স্কুলছাত্র সাঈদ হত্যার কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৬ জন, সিলেটজুড়ে বিক্ষোভ by ওয়েছ খছরু
স্কুলছাত্র সাঈদ হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় সহপাঠীরা -ছবি মানবজমিন |
অপহরণের
পরপরই মুখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল অপহৃত স্কুলছাত্র আবু সাঈদের। এরপর তার হাত ও
পা রশি দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। খুনের আগে গোটা রাত তাকে অন্ধকারের মধ্যে
এভাবেই রাখা হয়েছিল। এতে করে সকালের দিকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল ৯ বছরের ওই
শিশুটি। বুধবার অপহরণ করার পর বৃহস্পতিবার সকালের দিকে ৫জন মিলে খুন করে
শিশুটিকে। মৃত্যুর আগে বাঁচার জন্য ঘাতকদের কাছে অনেক আকুতি জানিয়েছিল আবু
সাঈদ। গতকাল সিলেটের আদালতে আলোচিত এ অপহরণ ও খুনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা
দিয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাকিব।
আদালতে সে জানিয়েছে, অপহরণের ঘটনায় সে জড়িত ছিল না। তবে খুনের সময় উপস্থিত
ছিল। পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর, র্যাবের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদা মিয়া,
ওলামা লীগের প্রচার সম্পাদক মুহিবুল রহমান মাছুম আগে থেকেই অপহরণের
পরিকল্পনা করেছিল। পরিকল্পনা মতো তারা দুপুরের দিকে স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে
নিয়ে আসে। রাকিব জানায়, ‘খুনের ঘটনার সময় সে দরোজায় পাহারা দিয়েছিল।
কনস্টেবল এবাদুল স্কুলছাত্র সাঈদের পা, মুহিবুল শরীরের অন্যান্য অংশ ধরে
রাখে আর সোর্স গেদা গলাটিপে হত্যা করে শিশু সাঈদকে। হত্যার পর দুটি বস্তার
ভেতরে লাশ ঢুকিয়ে রাখা হয়- গুম করার উদ্দেশ্যে।’ আলোচিত এ অপহরণ ও খুনের
ঘটনায় সিলেটে চলছে তোলপাড়। ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে সর্বত্রই। এলাকার
মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। কোন সান্ত্বনার ভাষা নেই কোথাও। মাত্র ৯ বছরের
স্কুলছাত্রকে টাকার জন্যই এভাবে খুন ও অপহরণ করা হয়েছে কেউই তা বিশ্বাস
করতে পারছে না। সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয় নগরীর ঝেরঝেরি পাড়া, ঝরনারপাড়,
কুমারপাড়া, শাহী ঈদগাহসহ বিভিন্ন এলাকায়। দুপুরের দিকে এই বিক্ষোভে শামিল
হন হাজার হাজার মানুষ। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ এই বিক্ষোভে
অংশ নেন। গতকাল সকালে সিলেট মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক
শাহেদুল করিমের আদালতে আতাউর রহমান ওরফে গেদা মিয়াকে হাজির করে মামলা
তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই ফয়েজ আহমদ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন
করেন। শুনানি শেষে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ সময় কড়া
প্রহরায় তাকে আদালত থেকে নিয়ে যায় পুলিশ। গেদাকে আদালত নেয়ার প্রায় এক
ঘণ্টা পর বেলা দেড়টার দিকে কোতোয়ালি পুলিশ আসামি আবদুর রাকিবকে সিলেট
মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক ফারহানা ইয়াসমীনের আদালতে
নিয়ে আসে। বেলা ২টার দিকে আবদুর রাকিব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
দেয়া শুরু করে। এক টানা বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আদালতে রাকিবের জবানবন্দি
রেকর্ড করা হয়। পুলিশ রাকিবকে আদালতে হাজির করার আগে তাকে হেলমেট ও
বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে আনে। জবানবন্দি শেষে তাকেও কড়া নিরাপত্তায় নিয়ে
যাওয়া হয়। আদালত সূত্র জানিয়েছে, পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরের বক্তব্যের সঙ্গে
ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাকিবের বক্তব্যের মিল রয়েছে। তবে, এক
জায়গায় সে ভিন্ন মত পোষণ করেছে। জানিয়েছে, অপহরণের পরিকল্পনায় সে ছিল না।
এবাদুর, গেদাসহ অন্যরা স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে অপহরণ করে নিয়ে আসে। এরপর
বুধবার দুপুর থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দেয় সে। আদালতকে
রাকিবও জানিয়েছে, মুক্তিপণের টাকার জন্য তারা স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে অপহরণ
করেছে। কিন্তু অপহরণের পর সাঈদ চিনে ফেলার কারণে রাতেই তাকে খুন করার
পরিকল্পনা হয়। তবে, অপহরণের পরপরই সাঈদকে ছেড়ে দেয়ার সিদ্বান্ত হয়েছিল।
কিন্তু ঝামেলা এড়াতে শেষ পর্যন্ত তাকে খুন করা হয়। খুনের ঘটনায় ৫ জনের
মধ্যে সোর্স গেদার সঙ্গে আরও একজন ছিল। কিন্তু তাকে রাকিব চিনে বলে জানায়।
আর খুনের ঘটনার পর পুলিশ কনস্টেবলের বাসার দিকে সে যায়নি বলেও জানায়।
স্কুলছাত্র আবু সাঈদ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিতে
কনস্টেবল এবাদুল ও ওলামা লীগ নেতা রাকিব একই বক্তব্য দিয়েছে। আদালতে তারা
জানায়, শিশুটিকে ছেড়ে দিলে আইনি ঝামেলা আসতে পারে। এজন্য রাতেই তারা
শিশুটিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অনুযায়ী রাকিব দরজা পাহারা দেয়- বাকি
তিন জনের মধ্যে এবাদুর পা, মুহিবুল শরীর আর গেদা গলাটিপে হত্যা করে শিশু
সাঈদকে। হত্যার পর দুটি বস্তার ভেতরে লাশ ঢুকিয়ে রাখা হয়- গুম করার
উদ্দেশে। হত্যার পরও মুক্তিপণের টাকার জন্য আবু সাঈদের পরিবারের সঙ্গে
যোগাযোগ রাখে তারা। অপহরণের পর পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়ে যাওয়ায় তারা লাশ
কোথাও ফেলতে পারেনি। এদিকে অপহরণ ও খুনের ঘটনায় সিলেট জেলা ওলামা লীগের
প্রচার সম্পাদক মুহিবুলকে গতকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে,
তাদের ধরতে একাধিক স্থানে অভিযান চালানো হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও
সিলেটের কোতোয়ালি থানার এসআই ফয়েজ আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঘটনাকারী ৫
জনের মধ্যে তিনজনই গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যরাও গ্রেপ্তার হবে। তাদের ধরতে
অভিযান চলছে। তিনি বলেন, এবাদুল ও রাকিব আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা
নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। এ কারণে তাদেরকে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন আদালত। আর
গেদাকে রিমান্ডে দিয়েছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে
উঠেছে নগরীর ঝেরঝেরি পাড়া, রায়নগর, শাহমীর, শাহী ঈদগা ও কুমারপাড়া এলাকার
মানুষ। একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। স্কুলছাত্র আবু
সাঈদ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় এলাকায় এই ক্ষোভ। গতকাল হাজার হাজার মানুষ দলবদ্ধ
হয়ে এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কমপক্ষে ১০টি
পাড়ার হাজার হাজার মানুষ হাতে ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে জমায়েত হন শাহী
ঈদগাহস্থ শাহমীর (রহ.) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে। এ সময় বিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরাও ছুটে আসেন সেখানে। সঙ্গে আসেন শিক্ষকরাও। ‘উই ওয়ান্ট
জাস্টিজ’-প্ল্যা-কার্ড হাতে নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এই
মানববন্ধনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রায় এক
ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনকালে সমাবেশে এলাকাবাসী প্রশ্ন রেখে বলেন, যেখানে
টাকার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটিকে
অপহরণের পর খুন করতে পারে সেখানে এখন কেউ-ই নিরাপদ নয়। এ ব্যাপারে থানায়
অভিযোগ দায়ের করার পরও পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন তারা।
তারা বলেন, স্কুলছাত্র সাঈদ অপহরণ ও খুনের ঘটনায় জড়িতদের ফাঁসি দিতে হবে।
তবেই তার আত্মার শান্তি হবে। তারা বলেন, সাঈদের পরিবারকে সান্ত্বনা জানানোর
ভাষা কারও নেই। শুধু একটি পরিবারই নয়, গোটা এলাকাবাসী সাঈদের জন্য কাঁদছে।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, হাজী শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং
কমিটির সভাপতি নজমুল ইসলাম এহিয়া, কাজী জালাল উদ্দিন বহুমুখী বালিকা উচ্চ
বিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল আবদুল খালিক, ইসলামী একাডেমির প্রিন্সিপাল আবদুল
হান্নান, ভাইস প্রিন্সিপাল জুনেদ আহমদ হায়দার, এলাকার মুরব্বি আবদুল কাইয়ুম
মোসাহেদ, ফজলুল হক, ফারুক আহমদ, বসুন্ধরা সমাজকল্যাণ সংস্থার সভাপতি
সালাউদ্দিন মামুন, মোস্তফা আহমদ হাজারী, শিক্ষক মোবারক হোসেন, আবদুস শহীদ
রুবেল, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের
প্রভাষক সাহেদ আহমদ, হাজী শাহমীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষিকা কাবেরী রানী দেবী, বিদ্যালয়ের সহসভাপতি এসএম শওকত আমীন তৌহিদ,
ঝরনা তরুণ সংঘের সভাপতি লায়ন সাজুওয়ান আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন
আহমদ, সমাজ কল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইমতিয়াজ, সাংগঠনিক সম্পাদক মুমিন আহমদ,
দেলওয়ার হোসেন রাজা, সদস্য শফিকুল ইসলাম আলকাছ, সদস্য আমিনুর রহমান
পাপ্পু প্রমুখ। এছাড়া স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর শামীম স্বাধীনও বক্তব্য
রাখেন। সমাবেশ শেষে শাহী ঈদগাহ থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিলটি কুমারপাড়া এলাকা
পর্যন্ত এসে শেষ হয়। আবু সাঈদের খুনিদের শাস্তির দাবিতে নগরীর কুমারপাড়ায়
ঝরনা তরুণ সংঘের ব্যানারে আলাদা মানববন্ধন পালন করা হয়েছে। মানববন্ধন শেষে
কুমারপাড়া এলাকা থেকে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নগরীর
কুমারপাড়া ঝরনা এলাকা থেকে বের হয়ে শাহী ঈদগাহ, শাহমীর স্কুল প্রাঙ্গণে
অতিক্রম করে কুমারপাড়া এলাকায় এসে শেষ হয়। বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে
বক্তারা বলেন, ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র আবু সাঈদের হত্যাকারী পুলিশ ও সোর্সসহ
জড়িতদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তি দিতে হবে। আর যাতে কোন মায়ের
বুক খালি না হয়, কোন স্কুলছাত্র যেন পুলিশের হাতে অপহরণ না হয় সে দিকে সকল
অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। আইনশৃখলা রক্ষাকারী পুলিশ
সদস্যদের হতে আর যাতে কোন স্কুলছাত্র অপহরণ ও হত্যার শিকার না হতে পারে সে
লক্ষে তাদেরকে দৃষ্টান্তুমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। ঝরনা তরুণ সংঘের
সভাপতি লায়ন সাজুওয়ান আহমদ এর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন
আহমদ এবং সমাজ কল্যাণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইমতিয়াজের যৌথ পরিচালনায় বিক্ষোভ
মিছিল ও মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পাদক মুমিন আহমদ, এলাকার
বিশিষ্ট মুরব্বি শফিকুর রহমান আলকাস, ফাত্তাহ আহমদ, সংঘের অর্থ সম্পাদক
আফছর আহমদ, সহ-অর্থ সম্পাদক হানিফ আহমদ, ক্রীড়া সম্পাদক আলমগীর আহমদ, দপ্তর
সম্পাদক কাওছার আহমদ, পাঠাগার সম্পাদক ফেরদৌস আহমদ, কার্যকরী কমিটির সদস্য
মাছুম আহমদ, শাফীন আহমদ, আবেদ আহমদ, তোফায়েল আহমদ, আকতার আহমদ, রুহোল
আহমদ, শাহিন আহমদ, ফাহাল আহমদ, বাপ্পি আহমদ, শাহ আলম, সোহেল, কবির, সাহিন,
সাহান, ইমন প্রমুখ। এদিকে, সিলেট জেলা আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি ক্বারী
শেখ মো. আল আমীন, সাধারণ এডভোকেট ওয়ারিছ আলী মামুন গতকাল এক প্রেস
বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, কথিত জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাকিব
আমাদের দলের কেউ নন। কোন খুনি, ছিনতাইকারী ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ওলামা লীগের
সদস্য হতে পারে না। রাকীব ও তাদের সহযোগীসহ যেসব খুনি চক্র শিশু সাঈদকে
হত্যা করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান
নেতৃবৃন্দ।
No comments