মেধা, যোগ্যতা ও কোটা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
আমরা
যারা খবরের কাগজে সম্পাদকীয় পাতায় বা তার ডান দিকের পাতায় নিবন্ধ বা
সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভৃতি বিষয়ে রচনা লিখি, তাদের কাছে পাঠকদের
কেউ কেউ তাঁদের পছন্দের বিষয়ে লেখার অনুরোধ করেন। কারও পেনশনের টাকা আটকে
আছে আড়াই বছর, ঘুরে ঘুরে জুতা ক্ষয় করেছেন, পাচ্ছেন না কোনো ঝামেলায়।
ফলে মেয়ে তিনটিকে বিয়ে দিতে পারছেন না। অনুরোধ করেন যেন একটা উপসম্পাদকীয়
নিবন্ধ ফেঁদে বসি।
কেউ বিনা বিচারে জেলের মোটা চালের ভাত খাচ্ছেন বছরের পর বছর। তাঁর বাবা বা ভাই আসেন সে সম্পর্কে কিছু লেখা যায় কি না। লেখার জন্য অনুরোধের বিষয়ের কোনো ঘাটতি নেই। একটি বিষয়ে বহু বছর যাবৎ বহু তরুণ-তরুণী অনুরোধ করছেন লেখার জন্য, তা হলো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ও সরকারি চাকরিতে কোটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে প্রায়ই আমাকে এই অনুরোধ শুনতে হয়। তা ছাড়া, বাড়ি পর্যন্ত ছুটে এসেছেন দল বেঁধে অনেকে অনেকবার। তাঁরা বোঝেন না কাগজে চুটিয়ে লিখলেই যদি সমস্যার সুরাহা হতো, তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট তো দূরের কথা, কোনো সমস্যাই থাকত না। বাংলাদেশ হতো স্কেনডিনেভিয়ার এক প্রান্তে পড়ে থাকা ফিনল্যান্ডের মতো সম্পূর্ণ ঝামেলামুক্ত শান্তিপূর্ণ এক দেশ।
একবার একটি মেয়ে আমাকে বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তার অবস্থান আট শর কিছু বেশি। সে ভর্তি হতে চেয়েছিল অর্থনীতি অথবা ইংরেজিতে। পারেনি। কিন্তু তার বান্ধবী এক শিক্ষকের মেয়ে, যার অবস্থান ছিল ২ হাজার ৮০০-এর কাছাকাছি, সে ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেল একজন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী, তার সুবিধা তার বাবা সেখানকার একজন শিক্ষক। অন্যদিকে, মেধাবী একজন ওই বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং তার অপছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হলো। তার দুর্বলতা, সে কোনো কোটায় পড়ে না। বাংলাদেশে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে কোটার মূল্য বেশি। এই যে একটি মেধাবী মেয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়তে পারল না, এতে ক্ষতিটা তার যতটা হলো, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হলো জাতির। উচ্চশিক্ষা কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, যার মেধা আছে তারই তাতে অগ্রাধিকার। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে এবং সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ সুযোগের সমতার অর্থ এই নয় যে যোগ্যতা থাক বা না থাক সবাইকে একই রকম সুযোগ দিতে হবে। সুযোগের সমতার অর্থ অধিকতর যোগ্য আগে সুযোগ পাবে। এবং সেই সুযোগ পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার। সেই সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা তাকে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। বাংলাদেশের যুবসমাজের সবচেয়ে যোগ্য একটি অংশকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে রাষ্ট্র কোটা-ব্যবস্থার কারণে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র নিজে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্যতর মানুষের সেবা থেকে।
কোটা-ব্যবস্থা বিলুপ্তির দাবিতে বহু দেনদরবার হয়েছে। ছেলেমেয়েরা রাস্তায় আন্দোলন গণ-অনশন পর্যন্ত করেছে। আমিও তাদের কোনো কোনো আন্দোলনে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছি। আরও অনেকে করেছেন নাগরিক সমাজ থেকে। কোনো কাজ হয়নি। বরং আন্দোলনকারীরা পুলিশি নির্যাতনে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
অপরাজনীতি, দলীয়করণ, ধর্মীয় মৌলবাদ, নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের যত ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে কিছুমাত্র কম ক্ষতি করেনি কোটা-ব্যবস্থা। প্রশাসনে লোকজনের অভাব নেই, তা সত্ত্বেও সরকারি-আধা সরকারি প্রশাসনে আজ যে সর্বকালের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থা, তার জন্য কোটা-ব্যবস্থাই বেশি দায়ী। যোগ্যতর নয় অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য অথবা অতি অযোগ্য বাপ-দাদার নামে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ। চাকরিবাকরির ৫৫ শতাংশই কোটায় খেয়ে ফেলছে। মেধায় প্রতিযোগিতার সুযোগ কম। এর ফলে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা এবং রাষ্ট্রের প্রতি তীব্র ক্ষোভ।
বিষয়টি নিয়ে সরকারও বর্তমানে ভাবছে। ‘সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা বন্ধের প্রস্তাব উঠেছে। এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে আলোচনা চলছে।...সুযোগ নিয়ে অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরিতে কোটা সুবিধা নিচ্ছে। তাই এটি বন্ধ হওয়া উচিত। তাঁদের [সংসদীয় কমিটির সদস্যদের] অনেকে অবশ্য শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা নয়, জেলা কোটাসহ সব ধরনের কোটা বাতিলেরও দাবি তুলেছেন।’ [কালের কণ্ঠ, ১৫ মার্চ]
১১ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যে কোটা রয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে যে কোটা মানা হচ্ছে এবং জেলাভিত্তিক যে কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে সেটি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাটি বড়জোর সন্তান পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনি কিংবা পুতিদের এসব সুবিধা দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।’
মোকতাদির চৌধুরীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মর্যাদা দেওয়াটাই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য, বংশানুক্রমে তাদের বৈষয়িক সুবিধা দিলে তা হবে বৈষম্যমূলক। এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনেক দিন থেকেই আমাদের দাবি ছিল, মহাজোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে সংবেদনশীল। কোনো সুযোগের অপব্যবহার করা আমাদের জাতিগত ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বাড়ানোর পর যে কাণ্ড হয়েছে তা শুধু লজ্জার বিষয় নয়, শুধু নৈতিক স্খলনও নয়, রীতিমতো অপরাধ।
সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিন্তা থেকে এক-একটি নিয়ম চালু করে। কোটাপদ্ধতিও সেভাবেই চালু হয়েছিল। একসময় রাজধানী নগর ঢাকার অধিবাসীরাই বেশি চাকরিবাকরি বাগিয়ে নিতেন। সেই বিবেচনায় জেলা কোটা চালু করা হয়ে থাকবে, যাতে অনগ্রসর জেলার মানুষও সুযোগ পান। উচ্চশিক্ষায় একসময় নারী ছিলেন খুব কম। এখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে প্রায় সমান সমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ফলাফল ভালো করছেন। যদি তাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রেই যোগ্যতা দেখাতে পারেন, চাকরিতে কোটার প্রয়োজন কী? তাঁরা যদি ছেলেদের চেয়ে বেশি চাকরি পান, তাতেই-বা বলার কী? শারীরিক প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক অনগ্রসর নৃ-জনগোষ্ঠীর জন্যই শুধু কোটা সংরক্ষণ রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
কোটা-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রশাসনে মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অনেক পদ বহুদিন যাবৎ খালি পড়ে আছে। এভাবে খালি পড়ে থাকা অথবা অযোগ্যদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণের ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাষ্ট্র আপনা-আপনিই অকার্যকর হয়ে পড়বে। যোগ্য মেধাবীরা হতাশায় উগ্রবাদী হয়ে উঠতে পারে। সে উগ্রবাদ হতে পারে ধর্মীয় মৌলবাদী অথবা লেনিন-স্ট্যালিন-মাওবাদী। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে দুটোর সম্ভাবনাই প্রবল। অবিচার ও বৈষম্য মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে।
জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ থেকে বের হচ্ছে। তারা বিরাট মানবসম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক আচরণে অধিকাংশ মেধাবী ছেলেমেয়ে উপযুক্ত সুযোগ পাচ্ছে না কর্মজীবনে। এই অবস্থাকে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আখ্যায়িত করেছিলেন ‘এক জাতির মধ্যে দুটি জাতি সৃষ্টি করা’ বলে। জাতির এক অংশ সুবিধাপ্রাপ্ত, আরেক অংশ সুবিধাবঞ্চিত। তাঁর ভাষায়, ‘একদিকে রয়েছে যারা রাষ্ট্র থেকে নিয়েছে তারা এবং অন্যদিকে যারা সরকারি অর্থ ব্যয় থেকে কোনোভাবে লাভবান হয় না তারা। তাই বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবী ও গোটা পরিশীলিত শ্রেণিটি দখল করে বসে আছে পিরামিডের শীর্ষস্থানটি। তবু জনগণের আরও বেশি অংশকে প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা অসাধ্য কিছু নয়। একবার যখন উপলব্ধি করা হবে যে জাতির অস্তিত্বের একমাত্র সুযোগ রয়ে গেছে তার প্রধান সম্পদ জনসম্পদের সুষ্ঠু প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যে তখন সেই লক্ষ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা আমার কাছে কঠিন মনে হয় না।’ [বাংলাদেশ: জাতির অবস্থা, পৃ. ৬৩]
‘সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতা’ শীর্ষক সংবিধানের ২৯(১) ধারায় অতি স্পষ্ট করে বলা আছে: ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’
এর পরও কোটাপদ্ধতি যে চালু রয়েছে, তা অসাংবিধানিক। অবিলম্বে সংবিধানসম্মতভাবে কোটাপদ্ধতির সংস্কার করা হবে, এ-ই আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
কেউ বিনা বিচারে জেলের মোটা চালের ভাত খাচ্ছেন বছরের পর বছর। তাঁর বাবা বা ভাই আসেন সে সম্পর্কে কিছু লেখা যায় কি না। লেখার জন্য অনুরোধের বিষয়ের কোনো ঘাটতি নেই। একটি বিষয়ে বহু বছর যাবৎ বহু তরুণ-তরুণী অনুরোধ করছেন লেখার জন্য, তা হলো সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ও সরকারি চাকরিতে কোটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে প্রায়ই আমাকে এই অনুরোধ শুনতে হয়। তা ছাড়া, বাড়ি পর্যন্ত ছুটে এসেছেন দল বেঁধে অনেকে অনেকবার। তাঁরা বোঝেন না কাগজে চুটিয়ে লিখলেই যদি সমস্যার সুরাহা হতো, তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট তো দূরের কথা, কোনো সমস্যাই থাকত না। বাংলাদেশ হতো স্কেনডিনেভিয়ার এক প্রান্তে পড়ে থাকা ফিনল্যান্ডের মতো সম্পূর্ণ ঝামেলামুক্ত শান্তিপূর্ণ এক দেশ।
একবার একটি মেয়ে আমাকে বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তার অবস্থান আট শর কিছু বেশি। সে ভর্তি হতে চেয়েছিল অর্থনীতি অথবা ইংরেজিতে। পারেনি। কিন্তু তার বান্ধবী এক শিক্ষকের মেয়ে, যার অবস্থান ছিল ২ হাজার ৮০০-এর কাছাকাছি, সে ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেল একজন অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী, তার সুবিধা তার বাবা সেখানকার একজন শিক্ষক। অন্যদিকে, মেধাবী একজন ওই বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং তার অপছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হলো। তার দুর্বলতা, সে কোনো কোটায় পড়ে না। বাংলাদেশে মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে কোটার মূল্য বেশি। এই যে একটি মেধাবী মেয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়তে পারল না, এতে ক্ষতিটা তার যতটা হলো, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হলো জাতির। উচ্চশিক্ষা কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার নয়, যার মেধা আছে তারই তাতে অগ্রাধিকার। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে এবং সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(১) ধারায় বলা হয়েছে: ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ সুযোগের সমতার অর্থ এই নয় যে যোগ্যতা থাক বা না থাক সবাইকে একই রকম সুযোগ দিতে হবে। সুযোগের সমতার অর্থ অধিকতর যোগ্য আগে সুযোগ পাবে। এবং সেই সুযোগ পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার। সেই সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত করা তাকে সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। বাংলাদেশের যুবসমাজের সবচেয়ে যোগ্য একটি অংশকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে রাষ্ট্র কোটা-ব্যবস্থার কারণে। অন্যদিকে, রাষ্ট্র নিজে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্যতর মানুষের সেবা থেকে।
কোটা-ব্যবস্থা বিলুপ্তির দাবিতে বহু দেনদরবার হয়েছে। ছেলেমেয়েরা রাস্তায় আন্দোলন গণ-অনশন পর্যন্ত করেছে। আমিও তাদের কোনো কোনো আন্দোলনে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছি। আরও অনেকে করেছেন নাগরিক সমাজ থেকে। কোনো কাজ হয়নি। বরং আন্দোলনকারীরা পুলিশি নির্যাতনে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
অপরাজনীতি, দলীয়করণ, ধর্মীয় মৌলবাদ, নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের যত ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে কিছুমাত্র কম ক্ষতি করেনি কোটা-ব্যবস্থা। প্রশাসনে লোকজনের অভাব নেই, তা সত্ত্বেও সরকারি-আধা সরকারি প্রশাসনে আজ যে সর্বকালের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থা, তার জন্য কোটা-ব্যবস্থাই বেশি দায়ী। যোগ্যতর নয় অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য অথবা অতি অযোগ্য বাপ-দাদার নামে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ। চাকরিবাকরির ৫৫ শতাংশই কোটায় খেয়ে ফেলছে। মেধায় প্রতিযোগিতার সুযোগ কম। এর ফলে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা এবং রাষ্ট্রের প্রতি তীব্র ক্ষোভ।
বিষয়টি নিয়ে সরকারও বর্তমানে ভাবছে। ‘সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা বন্ধের প্রস্তাব উঠেছে। এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মধ্যে আলোচনা চলছে।...সুযোগ নিয়ে অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরিতে কোটা সুবিধা নিচ্ছে। তাই এটি বন্ধ হওয়া উচিত। তাঁদের [সংসদীয় কমিটির সদস্যদের] অনেকে অবশ্য শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের কোটা নয়, জেলা কোটাসহ সব ধরনের কোটা বাতিলেরও দাবি তুলেছেন।’ [কালের কণ্ঠ, ১৫ মার্চ]
১১ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে যে কোটা রয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নামে যে কোটা মানা হচ্ছে এবং জেলাভিত্তিক যে কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে সেটি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধাদের কোটাটি বড়জোর সন্তান পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনি কিংবা পুতিদের এসব সুবিধা দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।’
মোকতাদির চৌধুরীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে মর্যাদা দেওয়াটাই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য, বংশানুক্রমে তাদের বৈষয়িক সুবিধা দিলে তা হবে বৈষম্যমূলক। এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনেক দিন থেকেই আমাদের দাবি ছিল, মহাজোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে সংবেদনশীল। কোনো সুযোগের অপব্যবহার করা আমাদের জাতিগত ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়স বাড়ানোর পর যে কাণ্ড হয়েছে তা শুধু লজ্জার বিষয় নয়, শুধু নৈতিক স্খলনও নয়, রীতিমতো অপরাধ।
সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিন্তা থেকে এক-একটি নিয়ম চালু করে। কোটাপদ্ধতিও সেভাবেই চালু হয়েছিল। একসময় রাজধানী নগর ঢাকার অধিবাসীরাই বেশি চাকরিবাকরি বাগিয়ে নিতেন। সেই বিবেচনায় জেলা কোটা চালু করা হয়ে থাকবে, যাতে অনগ্রসর জেলার মানুষও সুযোগ পান। উচ্চশিক্ষায় একসময় নারী ছিলেন খুব কম। এখন অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে প্রায় সমান সমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে ফলাফল ভালো করছেন। যদি তাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রেই যোগ্যতা দেখাতে পারেন, চাকরিতে কোটার প্রয়োজন কী? তাঁরা যদি ছেলেদের চেয়ে বেশি চাকরি পান, তাতেই-বা বলার কী? শারীরিক প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক অনগ্রসর নৃ-জনগোষ্ঠীর জন্যই শুধু কোটা সংরক্ষণ রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।
কোটা-ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রশাসনে মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে অনেক পদ বহুদিন যাবৎ খালি পড়ে আছে। এভাবে খালি পড়ে থাকা অথবা অযোগ্যদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণের ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাষ্ট্র আপনা-আপনিই অকার্যকর হয়ে পড়বে। যোগ্য মেধাবীরা হতাশায় উগ্রবাদী হয়ে উঠতে পারে। সে উগ্রবাদ হতে পারে ধর্মীয় মৌলবাদী অথবা লেনিন-স্ট্যালিন-মাওবাদী। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে দুটোর সম্ভাবনাই প্রবল। অবিচার ও বৈষম্য মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে।
জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। প্রতিবছর অন্তত ১০ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ থেকে বের হচ্ছে। তারা বিরাট মানবসম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারছে না রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষপাতমূলক আচরণে অধিকাংশ মেধাবী ছেলেমেয়ে উপযুক্ত সুযোগ পাচ্ছে না কর্মজীবনে। এই অবস্থাকে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আখ্যায়িত করেছিলেন ‘এক জাতির মধ্যে দুটি জাতি সৃষ্টি করা’ বলে। জাতির এক অংশ সুবিধাপ্রাপ্ত, আরেক অংশ সুবিধাবঞ্চিত। তাঁর ভাষায়, ‘একদিকে রয়েছে যারা রাষ্ট্র থেকে নিয়েছে তারা এবং অন্যদিকে যারা সরকারি অর্থ ব্যয় থেকে কোনোভাবে লাভবান হয় না তারা। তাই বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবী ও গোটা পরিশীলিত শ্রেণিটি দখল করে বসে আছে পিরামিডের শীর্ষস্থানটি। তবু জনগণের আরও বেশি অংশকে প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা অসাধ্য কিছু নয়। একবার যখন উপলব্ধি করা হবে যে জাতির অস্তিত্বের একমাত্র সুযোগ রয়ে গেছে তার প্রধান সম্পদ জনসম্পদের সুষ্ঠু প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যে তখন সেই লক্ষ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করা আমার কাছে কঠিন মনে হয় না।’ [বাংলাদেশ: জাতির অবস্থা, পৃ. ৬৩]
‘সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতা’ শীর্ষক সংবিধানের ২৯(১) ধারায় অতি স্পষ্ট করে বলা আছে: ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’
এর পরও কোটাপদ্ধতি যে চালু রয়েছে, তা অসাংবিধানিক। অবিলম্বে সংবিধানসম্মতভাবে কোটাপদ্ধতির সংস্কার করা হবে, এ-ই আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
No comments