লেখ্য–সংস্কৃতি, অস্তপ্রায় হস্তলিপি by উম্মে মুসলিমা
সংবাদটা
এ রকম: ‘এখন আর আমেরিকান কোনো স্কুলছাত্র বলতে পারবে না আমার বইটি
কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। কারণ, আমেরিকার অধিকাংশ স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বইয়ের
পরিবর্তে ল্যাপটপ দিয়ে শিক্ষাদান করা হচ্ছে। পাঠ্যবই, নোটবুক ও কাগজের
পরিবর্তে তাদের হাতে দেওয়া হচ্ছে ল্যাপটপ। তারা বইয়ের পরিবর্তে ল্যাপটপ
নিয়ে পড়াশোনা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আশঙ্কাটা এখানেই। তাহলে কি
ভবিষ্যতের শিশুরা কেবল পড়াই শিখবে, লেখা নয়? যেখানে কেবল অক্ষর চিনে
কম্পিউটারের বোতাম টিপলেই লেখা বের হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কোনো মা কি আর
সন্তানকে হাতে পেনসিল ধরিয়ে স্লেটে বা কাগজে অ আ ক খ-এ বি সি ডি লেখা
শেখাবেন? ছোট হাতের-বড় হাতের অক্ষর লেখা শেখার জন্য শিশুদের আর কসরত করতে
হবে না? হাতের লেখা প্রতিযোগিতা বলে আর কিছু থাকবে না? পরীক্ষার খাতায়
হাতের লেখা সুন্দর হলে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। হাতের লেখা কি একটা লুপ্ত
শিল্পে পরিণত হবে? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কাগজে তাঁর লেখা কাটাকুটি করতে
গিয়ে ছবি এঁকে ফেলেছিলেন, যা নিয়ে এখনো গবেষণা হচ্ছে। কম্পিউটারে লেখালেখি
হলে এমন বিমূর্ত চিত্রকলার আর জন্ম হবে? কম্পিউটারে অভ্যস্ত নিশ্চয় কেউ
হাতে–কলমে পরীক্ষা দেবে না।
সেকালে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গরিব কৃষক পরিবারে নবজাতক ছেলেশিশুর হিতাকাঙ্ক্ষীরা তার শয্যার পাশে প্রতীক হিসেবে মাটি-কাদা দিয়ে ছোট্ট লাঙল বানিয়ে রেখে দিতেন। যেন বড় হয়ে ছেলেটি ভালো কৃষক হতে পারে। যে ছেলেশিশুর আত্মীয়স্বজন একটু উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তাঁরা রেখে দিতেন দোয়াত-কলম। যাতে শিশুটি বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার হয়। মেয়েশিশুর জন্য দোয়াত-কলম দূরে থাকুক, হাঁড়ি-কড়াইও রাখা হতো না। কারণ, মেয়ে বড় হয়ে হাঁড়ি ঠেলা ছাড়া আর কীই-বা করবে? কালি–কলমের দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। চলছে বলপেনের যুগ। তো লেখাই যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বলপেনেরই বা কী দরকার? যুগটা কম্পিউটার আর সেলফোনের কবজায়। সেলফোনে যোগাযোগের সহজলভ্যতায় চিঠি লেখার সংস্কৃতি যেমন ক্রমেই অপস্রিয়মাণ, তেমনি কম্পিউটারের সুবিধা এসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের লেখাও বিলুপ্তির পথে যাওয়ারই আশঙ্কা।
আগের দিনের কবি-সাহিত্যিকেরা পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে প্রকাশের জন্য পাঠাতেন। বয়স্করা অনেকেই এখনো তা-ই করেন, কিন্তু সাহিত্যিক ভ্রাতৃত্রয় হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীবের গর্ভধারিণী বেগম ফয়জুন্নেসা প্রবীণ হলেও কম্পিউটারে লিখে বই প্রকাশ করেছেন। এখনকার তরুণেরা আর হাতে লেখার বাড়তি ঝামেলায় যাচ্ছেন না। তাঁরা বলেন, হাতে লেখার অসুবিধা অনেক—সাহিত্য কাটাছেঁড়া ছাড়া যেমন পারফেক্ট হয় না, তেমনি হাতে লিখে সঠিক স্থানে সংশোধিত ভাবনার অন্তর্ভুক্তিও অনেক সময় জায়গার অভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। আবার তাড়াহুড়ায় নিজের লেখা মাঝেমধ্যে নিজেরই বুঝতে অসুবিধা হয়। টেবিলে খোলাকাগজে লিখে রেখে চলে গেলে চায় কি পাতাটা দখিনা বাতাসে উড়ে বাইরে চলে যেতে পারে। খোলা লেখা কৌতূহলী পাঠকেরা আগেই পড়ে ফেলতে পারে বা শিশুরা নৌকা-উড়োজাহাজ বানানোর কাগজ খুঁজে না পেয়ে ওটার সদ্গতি করতে পারে।
এমন হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে বাসা বদলের পর লেখার খাতাটা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। চায়ের কাপ, পানির গ্লাস অসাবধানে লেখার ওপর ঢলে পড়লে চুল ছেঁড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। প্রখ্যাত লেখিকা নবনীতা দেবসেন রামায়ণ নিয়ে তাঁর অনেক পরিশ্রমের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ক্যাশ বাক্সের মতো একটা কিছুর মধ্যে রেখেছিলেন। সেটা চোরে নিয়ে গেলে তিনি সে কাজে আর হাত দিতে পারেননি। কী দরকার এসব হুমকির মুখে পড়ার? তারচেয়ে কি-বোর্ড চালনা শিখে ভাবনাগুলো কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দিয়ে বাক্সবন্দী করে রাখলে আর ভাবনা থাকে না।
হাতের লেখা শেখার সংস্কৃতি যদি ক্রমেই শেষ হয়ে যেতে থাকে, তবে খাতা-কাগজ, কলম, পেনসিল ও রিফিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পথে বসবে। অনেকে বলবেন লেখা শেখাও চলবে, কলমের প্রয়োজনও ফুরাবে না। কারণ, গৃহবধূ নারীরা বাজারের ফর্দ স্বামীর হাতে কীভাবে ধরিয়ে দেবেন? আপনার কাছে ভিজিটিং কার্ড নেই, বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে আপনার ঠিকানা শুধু মুখে বলে দিলেই কি হবে? কাগজে লিখে না দিলে মনে থাকবে? অস্থির প্রেমিকেরা প্রেমিকাদের হাতে লেখা চিরকুট না পাঠিয়ে থাকতে পারবেন? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, সই বা স্বাক্ষর করা ছাড়া বড় বড় চুক্তি সম্পাদন হবে কী করে? টাকাপয়সাই বা ব্যাংক থেকে ওঠাবেন কেমন করে? পাসপোর্টে, বিয়ের কাবিননামায়, তালাকপত্রে সই, ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ ইত্যাদি লেখা না শিখলে পারবেন?
এর একটাই উত্তর, সই-সাবুদ করার জন্য লেখা না শিখলেও চলে। সই হচ্ছে একটা চিহ্ন। হিজিবিজি আঁকিবুঁকি যেমন ইচ্ছে তেমন করে একটা নির্দিষ্ট স্টাইল তৈরি করে নিলেই হলো। ইমিগ্রেশন ফরম পূরণের জন্যও ভবিষ্যতে আর ছাপানো ফরম ধরিয়ে দেবে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে হয়তো অসংখ্য সারি দেওয়া কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা কম্পিউটারের মাধ্যমেই ফরম পূরণ করে এক সেকেন্ডে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। আর ফর্দ, চিরকুট বা ঠিকানা লেখার জন্য লেখা শেখা জরুরি? যারা এখন লিখতে পারেন, তাদের কজনই বা হাতে লিখে এসব করছেন? সেলফোনটিই তো এখন কম্পিউটারের কাজ করছে। খুদেবার্তা দিয়ে সব কাজ সারছেন আবার খরচও সাশ্রয় হচ্ছে।
তাই এখন কম্পিউটার ও সেলফোনের এ বিস্ময় যুগে প্রবেশ করে আমাদের যদি হাতের লেখার আর প্রয়োজন না পড়ে, তাহলে পৃথিবীর মিউজিয়ামগুলোয় একটা করে কম্পোনেন্ট বাড়বে, যেখানে মানুষের হাতের লেখা ভবিষ্যতের দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
সেকালে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গরিব কৃষক পরিবারে নবজাতক ছেলেশিশুর হিতাকাঙ্ক্ষীরা তার শয্যার পাশে প্রতীক হিসেবে মাটি-কাদা দিয়ে ছোট্ট লাঙল বানিয়ে রেখে দিতেন। যেন বড় হয়ে ছেলেটি ভালো কৃষক হতে পারে। যে ছেলেশিশুর আত্মীয়স্বজন একটু উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তাঁরা রেখে দিতেন দোয়াত-কলম। যাতে শিশুটি বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার হয়। মেয়েশিশুর জন্য দোয়াত-কলম দূরে থাকুক, হাঁড়ি-কড়াইও রাখা হতো না। কারণ, মেয়ে বড় হয়ে হাঁড়ি ঠেলা ছাড়া আর কীই-বা করবে? কালি–কলমের দিন কবেই শেষ হয়ে গেছে। চলছে বলপেনের যুগ। তো লেখাই যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বলপেনেরই বা কী দরকার? যুগটা কম্পিউটার আর সেলফোনের কবজায়। সেলফোনে যোগাযোগের সহজলভ্যতায় চিঠি লেখার সংস্কৃতি যেমন ক্রমেই অপস্রিয়মাণ, তেমনি কম্পিউটারের সুবিধা এসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের লেখাও বিলুপ্তির পথে যাওয়ারই আশঙ্কা।
আগের দিনের কবি-সাহিত্যিকেরা পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে প্রকাশের জন্য পাঠাতেন। বয়স্করা অনেকেই এখনো তা-ই করেন, কিন্তু সাহিত্যিক ভ্রাতৃত্রয় হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, আহসান হাবীবের গর্ভধারিণী বেগম ফয়জুন্নেসা প্রবীণ হলেও কম্পিউটারে লিখে বই প্রকাশ করেছেন। এখনকার তরুণেরা আর হাতে লেখার বাড়তি ঝামেলায় যাচ্ছেন না। তাঁরা বলেন, হাতে লেখার অসুবিধা অনেক—সাহিত্য কাটাছেঁড়া ছাড়া যেমন পারফেক্ট হয় না, তেমনি হাতে লিখে সঠিক স্থানে সংশোধিত ভাবনার অন্তর্ভুক্তিও অনেক সময় জায়গার অভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। আবার তাড়াহুড়ায় নিজের লেখা মাঝেমধ্যে নিজেরই বুঝতে অসুবিধা হয়। টেবিলে খোলাকাগজে লিখে রেখে চলে গেলে চায় কি পাতাটা দখিনা বাতাসে উড়ে বাইরে চলে যেতে পারে। খোলা লেখা কৌতূহলী পাঠকেরা আগেই পড়ে ফেলতে পারে বা শিশুরা নৌকা-উড়োজাহাজ বানানোর কাগজ খুঁজে না পেয়ে ওটার সদ্গতি করতে পারে।
এমন হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে বাসা বদলের পর লেখার খাতাটা আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। চায়ের কাপ, পানির গ্লাস অসাবধানে লেখার ওপর ঢলে পড়লে চুল ছেঁড়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। প্রখ্যাত লেখিকা নবনীতা দেবসেন রামায়ণ নিয়ে তাঁর অনেক পরিশ্রমের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ক্যাশ বাক্সের মতো একটা কিছুর মধ্যে রেখেছিলেন। সেটা চোরে নিয়ে গেলে তিনি সে কাজে আর হাত দিতে পারেননি। কী দরকার এসব হুমকির মুখে পড়ার? তারচেয়ে কি-বোর্ড চালনা শিখে ভাবনাগুলো কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দিয়ে বাক্সবন্দী করে রাখলে আর ভাবনা থাকে না।
হাতের লেখা শেখার সংস্কৃতি যদি ক্রমেই শেষ হয়ে যেতে থাকে, তবে খাতা-কাগজ, কলম, পেনসিল ও রিফিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পথে বসবে। অনেকে বলবেন লেখা শেখাও চলবে, কলমের প্রয়োজনও ফুরাবে না। কারণ, গৃহবধূ নারীরা বাজারের ফর্দ স্বামীর হাতে কীভাবে ধরিয়ে দেবেন? আপনার কাছে ভিজিটিং কার্ড নেই, বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে আপনার ঠিকানা শুধু মুখে বলে দিলেই কি হবে? কাগজে লিখে না দিলে মনে থাকবে? অস্থির প্রেমিকেরা প্রেমিকাদের হাতে লেখা চিরকুট না পাঠিয়ে থাকতে পারবেন? আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, সই বা স্বাক্ষর করা ছাড়া বড় বড় চুক্তি সম্পাদন হবে কী করে? টাকাপয়সাই বা ব্যাংক থেকে ওঠাবেন কেমন করে? পাসপোর্টে, বিয়ের কাবিননামায়, তালাকপত্রে সই, ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ ইত্যাদি লেখা না শিখলে পারবেন?
এর একটাই উত্তর, সই-সাবুদ করার জন্য লেখা না শিখলেও চলে। সই হচ্ছে একটা চিহ্ন। হিজিবিজি আঁকিবুঁকি যেমন ইচ্ছে তেমন করে একটা নির্দিষ্ট স্টাইল তৈরি করে নিলেই হলো। ইমিগ্রেশন ফরম পূরণের জন্যও ভবিষ্যতে আর ছাপানো ফরম ধরিয়ে দেবে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে হয়তো অসংখ্য সারি দেওয়া কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা কম্পিউটারের মাধ্যমেই ফরম পূরণ করে এক সেকেন্ডে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে দিতে পারবেন। আর ফর্দ, চিরকুট বা ঠিকানা লেখার জন্য লেখা শেখা জরুরি? যারা এখন লিখতে পারেন, তাদের কজনই বা হাতে লিখে এসব করছেন? সেলফোনটিই তো এখন কম্পিউটারের কাজ করছে। খুদেবার্তা দিয়ে সব কাজ সারছেন আবার খরচও সাশ্রয় হচ্ছে।
তাই এখন কম্পিউটার ও সেলফোনের এ বিস্ময় যুগে প্রবেশ করে আমাদের যদি হাতের লেখার আর প্রয়োজন না পড়ে, তাহলে পৃথিবীর মিউজিয়ামগুলোয় একটা করে কম্পোনেন্ট বাড়বে, যেখানে মানুষের হাতের লেখা ভবিষ্যতের দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।
No comments