গল্প- মিতাপু by আনিসুল হক
সত্য বটে আজ আর তাকে ভালোবাসি না, কিন্তু একসময় কী ভীষণ ভালোই না তাকে বেসেছিলুম... পাবলো নেরুদা।
মিতাপুকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেই মিতাপু। এ কি সেই মিতাপু!
রাতের বেলা গেছি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে। দিনের বেলা হরতাল। রাতের বেলা ‘ও’ লেভেলের পরীক্ষা হচ্ছে। আমার মেয়ে রিমঝিম পরীক্ষা দিচ্ছে। তাকে নিয়ে এই রাতের বেলা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আসতে হয়েছে। দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের গালিগালাজ করছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রিমঝিমের ক্লাসমেটদের মা–বাবারাও আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে। এই দেশটার ভবিষ্যৎ যে রাজনীতিই নষ্ট করছে, সে বিষয়ে একমত পোষণ করছেন তাঁরাও।
এরই মধ্যে হঠাৎ দূরে একটা গাড়িতে...কালো গাড়ি, তার দরজা খোলা, রাস্তার লাইটপোস্টের আলো তার ওপরে পড়েছে...আমি দেখতে পাই মিতাপুর মুখ।
আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়।
সেই মিতাপু। সেই টিকালো নাক, চশমা পরা দ্যুতিময় চোখ।...
মিতাপু কারমাইকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। আমি ফার্স্ট ইয়ারে। ইশা স্যারের কাছে যাই কেমিস্ট্রি পড়তে। স্যার দারুণ পড়ান। বলেন, কার্বনের চার হাত। হাউড্রোজেনের এক হাত। চার হাত দিয়ে একটা কার্বন চারটা হাইড্রোজেনকে ধরে।
স্যারের মাথায় টাক। শীতের রোদ জানালা দিয়ে তেরছা হয়ে তার টাকে পড়েছে। প্রতিফলিত হয়ে ছাদে পড়েছে সেই আলো। আমরা এ–ওর গায়ে চিমটি কেটে সেটা দেখাচ্ছি। একটা চড়ুই জানালার ওপারে জবাগাছে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে।
আমরা পাঁচ ফার্স্ট ইয়ার একসঙ্গে পড়ছি স্যারের কাছে। প্রাইভেট। এর পরের ব্যাচে সেকেন্ড ইয়ার। তিনটা ছেলে। দুটো মেয়ে। একজন মিতাপু। আরেকজন নার্গিস আপু।
মিতাপুর চোখে চশমা। নাকটা টিকালো। নাকে নাকফুল। মিতাপুর গায়ের রং কাঁঠালচাঁপা ফুলের মতো। মিতাপু আস্তে আস্তে হাঁটেন, এমনভাবে পা ফেলেন, মনে হয় তাঁর পা মাটিতে পড়ে না। তিনি রাজহাঁস। তিনি হাঁটছেন না, সাঁতার কাটছেন।
আমরা বেরিয়ে যাই। মিতাপুরা ঢোকেন। আমরা পড়ি, মিতাপুরা বারান্দায় অপেক্ষা করেন। আমি কেমিস্ট্রি বাদ দিয়ে মিতাপুর দুচোখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। আজ তিনি পরেছেন কালো সালোয়ার। তাঁর পায়ে দুই ফিতার কালো স্যান্ডেল। তাঁর ফরসা পা দুটোকে মনে হচ্ছে পারিজাত ফুল। আমি পারিজাত দেখিনি। শুনেছি, পারিজাত হলো স্বর্গের ফুল।
মিতাপুর পা দুটোই তো স্বর্গের ফুল।
আমার বয়স তখন ১৬+। তখনো আমি রবীন্দ্রসংগীত শোনার ও উপভোগ করার বয়সে পৌঁছুইনি। এখন রবীন্দ্রসংগীতের তুলনা আমি দিতে পারব। বলতে পারব, দুটো অতুল পদতল রাতুল শতদল জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল।
মাটির পৃথিবী মিতাপুর পা দুটোকে স্পর্শ করতে পারে না।
তাঁর স্যান্ডেল থেকে ঝরে পড়ে অপার্থিব জোছনা।
মিতাপুর প্রেমে আমি পড়ে গেলাম। পড়তাম না। কিন্তু এই ছিল বিধিলিপি। এই ছিল অদৃষ্টের নির্দেশ।
কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস ৯০০ বিঘা জমির ওপরে। তার একটা ডিপার্টমেন্ট মাঠের এক কোণে, তো আরেকটা ডিপার্টমেন্ট মাঠের আরেক কোণে। মাঠে চোরকাঁটা। আমরা কেমিস্ট্রি বিল্ডিংয়ে। এটা একটা পুরোনো ভবন। ওপরে টালির ছাদ। ক্লাসরুমটায় একটা গ্যালারি বানানো। পেছনের দিকে কাঠের পাটাতনে উঁচুতে বসানো চেয়ার। সামনের আসনগুলো অনেক নিচুতে।
সেই রসায়ন ভবনের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেমিস্ট্রির প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল। আমি লবণ কিছুতেই শনাক্ত করতে পারছিলাম না। পাঁচটা বেজে গেল। সবাই চলে গেল। আমি আর স্যার শুধু ল্যাবরেটরিতে।
বেরোলাম। ততক্ষণে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে কলেজের মাঠ। ভেসে গেছে দিগন্তরেখা। আবছা হয়ে গেছে দূরের মিনারশোভিত প্রশাসনিক ভবন। মেয়েদের কমনরুম দেখাই যাচ্ছে না।
বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে দুটো ছাগল।
এরই মধ্যে কোত্থেকে এসেছেন মিতাপু। বললেন, শান্ত, কী মুশকিল হলো বলো তো। একটা রিকশা কী করে পাই।
আমার গলার স্বর কেঁপে উঠছে...আমি বলছি, মিতাপু, আমার কাছে ছাতা আছে। আপনি চলেন। আপনাকে মেয়েদের কমনরুম পর্যন্ত পৌঁছে দিই।
তিনি বললেন, খুব ভালো হয়। চলো।
আমরা একটা ছাতার নিচে। ধন্যবাদ মিস্টার কারমাইকেল, ধন্যবাদ রংপুরের সাবেক জমিদারগণ, বাবু গোপাল লাল রায় আর মহিমারঞ্জন রায়কে, আপনাদের দাক্ষিণ্যে এই কলেজের ভবনগুলো অনেক দূরে দূরে বানানো সম্ভবপর হয়েছে। মিতাপু আমার ছাতার নিচে। বৃষ্টির ছাট ছাতা ডিঙিয়ে এসে চোখেমুখে লাগছে। পা ভিজে যাচ্ছে। মিতাপু এক হাতে তাঁর পাজামা উঁচু করে ধরেছেন। আমি তাঁর পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আছি। পানির স্রোতে পা ডুবছে-ভাসছে। তাঁর গায়ে বকুল ফুলের গন্ধ। আমি বুঁদ হয়ে যাচ্ছি। আমি ডুবে যাচ্ছি। এই পথ যেন শেষ না হয়। তিনি এক হাতে ছাতা ধরেছেন। আমার এক হাত ছাতার ডাঁটায়। বৃষ্টির পানিতে আমার নীরক্ত হাতে লাগে তাঁর স্পর্শ। আমার হাতে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়।
জোরে বাজ পড়ল। মিতাপু কেঁপে উঠলেন। তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। আমার গায়ের সঙ্গে তাঁর গা লাগল। আমার জন্ম ধন্য হয়ে গেল। আমার কিছু চাই না। আমি এখন কেঁদে ফেলব। আমি আর বাঁচব না।
আমার ঘুম বন্ধ হয়ে গেল। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি সারা রাত জেগে থাকি। সারা সপ্তাহ জেগে থাকি। আমি সারা মাস জেগে থাকি। আমি সর্বত্র মিতাপুকে দেখি। আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকলখানে। মধুমিতা হলে চলিতেছে...ইত্তেফাক–এ সিনেমার বিজ্ঞাপনে আমি মিতা শব্দের দিকে তাকিয়ে থাকি। মিতালি রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের সামনে গেলে আমার পা স্থির হয়ে যায়।
আমি কী করব। আমি কী করি? আমি গল্প লিখব। আমি একটা গল্প লিখেই ফেলি। গল্পের নামই দিই মিতা। গল্পের নায়কের নাম শফিকুল হাসান। আমার ভালো নাম। গল্পে মিতার সঙ্গে শফিকুল হাসানের বিয়ে হয়েছে। শফিকুল হাসান কেমিস্ট্রির শিক্ষক। তারা গ্রীষ্মের দুপুরে মাদুর বিছিয়ে ভাত খায়। বাইরে প্রান্তরে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাস ওড়ে। কাঁঠালগাছের নিচে এঁচোড় ঝরে পড়ে। শফিকুল হাসান ঘামে। তার পিঠে ঘামাচি। মিতা তার পিঠে পাউডার ছিটিয়ে দেয়। তার ঘামাচি দুই বুড়ো আঙুলের নখে গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর ক্যারম খেলে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে শফিকুল হাসান বিড়বিড় করে, আমি তোমাকে ভালোবাসি মিতা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সেই গল্পটা প্রকাশ করার জন্য আমি একটা গল্পপত্র বের করি। বর্ণসজ্জা প্রিন্টিং প্রেসে সেটা কম্পোজ করা হয়। আরডিআরএস আর রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেডের বিজ্ঞাপনও জোগাড় করা যায়। পত্রিকার নাম ‘হৃদয়’। সেটা বেরিয়ে গেলে পুরো কলেজে হইচই শুরু হয়। ছাত্রসংসদের ভিপি আমাকে ডেকে পাঠান। বলেন, তোমাকে আর কোনো দিনও যেন এই কলেজে না দেখি। যদি দেখি, তোমাকে ওই কৃষ্ণচূড়াগাছটার নিচে পুঁতে ফেলব। তোমার রক্ত ওই গাছের কৃষ্ণচূড়াকে লাল করে তুলবে। ভিপি ভাইয়ার গায়ের রং কালো, তাঁর দাঁতের রং সাদা, তাঁর চোখের রং লাল। তাঁর পকেটের পিস্তলের নল ইস্পাতের, তাতে রোদ পড়ে ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তাঁর টেবিলে পিতলের বুলেট। সেসব ঝনঝন করে বাজে।
তখন দেশে সামরিক শাসন। ভিপি সামরিক শাসকের দলে যোগ দিয়েছেন। তাঁর অগাধ ক্ষমতা। আব্বা কী করে যেন খবর পেয়ে যান। আমাকে নিয়ে সোজা চলে যান বগুড়ায়। আমি ফুপুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকি।
ছয় মাসের মধ্যেই মিতাপু আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছাড়েন। তারপর তাঁর সার্কেল অফিসার বাবা বদলি হয়ে রংপুর ছেড়ে চলে গেলে মিতাপুর প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। আমি আবার রংপুর ফিরে আসি, আর যথারীতি ক্লাস করে পরের বছরের পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে থাকি।
কিন্তু গল্প আমাকে ছাড়ে না। আমি ঢাকা আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে ভর্তি হই। আজাদ স্যারের চ্যালা হই। ভালো ছাত্র হিসেবে গণ্য, আবার গল্পও লিখি। গল্প লেখার প্রয়োজনে নীলক্ষেতে গিয়ে একরাতে দেশি মদ, সন্দীপনের গল্প এবং সুবিমল মিশ্রর প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটল ম্যাগাজিন পান করে দেখি।
এখন একটা ওষুধ কোম্পানির এমডি আমি। আমার মেয়ে রিমঝিম ‘ও’ লেভেল দিচ্ছে। ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনেছি। বেঙ্গলে গিয়ে অদিতির রবীন্দ্রসংগীত এবং কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম উপভোগ করি। মাসে একবার রেডওয়াইন, বছরে একবার ব্যাংকক কি ইস্তাম্বুল। আমার স্ত্রী সুরাইয়া এনজিওতে কাজ করে, মানুষের জন্যই করে। তার কুঁচি করে পরা শাড়ির ফাঁকে ঈষৎ চর্বির আভাস। বিয়ের সময় সে শ্যামলা ছিল, বিশ বছরে সে ফরসাত্ব অর্জন করেছে।
আর আমি, তার মেয়ে রিমঝিমের কর্তব্যপরায়ণ পিতা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রাত তিনটায় দাঁড়িয়ে আছি।
এবং ধন্দে পড়ে গেছি।
মিতাপু ওই সামনের কালো গাড়িতে। টয়োটা এলিয়েন।
আমার বুক কাঁপে। ৩০ বছর আগে যেভাবে কেঁপেছিল। আমার গলা শুকিয়ে আসে। ৩০ বছর আগে যেভাবে শুকাত।
আমি এগিয়ে যাই। চন্দ্রগ্রস্তের মতো। তখনই আমি আকাশে তাকিয়ে দেখি, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, আধা খাওয়া তালপিঠার মতো আকাশের প্লেটে।
আমি বলি, মিতাপু, আপনি?
তিনি আধশোয়া ছিলেন। তাঁর কানে হেডফোন। আইপডে গান শুনছেন।
তিনি কানের যন্ত্র খুলে ফেলেন।
আমি বলি, মিতাপু...
তিনি বলেন, আপনি আম্মিকে খুঁজছেন? আম্মি আম্মি, কই যে যায়। তিনি হাতের মোবাইল তুলে নিয়ে ফোন করেন। দূরে আরেকটা জটলায় একটা মোবাইল ফোনের সেটে আলো জ্বলে উঠলে তিনি বলেন, ওই যে আম্মি...চলেন আমি নিয়ে যাচ্ছি...
আমি মিতাপুর কাছে যাই। মিতাপুর মেয়েই নিয়ে যায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতাপুর মেয়ের মাকে দেখে, সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রত্যাশাভঙ্গ ঘটে। আমার কাছে মিতাপু আইএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়া এক কিশোরী। কিন্তু এ তো একজন মধ্যবয়স্কা নারী। ভীষণ মোটা। আশাহীনভাবে বুড়িয়ে যাওয়া। আম্মি, এই আংকেল তোমাকে খুঁজছেন...
মিতাপু বলেন, আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
আমি বলি, আমি ঠিক আপনার চেনার মতো কেউ না। কারমাইকেল কলেজে আপনার এক ক্লাস নিচে পড়তাম। আমার নাম শফিউল হাসান।
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, আমরা এক বছর রংপুরে ছিলাম। ওখান থেকেই আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিলাম। খুব ছোট বয়সের কথা তো। আমার কিছুই মনে নাই।
তিনি আবার জটলার একটা আলাপে ফিরে যান, ‘বোঝে না সে বোঝে না’র পাখি এটা কী করল, বলেন? আমাকে তেমন পাত্তাই দেন না।
আমিও পাত্তা দেব না।
যে মিতাপুকে আমি চিনতাম, এ তো তিনি নন।
আমার বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর ৩০ বছর পরে নেমে যায়।
ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ে।
আমিও হাঁটতে হাঁটতে আমার পরিচিত জটলায় ফিরে আসি।
আকাশে আধা খাওয়া তালপিঠা।
গাড়িতে গানের তালে পা দোলাচ্ছে একজোড়া পা।
আমি বিড়বিড় করে নেরুদা আবৃত্তি করি: সত্য বটে আজ আর তাকে ভালোবাসি না, কিন্তু একসময় কী ভীষণ ভালোই না তাকে বেসেছিলুম।
এই রাত তারকাখচিত, আর সে আমার পাশে নেই।
পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, রিমঝিমকে ভিড়ের মধ্য থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি ভিড়ের দিকে পা বাড়াই। রিমঝিমের মা ফোন করে, এই রিমঝিমকে পেয়েছ, ওর পরীক্ষা কেমন হয়েছে...
মিতাপুকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেই মিতাপু। এ কি সেই মিতাপু!
রাতের বেলা গেছি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে। দিনের বেলা হরতাল। রাতের বেলা ‘ও’ লেভেলের পরীক্ষা হচ্ছে। আমার মেয়ে রিমঝিম পরীক্ষা দিচ্ছে। তাকে নিয়ে এই রাতের বেলা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আসতে হয়েছে। দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের গালিগালাজ করছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রিমঝিমের ক্লাসমেটদের মা–বাবারাও আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে। এই দেশটার ভবিষ্যৎ যে রাজনীতিই নষ্ট করছে, সে বিষয়ে একমত পোষণ করছেন তাঁরাও।
এরই মধ্যে হঠাৎ দূরে একটা গাড়িতে...কালো গাড়ি, তার দরজা খোলা, রাস্তার লাইটপোস্টের আলো তার ওপরে পড়েছে...আমি দেখতে পাই মিতাপুর মুখ।
আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়।
সেই মিতাপু। সেই টিকালো নাক, চশমা পরা দ্যুতিময় চোখ।...
মিতাপু কারমাইকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে। আমি ফার্স্ট ইয়ারে। ইশা স্যারের কাছে যাই কেমিস্ট্রি পড়তে। স্যার দারুণ পড়ান। বলেন, কার্বনের চার হাত। হাউড্রোজেনের এক হাত। চার হাত দিয়ে একটা কার্বন চারটা হাইড্রোজেনকে ধরে।
স্যারের মাথায় টাক। শীতের রোদ জানালা দিয়ে তেরছা হয়ে তার টাকে পড়েছে। প্রতিফলিত হয়ে ছাদে পড়েছে সেই আলো। আমরা এ–ওর গায়ে চিমটি কেটে সেটা দেখাচ্ছি। একটা চড়ুই জানালার ওপারে জবাগাছে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে।
আমরা পাঁচ ফার্স্ট ইয়ার একসঙ্গে পড়ছি স্যারের কাছে। প্রাইভেট। এর পরের ব্যাচে সেকেন্ড ইয়ার। তিনটা ছেলে। দুটো মেয়ে। একজন মিতাপু। আরেকজন নার্গিস আপু।
মিতাপুর চোখে চশমা। নাকটা টিকালো। নাকে নাকফুল। মিতাপুর গায়ের রং কাঁঠালচাঁপা ফুলের মতো। মিতাপু আস্তে আস্তে হাঁটেন, এমনভাবে পা ফেলেন, মনে হয় তাঁর পা মাটিতে পড়ে না। তিনি রাজহাঁস। তিনি হাঁটছেন না, সাঁতার কাটছেন।
আমরা বেরিয়ে যাই। মিতাপুরা ঢোকেন। আমরা পড়ি, মিতাপুরা বারান্দায় অপেক্ষা করেন। আমি কেমিস্ট্রি বাদ দিয়ে মিতাপুর দুচোখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। আজ তিনি পরেছেন কালো সালোয়ার। তাঁর পায়ে দুই ফিতার কালো স্যান্ডেল। তাঁর ফরসা পা দুটোকে মনে হচ্ছে পারিজাত ফুল। আমি পারিজাত দেখিনি। শুনেছি, পারিজাত হলো স্বর্গের ফুল।
মিতাপুর পা দুটোই তো স্বর্গের ফুল।
আমার বয়স তখন ১৬+। তখনো আমি রবীন্দ্রসংগীত শোনার ও উপভোগ করার বয়সে পৌঁছুইনি। এখন রবীন্দ্রসংগীতের তুলনা আমি দিতে পারব। বলতে পারব, দুটো অতুল পদতল রাতুল শতদল জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল।
মাটির পৃথিবী মিতাপুর পা দুটোকে স্পর্শ করতে পারে না।
তাঁর স্যান্ডেল থেকে ঝরে পড়ে অপার্থিব জোছনা।
মিতাপুর প্রেমে আমি পড়ে গেলাম। পড়তাম না। কিন্তু এই ছিল বিধিলিপি। এই ছিল অদৃষ্টের নির্দেশ।
কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস ৯০০ বিঘা জমির ওপরে। তার একটা ডিপার্টমেন্ট মাঠের এক কোণে, তো আরেকটা ডিপার্টমেন্ট মাঠের আরেক কোণে। মাঠে চোরকাঁটা। আমরা কেমিস্ট্রি বিল্ডিংয়ে। এটা একটা পুরোনো ভবন। ওপরে টালির ছাদ। ক্লাসরুমটায় একটা গ্যালারি বানানো। পেছনের দিকে কাঠের পাটাতনে উঁচুতে বসানো চেয়ার। সামনের আসনগুলো অনেক নিচুতে।
সেই রসায়ন ভবনের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেমিস্ট্রির প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল। আমি লবণ কিছুতেই শনাক্ত করতে পারছিলাম না। পাঁচটা বেজে গেল। সবাই চলে গেল। আমি আর স্যার শুধু ল্যাবরেটরিতে।
বেরোলাম। ততক্ষণে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে কলেজের মাঠ। ভেসে গেছে দিগন্তরেখা। আবছা হয়ে গেছে দূরের মিনারশোভিত প্রশাসনিক ভবন। মেয়েদের কমনরুম দেখাই যাচ্ছে না।
বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে দুটো ছাগল।
এরই মধ্যে কোত্থেকে এসেছেন মিতাপু। বললেন, শান্ত, কী মুশকিল হলো বলো তো। একটা রিকশা কী করে পাই।
আমার গলার স্বর কেঁপে উঠছে...আমি বলছি, মিতাপু, আমার কাছে ছাতা আছে। আপনি চলেন। আপনাকে মেয়েদের কমনরুম পর্যন্ত পৌঁছে দিই।
তিনি বললেন, খুব ভালো হয়। চলো।
আমরা একটা ছাতার নিচে। ধন্যবাদ মিস্টার কারমাইকেল, ধন্যবাদ রংপুরের সাবেক জমিদারগণ, বাবু গোপাল লাল রায় আর মহিমারঞ্জন রায়কে, আপনাদের দাক্ষিণ্যে এই কলেজের ভবনগুলো অনেক দূরে দূরে বানানো সম্ভবপর হয়েছে। মিতাপু আমার ছাতার নিচে। বৃষ্টির ছাট ছাতা ডিঙিয়ে এসে চোখেমুখে লাগছে। পা ভিজে যাচ্ছে। মিতাপু এক হাতে তাঁর পাজামা উঁচু করে ধরেছেন। আমি তাঁর পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আছি। পানির স্রোতে পা ডুবছে-ভাসছে। তাঁর গায়ে বকুল ফুলের গন্ধ। আমি বুঁদ হয়ে যাচ্ছি। আমি ডুবে যাচ্ছি। এই পথ যেন শেষ না হয়। তিনি এক হাতে ছাতা ধরেছেন। আমার এক হাত ছাতার ডাঁটায়। বৃষ্টির পানিতে আমার নীরক্ত হাতে লাগে তাঁর স্পর্শ। আমার হাতে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়।
জোরে বাজ পড়ল। মিতাপু কেঁপে উঠলেন। তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে এলেন। আমার গায়ের সঙ্গে তাঁর গা লাগল। আমার জন্ম ধন্য হয়ে গেল। আমার কিছু চাই না। আমি এখন কেঁদে ফেলব। আমি আর বাঁচব না।
আমার ঘুম বন্ধ হয়ে গেল। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি সারা রাত জেগে থাকি। সারা সপ্তাহ জেগে থাকি। আমি সারা মাস জেগে থাকি। আমি সর্বত্র মিতাপুকে দেখি। আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকলখানে। মধুমিতা হলে চলিতেছে...ইত্তেফাক–এ সিনেমার বিজ্ঞাপনে আমি মিতা শব্দের দিকে তাকিয়ে থাকি। মিতালি রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের সামনে গেলে আমার পা স্থির হয়ে যায়।
আমি কী করব। আমি কী করি? আমি গল্প লিখব। আমি একটা গল্প লিখেই ফেলি। গল্পের নামই দিই মিতা। গল্পের নায়কের নাম শফিকুল হাসান। আমার ভালো নাম। গল্পে মিতার সঙ্গে শফিকুল হাসানের বিয়ে হয়েছে। শফিকুল হাসান কেমিস্ট্রির শিক্ষক। তারা গ্রীষ্মের দুপুরে মাদুর বিছিয়ে ভাত খায়। বাইরে প্রান্তরে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাস ওড়ে। কাঁঠালগাছের নিচে এঁচোড় ঝরে পড়ে। শফিকুল হাসান ঘামে। তার পিঠে ঘামাচি। মিতা তার পিঠে পাউডার ছিটিয়ে দেয়। তার ঘামাচি দুই বুড়ো আঙুলের নখে গলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর ক্যারম খেলে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে শফিকুল হাসান বিড়বিড় করে, আমি তোমাকে ভালোবাসি মিতা। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সেই গল্পটা প্রকাশ করার জন্য আমি একটা গল্পপত্র বের করি। বর্ণসজ্জা প্রিন্টিং প্রেসে সেটা কম্পোজ করা হয়। আরডিআরএস আর রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেডের বিজ্ঞাপনও জোগাড় করা যায়। পত্রিকার নাম ‘হৃদয়’। সেটা বেরিয়ে গেলে পুরো কলেজে হইচই শুরু হয়। ছাত্রসংসদের ভিপি আমাকে ডেকে পাঠান। বলেন, তোমাকে আর কোনো দিনও যেন এই কলেজে না দেখি। যদি দেখি, তোমাকে ওই কৃষ্ণচূড়াগাছটার নিচে পুঁতে ফেলব। তোমার রক্ত ওই গাছের কৃষ্ণচূড়াকে লাল করে তুলবে। ভিপি ভাইয়ার গায়ের রং কালো, তাঁর দাঁতের রং সাদা, তাঁর চোখের রং লাল। তাঁর পকেটের পিস্তলের নল ইস্পাতের, তাতে রোদ পড়ে ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তাঁর টেবিলে পিতলের বুলেট। সেসব ঝনঝন করে বাজে।
তখন দেশে সামরিক শাসন। ভিপি সামরিক শাসকের দলে যোগ দিয়েছেন। তাঁর অগাধ ক্ষমতা। আব্বা কী করে যেন খবর পেয়ে যান। আমাকে নিয়ে সোজা চলে যান বগুড়ায়। আমি ফুপুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকি।
ছয় মাসের মধ্যেই মিতাপু আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে কলেজ ছাড়েন। তারপর তাঁর সার্কেল অফিসার বাবা বদলি হয়ে রংপুর ছেড়ে চলে গেলে মিতাপুর প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। আমি আবার রংপুর ফিরে আসি, আর যথারীতি ক্লাস করে পরের বছরের পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে থাকি।
কিন্তু গল্প আমাকে ছাড়ে না। আমি ঢাকা আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে ভর্তি হই। আজাদ স্যারের চ্যালা হই। ভালো ছাত্র হিসেবে গণ্য, আবার গল্পও লিখি। গল্প লেখার প্রয়োজনে নীলক্ষেতে গিয়ে একরাতে দেশি মদ, সন্দীপনের গল্প এবং সুবিমল মিশ্রর প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটল ম্যাগাজিন পান করে দেখি।
এখন একটা ওষুধ কোম্পানির এমডি আমি। আমার মেয়ে রিমঝিম ‘ও’ লেভেল দিচ্ছে। ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনেছি। বেঙ্গলে গিয়ে অদিতির রবীন্দ্রসংগীত এবং কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্ম উপভোগ করি। মাসে একবার রেডওয়াইন, বছরে একবার ব্যাংকক কি ইস্তাম্বুল। আমার স্ত্রী সুরাইয়া এনজিওতে কাজ করে, মানুষের জন্যই করে। তার কুঁচি করে পরা শাড়ির ফাঁকে ঈষৎ চর্বির আভাস। বিয়ের সময় সে শ্যামলা ছিল, বিশ বছরে সে ফরসাত্ব অর্জন করেছে।
আর আমি, তার মেয়ে রিমঝিমের কর্তব্যপরায়ণ পিতা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রাত তিনটায় দাঁড়িয়ে আছি।
এবং ধন্দে পড়ে গেছি।
মিতাপু ওই সামনের কালো গাড়িতে। টয়োটা এলিয়েন।
আমার বুক কাঁপে। ৩০ বছর আগে যেভাবে কেঁপেছিল। আমার গলা শুকিয়ে আসে। ৩০ বছর আগে যেভাবে শুকাত।
আমি এগিয়ে যাই। চন্দ্রগ্রস্তের মতো। তখনই আমি আকাশে তাকিয়ে দেখি, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, আধা খাওয়া তালপিঠার মতো আকাশের প্লেটে।
আমি বলি, মিতাপু, আপনি?
তিনি আধশোয়া ছিলেন। তাঁর কানে হেডফোন। আইপডে গান শুনছেন।
তিনি কানের যন্ত্র খুলে ফেলেন।
আমি বলি, মিতাপু...
তিনি বলেন, আপনি আম্মিকে খুঁজছেন? আম্মি আম্মি, কই যে যায়। তিনি হাতের মোবাইল তুলে নিয়ে ফোন করেন। দূরে আরেকটা জটলায় একটা মোবাইল ফোনের সেটে আলো জ্বলে উঠলে তিনি বলেন, ওই যে আম্মি...চলেন আমি নিয়ে যাচ্ছি...
আমি মিতাপুর কাছে যাই। মিতাপুর মেয়েই নিয়ে যায়। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতাপুর মেয়ের মাকে দেখে, সত্যি কথা বলতে কি, আমার প্রত্যাশাভঙ্গ ঘটে। আমার কাছে মিতাপু আইএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়া এক কিশোরী। কিন্তু এ তো একজন মধ্যবয়স্কা নারী। ভীষণ মোটা। আশাহীনভাবে বুড়িয়ে যাওয়া। আম্মি, এই আংকেল তোমাকে খুঁজছেন...
মিতাপু বলেন, আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।
আমি বলি, আমি ঠিক আপনার চেনার মতো কেউ না। কারমাইকেল কলেজে আপনার এক ক্লাস নিচে পড়তাম। আমার নাম শফিউল হাসান।
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, আমরা এক বছর রংপুরে ছিলাম। ওখান থেকেই আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিলাম। খুব ছোট বয়সের কথা তো। আমার কিছুই মনে নাই।
তিনি আবার জটলার একটা আলাপে ফিরে যান, ‘বোঝে না সে বোঝে না’র পাখি এটা কী করল, বলেন? আমাকে তেমন পাত্তাই দেন না।
আমিও পাত্তা দেব না।
যে মিতাপুকে আমি চিনতাম, এ তো তিনি নন।
আমার বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর ৩০ বছর পরে নেমে যায়।
ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ে।
আমিও হাঁটতে হাঁটতে আমার পরিচিত জটলায় ফিরে আসি।
আকাশে আধা খাওয়া তালপিঠা।
গাড়িতে গানের তালে পা দোলাচ্ছে একজোড়া পা।
আমি বিড়বিড় করে নেরুদা আবৃত্তি করি: সত্য বটে আজ আর তাকে ভালোবাসি না, কিন্তু একসময় কী ভীষণ ভালোই না তাকে বেসেছিলুম।
এই রাত তারকাখচিত, আর সে আমার পাশে নেই।
পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে, রিমঝিমকে ভিড়ের মধ্য থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি ভিড়ের দিকে পা বাড়াই। রিমঝিমের মা ফোন করে, এই রিমঝিমকে পেয়েছ, ওর পরীক্ষা কেমন হয়েছে...
No comments