রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি জরুরি by ইমতিয়াজ আহমেদ
বিএনপিসহ
বিরোধী রাজনৈতিক জোটের টানা অবরোধ, নিয়মিত হরতাল ও সেই সঙ্গে নাশকতা
চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনায় এক চরম অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে
দেশ। এই পরিস্থিতি উত্তরণের পথ নিয়ে মতামত দিয়েছেন ইমতিয়াজ আহমেদ।
মানতেই হবে যে আজকের গভীর রাজনৈতিক সংকট ও তীব্র সংঘাতের গোড়ায় রয়েছে
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বিবাদ। কোন ধরনের পদ্ধতিতে
নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাবে, তা নিয়ে আমাদের কিছু
অভিজ্ঞতা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এমনকি ক্ষমতাসীন সরকারের
অধীনেও নির্বাচন হয়েছে। একটা বিষয় পরিষ্কার তা হলো তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থায় নির্বাচনের ফর্মুলা একটি বড় দল মানবে না। ৫ জানুয়ারির
নির্বাচনী ফর্মুলা আরেকটা বড় জোট মানবে না। এখন আমাদের প্রয়োজন তৃতীয়
আরেকটা ফর্মুলা, যা আগের দুটির মতো হবে না। এ ধরনের প্রস্তাব সরকারি দল
থেকে আসাই বাঞ্ছনীয়—যেহেতু বিগত সময়ের কেয়ারটেকার এবং ৫ জানুয়ারি মডেলে
নির্বাচনের ফর্মুলা সে সময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকেই এসেছিল।
রাজনীতির বাজারে আরও যা চিন্তা আছে, তা আমলে নিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে
সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার ফর্মুলাই এখন আমাদের খুঁজতে হবে। এবং এটা
সরকারই ভালো জানবে যে কী করলে অন্যরা নির্বাচনে আসবে। এই লক্ষ্যে সরকারের
উদ্যোগে রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে মীমাংসায় আসতে হবে। একে আমরা রাজনৈতিক
চুক্তি বা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে পারি।
তবে কেবল নির্বাচনী মীমাংসা ছাড়াও জনগণের দিক থেকে আরও কিছু চাহিদা উত্থাপিত হয়েছে। দেখা যায়, নির্বাচন আসন্ন হয়ে উঠলেই নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের ফলে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। ক্ষমতার কাড়াকাড়ির বড় খেসারতটা তাঁদেরই জীবন ও সম্পদের মূল্যে দিতে হয়। সে কারণে তাঁরাও ভরসা চান যে ভবিষ্যতে আর এ রকমটা হবে না। সে জন্যই দ্বিতীয় আরেকটা চুক্তি হতে হবে। এটা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সবার সঙ্গে জনগণের চুক্তি। তাই একে বলছি সামাজিক চুক্তি। এ দুই সমঝোতার কতগুলো মৌলিক দিক এখানে উল্লেখ করছি:
১. ১৯৭১-এর ব্যাপারে কোনো আপস না করা। যেমন: যুদ্ধাপরাধ যদি কেউ করে, সেই অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। তবে একে যেন দলীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে না দেখা তথা এর রাজনীতিকরণ করা যাবে না। এ বিষয়টিকে নির্বাচন বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। যেহেতু এটা জনগণের দাবি, তাই আইনের শাসনের অংশ হিসেবেই একে দেখতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
২. জাতির পিতার ব্যাপারে, তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বিষয়ে জাতীয়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
৩. বাংলাদেশের ফাউন্ডিং হিরো তথা প্রতিষ্ঠা নায়কেরা যেমন মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমানসহ যাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন, তাঁদের উচ্চ সম্মানের আসন দিতে হবে—পরে তাঁদের ভূমিকা যা-ই হোক।
৪. ঘৃণাবিদ্বেষের ভাষণ তথা ‘হেইট স্পিচ’ থেকে বিরত থাকা। সেটা সংসদের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই করা হোক। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সিভিল সোসাইটি বা অন্য যেখানেই কেউ থাকুন, সবাইকেই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।
৫. হরতাল ডাকা যেতে পারে, কিন্তু পিকেটিং করা বা কাউকে বাধ্য করা যাবে না। একে জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পিকেটিং বা সহিংসতা হলে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।
৬. দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দল যেহেতু জনগণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সেহেতু তারা বলতে পারে না তারা নিজেদের মতো করে দলের নিয়মকানুন ঠিক করে নেবে। সব দলীয় পদে দলীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং কোনো নেতা এক পদে দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। ওই পদে ফিরে আসতে হলে তাঁকে মাঝখানে বিরতি দিয়ে আসতে হবে।
৭. সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। দেখা যায় ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব। সুতরাং মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে গণভোট দিতে হবে।
এই রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি একসঙ্গেই হতে হবে। প্রশ্ন হলো, কে করবে? রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাব সরকারের তরফেই আসতে হবে। আর সামাজিক চুক্তি সমাজের বিভিন্ন পক্ষ মিলে তৈরি করবে। সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে ধর্মসমাজ, সামরিক সমাজ; সবারই মতামত নিতে হবে। এভাবে রাজনীতিবিদদের সমাজের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে।
আমি মনে করি, এ ধরনের সাত-আটটা বিষয়ে সমঝোতা হলে ভবিষ্যতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, জনগণ আশ্বস্ত হবে যে আবার আগের সংঘাত-প্রাণহানির পরিস্থিতি ফিরে আসবে না।
বাংলাদেশে নির্বাচনে যে হেরে যায়, তার ওপরে দমন-পীড়নের সুনামি নেমে আসে। এ জন্যই ক্ষমতায় থাকাকালে তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। এটা রোধ করতে হলে এ ধরনের সমঝোতা ও মীমাংসা দরকার। তাহলে মনে হবে যে এক জায়গায় আমরা থামলাম।
নাগরিক সমাজ এ প্রস্তাবগুলো আরও পরিষ্কার করে আলোচনা করতে পারে। জনগণ ও রাজনীতিবিদ, সবারই স্বতঃসিদ্ধ অধিকার আছে রাজনীতির ব্যাপারে মত দেওয়ার। যেহেতু নাগরিকেরা ভোট দেন, সেহেতু তাঁরাও রাজনৈতিক সত্তাধারী। সেহেতু রাজনীতির এখতিয়ার কেবল রাজনীতিবিদদের হতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সমাজের অন্যান্য অংশেরও ভূমিকা রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে কেবল নির্বাচনী মীমাংসা ছাড়াও জনগণের দিক থেকে আরও কিছু চাহিদা উত্থাপিত হয়েছে। দেখা যায়, নির্বাচন আসন্ন হয়ে উঠলেই নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের ফলে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। ক্ষমতার কাড়াকাড়ির বড় খেসারতটা তাঁদেরই জীবন ও সম্পদের মূল্যে দিতে হয়। সে কারণে তাঁরাও ভরসা চান যে ভবিষ্যতে আর এ রকমটা হবে না। সে জন্যই দ্বিতীয় আরেকটা চুক্তি হতে হবে। এটা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সবার সঙ্গে জনগণের চুক্তি। তাই একে বলছি সামাজিক চুক্তি। এ দুই সমঝোতার কতগুলো মৌলিক দিক এখানে উল্লেখ করছি:
১. ১৯৭১-এর ব্যাপারে কোনো আপস না করা। যেমন: যুদ্ধাপরাধ যদি কেউ করে, সেই অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। তবে একে যেন দলীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে না দেখা তথা এর রাজনীতিকরণ করা যাবে না। এ বিষয়টিকে নির্বাচন বা রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। যেহেতু এটা জনগণের দাবি, তাই আইনের শাসনের অংশ হিসেবেই একে দেখতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
২. জাতির পিতার ব্যাপারে, তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বিষয়ে জাতীয়ভাবে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
৩. বাংলাদেশের ফাউন্ডিং হিরো তথা প্রতিষ্ঠা নায়কেরা যেমন মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমানসহ যাঁরা স্বাধীনতাসংগ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন, তাঁদের উচ্চ সম্মানের আসন দিতে হবে—পরে তাঁদের ভূমিকা যা-ই হোক।
৪. ঘৃণাবিদ্বেষের ভাষণ তথা ‘হেইট স্পিচ’ থেকে বিরত থাকা। সেটা সংসদের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই করা হোক। রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সিভিল সোসাইটি বা অন্য যেখানেই কেউ থাকুন, সবাইকেই এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।
৫. হরতাল ডাকা যেতে পারে, কিন্তু পিকেটিং করা বা কাউকে বাধ্য করা যাবে না। একে জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। পিকেটিং বা সহিংসতা হলে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।
৬. দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দল যেহেতু জনগণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়, সেহেতু তারা বলতে পারে না তারা নিজেদের মতো করে দলের নিয়মকানুন ঠিক করে নেবে। সব দলীয় পদে দলীয় নির্বাচন দিতে হবে এবং কোনো নেতা এক পদে দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। ওই পদে ফিরে আসতে হলে তাঁকে মাঝখানে বিরতি দিয়ে আসতে হবে।
৭. সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। দেখা যায় ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সম্ভব। সুতরাং মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে গণভোট দিতে হবে।
এই রাজনৈতিক ও সামাজিক চুক্তি একসঙ্গেই হতে হবে। প্রশ্ন হলো, কে করবে? রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাব সরকারের তরফেই আসতে হবে। আর সামাজিক চুক্তি সমাজের বিভিন্ন পক্ষ মিলে তৈরি করবে। সিভিল সোসাইটি থেকে শুরু করে ধর্মসমাজ, সামরিক সমাজ; সবারই মতামত নিতে হবে। এভাবে রাজনীতিবিদদের সমাজের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে।
আমি মনে করি, এ ধরনের সাত-আটটা বিষয়ে সমঝোতা হলে ভবিষ্যতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক, জনগণ আশ্বস্ত হবে যে আবার আগের সংঘাত-প্রাণহানির পরিস্থিতি ফিরে আসবে না।
বাংলাদেশে নির্বাচনে যে হেরে যায়, তার ওপরে দমন-পীড়নের সুনামি নেমে আসে। এ জন্যই ক্ষমতায় থাকাকালে তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চায়। এটা রোধ করতে হলে এ ধরনের সমঝোতা ও মীমাংসা দরকার। তাহলে মনে হবে যে এক জায়গায় আমরা থামলাম।
নাগরিক সমাজ এ প্রস্তাবগুলো আরও পরিষ্কার করে আলোচনা করতে পারে। জনগণ ও রাজনীতিবিদ, সবারই স্বতঃসিদ্ধ অধিকার আছে রাজনীতির ব্যাপারে মত দেওয়ার। যেহেতু নাগরিকেরা ভোট দেন, সেহেতু তাঁরাও রাজনৈতিক সত্তাধারী। সেহেতু রাজনীতির এখতিয়ার কেবল রাজনীতিবিদদের হতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সমাজের অন্যান্য অংশেরও ভূমিকা রয়েছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments