পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোলট্রিশিল্প
গত
২৮ জানুয়ারি ২০১৫ প্রথমআলোর আয়োজনে ‘পুষ্টিচাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক
উন্নয়নে পোলট্রিশিল্প’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে
উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো...
আলোচনায় সুপারিশ
. পোলট্রিশিল্পের ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
. ট্যানারি মালিকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাধ্য করতে হবে
. কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের লোকবল, বিনিয়োগসহ সব ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে হবে
. কোনো খামার নিবন্ধন ছাড়া থাকতে পারবে না
. মাত্র ৫–১০ শতাংশ ব্যাড নিউজের প্রচার যেন পুেরা শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে না দেয়, গণমাধ্যমকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে
. মুরগি ও ডিম অনেক সহজলভ্য করতে হবে
. ক্ষুদ্র পোলট্রিশিল্পের ওপর অবশ্যই তদারক ও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ আমিষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু দেশে এ আমিষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পোলট্রিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পোলট্রিশিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দৈনিক খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ হয় পোলট্রিশিল্প থেকে। এ শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
অন্যদিকে সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে পোলট্রিশিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ শিল্প সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করি, এ শিল্প সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর হোক। পোলট্রিশিল্পের আরও উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করার বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরি হোক।
মসিউর রহমান: পোলট্রিশিল্প শুরুতে একটি আমদািননির্ভর শিল্প ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পোলট্রির মুরগি ও ডিমের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শিল্পটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এর বিনিয়োগ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে খামার ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে মোট উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিডমিলগুলোতে উৎপন্ন হচ্ছে। পোলট্রির খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন প্রায় ৭০–৮০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প।আমরা নিরাপদ পোলট্রিশিল্প–খাদ্য নিশ্চিত করেছি। বাইরের কাউকে খামারে প্রবেশ করতে হলে কয়েক ধাপে জীবাণুমুক্ত হয়ে, গোসল করে ও নির্দিষ্ট কাপড় পরে প্রবেশ করতে হয়। বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প এখন প্রযুক্তিনির্ভর।
আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে সপ্তাহে এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি ডিম ফোটানো হয়। মুরগি পালনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খাবার ও পানি সরবরাহ, ডিম সংগ্রহ—সবকিছু স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা হয়। ফলে ভোক্তা স্বাস্থ্যকর-জীবাণুমুক্ত ডিম ও মুরগির মাংস পেয়ে থাকে।
প্রায় প্রতিটি বড় ফিড মিলের নিজস্ব গবেষণাগার আছে। খাদ্য তৈরিতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভুট্টা, ওষুধ ও কাঁচামালের পরিমাণ—সবকিছুর সঠিক মান নিশ্চিত করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, নিরাপদ-স্বাস্থ্যকর ডিম ও মাংস সরবরাহ। পোলট্রিশিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ মাংস এখন হোটেল সোনারগাঁও, রেডিসনসহ বড় বড় শপিং মলে পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের মাংস ও ডিম গুণগত মানসম্পন্ন।
সরকারের সহযোগিতা পেলে ২০২০ সাল নাগাদ বিনিয়োগ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পোলট্রিশিল্পের ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তা, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মো. রফিকুল হক: ডিম একটি আদর্শ প্রোটিন হিসেবে বিবেচিত। দেশে ডিমের পর্যাপ্ত চাহিদা রয়েছে। একটি প্রবাদ আছে, ‘হেলদি ফুড হেলদি নেশন’। আমরা নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিই। নিরাপদ ডিমের বিষয়ে আপস করি না। ডিম উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লেয়ার ফার্ম তৈরি করতে হয়। সেখানে রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় জৈব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। মুরগিকে সুষম, জীবাণুমুক্ত খাবার এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা দিলেই কেবল এ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ডিম উৎপাদন করা সম্ভব হয়। খাবার কীভাবে দূষিত হয়? খাবারে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। টক্সিন-মাইক্রোটক্সিন থাকতে পারে। আমরা দেখেশুনে গুণগত মান বজায় আছে এমন খাবার কিনি। এর পরও ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খাবারকে প্রক্রিয়া করি। তা ছাড়া খাদ্যে কোনো টক্সিন থাকলে এটা মুক্ত করার জন্য টক্সিন বাইন্ডার ব্যবহার করা হয়। খাদ্যের মান বৃদ্ধির জন্য খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ব্যবহার করা হয়। এর ফলে মুরগি খাদ্য থেকে সম্পূর্ণ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে।
আগে মুরগির অসুখ হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতো। এখন আমরা রোগ প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দিই। রোগ যাতে না আসতে পারে, সেটিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা এমন ব্যবস্থা নিই, যাতে রোগ না হয়। খামারিদের স্বার্থেই খামারিরা মানসম্মত খাবার ব্যবহার করেন। তাই মুরগি থেকে যে ডিম পাইন সেটা আদর্শ, নিরাপদ ও প্রোটিনসমৃদ্ধ। কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সবাই ফার্মের প্রোটিনসমৃদ্ধ ডিম ও মাংস খেতে পারেন।
নাজমা শাহীন: পোলট্রি ফার্মগুলোর বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মানুষের কোনো প্রকার ভুল ধারণা থাকবে না। বাংলাদেশের পুষ্টির অবস্থা সবাইকে ভাবতে হবে। তাহলে পোলট্রিশিল্পের গুরুত্ব বোঝা যাবে। দেশে পাঁচ বছরের শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। মেডিকেলের ভাষায় একে স্টানটিং বলা হয়। দেশের ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন কম। প্রজননক্ষম নারীর ২৫ শতাংশ ক্রনিক এনার্জি ঘাটতিতে ভুগছেন। এ কারণে জন্মের সময় বাচ্চাদের ওজন কম হচ্ছে। আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও পুষ্টিতে বেশ পিছিয়ে আছি। খাদ্য ও কৃষি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের শক্তির ৬০ শতাংশ আসার কথা শস্যজাতীয় পণ্য থেকে। ১০-১৫ শতাংশ আসার কথা আমিষ থেকে। এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ।
বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একজন ৭ গ্রাম ডিম, ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খায়। এর থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে এক ও তিন গ্রাম। মুরগি ও ডিম থেকে দৈনিক চার গ্রাম আমিষ। প্রতিদিনের খাদ্যে ৩৩-৬৬ শতাংশ আমিষ থাকার কথা। এর মধ্যে প্রাণিজ আমিষ থাকবে কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট শরীরে জমা থাকে। কিন্তু আমিষ জমা থাকে না। প্রতিদিনের খাদ্য থেকে এটা গ্রহণ করতে হয়।
অমিষের অভাব হলে শিশু খর্বাকৃতির হবে। কিছু প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল প্রাণিজ আমিষ থেকে আসে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যানারি বর্জ্য গ্রহণের ফলে কিছু মুরগির মধ্যে সামান্য পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। ক্রোমিয়াম শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পোলট্রি থেকে যথেষ্ট প্রাণিজ আমিষ আসছে। কিন্তু ছোট খামারিরা যাতে কোনোভাবে ট্যানারি বর্জ্য খাওয়ানোর সুযোগ না পান, সে ব্যবস্থা করতে হবে।ট্যানারির মালিকদের যেকোনোভাবে তাঁদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাধ্য করতে হবে। প্রাণিজ আমিষ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে সেটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
গোলাম রহমান, অধ্যাপক : আমাদের দেশে পোলট্রিশিল্প অনেক বড় হচ্ছে। যেকোনো শিল্প বড় হওয়ার সময় কিছু বাধা আসে। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, যাতে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। উপস্থাপনায় যে ভিডিওচিত্র দেখা গেল, সেটি একটি আদর্শ মানসম্মত ফার্ম। কিন্তু কত শতাংশ ফার্ম মানসম্মত, কত শতাংশ মানসম্মত না, সেটা আমরা জানি না। ফলে কোন ধরনের ফার্মের ডিম ও মাংস খাচ্ছি সেটাও জানি না। এসব বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ থেকে যাবে। সংবাদের ভাষায় একটা কথা আছে, ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’। কিন্তু এই ‘ব্যাড নিউজ’ হয়তো মোট বিষয়ের খুব কম অংশ। ব্যাড নিউজের প্রচার যেন পুেরা শিল্পকে হুমিকর মুখে ফেলে না দেয়, গণমাধ্যমকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা ঝুঁকি নিয়েও অনেক সংবাদ প্রকাশ করে।
কিছুদিন আগে পত্রপত্রিকায় খদ্যের মান নিয়ে কয়েকটি পর্ব প্রচার করে। এতে মানুষ কিছুটা শঙ্কার মধ্যে পড়ে যায়। তারা কোন খাবার খাবে, কোনটা খাবে না। পত্রিকাগুলো আবার সংশয় দূর করারও উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো একটি গবেষণার ফলাফল নিশ্চিত না হয়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা একেবারেই ঠিক না। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে
এম এ রশিদ: পোলট্রিশিল্প বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, সুস্থ জীবনের জন্য ভারসাম্য খাবার খুব প্রয়োজন। ভারসাম্য খাবারের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, মিনারেলস, ভিটামিনস, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। খাবার কতটুকু গ্রহণ করলাম সেটা বড় কথা না, ভারসাম্য খাবার কি না, সেটি প্রধান বিষয়। প্রোটিন বা প্রাণিজ আমিষ ভারসাম্য খাবারের একটি অন্যতম উপাদান। আমিষ শিশুদের বৃদ্ধি ও শরীর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রাণিজ আমিষের একটি বড় অংশ আসে মুরগির মাংস ও ডিম থেকে। তাই পোলট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। রোগের পর শরীরে শক্তি ফিরে আসার জন্য আমিষের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে আমিষ পাওয়া যায়। তবে প্রাণিজ আমিষ হলো শরীরের প্রধান ও উন্নত আমিষ। দেশের পোলট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করছে। তবে শহরের বস্তির মানুষ ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ যেন পোলট্রিশিল্পের এ সুবিধা পায়, খামারমালিকদের সেটা ভাবতে হবে।
এম নজরুল ইসলাম: প্রতি দুই বছর পর ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী ও আলোচনা অনুষ্ঠান করি। এবারের মূল বিষয় হলো ‘সেফ ফুড হেলদি নেশন’। আমরা দেশের মানুষকে কেবল ডিম ও মাংস দিচ্ছি তা না, এ শিল্পের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২০ সালে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। ডিম ও মাংস গ্রাম-শহর সব মানুষের হাতের কাছে ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। সাদা মাংস শরীরের জন্য বেশি উপকারী। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে এর ব্যাপক বিস্তার হতে থাকে। ২০০৭ সালের একটি রোগে এ খাত মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। সরকার ও অন্যদের সহযোগিতায় আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই। ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’–এর কবলে পড়ে পোলট্রিশিল্প যাতে ধ্বংস না হয়, ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান যেন বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়ে, এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা চাই।
তৌফিকুল ইসলাম খান: ব্যবসা বৃৃদ্ধি করতে হলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এটি সহজলভ্য করতে হবে। এখনো গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে আমিষ গ্রহণের অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে গত এক দশকে এ পার্থক্য বেশ কিছুটা কমে এসেছে। এ পার্থক্য কমার প্রধান কারণ হচ্ছে ব্রয়লার মুরগির মাংস। ডিম নয়। গ্রামের মানুষ এখনো ডিম সেভাবে গ্রহণ করে না। গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ মুরগির জোগানদাতা। তাঁরা আবার স্থানীয়ভাবে মুরগির খাবার সংগ্রহ করেন। ফলে মুরগির খাবারের মান কতটা ঠিক থাকে, সেটা দেখার বিষয়। আমরা নিরাপদ খাদ্যের কথা বলি। ছোট খামারিদের নিরাপদ খাদ্যের তালিকার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যাচাই-বাছাই করার তদারক সংস্থা থাকতে হবে। এদের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, সরকার ও ফার্মের মালিক—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের কৃষিব্যবস্থার ব্লক সুপারভাইজারদের পোলট্রিশিল্পের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হয়তো না জেনেই অনেক ভুল করছেন। আবার বেশি লাভের জন্য জেনেও অন্যায় করছেন। এসব ব্যাপারে তাঁদের একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মো. হেলাল উদ্দিন: সত্তরের দশকে হাটের দিন ছাড়া কোথাও কোনো মুরগি বা ডিম পাওয়া যেত না। আশির দশকে দেশে ফার্মের মুরিগ আসে। তখন থেকে এ অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ডিম এখন একটি অন্যতম প্রধান খাবার। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সবাই ডিম খায়। প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ডিম উৎপাদন হয়, যা আমাদের চাহিদার কাছাকাছি। ফার্মের মালিকেরা ভালোভাবে এ কাজটি করছেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে ডিম ও মুরিগ এখনো সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে কি না, সেটি ভাবার অবকাশ রয়েছে। মাত্র কয়েকটি ফার্মের মালিক বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।মুরগি ও ডিম অনেক সহজলভ্য করতে হবে।
ডিম ও মাংসের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব জোরালোভাবে এসেছে। এ ক্ষেত্রে তথ্যের অসম্পূর্ণতার কথাও নাজমা শাহীন বলেছেন। ফরমালিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমিও বিপাকে পড়ি। মানুষের শরীর কতটুকু ফরমালিন গ্রহণ করতে পারে, কী কী ফল নিজে ফরমালিন জেনারেট করে, তার মাত্রা কী? এসব কোনো তথ্যই পাচ্ছিলাম না। আরেকটা সমস্যা হলো, যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা গবেষণার ফলাফল নিয়ে বসে থাকেন। মানুষকে জানান না। আবার এমন মানুষও আছেন, যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করেন।
পরে জানলাম, আম, লিচু, কলায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরমালিন তৈরি হয়। মুরগি বাজারে নেওয়ার সাত দিন আগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে। দেশে হাজার হাজার ছোট খামারি আছেন, তাঁরা হয়তো এটা পুেরাপুরিভাবে অনুসরণ করেন না। তঁাদের অবশ্যই এটা মেনে চলতে হবে। নিরাপদ ডিম-মাংসের ক্ষেত্রে এসব নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান: ২০২০ সালে উৎপাদন দ্বিগুণ করতে চাই। তাহলে আমাদের মাংস রপ্তানির কথাও ভাবতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হালাল মাংস রপ্তানি আমাদের জন্য একটি বিশাল বাজার হতে পারে। বিশ্বে পোলট্রিশিল্পের নেতা হচ্ছে ব্রাজিল ও থাইল্যান্ড। এরা মুরগি পালনের জন্য বিভিন্ন এলাকা ভাগ করেছে। যেসব এলাকায় মুরগির রোগ হয় না, মুরগি নিরাপদ থাকে, সেসব এলাকা থেকে মুরগি রপ্তানি করে। আমাদেরও এসব বিষয় ভাবতে হবে। এখন বিশ্বে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল খাদ্য রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৮ সালে হবে ১ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্বে প্রতিবছর মাছ, মাংস ও পোলট্রি রপ্তানির পারিমাণ প্রায় ৭৪০ বিলিয়ন ডলার। গত বছর শুধু পোলট্রি রপ্তানি হয়েছে ১১০ মিলিয়ন টন। মালয়েশিয়া সরকার হালাল মাংস রপ্তানির জন্য ইনসেনটিভ দিচ্ছে। পোলট্রি থেকে তারা ৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করতে চায়। আমাদের দেশের অনেক ফার্ম আন্তর্জাতিকমানের। অন্যান্য দেশ পারলে আমরাও পারব। আমাদের পোলট্রিশিল্প দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে। সরকারের তদারক ও সহযোগিতা থাকলে মূল্যের মধ্যে ভারসাম্য আসবে এবং পোলট্রিশিল্পের আরও সম্প্রসারণ হবে।
সাইদুর রহমান বাবু: বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে ১ কোটি ১০ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। মুরগির জন্য ছয় হাজার মেট্রিক টন খাবার প্রয়োজন। খাসি, গরু, মাছ ও সবজির সঙ্গে তুলনা করলে মুরগি ও ডিমের চেয়ে সস্তা আমিষ বাংলাদেশে আর নেই। দেশের মানুষকে সস্তা প্রোটিন দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। কিন্তু আজ আমাদের ব্যাংক থেকে ১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হয়। কৃষি খাতে ঋণের সুদ ৫ শতাংশ। মুরগির ফার্ম একটি কৃষিশিল্প। তার পরও আমাদের চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ফার্ম করতে হয়। সরকারকে বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি। বিদেশিরা ৩ শতাংশ সুদে মূলধন পাচ্ছে। আমাদের সুদ ১৬ শতাংশ। শুরুতেই তঁারা আমাদের থেকে ১৩ শতাংশ বেশি লাভ পাচ্ছে। এ অবস্থায় কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকব? সরকারকে এ বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাবতে হবে।
এখন প্রতিদিন মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। ২০২০ সালে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। দেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকবে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে দেশে পুষ্টি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি বিপ্লব ঘটবে। এ জন্য সরকার, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে।
কুতুব উদ্দিন আহমেদ: আমরা বেঙ্গল মিটের সঙ্গে যুক্ত থেকে এক কনটেইনার মাংস সৌদি আরবে পাঠাই। কিন্তু আমাদের দেশের ওয়েবসাইটে রোগমুক্ত নিরাপদ মাংসের তথ্য না থাকায় দেশে ফিরিয়ে আনতে হয়। মাংস স্পর্শকাতর একটা পণ্য। রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সচেতনতা প্রয়োজন আছে। মাংসের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়মকানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে প্রক্রিয়াজাত মাংসের নিয়মকানুনে কিছুটা ছাড় থাকলেও কাঁচা মাংসের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন কড়াকড়ি। এখন প্রক্রিয়াজাত মাংসের একটা শিল্প তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করি। মধ্যপ্রাচ্যে যে বাংলাদেশি আছে, সেটা একটা বিশাল বাজার।বিদেশে আমাদের মাংসের ক্রেতা শুধু বাংলাদেশিরাই। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি আছে। আমরা এ বাজার ধরতে পারি। বেঙ্গল মিট দুবাই ও কুয়েতে প্রচুর মাংস পাঠায়। এ জন্যই প্রতিষ্ঠানটি টিকে গেছে। ব্যাংককে একবার বার্ড ফ্লুতে মুরিগ ধ্বংস হলো। আবার যখন শুরু হলো, মানুষ ভয়ে মুরিগ খেত না। তখন ব্যাংককের প্রধানমন্ত্রী মুরিগর ওপর প্রদর্শনী করলেন। সেখানে তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা মুরিগর মাংস খেলেন। এ ধরনের উদ্যোগ যেকোনো সময় যেকোনো দেশে প্রয়োজন হতে পারে। মাংসের থেকে প্রক্রিয়াজাত মাংস বেশি সুফল দেয়, এ বিষয়টি আমরা ভাবতে পারি। বড় এনজিওগুলো এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
গোলাম রহমান: আপনারা ২০২০ সালে বিনিয়োগ, উৎপাদন সবকিছু দ্বিগুণ করতে চান। এসব সম্ভব তখনই হবে যখন অর্থনীতির চাকা ঠিক থাকবে। তা না হলে এসব হয়তো কেবল আশাবাদই থেকে যাবে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ ভোক্তা। কিন্তু ভোক্তাদের অনেক দুর্ভাবনা রয়েছে। ট্যানারি বর্জ্য, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোনসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসছে। এসব বিষয়ে ভোক্তাদের মধ্যে প্রশ্ন থাকবে।
এ সম্পর্কে ভোক্তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে পোলট্রির মাংস নিরাপদ। ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে এ শিল্পের সম্প্রসারণ হবে না। দেশে হয়তো ৭০-৮০ হাজার পোলট্রিশিল্প আছে। উপস্থাপনায় যে শিল্প দেখানো হলো, এ মানের শিল্প সংখ্যায় অনেক কম। অধিকাংশ ক্ষুদ্রশিল্প। এরা জেনে না–জেনে নিম্নমানের খাবার দিচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। ক্ষুদ্র পোলট্রিশিল্পের ওপর অবশ্যই তদারক ও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
তা না হলে পোলট্রি মাংসের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে। এ জন্য হয়তো বড় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষুদ্রশিল্পের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। প্রতিটি বড় ফার্ম অনেকগুলো ছোট ফার্মের মান নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। তাদের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে পারে। তাহলে শিল্পের বিকাশ হবে। ভোক্তারাও নিরাপদ থাকবে।
আবদুস সাত্তার মণ্ডল: ২০০-৩০০ মুরগিআছে, দেশে এমন ফার্মও আছে। খাদ্য ও জৈবনিরাপত্তা দুটোতেই এদের অব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞান ছোট ফার্ম ও বড় ফর্মের জন্য আলাদা না। অ্যান্টিবায়োটিক ও অনিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা ছোট-বড় সব ফার্মকে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি একটি স্পর্শকাতর শিল্প। সবার এ শিল্প করতে হবে, সেটি আমি মনে করি না। বাথরুমের পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে ২০০-৩০০ মুরগি নিয়ে ফার্ম হবে, সেটা হয় না। আর এটি যে হয় না, এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ২০১০ সালে যখন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় মুরগি আক্রান্ত হয়ে অনেক ফার্ম বিলুপ্ত হয়েছে।
পোলট্রি ফার্মের সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। এখন এ সংখ্যা ৭০-৮০ হাজারে নেমে এসেছে। ২০০৮ সলে পোলট্রিশিল্পের নীতিমালা হয়েছে। এ নীতিমালায় জৈব ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয় বলা আছে। প্রতিটি ফার্মকেই এ নীতিমালা শক্তভাবে মেনে চলতে হবে। তবে নীতিমালার এখন সংশোধন প্রয়োজন। বড় কাজ হবে ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ, গণমাধ্যম, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর—সবাই মিলে পোলট্রি নীতিমালার প্রয়োজনীয় সংশোধনী তৈরি করা। প্রান্তিক চাষিরা বলেছেন, একটা ডিমের উৎপাদন খরচ সাত টাকা পড়ে যায়। ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হলো খাদ্যের। খাদ্যের প্রধান উপাদান ভুট্টা। ভুট্টা উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে ডিম ও মাংসের দাম কমে আসবে। কীভাবে ভুট্টার দাম কমানো যায়, সেটি সবাইকে ভাবতে হবে। পোলট্রিশিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপদ খাদ্য (ডিম ও মাংস)। এ শিল্পের নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি একটি বিজ্ঞান। অর্থাৎ এর কিছু নিয়মকানুন আছে। এর সঠিক বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের লোকবল, বিনিয়োগসহ সব ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। পোলট্রিশিল্পের জৈবনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা জরুরি।
অজয় কুমার রায়: আমাদের প্রধান লক্ষ্যনিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দারিদ্র্য বিমোচন। সত্তরের দশকে দরিদ্র মানুষের সহযোগিতার জন্য সেবার মানোভাব থেকে মুরগির ফার্ম তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ফার্মগুলো শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে। এটি এমন একটি শিল্প, যা খুব অল্প সময়ে, কম খরচে ভালো প্রাণিজ প্রোটিন দিতে পারে। পোলট্রিশিল্পের ভোক্তা আমরা সবাই। এশিয়ার মধ্যে জাপান সবচেয়ে বেশি প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ করে।
আমরা এগিয়েছি কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক পেছনে আছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পোলট্রিশিল্পের বিশাল বাজার রয়েেছ। সারা পৃথিবীতে মানসম্মত আমিষের ঘাটতি রয়েছে। মানসম্মত আমিষ নির্ভর করে এর প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের ওপর। মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় কম–বেশি আটটি অ্যামাইনো অ্যাসিড, ভিটামিন সি ছাড়া কম–বেশি সব ভিটামিন, মিনারেল ডিমে আছে। তাই ডিম একটি উচ্চমানসম্পন্ন খাবার। প্রশ্ন এসেছে, ডিম ও মাংসের নিরাপত্তা নিয়ে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার টেবিলে আসা পর্যন্ত যত ধাপ আছে, সব ধাপে নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পোলট্রিশিল্পের নীতিমালা আছে। নীতিমালার আলোকে অ্যাক্ট আছে। নীতিমালায় নিবন্ধনের বিষয় আছে।
কোনো খামার নিবন্ধন ছাড়া থাকতে পারবে না। নিবন্ধন করতে হলে কিছু শর্ত মানতে হবে। পুরোনোদের একটা ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু নতুন যারা আসছে, তাদের সব ধরনের নিরাপত্তার বিষয়টি মেনেই আসতে হবে। এর সঙ্গে সচেতনতার বিষয়টি সব সময় চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের খাদ্য অ্যাক্ট ও বিধিমালা আছে। এটা নিয়েই আমাদের যত চিন্তা।
খাদ্য বিধিমালায় স্টেরয়েড, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক, টক্সিন ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলো কোনোভাবে প্রয়োগের সুযোগ নেই। কিন্তু সব কৌশলেরই অপকৌশল আছে। আমাদের বিভাগ থেকে উপজেলা পর্যন্ত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এসব কমিটি খাদ্যের মান নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করে থাকে। ভবিষ্যতে এ শিল্পের আরও সম্প্রসারণের জন্য আমরা কাজ করব।
আব্দুল কাইয়ুম: আমাদের প্রাণিজ আমিষের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এ চহিদা পূরণে পোলট্রিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু দেশের অসংখ্য ক্ষুদ্র পোলট্রি ফার্ম নিরাপদ ডিম, মাংস সরবরাহ করছে কি না, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। ফার্মগুলো নিয়মনীতি মানছে কি না সে বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
অজয় কুমার রায় : মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
আবদুস সাত্তার মণ্ডল : সাবেক ভিসি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
গোলাম রহমান : সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
মসিউর রহমান : সভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
গোলাম রহমান : অধ্যাপক, সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাজমা শাহীন : অধ্যাপক, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কুতুব উদ্দিন আহমেদ : চেয়ারম্যান, এনভয় টেক্সটাইল গ্রুপ
মো. হেলাল উদ্দিন : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
এম এ রশিদ : ভাইস প্রিন্সিপাল, অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
তৌফিকুল ইসলাম খান : রিসার্চ ফেলো, সিপিডি
আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান : সহসভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
সাইদুর রহমান বাবু : সহসভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
মো. রফিকুল হক : সম্পাদক, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
এম নজরুল ইসলাম : কোষাধ্যক্ষ, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনায় সুপারিশ
. পোলট্রিশিল্পের ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
. ট্যানারি মালিকদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাধ্য করতে হবে
. কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের লোকবল, বিনিয়োগসহ সব ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে হবে
. কোনো খামার নিবন্ধন ছাড়া থাকতে পারবে না
. মাত্র ৫–১০ শতাংশ ব্যাড নিউজের প্রচার যেন পুেরা শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে না দেয়, গণমাধ্যমকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে
. মুরগি ও ডিম অনেক সহজলভ্য করতে হবে
. ক্ষুদ্র পোলট্রিশিল্পের ওপর অবশ্যই তদারক ও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাণিজ আমিষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু দেশে এ আমিষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে পোলট্রিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পোলট্রিশিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আমাদের দৈনিক খাদ্যতালিকায় প্রোটিনের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণ হয় পোলট্রিশিল্প থেকে। এ শিল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
অন্যদিকে সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে পোলট্রিশিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ শিল্প সম্পর্কে মানুষের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করি, এ শিল্প সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর হোক। পোলট্রিশিল্পের আরও উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করার বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরি হোক।
মসিউর রহমান: পোলট্রিশিল্প শুরুতে একটি আমদািননির্ভর শিল্প ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পোলট্রির মুরগি ও ডিমের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শিল্পটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে এর বিনিয়োগ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে খামার ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে মোট উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিডমিলগুলোতে উৎপন্ন হচ্ছে। পোলট্রির খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন প্রায় ৭০–৮০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প।আমরা নিরাপদ পোলট্রিশিল্প–খাদ্য নিশ্চিত করেছি। বাইরের কাউকে খামারে প্রবেশ করতে হলে কয়েক ধাপে জীবাণুমুক্ত হয়ে, গোসল করে ও নির্দিষ্ট কাপড় পরে প্রবেশ করতে হয়। বাংলাদেশের পোলট্রিশিল্প এখন প্রযুক্তিনির্ভর।
আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে সপ্তাহে এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি ডিম ফোটানো হয়। মুরগি পালনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খাবার ও পানি সরবরাহ, ডিম সংগ্রহ—সবকিছু স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা হয়। ফলে ভোক্তা স্বাস্থ্যকর-জীবাণুমুক্ত ডিম ও মুরগির মাংস পেয়ে থাকে।
প্রায় প্রতিটি বড় ফিড মিলের নিজস্ব গবেষণাগার আছে। খাদ্য তৈরিতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ভুট্টা, ওষুধ ও কাঁচামালের পরিমাণ—সবকিছুর সঠিক মান নিশ্চিত করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, নিরাপদ-স্বাস্থ্যকর ডিম ও মাংস সরবরাহ। পোলট্রিশিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ মাংস এখন হোটেল সোনারগাঁও, রেডিসনসহ বড় বড় শপিং মলে পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের মাংস ও ডিম গুণগত মানসম্পন্ন।
সরকারের সহযোগিতা পেলে ২০২০ সাল নাগাদ বিনিয়োগ হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পোলট্রিশিল্পের ২০২০ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তা, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মো. রফিকুল হক: ডিম একটি আদর্শ প্রোটিন হিসেবে বিবেচিত। দেশে ডিমের পর্যাপ্ত চাহিদা রয়েছে। একটি প্রবাদ আছে, ‘হেলদি ফুড হেলদি নেশন’। আমরা নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিই। নিরাপদ ডিমের বিষয়ে আপস করি না। ডিম উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লেয়ার ফার্ম তৈরি করতে হয়। সেখানে রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় জৈব নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। মুরগিকে সুষম, জীবাণুমুক্ত খাবার এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা দিলেই কেবল এ থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ডিম উৎপাদন করা সম্ভব হয়। খাবার কীভাবে দূষিত হয়? খাবারে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। টক্সিন-মাইক্রোটক্সিন থাকতে পারে। আমরা দেখেশুনে গুণগত মান বজায় আছে এমন খাবার কিনি। এর পরও ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় খাবারকে প্রক্রিয়া করি। তা ছাড়া খাদ্যে কোনো টক্সিন থাকলে এটা মুক্ত করার জন্য টক্সিন বাইন্ডার ব্যবহার করা হয়। খাদ্যের মান বৃদ্ধির জন্য খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ব্যবহার করা হয়। এর ফলে মুরগি খাদ্য থেকে সম্পূর্ণ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে।
আগে মুরগির অসুখ হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হতো। এখন আমরা রোগ প্রতিরোধকে বেশি গুরুত্ব দিই। রোগ যাতে না আসতে পারে, সেটিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা এমন ব্যবস্থা নিই, যাতে রোগ না হয়। খামারিদের স্বার্থেই খামারিরা মানসম্মত খাবার ব্যবহার করেন। তাই মুরগি থেকে যে ডিম পাইন সেটা আদর্শ, নিরাপদ ও প্রোটিনসমৃদ্ধ। কোনো রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই সবাই ফার্মের প্রোটিনসমৃদ্ধ ডিম ও মাংস খেতে পারেন।
নাজমা শাহীন: পোলট্রি ফার্মগুলোর বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মানুষের কোনো প্রকার ভুল ধারণা থাকবে না। বাংলাদেশের পুষ্টির অবস্থা সবাইকে ভাবতে হবে। তাহলে পোলট্রিশিল্পের গুরুত্ব বোঝা যাবে। দেশে পাঁচ বছরের শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম। মেডিকেলের ভাষায় একে স্টানটিং বলা হয়। দেশের ৩৬ শতাংশ শিশুর ওজন কম। প্রজননক্ষম নারীর ২৫ শতাংশ ক্রনিক এনার্জি ঘাটতিতে ভুগছেন। এ কারণে জন্মের সময় বাচ্চাদের ওজন কম হচ্ছে। আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও পুষ্টিতে বেশ পিছিয়ে আছি। খাদ্য ও কৃষি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের শক্তির ৬০ শতাংশ আসার কথা শস্যজাতীয় পণ্য থেকে। ১০-১৫ শতাংশ আসার কথা আমিষ থেকে। এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ।
বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একজন ৭ গ্রাম ডিম, ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খায়। এর থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে এক ও তিন গ্রাম। মুরগি ও ডিম থেকে দৈনিক চার গ্রাম আমিষ। প্রতিদিনের খাদ্যে ৩৩-৬৬ শতাংশ আমিষ থাকার কথা। এর মধ্যে প্রাণিজ আমিষ থাকবে কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট শরীরে জমা থাকে। কিন্তু আমিষ জমা থাকে না। প্রতিদিনের খাদ্য থেকে এটা গ্রহণ করতে হয়।
অমিষের অভাব হলে শিশু খর্বাকৃতির হবে। কিছু প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল প্রাণিজ আমিষ থেকে আসে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ট্যানারি বর্জ্য গ্রহণের ফলে কিছু মুরগির মধ্যে সামান্য পরিমাণ ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। ক্রোমিয়াম শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পোলট্রি থেকে যথেষ্ট প্রাণিজ আমিষ আসছে। কিন্তু ছোট খামারিরা যাতে কোনোভাবে ট্যানারি বর্জ্য খাওয়ানোর সুযোগ না পান, সে ব্যবস্থা করতে হবে।ট্যানারির মালিকদের যেকোনোভাবে তাঁদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বাধ্য করতে হবে। প্রাণিজ আমিষ যদি নিরাপদ না হয় তাহলে সেটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
গোলাম রহমান, অধ্যাপক : আমাদের দেশে পোলট্রিশিল্প অনেক বড় হচ্ছে। যেকোনো শিল্প বড় হওয়ার সময় কিছু বাধা আসে। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে, যাতে শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। উপস্থাপনায় যে ভিডিওচিত্র দেখা গেল, সেটি একটি আদর্শ মানসম্মত ফার্ম। কিন্তু কত শতাংশ ফার্ম মানসম্মত, কত শতাংশ মানসম্মত না, সেটা আমরা জানি না। ফলে কোন ধরনের ফার্মের ডিম ও মাংস খাচ্ছি সেটাও জানি না। এসব বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। তা না হলে মানুষের মধ্যে সন্দেহ থেকে যাবে। সংবাদের ভাষায় একটা কথা আছে, ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’। কিন্তু এই ‘ব্যাড নিউজ’ হয়তো মোট বিষয়ের খুব কম অংশ। ব্যাড নিউজের প্রচার যেন পুেরা শিল্পকে হুমিকর মুখে ফেলে না দেয়, গণমাধ্যমকে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা ঝুঁকি নিয়েও অনেক সংবাদ প্রকাশ করে।
কিছুদিন আগে পত্রপত্রিকায় খদ্যের মান নিয়ে কয়েকটি পর্ব প্রচার করে। এতে মানুষ কিছুটা শঙ্কার মধ্যে পড়ে যায়। তারা কোন খাবার খাবে, কোনটা খাবে না। পত্রিকাগুলো আবার সংশয় দূর করারও উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো একটি গবেষণার ফলাফল নিশ্চিত না হয়ে গণমাধ্যমে প্রচার করা একেবারেই ঠিক না। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে
এম এ রশিদ: পোলট্রিশিল্প বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে বলতে পারি, সুস্থ জীবনের জন্য ভারসাম্য খাবার খুব প্রয়োজন। ভারসাম্য খাবারের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, মিনারেলস, ভিটামিনস, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি। খাবার কতটুকু গ্রহণ করলাম সেটা বড় কথা না, ভারসাম্য খাবার কি না, সেটি প্রধান বিষয়। প্রোটিন বা প্রাণিজ আমিষ ভারসাম্য খাবারের একটি অন্যতম উপাদান। আমিষ শিশুদের বৃদ্ধি ও শরীর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রাণিজ আমিষের একটি বড় অংশ আসে মুরগির মাংস ও ডিম থেকে। তাই পোলট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। রোগের পর শরীরে শক্তি ফিরে আসার জন্য আমিষের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে আমিষ পাওয়া যায়। তবে প্রাণিজ আমিষ হলো শরীরের প্রধান ও উন্নত আমিষ। দেশের পোলট্রিশিল্প প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করছে। তবে শহরের বস্তির মানুষ ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ যেন পোলট্রিশিল্পের এ সুবিধা পায়, খামারমালিকদের সেটা ভাবতে হবে।
এম নজরুল ইসলাম: প্রতি দুই বছর পর ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী ও আলোচনা অনুষ্ঠান করি। এবারের মূল বিষয় হলো ‘সেফ ফুড হেলদি নেশন’। আমরা দেশের মানুষকে কেবল ডিম ও মাংস দিচ্ছি তা না, এ শিল্পের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২০ সালে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। ডিম ও মাংস গ্রাম-শহর সব মানুষের হাতের কাছে ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। সাদা মাংস শরীরের জন্য বেশি উপকারী। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে এর ব্যাপক বিস্তার হতে থাকে। ২০০৭ সালের একটি রোগে এ খাত মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। সরকার ও অন্যদের সহযোগিতায় আমরা সে অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হই। ‘ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ’–এর কবলে পড়ে পোলট্রিশিল্প যাতে ধ্বংস না হয়, ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান যেন বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়ে, এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা চাই।
তৌফিকুল ইসলাম খান: ব্যবসা বৃৃদ্ধি করতে হলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে এটি সহজলভ্য করতে হবে। এখনো গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে আমিষ গ্রহণের অনেক পার্থক্য রয়েছে। তবে গত এক দশকে এ পার্থক্য বেশ কিছুটা কমে এসেছে। এ পার্থক্য কমার প্রধান কারণ হচ্ছে ব্রয়লার মুরগির মাংস। ডিম নয়। গ্রামের মানুষ এখনো ডিম সেভাবে গ্রহণ করে না। গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এ মুরগির জোগানদাতা। তাঁরা আবার স্থানীয়ভাবে মুরগির খাবার সংগ্রহ করেন। ফলে মুরগির খাবারের মান কতটা ঠিক থাকে, সেটা দেখার বিষয়। আমরা নিরাপদ খাদ্যের কথা বলি। ছোট খামারিদের নিরাপদ খাদ্যের তালিকার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। যাচাই-বাছাই করার তদারক সংস্থা থাকতে হবে। এদের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম, সরকার ও ফার্মের মালিক—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের কৃষিব্যবস্থার ব্লক সুপারভাইজারদের পোলট্রিশিল্পের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হয়তো না জেনেই অনেক ভুল করছেন। আবার বেশি লাভের জন্য জেনেও অন্যায় করছেন। এসব ব্যাপারে তাঁদের একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
মো. হেলাল উদ্দিন: সত্তরের দশকে হাটের দিন ছাড়া কোথাও কোনো মুরগি বা ডিম পাওয়া যেত না। আশির দশকে দেশে ফার্মের মুরিগ আসে। তখন থেকে এ অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ডিম এখন একটি অন্যতম প্রধান খাবার। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সবাই ডিম খায়। প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ডিম উৎপাদন হয়, যা আমাদের চাহিদার কাছাকাছি। ফার্মের মালিকেরা ভালোভাবে এ কাজটি করছেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে ডিম ও মুরিগ এখনো সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে কি না, সেটি ভাবার অবকাশ রয়েছে। মাত্র কয়েকটি ফার্মের মালিক বাচ্চা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত।মুরগি ও ডিম অনেক সহজলভ্য করতে হবে।
ডিম ও মাংসের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব জোরালোভাবে এসেছে। এ ক্ষেত্রে তথ্যের অসম্পূর্ণতার কথাও নাজমা শাহীন বলেছেন। ফরমালিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমিও বিপাকে পড়ি। মানুষের শরীর কতটুকু ফরমালিন গ্রহণ করতে পারে, কী কী ফল নিজে ফরমালিন জেনারেট করে, তার মাত্রা কী? এসব কোনো তথ্যই পাচ্ছিলাম না। আরেকটা সমস্যা হলো, যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা গবেষণার ফলাফল নিয়ে বসে থাকেন। মানুষকে জানান না। আবার এমন মানুষও আছেন, যাঁরা মানুষের জন্য কাজ করেন।
পরে জানলাম, আম, লিচু, কলায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরমালিন তৈরি হয়। মুরগি বাজারে নেওয়ার সাত দিন আগে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে। দেশে হাজার হাজার ছোট খামারি আছেন, তাঁরা হয়তো এটা পুেরাপুরিভাবে অনুসরণ করেন না। তঁাদের অবশ্যই এটা মেনে চলতে হবে। নিরাপদ ডিম-মাংসের ক্ষেত্রে এসব নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান: ২০২০ সালে উৎপাদন দ্বিগুণ করতে চাই। তাহলে আমাদের মাংস রপ্তানির কথাও ভাবতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হালাল মাংস রপ্তানি আমাদের জন্য একটি বিশাল বাজার হতে পারে। বিশ্বে পোলট্রিশিল্পের নেতা হচ্ছে ব্রাজিল ও থাইল্যান্ড। এরা মুরগি পালনের জন্য বিভিন্ন এলাকা ভাগ করেছে। যেসব এলাকায় মুরগির রোগ হয় না, মুরগি নিরাপদ থাকে, সেসব এলাকা থেকে মুরগি রপ্তানি করে। আমাদেরও এসব বিষয় ভাবতে হবে। এখন বিশ্বে ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল খাদ্য রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৮ সালে হবে ১ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্বে প্রতিবছর মাছ, মাংস ও পোলট্রি রপ্তানির পারিমাণ প্রায় ৭৪০ বিলিয়ন ডলার। গত বছর শুধু পোলট্রি রপ্তানি হয়েছে ১১০ মিলিয়ন টন। মালয়েশিয়া সরকার হালাল মাংস রপ্তানির জন্য ইনসেনটিভ দিচ্ছে। পোলট্রি থেকে তারা ৪ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি করতে চায়। আমাদের দেশের অনেক ফার্ম আন্তর্জাতিকমানের। অন্যান্য দেশ পারলে আমরাও পারব। আমাদের পোলট্রিশিল্প দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে। সরকারের তদারক ও সহযোগিতা থাকলে মূল্যের মধ্যে ভারসাম্য আসবে এবং পোলট্রিশিল্পের আরও সম্প্রসারণ হবে।
সাইদুর রহমান বাবু: বাংলাদেশে প্রতি সপ্তাহে ১ কোটি ১০ লাখ বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। মুরগির জন্য ছয় হাজার মেট্রিক টন খাবার প্রয়োজন। খাসি, গরু, মাছ ও সবজির সঙ্গে তুলনা করলে মুরগি ও ডিমের চেয়ে সস্তা আমিষ বাংলাদেশে আর নেই। দেশের মানুষকে সস্তা প্রোটিন দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। কিন্তু আজ আমাদের ব্যাংক থেকে ১৬ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে হয়। কৃষি খাতে ঋণের সুদ ৫ শতাংশ। মুরগির ফার্ম একটি কৃষিশিল্প। তার পরও আমাদের চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ফার্ম করতে হয়। সরকারকে বিষয়টি অতি দ্রুত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি। বিদেশিরা ৩ শতাংশ সুদে মূলধন পাচ্ছে। আমাদের সুদ ১৬ শতাংশ। শুরুতেই তঁারা আমাদের থেকে ১৩ শতাংশ বেশি লাভ পাচ্ছে। এ অবস্থায় কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকব? সরকারকে এ বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভাবতে হবে।
এখন প্রতিদিন মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ১ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। ২০২০ সালে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। দেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধিতে এ খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকবে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে দেশে পুষ্টি, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি বিপ্লব ঘটবে। এ জন্য সরকার, গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে।
কুতুব উদ্দিন আহমেদ: আমরা বেঙ্গল মিটের সঙ্গে যুক্ত থেকে এক কনটেইনার মাংস সৌদি আরবে পাঠাই। কিন্তু আমাদের দেশের ওয়েবসাইটে রোগমুক্ত নিরাপদ মাংসের তথ্য না থাকায় দেশে ফিরিয়ে আনতে হয়। মাংস স্পর্শকাতর একটা পণ্য। রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সচেতনতা প্রয়োজন আছে। মাংসের ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিয়মকানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে প্রক্রিয়াজাত মাংসের নিয়মকানুনে কিছুটা ছাড় থাকলেও কাঁচা মাংসের ক্ষেত্রে নিয়মকানুন কড়াকড়ি। এখন প্রক্রিয়াজাত মাংসের একটা শিল্প তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করি। মধ্যপ্রাচ্যে যে বাংলাদেশি আছে, সেটা একটা বিশাল বাজার।বিদেশে আমাদের মাংসের ক্রেতা শুধু বাংলাদেশিরাই। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ৬০ লাখ বাংলাদেশি আছে। আমরা এ বাজার ধরতে পারি। বেঙ্গল মিট দুবাই ও কুয়েতে প্রচুর মাংস পাঠায়। এ জন্যই প্রতিষ্ঠানটি টিকে গেছে। ব্যাংককে একবার বার্ড ফ্লুতে মুরিগ ধ্বংস হলো। আবার যখন শুরু হলো, মানুষ ভয়ে মুরিগ খেত না। তখন ব্যাংককের প্রধানমন্ত্রী মুরিগর ওপর প্রদর্শনী করলেন। সেখানে তিনি ও তাঁর মন্ত্রীরা মুরিগর মাংস খেলেন। এ ধরনের উদ্যোগ যেকোনো সময় যেকোনো দেশে প্রয়োজন হতে পারে। মাংসের থেকে প্রক্রিয়াজাত মাংস বেশি সুফল দেয়, এ বিষয়টি আমরা ভাবতে পারি। বড় এনজিওগুলো এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
গোলাম রহমান: আপনারা ২০২০ সালে বিনিয়োগ, উৎপাদন সবকিছু দ্বিগুণ করতে চান। এসব সম্ভব তখনই হবে যখন অর্থনীতির চাকা ঠিক থাকবে। তা না হলে এসব হয়তো কেবল আশাবাদই থেকে যাবে। দেশের ১৬ কোটি মানুষ ভোক্তা। কিন্তু ভোক্তাদের অনেক দুর্ভাবনা রয়েছে। ট্যানারি বর্জ্য, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোনসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসছে। এসব বিষয়ে ভোক্তাদের মধ্যে প্রশ্ন থাকবে।
এ সম্পর্কে ভোক্তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে পোলট্রির মাংস নিরাপদ। ভোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে এ শিল্পের সম্প্রসারণ হবে না। দেশে হয়তো ৭০-৮০ হাজার পোলট্রিশিল্প আছে। উপস্থাপনায় যে শিল্প দেখানো হলো, এ মানের শিল্প সংখ্যায় অনেক কম। অধিকাংশ ক্ষুদ্রশিল্প। এরা জেনে না–জেনে নিম্নমানের খাবার দিচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। ক্ষুদ্র পোলট্রিশিল্পের ওপর অবশ্যই তদারক ও নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
তা না হলে পোলট্রি মাংসের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে। এ জন্য হয়তো বড় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষুদ্রশিল্পের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। প্রতিটি বড় ফার্ম অনেকগুলো ছোট ফার্মের মান নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব নিতে পারে। তাদের সনদ প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে পারে। তাহলে শিল্পের বিকাশ হবে। ভোক্তারাও নিরাপদ থাকবে।
আবদুস সাত্তার মণ্ডল: ২০০-৩০০ মুরগিআছে, দেশে এমন ফার্মও আছে। খাদ্য ও জৈবনিরাপত্তা দুটোতেই এদের অব্যবস্থাপনা। বিজ্ঞান ছোট ফার্ম ও বড় ফর্মের জন্য আলাদা না। অ্যান্টিবায়োটিক ও অনিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা ছোট-বড় সব ফার্মকে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি একটি স্পর্শকাতর শিল্প। সবার এ শিল্প করতে হবে, সেটি আমি মনে করি না। বাথরুমের পাশে বাঁশঝাড়ের নিচে ২০০-৩০০ মুরগি নিয়ে ফার্ম হবে, সেটা হয় না। আর এটি যে হয় না, এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ২০১০ সালে যখন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জায় মুরগি আক্রান্ত হয়ে অনেক ফার্ম বিলুপ্ত হয়েছে।
পোলট্রি ফার্মের সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। এখন এ সংখ্যা ৭০-৮০ হাজারে নেমে এসেছে। ২০০৮ সলে পোলট্রিশিল্পের নীতিমালা হয়েছে। এ নীতিমালায় জৈব ও খাদ্যনিরাপত্তার বিষয় বলা আছে। প্রতিটি ফার্মকেই এ নীতিমালা শক্তভাবে মেনে চলতে হবে। তবে নীতিমালার এখন সংশোধন প্রয়োজন। বড় কাজ হবে ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ, গণমাধ্যম, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর—সবাই মিলে পোলট্রি নীতিমালার প্রয়োজনীয় সংশোধনী তৈরি করা। প্রান্তিক চাষিরা বলেছেন, একটা ডিমের উৎপাদন খরচ সাত টাকা পড়ে যায়। ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হলো খাদ্যের। খাদ্যের প্রধান উপাদান ভুট্টা। ভুট্টা উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে ডিম ও মাংসের দাম কমে আসবে। কীভাবে ভুট্টার দাম কমানো যায়, সেটি সবাইকে ভাবতে হবে। পোলট্রিশিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিরাপদ খাদ্য (ডিম ও মাংস)। এ শিল্পের নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি একটি বিজ্ঞান। অর্থাৎ এর কিছু নিয়মকানুন আছে। এর সঠিক বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের লোকবল, বিনিয়োগসহ সব ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। পোলট্রিশিল্পের জৈবনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা জরুরি।
অজয় কুমার রায়: আমাদের প্রধান লক্ষ্যনিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন। কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দারিদ্র্য বিমোচন। সত্তরের দশকে দরিদ্র মানুষের সহযোগিতার জন্য সেবার মানোভাব থেকে মুরগির ফার্ম তৈরি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ফার্মগুলো শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে। এটি এমন একটি শিল্প, যা খুব অল্প সময়ে, কম খরচে ভালো প্রাণিজ প্রোটিন দিতে পারে। পোলট্রিশিল্পের ভোক্তা আমরা সবাই। এশিয়ার মধ্যে জাপান সবচেয়ে বেশি প্রাণিজ প্রোটিন গ্রহণ করে।
আমরা এগিয়েছি কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় অনেক পেছনে আছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পোলট্রিশিল্পের বিশাল বাজার রয়েেছ। সারা পৃথিবীতে মানসম্মত আমিষের ঘাটতি রয়েছে। মানসম্মত আমিষ নির্ভর করে এর প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডের ওপর। মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় কম–বেশি আটটি অ্যামাইনো অ্যাসিড, ভিটামিন সি ছাড়া কম–বেশি সব ভিটামিন, মিনারেল ডিমে আছে। তাই ডিম একটি উচ্চমানসম্পন্ন খাবার। প্রশ্ন এসেছে, ডিম ও মাংসের নিরাপত্তা নিয়ে। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার টেবিলে আসা পর্যন্ত যত ধাপ আছে, সব ধাপে নিরাপত্তার বিষয়টি জরুরি। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পোলট্রিশিল্পের নীতিমালা আছে। নীতিমালার আলোকে অ্যাক্ট আছে। নীতিমালায় নিবন্ধনের বিষয় আছে।
কোনো খামার নিবন্ধন ছাড়া থাকতে পারবে না। নিবন্ধন করতে হলে কিছু শর্ত মানতে হবে। পুরোনোদের একটা ব্যবস্থার মধ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু নতুন যারা আসছে, তাদের সব ধরনের নিরাপত্তার বিষয়টি মেনেই আসতে হবে। এর সঙ্গে সচেতনতার বিষয়টি সব সময় চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের খাদ্য অ্যাক্ট ও বিধিমালা আছে। এটা নিয়েই আমাদের যত চিন্তা।
খাদ্য বিধিমালায় স্টেরয়েড, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক, টক্সিন ইত্যাদি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলো কোনোভাবে প্রয়োগের সুযোগ নেই। কিন্তু সব কৌশলেরই অপকৌশল আছে। আমাদের বিভাগ থেকে উপজেলা পর্যন্ত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ কমিটি আছে। এসব কমিটি খাদ্যের মান নিশ্চিতকরণের জন্য কাজ করে থাকে। ভবিষ্যতে এ শিল্পের আরও সম্প্রসারণের জন্য আমরা কাজ করব।
আব্দুল কাইয়ুম: আমাদের প্রাণিজ আমিষের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এ চহিদা পূরণে পোলট্রিশিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কিন্তু দেশের অসংখ্য ক্ষুদ্র পোলট্রি ফার্ম নিরাপদ ডিম, মাংস সরবরাহ করছে কি না, সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। ফার্মগুলো নিয়মনীতি মানছে কি না সে বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
অজয় কুমার রায় : মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর
আবদুস সাত্তার মণ্ডল : সাবেক ভিসি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
গোলাম রহমান : সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ
মসিউর রহমান : সভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
গোলাম রহমান : অধ্যাপক, সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাজমা শাহীন : অধ্যাপক, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কুতুব উদ্দিন আহমেদ : চেয়ারম্যান, এনভয় টেক্সটাইল গ্রুপ
মো. হেলাল উদ্দিন : সহসভাপতি, এফবিসিসিআই
এম এ রশিদ : ভাইস প্রিন্সিপাল, অধ্যাপক, ফিজিক্যাল মেডিসিন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
তৌফিকুল ইসলাম খান : রিসার্চ ফেলো, সিপিডি
আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান : সহসভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
সাইদুর রহমান বাবু : সহসভাপতি, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
মো. রফিকুল হক : সম্পাদক, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
এম নজরুল ইসলাম : কোষাধ্যক্ষ, ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্রাঞ্চ
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
No comments