সমাধানের চাবিকাঠি শেখ হাসিনার হাতে। তার ইচ্ছার ওপরই সমাধান নির্ভর করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টা সমাধান করলেই হয়।
শেখ হাসিনা তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেছেন। তার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। ইচ্ছা করলেই তিনি সঙ্কটের সমাধানে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। এমন একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে পারেন, যাতে দেশে আর কখনো রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি না হয়। এমন একটি জাতীয় সনদ তিনি তৈরির উদ্যোগ নিতে পারেন, যার মধ্যে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে। পাঁচ বছর পর পর ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’Ñ সেøাগানের সত্যিকার প্রতিফলন ঘটবে। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা এগিয়ে যাবে।
বর্তমান সঙ্কট যে কারণে
দেশের বর্তমান সঙ্কটের মূলে রয়েছে গত বছরের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন। জনগণের ভোটের অধিকারকে এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। নির্লজ্জ প্রহসনের অংশ হিসেবে এ নির্বাচনে ভোট ছাড়াই সংসদের ১৫৩টি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। বাকি ১৪৭টি আসনে গড়ে ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। সেদিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোয় কুকুর-বিড়াল ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য দৈনিক পত্রিকায় প্রধান ছবি হিসেবে ছাপা হয়েছে। প্রচণ্ড সহিংসতাপূর্ণ এ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে নিহত হয়েছেন ১২৩ জন। আর ভোটের দিন সংহিসতায় মারা গেছেন ১৯ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায়নি। ৫৯টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। দেশের জনগণ কোনোভাবেই সেই ভোটহীন, ভোটারহীন ও প্রার্থীহীন নির্বাচন মেনে নেয়নি। নির্বাচনে শাসক দলের আজ্ঞাবহ কয়েকটি দল ছাড়া দেশের আর কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেনি। বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে এবং অর্ধেকের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা দিয়ে এক বিচিত্র সংসদ গঠিত হয়। এ সংসদের বিরোধী দলের সদস্যরা একসাথে বিরোধী দলেও আছে, আবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও আছে।
বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ‘সংবিধানের বাধ্যবাধতার কারণে এটা একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। সবার সাথে আলোচনা করে আবার পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন করা হবে।’ অর্থাৎ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রধানমন্ত্রীর মতেই ছিল অপূর্ণাঙ্গ, অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘ফলাফল শূন্য খেলায় নেমেছেন রাজনীতিকরা’ শীর্ষক তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। সেই রাজনৈতিক সমস্যার উৎস থেকে শাসকগোষ্ঠী দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে বলেই মনে হয়। এক বছর ধরে শাসকেরা নির্বাচনের আগে ভোটারদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখেছে। ওই নির্বাচনের আগে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, জানুয়ারির ওই নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য তারা গ্রহণযোগ্যমূলক মধ্যবর্তী একটি নির্বাচন দেবে। ওই নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সবাই পূর্ণাঙ্গভাবে ওয়াকিবহাল। ... ... আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে নেতৃত্বদানকারী একটি দল। তাদের ঐতিহাসিক রীতির সাথে এ ঘটনা মিলানো যায় না। পরিষ্কার নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার যে প্রবণতা তা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নেই। আওয়ামী লীগ যদি তার নিজেকে পিছলে পড়ে যেতে পারে এমন একটি পাহাড়ের ঢালে নিয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র নিজে বিপন্ন হবে। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে তাই সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট অর্জনের মাধ্যমে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান করতে এগিয়ে যেতে হবে।’
সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশ
ভুয়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সঙ্কট বর্তমানে দেশকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশ এক প্রকার অচল হয়ে আছে। এক দিকে চলছে প্রতিরোধ আন্দোলন, অবরোধ-হরতাল, অন্য দিকে সরকারি বাহিনীর বন্দুকের গুলিতে সহিংসতায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত আর দগ্ধ মানুষের সারি, সরকারি সব বাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা প্রয়োগ। চলমান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের দমনের নামে সরকারি বাহিনী সরাসরি বুকে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। হত্যার পর সেই পুরনো পন্থায় বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে নিহতের হয়েছে বলে মিথ্যা কল্পকাহিনীর প্রচার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছে বেপরোয়াভাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবেই রাজনৈতিক কর্মীদের গাড়ির নিচে চাপা দিয়ে কিংবা সারা শরীরে অসংখ্য গুলিবিদ্ধ মৃত ব্যক্তিকে গণপিটুনিতে মৃত বলে দেখানো হচ্ছে। ১৪ মার্চ অবরোধের ৬৮তম দিনে সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ১২১ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ার ‘গণপিটুনি’ তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৩৭ জন (প্রথম আলো)। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম। সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া হিসাবেই চলমান সঙ্কটে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এই ভয়াবহ সঙ্কট সমাধানের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
সংলাপ কেন প্রয়োজন
সরকার সমস্যার মূলে না গিয়ে বলপ্রয়োগ করে সমাধান চাচ্ছে। কিন্তু বলপ্রয়োগ কখনই সমস্যার সমাধান নয়। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের সর্বমহল থেকে তাই সঙ্কট সমাধানে দুই রাজনৈতিক পক্ষকে দ্রুত সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাতই করা হচ্ছে না। সরকার একটি ন্যায্য রাজনৈতিক আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ প্রয়াসই চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অস্ত্রের ভাষা যে রাজনীতির ভাষা হতে পারে না, সে কথা কিছুতেই তারা বুঝতে চাচ্ছে না। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গোটা জাতি তাই চিন্তিত। মানুষের মুক্তি মিলছে না আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে। চার দিকের দমবন্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় মানুষ।
বাংলাদেশের মানুষের এই শঙ্কা ও দমবন্ধ অবস্থা এবং বিরাজমান ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থা। তারা চরম বৈরী অবস্থান থেকে সরে এসে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে উভয়পক্ষকে সঙ্কট নিরসনে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘে বড় বড় বিশ্ব সমস্যার সাথে প্রথম যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের ঘটনায় জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে প্রথমে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন উদ্বেগ জানায়। এরপর জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন বিবৃতির মাধ্যমে উদ্বেগ জানিয়ে দুই পক্ষকে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। উদ্বিগ্ন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সরকারের সাথে সমন্বয়ের জন্য সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়েই তারানকো দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাই বিসওয়ালের সাথে বৈঠক করেন। একই সাথে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সঙ্কট সমাধানে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠিও দেন। সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সম্প্রতি ওয়াশিংটনে গেলে তার সাথেও বৈঠক করে আবারো সংলাপের আহ্বান জানান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিকের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রায় প্রতিদিনই উঠছে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়েও উঠে আসছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের ঘটনায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সাথে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিও বৈঠক করেন। তিনি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সহযোগিতারও প্রস্তাব করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট বাংলাদেশের অচলাবস্থায় উদ্বেগ জানিয়ে শুধু বিবৃতিই দেয়নি, ইইউর মানবাধিকারবিষয়ক একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেও গেছে। ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেডার নেতৃত্বে তিন সদস্যের এই প্রতিনিধিদল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস, মানবাধিকার কমিশন, আইনমন্ত্রী, স্পিকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে ২৬টি বৈঠকে মিলিত হয়। সফর শেষে এক বিবৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া জানায় ইইউ। বিবৃতিতে তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে বাংলাদেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইইউ রাজনৈতিক সঙ্কটের সুরাহা ও ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। সুস্পষ্টভাবে বলেছে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে হতে পারে না। বিবৃতিতে বলপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের তাগিদ
আওয়ামী লীগ বলয়ের বাইরের সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে নাগরিক সমাজের উদ্যোগটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় সঙ্কট নিরসনে জাতীয় সংলাপ’ শিরোনামে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটশনে একটি গোলটেবিল হয়। এই গোলটেবিলে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অংশ নেন। দেশের অবস্থা বর্ণনা করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। একপক্ষ আরেক পক্ষকে শেষ করে দিতে চাইছে। এ গোলটেবিল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনকে সংলাপের শুভ উদ্যোগ নিতে আকুতি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্য তাদের কাছে একটি প্রস্তাবও পাঠানো হয়। তারা সংলাপের আহ্বানের পাশাপাশি একটি জাতীয় সনদ তৈরির জন্য ১২ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেন। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আরেকটি গোলটেবিল আলোচনা থেকে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠায় সংলাপের আহ্বান জানান। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বরাবরে চিঠি পাঠিয়েও বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে সহযোগিতা কামনা করেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী চলমান সঙ্কট নিরসনে দুই নেত্রী এবং দুই পক্ষকে সংলাপে বসাতে প্রতীকী গণ-অনশন করেন দলের কার্যালয়ে। তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে সংলাপ করতেই হবে। দেশে আজ যা কিছু হচ্ছে তার জন্য দায়ী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন করতে হবে। সে কথা তিনি ভুলে গেছেন। ফলে যে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, সংলাপ ছাড়া উত্তরণের উপায় নেই।
গণফোরাম সভাপতি ডক্টর কামাল হোসেন একাধিকবার বলেছেন, সঙ্ঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ২৮ জানুয়ারি থেকে মতিঝিলে দলের অফিসের সামনে ফুটপাথে রাত দিন অবস্থান করছেন দুই নেত্রীর সংলাপের দাবিতে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গ্রেফতার হওয়ার আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান করে বলেছেন, সঙ্কট উত্তরণের জন্যই সংলাপ। সংলাপের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে প্রধানমন্ত্রী এক সময় কথা বলারও সুযোগ পাবেন না। টেলিভিশনের টকশোগুলোতেও বিশিষ্টজনেরা প্রতিদিনই সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের একটি বক্তব্য এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সংলাপ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যদি ৭ মার্চের পরও পাকিস্তানিদের সাথে সংলাপে বসতে পারেন, তাহলে আপনি কেন পারবেন না।’
তোপের মুখে সংলাপ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতারা এখন পর্যন্ত সংলাপের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দেখিয়ে আসছেন। যারাই সংলাপের আহ্বান বা পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা তোপের মুখে পড়ছেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস-এর সাথে তুলনা করে তাদের সাথে কোনো সংলাপ বা আলোচনা না করার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। অবরোধের ৩১ দিন পর অনুষ্ঠিত সরকারি দলের ওই বৈঠক শেষে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ সিদ্ধান্ত জানান। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আইএস ও খালেদা জিয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তিনি ‘খুনি’ ও ‘দানব’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংলাপের প্রস্তাব অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি এম ইমাম বলেন, নাগরিক সমাজের একমাত্র শামসুল হুদা ছাড়া অন্য সবার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। তাদের নিশ্চয়ই এজেন্ডা আছে। আততায়ীর সাথে কিসের সংলাপ? ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম বলেন, যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের সাথে সংলাপ হতে পারে না।
দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে হাত মেলান
একগুঁয়েমি দেখালে চলবে না। দেশের কথা ভাবতে হবে। মানুষের কথা ভাবতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। জনগণের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। জনগণকে পাশ কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলবাজ কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করে হয়তো সাময়িক ক্ষমতায় থাকা যাবে। কিন্তু এক সময় তা বুমেরাং হতে বাধ্য। আওয়ামী লীগ ৬৫ বছরের একটি পুরনো রাজনৈতিক দল। রাজনীতিতে বিএনপিরও হয়েছে ৩৭ বছর। রাজনীতির মাঠে একে অপরকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। শত্রুতার বশবর্তী হয়ে নয়। একে অপরকে নির্মূল করে দেয়ার বর্তমান মানসিকতা এখনই পরিহার করতে হবে। উভয়েরই উচিত জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনে কাজ করা। দেশ ও জনগণের স্বার্থে আর বিরোধ না বাড়িয়ে একে অপরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিন।
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
No comments