ব্যাটের গ্রাম নরেন্দ্রপুর by নূর ইসলাম
যশোরের
সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের মিস্ত্রিপাড়ায় ঘরে ঘরে এখন তৈরি হচ্ছে
বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট। এ পাড়ার কয়েক শ’ নারী-পুরুষ আর শিশুরা ব্যস্ত
সময় পার করছেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজে। আয়-রোজগার ভাল হওয়ায় এই গ্রামের
মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে। অর্থনৈতিকভাবেও তারা এখন বেশ সচ্ছল। এক সময় যাদের
নুন আনতে পানতা ফুরাতো তাদের বাড়িতে উঠছে পাকা দালান। ছেলেমেয়েরা এখন
স্কুলে যাচ্ছে। পাল্টে গেছে জীবনযাত্রার মান। নিরক্ষর এই গ্রামটিতে লেগেছে
শিক্ষার আলো। তারাও এখন স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। ভালবাসে সুস্থ জীবনযাপন
করতে। ক্রিকেট ব্যাটের কারিগররা বললেন, বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা উপলক্ষে
ব্যাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্ডারও হচ্ছে ভাল। কিন্তু টানা
অবরোধ-হরতালে তারা দেশের নানা স্থানে সঠিক সময়ে ব্যাট পাঠাতে পারছেন না।
ফলে তাদের আয়-রোজগারে কিছুটা ভাটা পড়ছে। তবে ব্যাটের কারিগররা আশাবাদী,
পরিস্থিতি পাল্টাবে। একই সঙ্গে তারা মনে করেন এই খাতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা
পেলে তাদের তৈরি ব্যাট হতে পারে দেশের একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর।
যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রূপদিয়া বাজার। যশোর খুলনা মহাসড়কের ওপর গড়ে ওঠা একটি বাণিজ্য কেন্দ্র এই রূপদিয়া। রূপদিয়া বাজার থেকে সোজা দক্ষিণে ২ কিলোমিটার পেরোলেই রাস্তার পাশের গ্রামটির নাম নরেন্দ্রপুর। এখনও এই গ্রামের প্রধান সড়কটি কাঁচা। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বছর দুয়েক হলো। এই কাঁচা সড়কের দুই পাশে বাস করেন কয়েক শ’ পরিবার। গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় বাস করেন কয়েক ঘর নিম্ন আয়ের মানুষ। হিন্দু-মুসলমান মিলে এসব পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে ছুতার বা কাঠের মিস্ত্রি বলে পরিচিত। আর পাড়াটিকে মানুষজন চেনে ছুতোরপাড়া বলে। তবে বর্তমানে এসব পরিচয় ছাড়িয়ে এই পাড়ার নাম হয়ে গেছে ক্রিকেট ব্যাটের পাড়া বা গ্রাম হিসেবে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এই পাড়ার প্রায় ৬-৭শ’ নারী-পুরুষ বর্তমানে ক্রিকেট ব্যাটের কারখানায় কর্মরত। বিভিন্ন মালিকের কারখানায় এদের কেউ দিনমজুর হিসেবে আবার কেউ কমিশনে কাজ করছেন। এসব কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ শ’ ব্যাট তৈরি হচ্ছে। যন্ত্রপাতি আর হাতের ব্যবহার এক সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে ক্রিকেট ব্যাট। বাড়ির বউঝিরাও সাংসারিক কাজের পাশাপাশি ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজে পুরুষদের সহায়তা করছেন। পৈতৃক পেশাকে পাশকাটিয়ে এই পাড়ার মানুষ এখন রাতদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজে। তাদের যেন কথা বলারও ফুসরত নেই।
সম্প্রতি সরজমিন ব্যাটের গ্রাম নরেন্দ্রপুরে গিয়ে চোখে পড়ে কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততার চিত্র। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কথা হয় ব্যাট তৈরির মূল উদ্যোক্তা যিনি স্থানীয় ভাবে ব্যাটের ওস্তাদ বলে পরিচিত সেই সনজিত মজুমদারের সঙ্গে। তিনি শোনালেন কিভাবে তিনি পৈতৃক পেশাকে আঁকড়ে ধরে তার জীবন পাল্টালেন সেই গল্প। প্রায় ২০/২২ বছর আগে এই সনজিত মজুমদারই প্রথম নীন, শাবল, হাতুড়ি, করাত, বাটাল আর ন্যানদা দিয়ে হাতেকলমে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ শুরু করেন। আজ তিনি ক্রিকেট ব্যাটের বড় মাপের একজন কারবারি। কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা ভোলেননি। সুযোগ পেলেই তুলে ধরেন পুরনো সেই দিনের কথা। শোনান কিভাবে নরেন্দ্রপুরের ছুতোরপাড়া বর্তমানের ব্যাটের গ্রাম হলো।
২০ বছর আগের কথা। এ গ্রামের বাসিন্দারা গরুর গাড়ির চাকা, লাঙ্গল, দাঁড়িপাল্লা, লাটিমসহ কাঠের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রি তৈরি করে বিক্রি করতেন। এটিই ছিল তাদের মূল পেশা। তবে সবক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় কাঠের তৈরি এসব সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বন্ধ হতে শুরু করে। মানুষ হয়ে পড়ে যান্ত্রিক। গরুর গাড়ির পরিবর্তে আসে নসিমন করিমন। কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে আসে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর। শিশুরা লাটিম খেলার পরিবের্ত মেতে ওঠে ভিডিও গেম আর ক্রিকেট খেলা নিয়ে। কাঠের দাঁড়িপাল্লার পরিবর্তে বাজারে আসতে শুরু করে টিন আর অ্যালমুনিয়ামের পাল্লা। যুক্ত হয় ইলেকট্রিক্যাল ওজন মেশিন। কাঠের আসবাবপত্রের পরিবর্তে মানুষের সংসারে জায়গা করে নেয় প্লাস্টিক সামগ্রী। এক কথায় নরেদ্রপুরের মানুষের কাজকর্ম থেমে যায়। বেকার হতে শুরু করে এই পাড়ার কয়েক শ’ মানুষ। বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হচ্ছিল ছুতোরপাড়ার মানুষেরা। জড়াচ্ছিল সুদে কারবারে। অনেকে পেশা ত্যাগ করে শুরু করেন অন্যকাজ। ঠিক এ অবস্থায় দেশে ক্রিকেট জোয়ার শুরু হয়। বাজারে বাড়তে থাকে ক্রিকেট ব্যাটের চাহিদা। বাজারের চাহিদানুসারে সনজিত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মনস্থ করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজের অতীত অভিজ্ঞতা দিয়ে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাঠ ব্যবহার করে সনজিত অনেকটা হাতেকলমে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। প্রথম প্রথম তার এই উদ্যোগকে অনেকে হাস্যকর ভাবলেও অল্প দিনে সনজিতের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। ভিড় বাড়তে থাকে সনজিতের বাড়িতে। সনজিতের কারবার বড়ো হতে থাকে। যা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। দেশের নামীদামি ক্রিকেট ব্যাটের ব্যবসায়ীরা ভিড় জমান নরেন্দ্রপুরের ছুতোরপাড়ায়। সেই থেকে শুরু। এরপর আর এ পাড়ার মানুষকে পেছনে ফিরতে হয়নি। বর্তমানে এই পাড়ার ৬-৭ শ’ মানুষ সরাসরি ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ করছেন। গড়ে প্রতিদিন এই গ্রামের কারিগররা ৫০ থেকে ৬০টি কারখানায় ৫-৭ শ’ ব্যাট তৈরি করছেন। শুরুতে প্রতিটি ব্যাটের দাম একশ’ থেকে দুশো টাকা হলেও বর্তমানে এই গ্রামের তৈরি ব্যাট বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। সর্বনিম্ন ৩ শ’ টাকা থেকে শুরু করে দেড় ২ হাজার টাকার ব্যাটও তৈরি করছেন এই পাড়ার কারিগররা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই পাড়ার ব্যাট যাচ্ছে বিদেশেও। পাইকাররা এখান থেকে ব্যাট কিনে বিভিন্ন ব্রান্ডের সিল লাগিয়ে তা বিদেশে পাঠাচ্ছে বলেও দাবি করলেন ব্যাটের কারিগর সনৎ মজুমদার। তার মতো পরেশ মজুমদার, হরিস চন্দ্র, হারেজ দফাদার, মদন মোহন সরকার, সরজিত, বিকাশ, পলাশ, মান্দার মোড়লসহ অনেকে বিশ্বাস করেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারাও বিশ্বমানের ব্যাট তৈরি করতে পারেন। বংশপরম্পরায় নরেন্দ্রপুর গ্রামের কারিগররা ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করছেন গত ২০ বছর ধরে। পুরুষরা কারখানায় ব্যাট তৈরি করেন আর মহিলারা তাতে রং ধরানোসহ স্টিকার লাগানো, মোড়কিকরণসহ ব্যাটের সাজসজ্জার কাজটি করেন। মায়েদের সঙ্গে শিশুরাও এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। নারী-পুরুষের সম্মিলত প্রচেষ্টায় তৈরি ব্যাট দেশের প্রত্যেকটি এলাকার চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু আজও কারিগরদের চাহিদা সেই মূল রাস্তাটি পাকা হয়নি। ব্যাটের ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম বললেন, প্রতি বছর এখানকার কারিগররা কোটি কোটি টাকার ব্যাট তৈরি করছেন। সরকার এই ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাটের কারিগরদের ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোন চেষ্টা নেই বললেই চলে। এই ব্যবসায়ীর মতো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও মনে করেন নরেন্দ্রপুরের ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানকার কারিগররা বিপ্লব ঘটাতে পারবেন।
এদিকে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রপুর গ্রামের ক্রিকেট ব্যাট তৈরির পাড়াতেও ধুম লাগে। এপাড়ার তৈরি ক্রিকেট ব্যাটের বেচাবিক্রিও ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকে। যে কারণে নরেন্দ্রপুরের মানুষও আয়ের ভাল পথ পেয়ে যান। এ ব্যবসা করে এ গ্রামের মানুষ শুধু বেকারত্বই দূর করেনি, তারা স্বাবলম্বীও হয়েছেন। গ্রামের কাঁচাবাড়ির পরিবর্তে বসেছে ইটের পাকা দালান। বেড়েছে শিক্ষিতের হার। বর্তমানে এই পাড়ার শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। ২০ বছর আগেও যা ছিল স্বপ্ন।
বর্তমানে দেশে বা বিদেশে ক্রিকেটের কোন বড় আসর বসলেই এই পাড়ার মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এজন্য তারা লাখ লাখ টাকাও বিনিয়োগ করেন। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে এ গ্রামের সবাই সাধ্যমত অর্থ বিনিয়োগ করে কাঠসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনেন। তৈরি করেন প্রায় লাখ খানিক ক্রিকেট ব্যাট। গড়ে তোলেন ব্যাটের মজুত। অর্ডারও পান ভাল। কিন্তু বিএনপি জোটের টানা অবরোধ আর হরতালের ঢেউ লেগেছে নরেন্দ্রপুরের ব্যাটের গ্রামেও। দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা অবরোধ আর হরতালে এখানকার ব্যবসায়ী বা কারিগররা ভাল ব্যবসা করতে পারেননি বলে জানান। এ গ্রামের বাসিন্দা স্বপন বিশ্বাস জানান, চলতি বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই পাড়ার কারিগর আর কারখানার মালিকরা কমপক্ষে শত কোটি টাকার ক্রিকেট ব্যাট বেচাকেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই ভাবে তাদের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু অবরোধ আর হরতাল তাদের সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে।
এ গ্রামের ব্যাটের বড় ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম জানান, নরেন্দ্রপুরে এখন প্রতিদিন শ’ শ’ ব্যাট তৈরি হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে সবাই সাধ্যমত বিনিয়োগ করে ব্যাট তৈরি করেন। কিন্তু অবরোধ আর হরতালে তাদের ব্যবসায়ে ধস নেমেছে। ব্যবসায়ীরা আসতে পারেননি। তাদের অর্ডার অনুযায়ী সময়মতো ব্যাট সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে লাখ লাখ টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। তারপরও এই পাড়ার কারবারিরা মনে করেন তাদের হতাশার কিছু নেই। কারণ তারা কাজ জানে। তাদের পণ্যের মান সম্পর্কেও তাদের রয়েছে উচ্চ ধারণা। ফলে সময় আর সুযোগ পেলে তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করবেন, ঘুরে দাঁড়াবেন।
যশোর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রূপদিয়া বাজার। যশোর খুলনা মহাসড়কের ওপর গড়ে ওঠা একটি বাণিজ্য কেন্দ্র এই রূপদিয়া। রূপদিয়া বাজার থেকে সোজা দক্ষিণে ২ কিলোমিটার পেরোলেই রাস্তার পাশের গ্রামটির নাম নরেন্দ্রপুর। এখনও এই গ্রামের প্রধান সড়কটি কাঁচা। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বছর দুয়েক হলো। এই কাঁচা সড়কের দুই পাশে বাস করেন কয়েক শ’ পরিবার। গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় বাস করেন কয়েক ঘর নিম্ন আয়ের মানুষ। হিন্দু-মুসলমান মিলে এসব পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে ছুতার বা কাঠের মিস্ত্রি বলে পরিচিত। আর পাড়াটিকে মানুষজন চেনে ছুতোরপাড়া বলে। তবে বর্তমানে এসব পরিচয় ছাড়িয়ে এই পাড়ার নাম হয়ে গেছে ক্রিকেট ব্যাটের পাড়া বা গ্রাম হিসেবে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, এই পাড়ার প্রায় ৬-৭শ’ নারী-পুরুষ বর্তমানে ক্রিকেট ব্যাটের কারখানায় কর্মরত। বিভিন্ন মালিকের কারখানায় এদের কেউ দিনমজুর হিসেবে আবার কেউ কমিশনে কাজ করছেন। এসব কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ শ’ ব্যাট তৈরি হচ্ছে। যন্ত্রপাতি আর হাতের ব্যবহার এক সঙ্গে মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে ক্রিকেট ব্যাট। বাড়ির বউঝিরাও সাংসারিক কাজের পাশাপাশি ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজে পুরুষদের সহায়তা করছেন। পৈতৃক পেশাকে পাশকাটিয়ে এই পাড়ার মানুষ এখন রাতদিন ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজে। তাদের যেন কথা বলারও ফুসরত নেই।
সম্প্রতি সরজমিন ব্যাটের গ্রাম নরেন্দ্রপুরে গিয়ে চোখে পড়ে কর্মজীবী মানুষের ব্যস্ততার চিত্র। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর কথা হয় ব্যাট তৈরির মূল উদ্যোক্তা যিনি স্থানীয় ভাবে ব্যাটের ওস্তাদ বলে পরিচিত সেই সনজিত মজুমদারের সঙ্গে। তিনি শোনালেন কিভাবে তিনি পৈতৃক পেশাকে আঁকড়ে ধরে তার জীবন পাল্টালেন সেই গল্প। প্রায় ২০/২২ বছর আগে এই সনজিত মজুমদারই প্রথম নীন, শাবল, হাতুড়ি, করাত, বাটাল আর ন্যানদা দিয়ে হাতেকলমে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ শুরু করেন। আজ তিনি ক্রিকেট ব্যাটের বড় মাপের একজন কারবারি। কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা ভোলেননি। সুযোগ পেলেই তুলে ধরেন পুরনো সেই দিনের কথা। শোনান কিভাবে নরেন্দ্রপুরের ছুতোরপাড়া বর্তমানের ব্যাটের গ্রাম হলো।
২০ বছর আগের কথা। এ গ্রামের বাসিন্দারা গরুর গাড়ির চাকা, লাঙ্গল, দাঁড়িপাল্লা, লাটিমসহ কাঠের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রি তৈরি করে বিক্রি করতেন। এটিই ছিল তাদের মূল পেশা। তবে সবক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় কাঠের তৈরি এসব সামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বন্ধ হতে শুরু করে। মানুষ হয়ে পড়ে যান্ত্রিক। গরুর গাড়ির পরিবর্তে আসে নসিমন করিমন। কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে আসে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর। শিশুরা লাটিম খেলার পরিবের্ত মেতে ওঠে ভিডিও গেম আর ক্রিকেট খেলা নিয়ে। কাঠের দাঁড়িপাল্লার পরিবর্তে বাজারে আসতে শুরু করে টিন আর অ্যালমুনিয়ামের পাল্লা। যুক্ত হয় ইলেকট্রিক্যাল ওজন মেশিন। কাঠের আসবাবপত্রের পরিবর্তে মানুষের সংসারে জায়গা করে নেয় প্লাস্টিক সামগ্রী। এক কথায় নরেদ্রপুরের মানুষের কাজকর্ম থেমে যায়। বেকার হতে শুরু করে এই পাড়ার কয়েক শ’ মানুষ। বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হচ্ছিল ছুতোরপাড়ার মানুষেরা। জড়াচ্ছিল সুদে কারবারে। অনেকে পেশা ত্যাগ করে শুরু করেন অন্যকাজ। ঠিক এ অবস্থায় দেশে ক্রিকেট জোয়ার শুরু হয়। বাজারে বাড়তে থাকে ক্রিকেট ব্যাটের চাহিদা। বাজারের চাহিদানুসারে সনজিত স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মনস্থ করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কোন প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজের অতীত অভিজ্ঞতা দিয়ে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাঠ ব্যবহার করে সনজিত অনেকটা হাতেকলমে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। প্রথম প্রথম তার এই উদ্যোগকে অনেকে হাস্যকর ভাবলেও অল্প দিনে সনজিতের ভাগ্য বদলাতে শুরু করে। ভিড় বাড়তে থাকে সনজিতের বাড়িতে। সনজিতের কারবার বড়ো হতে থাকে। যা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। দেশের নামীদামি ক্রিকেট ব্যাটের ব্যবসায়ীরা ভিড় জমান নরেন্দ্রপুরের ছুতোরপাড়ায়। সেই থেকে শুরু। এরপর আর এ পাড়ার মানুষকে পেছনে ফিরতে হয়নি। বর্তমানে এই পাড়ার ৬-৭ শ’ মানুষ সরাসরি ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ করছেন। গড়ে প্রতিদিন এই গ্রামের কারিগররা ৫০ থেকে ৬০টি কারখানায় ৫-৭ শ’ ব্যাট তৈরি করছেন। শুরুতে প্রতিটি ব্যাটের দাম একশ’ থেকে দুশো টাকা হলেও বর্তমানে এই গ্রামের তৈরি ব্যাট বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। সর্বনিম্ন ৩ শ’ টাকা থেকে শুরু করে দেড় ২ হাজার টাকার ব্যাটও তৈরি করছেন এই পাড়ার কারিগররা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই পাড়ার ব্যাট যাচ্ছে বিদেশেও। পাইকাররা এখান থেকে ব্যাট কিনে বিভিন্ন ব্রান্ডের সিল লাগিয়ে তা বিদেশে পাঠাচ্ছে বলেও দাবি করলেন ব্যাটের কারিগর সনৎ মজুমদার। তার মতো পরেশ মজুমদার, হরিস চন্দ্র, হারেজ দফাদার, মদন মোহন সরকার, সরজিত, বিকাশ, পলাশ, মান্দার মোড়লসহ অনেকে বিশ্বাস করেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারাও বিশ্বমানের ব্যাট তৈরি করতে পারেন। বংশপরম্পরায় নরেন্দ্রপুর গ্রামের কারিগররা ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করছেন গত ২০ বছর ধরে। পুরুষরা কারখানায় ব্যাট তৈরি করেন আর মহিলারা তাতে রং ধরানোসহ স্টিকার লাগানো, মোড়কিকরণসহ ব্যাটের সাজসজ্জার কাজটি করেন। মায়েদের সঙ্গে শিশুরাও এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। নারী-পুরুষের সম্মিলত প্রচেষ্টায় তৈরি ব্যাট দেশের প্রত্যেকটি এলাকার চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু আজও কারিগরদের চাহিদা সেই মূল রাস্তাটি পাকা হয়নি। ব্যাটের ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম বললেন, প্রতি বছর এখানকার কারিগররা কোটি কোটি টাকার ব্যাট তৈরি করছেন। সরকার এই ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর রাজস্ব পাচ্ছে। কিন্তু ব্যাটের কারিগরদের ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোন চেষ্টা নেই বললেই চলে। এই ব্যবসায়ীর মতো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও মনে করেন নরেন্দ্রপুরের ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখানকার কারিগররা বিপ্লব ঘটাতে পারবেন।
এদিকে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্রপুর গ্রামের ক্রিকেট ব্যাট তৈরির পাড়াতেও ধুম লাগে। এপাড়ার তৈরি ক্রিকেট ব্যাটের বেচাবিক্রিও ব্যাপক ভাবে বাড়তে থাকে। যে কারণে নরেন্দ্রপুরের মানুষও আয়ের ভাল পথ পেয়ে যান। এ ব্যবসা করে এ গ্রামের মানুষ শুধু বেকারত্বই দূর করেনি, তারা স্বাবলম্বীও হয়েছেন। গ্রামের কাঁচাবাড়ির পরিবর্তে বসেছে ইটের পাকা দালান। বেড়েছে শিক্ষিতের হার। বর্তমানে এই পাড়ার শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। ২০ বছর আগেও যা ছিল স্বপ্ন।
বর্তমানে দেশে বা বিদেশে ক্রিকেটের কোন বড় আসর বসলেই এই পাড়ার মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এজন্য তারা লাখ লাখ টাকাও বিনিয়োগ করেন। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে এ গ্রামের সবাই সাধ্যমত অর্থ বিনিয়োগ করে কাঠসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রী কেনেন। তৈরি করেন প্রায় লাখ খানিক ক্রিকেট ব্যাট। গড়ে তোলেন ব্যাটের মজুত। অর্ডারও পান ভাল। কিন্তু বিএনপি জোটের টানা অবরোধ আর হরতালের ঢেউ লেগেছে নরেন্দ্রপুরের ব্যাটের গ্রামেও। দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা অবরোধ আর হরতালে এখানকার ব্যবসায়ী বা কারিগররা ভাল ব্যবসা করতে পারেননি বলে জানান। এ গ্রামের বাসিন্দা স্বপন বিশ্বাস জানান, চলতি বিশ্বকাপ উপলক্ষে এই পাড়ার কারিগর আর কারখানার মালিকরা কমপক্ষে শত কোটি টাকার ক্রিকেট ব্যাট বেচাকেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই ভাবে তাদের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু অবরোধ আর হরতাল তাদের সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে।
এ গ্রামের ব্যাটের বড় ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম জানান, নরেন্দ্রপুরে এখন প্রতিদিন শ’ শ’ ব্যাট তৈরি হচ্ছে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে সবাই সাধ্যমত বিনিয়োগ করে ব্যাট তৈরি করেন। কিন্তু অবরোধ আর হরতালে তাদের ব্যবসায়ে ধস নেমেছে। ব্যবসায়ীরা আসতে পারেননি। তাদের অর্ডার অনুযায়ী সময়মতো ব্যাট সাপ্লাই দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে লাখ লাখ টাকার অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। তারপরও এই পাড়ার কারবারিরা মনে করেন তাদের হতাশার কিছু নেই। কারণ তারা কাজ জানে। তাদের পণ্যের মান সম্পর্কেও তাদের রয়েছে উচ্চ ধারণা। ফলে সময় আর সুযোগ পেলে তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করবেন, ঘুরে দাঁড়াবেন।
No comments