যে প্রশ্নের উত্তর সহজ নয় by সলিল ত্রিপাঠি
চলতি
বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আমি লাহোরে ছিলাম। চিত্তাকর্ষক আল হামরা আর্ট
সেন্টারে ঢুকে দেখি, মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শকেরা গত নভেম্বরে
প্রকাশিত আমার বই দ্য কর্নেল হু উড নট রিপেন্ট: দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অ্যান্ড
ইটস আনকোয়ায়েট লিগেসির ব্যাপারে কৌতূহলী। প্রগতিশীল গোষ্ঠী লাল-এর
প্রাগ্রসর সংগীতজ্ঞ তৈমুর রহমান লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট
সায়েন্সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান। সেদিনের আলোচনা সঞ্চালনার ভার পড়েছিল তাঁর
ওপর। কাজটা খুব স্বস্তিদায়ক নয়। আমার বই ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে, যে যুদ্ধে
পাকিস্তান ভেঙেছে। এই আলোচনায় সেই ক্ষত হয়তো আবার দগদগে হয়ে উঠবে।
আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার কবি সাদাফ সাজ সিদ্দিকী, তিনি বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যে বাংলাদেশি নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, তাঁদের সেখানে বীরাঙ্গনা বলা হয়। আমার সঙ্গে হিনা জিলানি নামের লাহোরের এক সাহসী মানবাধিকারকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। সে সময় লাহোরের মল রোডে তিনি পাকিস্তানিদের এই যুদ্ধের বিরোধিতার জন্য বিবৃতিতে সই করানোর চেষ্টা করেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি অবমাননার শিকার হন। তিনি অন্য কয়েকজনের কথা বলেন, যাদের গায়ে থুতু দেওয়া হয়েছিল।
আমার বইয়ের প্রশংসায় তৈমুর যারপরনাই উদার ছিলেন। তিনি এটাকে আখ্যা দেন ‘পাঠযোগ্য অপাঠ্যবই’ হিসেবে। তিনি বলেন, পাঠযোগ্যতার বিচারে বইটি উত্তম। কিন্তু পাকিস্তানি হিসেবে এর গল্পে তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। আমাদের প্রাথমিক আলোচনা ছিল টানটান উত্তেজনার টেস্ট ম্যাচের মতো, সোজা বল সোজা ব্যাটে খেলার মতো।
এরপর তৈমুরকে কঠিন প্রশ্নে আসতেই হয়: আমি পাকিস্তানিদের জানালাম, তারা অতীতে কী করেছে। আমার এখন কেমন লাগছে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা খুব সহজ ছিল না। উপস্থিত দর্শকদের অন্তত অর্ধেকেরই ১৯৭১ সালে জন্ম হয়নি। তাঁরা সাহিত্য ও মননশীল চর্চায় আগ্রহী, তাঁরা লাহোরের সেই সব উদার মানুষ, যাঁরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে চান। লাহোরের বোমা বিস্ফোরণের দিন কয়েক পরেই অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হওয়ার সাহস তাঁরা দেখিয়েছেন। কেন্দ্রের বাইরে সশস্ত্র রক্ষীদের টহল, ছাদের ওপর স্নাইপারদের পাহারা। কেন্দ্রের ভেতরেও উর্দি পরিহিত সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারা ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিষয়ে জিলানির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা জানত, তারা সেটার প্রশংসাও করত। কিন্তু যে সত্য আমি লিখেছি, তাতে তাদের মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছে, তার জন্য দর্শকেরা দায়ী নয়। ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। সব পাকিস্তানি নাগরিক এ সরকার অনুমোদন করেনি। তাই আমি কয়েকজন সাহসী ও ইতিবাচক মানুষের উদাহরণ দিয়েছি। বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বিবেকের তাড়নায় বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা করতে অস্বীকার করেন। একজন কর্নেল চাকরি ছেড়ে দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। এমনকি দুই জাতিকে (ভারত ও পাকিস্তান) এক করারও কথা বলেন।
আরেকজন কর্মকর্তার কথা আমি লিখেছি, যিনি তাঁর জানা ধর্ষণের ঘটনার কথা লিখেছেন। আর আরেকজন নিদারুণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কথা আমি লিখেছি, যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে যিনি হৃদয়ে দোলা দেওয়া গজল লিখেছেন। কাশ্মীরি-মার্কিন কবি আগা শহীদ আলীর ইংরেজি তর্জমার বাংলা অনুবাদে গজলটির দুটি লাইন এ রকম:
বহুবার মোলাকাত ও সহজিয়া ঘনিষ্ঠতার পর আমরা এখন আগন্তুক—
আরও কতবার দেখা হলে আমরা আবার পরিচিত হব?
দর্শকদের উদ্দেশে আমি বললাম, আপনাদের নামে ভয়ানক অপরাধ করা হয়েছে, যার কোনো জবাবদিহিও নেই।
হিনা জিলানি তাঁর স্বদেশবাসীকে সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তিনি আমার ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, খুব কম পাকিস্তানিই এ নিয়ে কথা বলেছে। তিনি তাঁর বাবার কথা স্মরণ করেন। তাঁর বাবা সামরিক আক্রমণের বিরোধিতা করে জেনারেল ইয়াহিয়াকে চিঠি লেখায় তাঁকে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অন্তরীণ করে রাখা হয়। শান্তিকামীদের উদ্দেশে মল সড়কে যে অবমাননাকর কটূক্তি করা হয়েছে, সে কথাও তিনি স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমরা নীরব ছিলাম। হিনা দর্শকদের অভিবাদনে সিক্ত হলেন।
সে সময় বাংলাদেশে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাদের ডজন ডজন শিবিরে নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের অনেককে প্রায় প্রতি রাতেই ধর্ষণ করা হতো, মাসের পর মাস ধরে এটা হয়েছে। সেই অঙ্কটা কষলে ফলাফল নেহাত কম হয় না। সংখ্যাটা কি আড়াই লাখ? পাঁচ লাখ? আমরা কীভাবে তা গণনা করব? যতটুকু নথিপত্র ছিল, তা-ও তো ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক শিশুকেই দত্তক দেওয়া হয়েছে। অনেক ভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে।
সে সময় দর্শকসারিতে একজন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এগুলো বাজে কথা।’ হল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তিনি বলেন, ‘এটা ভারতীয় প্রচারণা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ।’ আমি তাঁকে বললাম, সাদাফকে শেষ করতে দিন। কিন্তু তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। আবার অনেক পাকিস্তানি ওই শ্রোতাকে দুয়োধ্বনি দিয়ে বললেন, তাঁর লজ্জিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
হলের পরিবেশ বদলে গেল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে আবেগকম্পিত কণ্ঠে সাদাফ ও তাঁর বাঙালি বোনদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। আরও অনেকে দাঁড়ালেন। তাঁরা বললেন, ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছে, সেটা তাঁদের জানানো হয়নি কেন। পাকিস্তানে যে আলোচনা করা দুরূহ ব্যাপার ছিল, তা শেষমেশ গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো।
গোলযোগ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিটিকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার হস্তক্ষেপের কারণে অন্যরাও আমাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ব্রিটিশ বাংলাদেশি কবি আহসান আকবর আমাকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই রোমান্টিক কল্পনায় আপ্লুত হই, আজকের পাকিস্তানি তরুণেরা সঠিক চিন্তা করে। তারা ১৯৭১ সালের নৃশংসতার দায় স্বীকার করতে ও ক্ষমা চাইতে চায়। এটা রোমান্টিক, কারণ আমি সেখান ছিলাম, আর দর্শকেরা ছিল উত্তেজিত। আমি অনেক তরুণকে দেখেছি, যারা আপনার ও সাদাফের কথাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়। শুধু বয়োজ্যেষ্ঠরাই একটি ক্ষেত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চান না। ক্ষতিটা অনেক গভীর, আর আমরা প্রায়ই আশাবাদী হতে চাই: “অন্তত পরের প্রজন্ম তা স্বীকার করছে”। যদিও আমিই প্রথম বলছি যে এটা তাদের দোষ নয়, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়। পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার এ রকমটা মনে হয়েছে।’
একজন বললেন, ‘আপনি সেটা বলছেন না, আপনার কথা নিরপেক্ষ নয়।’
ধর্ষণের কথা বলার সময় মানুষ নিরপেক্ষ থাকে কী করে? কিন্তু সেটা বলার আগে আমি বারবার অতীত রোমন্থন ও অপর পক্ষকে দোষারোপের সংস্কৃতির দুরবস্থা নিয়ে কথা বলেছি: দুটি ভুল কোনো কিছুকে সঠিক বানায় না। হিনা জিলানি এর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি ব্যাখ্যা করেছেন: অরাষ্ট্রীয় সংস্থার চেয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার দায়িত্ব অনেক বেশি। মুক্তিবাহিনী তেমন একটি অরাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল, তারা ছিল এক বিদ্রোহী বাহিনী। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের কাজে জবাবদিহি করতে বাধ্য, তারা গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ইচ্ছামাফিক প্রতিশোধ নিতে পারে না। জেনেভা কনভেনশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মারফত সেনাবাহিনীর ওপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, আমি তা উল্লেখ করেছি।
সন্দেহবাদীদের বললাম, বইটা পড়ে দেখুন। ‘আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন বা বইটি কিনতে না-ও চান, পাঠাগার থেকে ধার করে বইটি পড়ুন। কিন্তু আগে বইটি অন্তত পড়ুন,’ আমি বললাম।
সামনে এগানো কি সম্ভব? এর কি সমাপ্তি আছে? তৈমুর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ ও গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা আমাকে যা বলেছিলেন, তা স্মরণ করলাম। সেই গল্পটি আমার বইয়েও আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়, তাঁদের মধ্যে তাঁর বাবা অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা অন্যতম। মেঘনা বলেন, ভুক্তভোগীদের এ কথা বলা সহজ যে তারা ক্ষমা করতে চায় কি না। কিন্তু সেই ক্ষমা করার আগে অপরাধীকে অনুশোচনা করতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই অনুশোচনা? সেটার ধরনটাই বা কেমন? বার্লিনে হলোকাস্ট জাদুঘর আছে। ইসলামাবাদে সে রকম কিছু আছে কি?
এরপর করতালি ও হর্ষধ্বনি হলো। আমার বক্তব্যের পর এত উচ্চ স্বরের করতালি আমি শুনিনি। দীর্ঘ সেই হর্ষধ্বনি ছিল বজ্রতুল্য। আমার কানে এখনো সেটা বাজছে। এই হৃদয়ানুভূতি ছিল বেশ শক্তিশালী। অনেক মানুষই এতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমি ছিলাম নিতান্ত একজন বার্তাবাহক, ধ্বনি এসেছে ১৯৭১-এর যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া মানুষের কণ্ঠ থকে।
সেদিন অনেকেই বইটি কিনে আমার অটোগ্রাফ নিয়েছেন। অনেকে এসে আমার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। অনেকেই আমার সঙ্গে ই-মেইল ঠিকানা বিনিময় করেছেন, অনেকে পরবর্তীকালে আমাকে চিঠিপত্র লিখেছেন, আমিও তাঁদের লিখেছি। তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। তাঁরা ক্ষমতাকাঠামোর নির্মিত ইতিহাস পড়ে বেড়ে উঠেছেন। যে অতীত তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তার অংশবিশেষ তাঁরা আবিষ্কার করেছেন। সে গল্প তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর, বোধগম্যভাবেই।
ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এক পাকিস্তানি তরুণীর কথা আমাকে বলেছিলেন। সে মেয়েটি জাদুঘর পরিদর্শন করে একটি ভিডিও বানিয়েছিল, তাতে সে তার মা-বাবার প্রজন্মকে উদ্দেশ করে বলেছিল: তোমরা এটা লুকিয়ে রেখেছিলে/ আমার সমাজও তা-ই করেছে/ আমিও তা লুকিয়ে রেখেছিলাম।
ক্যামিলা শামসির ২০০২ সালের উপন্যাস কারটোগ্রাফি-তে মাহিন রাহিনকে বলে, ‘যে সত্য আমরা লুকিয়ে রেখেছি, তা হারিয়ে যায়নি। রাহিন, সেই সত্য নানা রূপে ধরা দিচ্ছে।’
পাকিস্তানে এমন কথাবার্তা প্রয়োজন।
www.livemint.com থেকে নেওয়া (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
সলিল ত্রিপাঠি: ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক।
আমার সঙ্গে ছিলেন ঢাকার কবি সাদাফ সাজ সিদ্দিকী, তিনি বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যে বাংলাদেশি নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন, তাঁদের সেখানে বীরাঙ্গনা বলা হয়। আমার সঙ্গে হিনা জিলানি নামের লাহোরের এক সাহসী মানবাধিকারকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। সে সময় লাহোরের মল রোডে তিনি পাকিস্তানিদের এই যুদ্ধের বিরোধিতার জন্য বিবৃতিতে সই করানোর চেষ্টা করেন। সেটা করতে গিয়ে তিনি অবমাননার শিকার হন। তিনি অন্য কয়েকজনের কথা বলেন, যাদের গায়ে থুতু দেওয়া হয়েছিল।
আমার বইয়ের প্রশংসায় তৈমুর যারপরনাই উদার ছিলেন। তিনি এটাকে আখ্যা দেন ‘পাঠযোগ্য অপাঠ্যবই’ হিসেবে। তিনি বলেন, পাঠযোগ্যতার বিচারে বইটি উত্তম। কিন্তু পাকিস্তানি হিসেবে এর গল্পে তিনি অস্বস্তিবোধ করেন। আমাদের প্রাথমিক আলোচনা ছিল টানটান উত্তেজনার টেস্ট ম্যাচের মতো, সোজা বল সোজা ব্যাটে খেলার মতো।
এরপর তৈমুরকে কঠিন প্রশ্নে আসতেই হয়: আমি পাকিস্তানিদের জানালাম, তারা অতীতে কী করেছে। আমার এখন কেমন লাগছে?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা খুব সহজ ছিল না। উপস্থিত দর্শকদের অন্তত অর্ধেকেরই ১৯৭১ সালে জন্ম হয়নি। তাঁরা সাহিত্য ও মননশীল চর্চায় আগ্রহী, তাঁরা লাহোরের সেই সব উদার মানুষ, যাঁরা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে চান। লাহোরের বোমা বিস্ফোরণের দিন কয়েক পরেই অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে হাজির হওয়ার সাহস তাঁরা দেখিয়েছেন। কেন্দ্রের বাইরে সশস্ত্র রক্ষীদের টহল, ছাদের ওপর স্নাইপারদের পাহারা। কেন্দ্রের ভেতরেও উর্দি পরিহিত সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারা ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিষয়ে জিলানির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তারা জানত, তারা সেটার প্রশংসাও করত। কিন্তু যে সত্য আমি লিখেছি, তাতে তাদের মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড়।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছে, তার জন্য দর্শকেরা দায়ী নয়। ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। সব পাকিস্তানি নাগরিক এ সরকার অনুমোদন করেনি। তাই আমি কয়েকজন সাহসী ও ইতিবাচক মানুষের উদাহরণ দিয়েছি। বিমানবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বিবেকের তাড়নায় বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা করতে অস্বীকার করেন। একজন কর্নেল চাকরি ছেড়ে দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন। এমনকি দুই জাতিকে (ভারত ও পাকিস্তান) এক করারও কথা বলেন।
আরেকজন কর্মকর্তার কথা আমি লিখেছি, যিনি তাঁর জানা ধর্ষণের ঘটনার কথা লিখেছেন। আর আরেকজন নিদারুণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কথা আমি লিখেছি, যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে যিনি হৃদয়ে দোলা দেওয়া গজল লিখেছেন। কাশ্মীরি-মার্কিন কবি আগা শহীদ আলীর ইংরেজি তর্জমার বাংলা অনুবাদে গজলটির দুটি লাইন এ রকম:
বহুবার মোলাকাত ও সহজিয়া ঘনিষ্ঠতার পর আমরা এখন আগন্তুক—
আরও কতবার দেখা হলে আমরা আবার পরিচিত হব?
দর্শকদের উদ্দেশে আমি বললাম, আপনাদের নামে ভয়ানক অপরাধ করা হয়েছে, যার কোনো জবাবদিহিও নেই।
হিনা জিলানি তাঁর স্বদেশবাসীকে সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তিনি আমার ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, খুব কম পাকিস্তানিই এ নিয়ে কথা বলেছে। তিনি তাঁর বাবার কথা স্মরণ করেন। তাঁর বাবা সামরিক আক্রমণের বিরোধিতা করে জেনারেল ইয়াহিয়াকে চিঠি লেখায় তাঁকে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অন্তরীণ করে রাখা হয়। শান্তিকামীদের উদ্দেশে মল সড়কে যে অবমাননাকর কটূক্তি করা হয়েছে, সে কথাও তিনি স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমরা নীরব ছিলাম। হিনা দর্শকদের অভিবাদনে সিক্ত হলেন।
সে সময় বাংলাদেশে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাদের ডজন ডজন শিবিরে নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের অনেককে প্রায় প্রতি রাতেই ধর্ষণ করা হতো, মাসের পর মাস ধরে এটা হয়েছে। সেই অঙ্কটা কষলে ফলাফল নেহাত কম হয় না। সংখ্যাটা কি আড়াই লাখ? পাঁচ লাখ? আমরা কীভাবে তা গণনা করব? যতটুকু নথিপত্র ছিল, তা-ও তো ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক শিশুকেই দত্তক দেওয়া হয়েছে। অনেক ভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে।
সে সময় দর্শকসারিতে একজন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘এগুলো বাজে কথা।’ হল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তিনি বলেন, ‘এটা ভারতীয় প্রচারণা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ।’ আমি তাঁকে বললাম, সাদাফকে শেষ করতে দিন। কিন্তু তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। আবার অনেক পাকিস্তানি ওই শ্রোতাকে দুয়োধ্বনি দিয়ে বললেন, তাঁর লজ্জিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।
হলের পরিবেশ বদলে গেল। একজন উঠে দাঁড়িয়ে আবেগকম্পিত কণ্ঠে সাদাফ ও তাঁর বাঙালি বোনদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। আরও অনেকে দাঁড়ালেন। তাঁরা বললেন, ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছে, সেটা তাঁদের জানানো হয়নি কেন। পাকিস্তানে যে আলোচনা করা দুরূহ ব্যাপার ছিল, তা শেষমেশ গত ২১ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো।
গোলযোগ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিটিকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার হস্তক্ষেপের কারণে অন্যরাও আমাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ব্রিটিশ বাংলাদেশি কবি আহসান আকবর আমাকে বলেন, ‘আমরা প্রায়ই রোমান্টিক কল্পনায় আপ্লুত হই, আজকের পাকিস্তানি তরুণেরা সঠিক চিন্তা করে। তারা ১৯৭১ সালের নৃশংসতার দায় স্বীকার করতে ও ক্ষমা চাইতে চায়। এটা রোমান্টিক, কারণ আমি সেখান ছিলাম, আর দর্শকেরা ছিল উত্তেজিত। আমি অনেক তরুণকে দেখেছি, যারা আপনার ও সাদাফের কথাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়। শুধু বয়োজ্যেষ্ঠরাই একটি ক্ষেত্রে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চান না। ক্ষতিটা অনেক গভীর, আর আমরা প্রায়ই আশাবাদী হতে চাই: “অন্তত পরের প্রজন্ম তা স্বীকার করছে”। যদিও আমিই প্রথম বলছি যে এটা তাদের দোষ নয়, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়। পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার এ রকমটা মনে হয়েছে।’
একজন বললেন, ‘আপনি সেটা বলছেন না, আপনার কথা নিরপেক্ষ নয়।’
ধর্ষণের কথা বলার সময় মানুষ নিরপেক্ষ থাকে কী করে? কিন্তু সেটা বলার আগে আমি বারবার অতীত রোমন্থন ও অপর পক্ষকে দোষারোপের সংস্কৃতির দুরবস্থা নিয়ে কথা বলেছি: দুটি ভুল কোনো কিছুকে সঠিক বানায় না। হিনা জিলানি এর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ নীতিটি ব্যাখ্যা করেছেন: অরাষ্ট্রীয় সংস্থার চেয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থার দায়িত্ব অনেক বেশি। মুক্তিবাহিনী তেমন একটি অরাষ্ট্রীয় বাহিনী ছিল, তারা ছিল এক বিদ্রোহী বাহিনী। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের কাজে জবাবদিহি করতে বাধ্য, তারা গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ইচ্ছামাফিক প্রতিশোধ নিতে পারে না। জেনেভা কনভেনশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মারফত সেনাবাহিনীর ওপর যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, আমি তা উল্লেখ করেছি।
সন্দেহবাদীদের বললাম, বইটা পড়ে দেখুন। ‘আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন বা বইটি কিনতে না-ও চান, পাঠাগার থেকে ধার করে বইটি পড়ুন। কিন্তু আগে বইটি অন্তত পড়ুন,’ আমি বললাম।
সামনে এগানো কি সম্ভব? এর কি সমাপ্তি আছে? তৈমুর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ ও গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা আমাকে যা বলেছিলেন, তা স্মরণ করলাম। সেই গল্পটি আমার বইয়েও আছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়, তাঁদের মধ্যে তাঁর বাবা অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা অন্যতম। মেঘনা বলেন, ভুক্তভোগীদের এ কথা বলা সহজ যে তারা ক্ষমা করতে চায় কি না। কিন্তু সেই ক্ষমা করার আগে অপরাধীকে অনুশোচনা করতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই অনুশোচনা? সেটার ধরনটাই বা কেমন? বার্লিনে হলোকাস্ট জাদুঘর আছে। ইসলামাবাদে সে রকম কিছু আছে কি?
এরপর করতালি ও হর্ষধ্বনি হলো। আমার বক্তব্যের পর এত উচ্চ স্বরের করতালি আমি শুনিনি। দীর্ঘ সেই হর্ষধ্বনি ছিল বজ্রতুল্য। আমার কানে এখনো সেটা বাজছে। এই হৃদয়ানুভূতি ছিল বেশ শক্তিশালী। অনেক মানুষই এতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমি ছিলাম নিতান্ত একজন বার্তাবাহক, ধ্বনি এসেছে ১৯৭১-এর যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া মানুষের কণ্ঠ থকে।
সেদিন অনেকেই বইটি কিনে আমার অটোগ্রাফ নিয়েছেন। অনেকে এসে আমার সঙ্গে ছবি তুলেছেন। অনেকেই আমার সঙ্গে ই-মেইল ঠিকানা বিনিময় করেছেন, অনেকে পরবর্তীকালে আমাকে চিঠিপত্র লিখেছেন, আমিও তাঁদের লিখেছি। তাঁদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। তাঁরা ক্ষমতাকাঠামোর নির্মিত ইতিহাস পড়ে বেড়ে উঠেছেন। যে অতীত তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তার অংশবিশেষ তাঁরা আবিষ্কার করেছেন। সে গল্প তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর, বোধগম্যভাবেই।
ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এক পাকিস্তানি তরুণীর কথা আমাকে বলেছিলেন। সে মেয়েটি জাদুঘর পরিদর্শন করে একটি ভিডিও বানিয়েছিল, তাতে সে তার মা-বাবার প্রজন্মকে উদ্দেশ করে বলেছিল: তোমরা এটা লুকিয়ে রেখেছিলে/ আমার সমাজও তা-ই করেছে/ আমিও তা লুকিয়ে রেখেছিলাম।
ক্যামিলা শামসির ২০০২ সালের উপন্যাস কারটোগ্রাফি-তে মাহিন রাহিনকে বলে, ‘যে সত্য আমরা লুকিয়ে রেখেছি, তা হারিয়ে যায়নি। রাহিন, সেই সত্য নানা রূপে ধরা দিচ্ছে।’
পাকিস্তানে এমন কথাবার্তা প্রয়োজন।
www.livemint.com থেকে নেওয়া (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
সলিল ত্রিপাঠি: ভারতীয় সাংবাদিক ও লেখক।
No comments