বিচারের বাণীকে কাঁদবার জায়গা অন্তত দিন by ফারুক ওয়াসিফ

বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে যে কাঁদবে, সে রকম একটা জায়গা দরকার ‘সংখ্যালঘুদের’। পূজা এলে প্রতিমা ভাঙা হবে, দেবী ভাসানোর আগেই আরেকবার ভাসবে চোখ। নির্বাচন এলে ঘর পুড়বে, দেশের ভেতরেই শরণার্থীর হা-হুতাশ শোনা যাবে। কিন্তু বিচার হবে না। তাহলেও যারা দরিদ্র, যাদের সংখ্যা কম, যাদের মনের মধ্যে অপমানের চিতা; তাদের তো কাঁদবার একটা জায়গা দিতে হবে। তবেই না ‘বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কেঁদে কেঁদে’ লাঘব হবে, সান্ত্বনা পাবে। বিচার না হলেও বিচারের অপেক্ষা থাকে, কিন্তু যদি ফরিয়াদ প্রকাশেরই সুযোগ না থাকে, তাহলে তো দমবন্ধ গুমটি ঘর হয়ে পড়বে পুরো সমাজ। বিচারহীনতার এই বিপর্যয়ে সংখ্যায় লঘু ও গুরুরা সবাই আজ এককাতারে।
অসাম্প্রদায়িকতা যদি থাকে, তা আছে জনসমাজে। কিন্তু রাজনীতির সিঁড়ি দিয়ে যত ওপরে যাই তত বিষ। ‘বত্রিশ জাতি ছাড়া দ্যাশ হয় না’ স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন উপদ্রুত হিন্দুসমাজের এক প্রতিবেশী মুসলমান কৃষক। আরেকজন গ্রামের মানুষ শুনিয়েছিলেন ‘হিন্দু ছাড়া কি দ্যাশ হয়?’ ঘরে দুর্গতদের ঠাঁই দিয়ে দরজায় বঁটি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মুহুরির বউ। এই গল্প গত বছরের সাঁথিয়ার। রামুতে বুক পেতে হামলা ঠেকাতে গিয়ে আহত হন কয়েকজন মুসলমান যুবক। অভয়নগরে রাজনৈতিক দস্যুদের হামলার সময় পাশে এসে দাঁড়ান নদীর ওপারের এক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু-মুসলমান মিলে রাত জেগে গ্রাম পাহারার খবরও পাই। তাই বলা যাবে না, ১৫ ভাগ সংখ্যালঘুর অভিযোগের কাঠগড়ায় ৮৫ ভাগ মুসলমানই দাঁড়িয়ে। কোথাও বাঙালির নামে, কোথাও মুসলমানের নামে যে সন্ত্রাস, সেগুলো তাহলে কারা করে?
আমরা জানি না কারা করে! কারণ, আদালতে তা প্রমাণিত হয়নি। কেবল জানি, স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দু-সম্পত্তি দখলের কৃতিত্বে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির আনুপাতিক ভাগ আছে। অর্থাৎ, যে যত বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল বা যতটা ছিল ক্ষমতার অংশীদার, ততটা লুণ্ঠিত সম্পদ এসব দলের নেতা-কর্মীর হাতে এসেছে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত এটা রীতিমতো গবেষণা করে দেখিয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিচার না হওয়ার খতিয়ান দেখিয়েছেন ব্র্যাকের গবেষক মোহাম্মদ রাফি। আর দৈনিক পত্রিকায় হররোজ জাতীয় আত্মজীবনীর যে খণ্ডচিত্র ছাপা হয়, তাতেও দেখা যায় হিন্দুদের মন্দির, ঘরবাড়ি, খেতখামার-পুকুরে মাঝেমধ্যেই পড়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ-জামায়াতের সদস্যদের হাত। এ যদি সর্বদলীয় অবদান না হতো, তাহলে হয়তো বিচার হতো!
সাঁথিয়ার বাবলু সাহার বাড়িঘরে হামলা হয়েছিল গত বছর। তিনি এখন ভালো আছেন, মনের আনন্দে পূজাও করেছেন। রাতে পুলিশের বাঁশি শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যান। কিন্তু গত বছরের হামলার মামলার কী হলো? বাবলু সাহা বলেন, পুলিশ তো ‘ধরতেছে আর জামিন দিচ্ছে। এক বছর তো হলো, মনে হয় না ২-৪-৫ বছরেও সুরাহা হবে!’ খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওই ঘটনার মূল হোতা খোকন এখনো পলাতক। আর সে সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর সাঙাতেরাও পুলিশের খাতা থেকে খালাস। সেই ঘটনায় চারটি মামলা হয়, দুটির তদন্ত করছে সিআইডি। ৪৪ জন গ্রেপ্তার আছে বটে, গ্রেপ্তার-বাণিজ্য করে নিরীহ লোকদের হয়রানির অভিযোগও আছে বটে, তবে আজ অবধি অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। বাবলু সাহা তাই বিচারের আশা করেন না, কেবল নিরাপদে ভালো থাকতে চান।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের রাতে যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় নদীপথে তিন দিক থেকে আক্রমণ আসে। মেয়ে-শিশুরা নদীর ধারের ঝোপের আঁধারে লুকায়। ভাগ্যিস সে সময়েই উদ্ধারের তরি পাঠিয়েছিলেন প্রতিবেশী মুসলিম সমাজপতি। কিন্তু পুলিশ ছিল না, প্রশাসন ছিল না। ওই ঘটনায় ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়। এজাহারভুক্ত আসামিদের আটজনকে আটকও করা হয়। কিন্তু এখন তারা সবাই জামিনে। জামায়াতের যে নেতা ও তাঁর পুত্রদের নাম এসেছিল, তিনি সপুত্র পলাতক। জামায়াত নেতা বদরুল ইসলাম ও আবদুল কাদেরের নাম এজাহারে ছিল না। কারণ, তাঁর ভাই হাবিবুর রহমান হবি আওয়ামী লীগের নেতা। পরে পত্রিকায় নামধাম প্রমাণসহ খবর হলে থানায় নাম ওঠে বটে, কিন্তু ওতটুকুই সার। ওদিকে হিন্দু প্রার্থীর কাছে মনোনয়নের দৌড়ে হেরে যাওয়া শেখ আবদুল ওহাব এখন ধোয়া তুলসীপাতা। ঘটনার কয়েক দিন আগে স্থানীয় সুন্দলী উচ্চবিদ্যালয়ে মালোপাড়ার ভোটারদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দিলেও ২৩ জানুয়ারি অভয়নগরে অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর জনসভার মঞ্চে বসতে তাঁকে কেউ নিষেধ করেনি। এত সব দেখে মালোপাড়ার শেখর বর্মণ বলেন, ‘নেতারা কেউ আসেনি... আমরা আবার মার খাব।’ তবে প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর গ্রামটায় বিদ্যুৎ গেছে, স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পও বসেছে। খেলার মাঠে মুসলিম ও হিন্দু ছেলেমেয়েদের আবার একসঙ্গে খেলতে দেখা যাচ্ছে। সমাজ নিজের মতো উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু বিচার না হলে আবার বিপদের আশঙ্কা ঘনিয়ে আসে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রামুতে। রাতের অন্ধকারে পরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার মানুষ সেখানকার বৌদ্ধপল্লির বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা চালায়। টেকনাফ ও কক্সবাজারেও হামলা হয়। ওই ঘটনায় মামলা হয় ১৫ হাজার আসামির নামে। মোট ১৯টি মামলায় অভিযোগপত্রে নাম আসে ৯৪৮ জনের। এর মধ্যে ৭৮ জন জামিনে রয়েছেন এবং বাদবাকি সব পলাতক। এত আসামি, তবু মূল অভিযুক্তদের নাম নেই। স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতির উসকানি ও নেতৃত্বদানের আলামত থাকলেও পুলিশের চোখে তিনি নির্দোষ। কিন্তু এ ঘটনায় উচ্চ আদালতে যে রিট পিটিশন করা হয় সেখানে তিনিই ১ নম্বর আসামি। সেই রিট পিটিশন করেন রামুর সন্তান জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনে যে আসামির নাম আছে, পুলিশের মামলায় তার নাম নাই কেন? বিচার তো একটাই হবে!’
তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়নি, অথচ তার বিভিন্ন ছেঁড়া পৃষ্ঠা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে দেখা গেছে। প্রতিবেদনটি এখন বিচার বিভাগের নিরাপত্তা হেফাজতে আছে। কিন্তু বিচার তো বন্ধ। দুই বছর ধরে রামুর মামলা আদালতের অপেক্ষমাণ তালিকায় ক্রমেই নিচে নামছে। যে আদালতে এর বিচার হওয়ার কথা সেই আদালতের কর্তৃত্বও কমেছে। দেখেশুনে মনে হয় সরকারের তদন্ত প্রতিবেদনের শেষের বাক্যটাই ভরসা। ওখানে অতীত ভুলে সামনে যাওয়ার সুপারিশের পর লেখা ছিল: বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। অর্থাৎ যাঁরা তদন্ত করছেন তাঁদেরই বিচারে ভরসা নেই। তাই তাঁরা আহত বৌদ্ধসমাজকে ভগবান বুদ্ধের শরণ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভগবান বুদ্ধই যদি বিচার করবেন, তাহলে আর আইন-পুলিশ-প্রশাসন আছে কেন?
রামু-সাঁথিয়া-অভয়নগরের ঘটনায়, এ বছরের প্রতিমা ভাঙার উদাহরণের পর প্রশাসনের ওপর আস্থা নড়ে গেছে অনেকের। রামুতে মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে সামাজিক ফাটল আরও বেড়েছে পুলিশের কারণে। পুলিশের গ্রেপ্তার-বাণিজ্যে যখন যাকে-তাকে হয়রান করা হচ্ছে, তখন নিরীহ মুসলমান মানুষটা অবিশ্বাস করছে প্রতিবেশী বৌদ্ধকে। বৌদ্ধসমাজের নেতাদের তখন বারবার বলতে হচ্ছে, এসব নাম আমরা দিইনি, আমরা তোমাদের দোষী বলিনি। চিহ্নিত আসামি ছাড় পেয়ে যায়, আর দুর্বল বা নিরীহ ব্যক্তিরা আটক হন। পুলিশ কি এতই বেকুব? জামায়াত নেতার জন্য তদবির করেন লীগ নেতা, প্রতিমা ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়ে যুবলীগের নেতা। পুলিশ করে গ্রেপ্তার-বাণিজ্য, রাজনীতি হয় দুর্বৃত্তদের স্বপ্নপুরী। জামায়াত-বিএনপি-লীগের তিন ভাই মিলে অপকর্ম করে, আর দোষ হয় দেশের, সংখ্যাগুরুর।
বর্তমান আইনমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা দ্রুত বিচার আইনে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওই আইনে বিচার বড়জোর কয়েক মাস লাগার কথা। কিন্তু বছর পেরিয়ে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদবার জায়গাটাও হারায়। বড় আশ্চর্য এই দেশ! 

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।  
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.