কণ্ঠস্বর-পশ্চিমবঙ্গে এবার বুদ্ধ না মমতা? by রাহাত খান
নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের ঘটনাবলির পর, প্রেমঘটিত কারণে জনৈক মুসলিম যুবকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও বুদ্ধদেব সরকারের নিশ্চুপতা, রাজ্যে বাম পেটোয়া বাহিনীর তাণ্ডব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের একে একে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করা এবং প্রশাসনে ভয়াবহ স্থবিরতা ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্য বামদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে
আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনী, তার তর্জন-গর্জন এবং সেসবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে দু'চার কথা। এরপর যথাবিহিত মূল আলোচনায় আসব। মুফতি আমিনী-সংক্রান্ত আলোচনার সঙ্গে মূল বিষয়ে আলোচনার কিছু সম্পর্কও রয়েছে।
সম্প্রতি মুফতি আমিনী কোনো এক সমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, তার ছেলে মাওলানা হাসনাতকে (সংক্ষেপে) সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা অপহরণ করেছে এবং তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আমিনী সাহেব বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে কোরআন-রক্ষা আন্দোলনে নেমেছেন, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমৃত্যু কোরআন-রক্ষা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আর তার ছেলে হাসনাতকে যদি অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া না হয় তাহলে এর যোগ্য উত্তর দেওয়া হবে। গত একদিনের হরতালেই তো দেখিয়েছি, আমরা কী পারি। প্রয়োজন হলে এরপর আরও হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। মাত্র ১০ মিনিটে পুরো বাংলাদেশ অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের (আমিনীদের) আছে।
তর্জন-গর্জন পর্যন্ত ঘটনা থেমে থাকলে হতো; কিন্তু ঘটনাটা ইতির দিকে গড়ায়নি। এই তর্জন-গর্জনের জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ১০ মিনিট কেন, ১০ বছরেও দেশ অচল করার ক্ষমতা নেই মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী আমিনীর। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেছেন, যারা ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন করে না, তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। (দ্রষ্টব্য : দৈনিক সমকাল, কলাম এক, পৃষ্ঠা-১৯)
একই দিনে (১৮ এপ্রিল) একই পৃষ্ঠায় চারের কলামে সমকালে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন আরও ভয়ঙ্কর কথা। মুফতি আমিনী সম্পর্কে। আমিনী সাহেব নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নিজেই নিজের ছেলেকে গুম করেছেন। তিনি বলেছেন, আমিনী যে ধরনের চালবাজ ও ধূর্ত, তাতে এমনটা করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। আমিনী এসব কাজে অভ্যস্ত বলেও তিনি জানান। আমিনীকে প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ইবলিসের (শয়তানের) সঙ্গেও তুলনা করেন। তিনি বলেন, এই সময় ইবলিস একটু বিশ্রামে আছে। এখন ফজলুল হক আমিনী বাংলাদেশে ইবলিসের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
সমকালে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে কেউ কেউ কৌতুকছলে প্রতিবাদ জানিয়ে আমাকে বলেছেন, ইবলিসের সঙ্গে আমিনীর তুলনা করে নাকি ইবলিসকে অপমান করা হয়েছে। সকালবেলা রমনা পার্কে হাঁটতে যাই। নানাজন নানা কথা বলেন নেহাতই ঠাট্টা-বিদ্রূপের ছলে। যাহোক, বর্তমান নিবন্ধে আমিনী ও ইবলিসের এই বিতর্কে আর অধিক কিছু বলতে চাই না। এসব রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার। রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের এমন ধারা উক্তি হয়েই থাকে। ঢিলটি দিলে পাটকেলটি খেতে হয়। আমিনীও কিছুদিন আগে নারীনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাপের যে পরিণতি হয়েছিল, মেয়েরও সেই পরিণতি হবে। আর প্রতিপক্ষের লোকদের জিহ্বা টেনে তুলে ফেলার হুমকি তো যখন-তখনই দেন।
তবে আজ আমিনী প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানি। শুধু একটি কথা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য আমিনী নিজেই নিজের ছেলেকে গুম করেছেন, নাকি আমিনী যেমন বলছেন_ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা আমিনীর ছেলেকে ধরে নিয়ে গুম করে রেখেছে, এটা আর রহস্যের মধ্যে থাকা উচিত নয়। সত্য উদ্ঘাটিত হোক, এই-ই আমাদের প্রত্যাশা। দায়িত্ব সরকার ও আমিনী_ উভয়েরই।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ১৮ এপ্রিল থেকে। ওইদিন রাজ্যের ছয়টি জেলার ৫৪টি আসনে ভোট দেওয়া পর্ব শেষ হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ। ৫৪টি আসনে ভোটপ্রার্থীর সংখ্যা ৩৮৫ জন। তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোট এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল সিপিএম তথা বাম কোয়ালিশন সবক'টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে প্রায় অচ্ছুত একটি দল। তবে এ দলটি এবার কিছুটা 'রাজনৈতিক দূরদর্শিতা' দেখিয়েছে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দার্জিলিংয়ের আদিবাসী জনগণের দাবিকে সমর্থন দিয়ে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি এলাকায় বিজেপির পাঁচজন থেকে সাতজন প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে বিজেপি দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি এলাকার মুসলিম ভোট পাবে না, বামদের ভোট পাবে না, তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের ভোট তো পাবেই না। আদিবাসীদের মধ্যেও বিভক্তি আছে। আদিবাসীদের অন্তত শতকরা ৩০ জনের ভোট বিজেপি পাবে না বলে নির্বাচন বিশ্লেষকদের অভিমত। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি তিনটি আসনও জিততে পারে, তাহলে সেটাও তাদের জন্য একটা বিশাল রাজনৈতিক জয় বলে গণ্য হবে। গত নির্বাচনের আগের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র একটি আসন, তপন রায় চৌধুরীর আসনটি। তপন চৌধুরীকে কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব দিয়ে পুরস্কৃতও করেছিল বিজেপি।
তবে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা কিংবা বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি কোনো ফ্যাক্টরই নয়। একে সাম্প্রদায়িক দল; চরম মুসলিমবিদ্বেষী বললে অত্যুক্তি হয় না। তারপর রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যে বিজেপি নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বড়জোর বলা যায় নামকাওয়াস্তে বা প্রতীকী।
পশ্চিমবঙ্গে এবার নির্বাচনী লড়াই হবে মূলত বাম দলের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। দু'দলেরই দাবি, তারা জিতবে। অ-বাম দলের লোকেরা বলছেন, পালে (নির্বাচনে) বাতাস লেগেছে মমতার। মমতা মানে তৃণমূল এবং কংগ্রেস দুই-ই। আর বাম সমর্থক এবং বাম রাজনীতি বিশ্লেষকদের মন্তব্য, যত গর্জে তত বর্ষে না। বামেরা আগের চেয়ে কিছু আসন হারাবে হয়তো। নির্বাচনে কয়েকজন বাম হেভিওয়েট রাজনীতিকের পতন হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে শেষ পর্যন্ত রাইটার বিল্ডিংয়ে যাবে সিপিএম কোয়ালিশনের বামেরাই। কাদের দাবি শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দেখা দেয় পঞ্চম দফা নির্বাচনের শেষে_ ১৩ মের আগে সেটা জানা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৩ এপ্রিল। তৃতীয় দফায় নির্বাচন ২৭ এপ্রিল। চতুর্থ ও সর্বশেষ পঞ্চম দফায় নির্বাচন যথাক্রমে ৭ এবং ১০ মে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবে ১৩ মে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন একদিকে যেমন স্বাধীন ও শক্তিশালী, অন্যদিকে তেমনি দক্ষ। ইতিমধ্যেই তাদের নির্দেশে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং পশ্চিমবঙ্গে সীমান্তবর্তী 'ভারতের বিহার ও উড়িষ্যার' সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, সম্ভাব্য জাল ভোটারদের প্রতিহত করা এবং নির্বাচন ও নির্বাচনী বুথ যাতে কোনোমতেই সন্ত্রাসীদের কবলে না পড়ে, তার পূর্বাহ্নিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। ভারতে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে জাল ভোট একদমই যে পড়ে না, বুথকেন্দ্রে হামলা এবং ভোটের বাক্স ভাঙার ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না, তা নয়। তবে সামগ্রিক বিচারে এসব ঘটনা খুবই অকিঞ্চিৎকর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। এখানেও নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হয়, প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, ফাঁকফোকরে অনেক ফৌজদারি মামলার আসামি এবং সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মওকা পেয়ে যায়। তবে সামগ্রিক বিচারে ভারতে নির্বাচন হয় অবাধ, নিরপেক্ষ এবং বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে ভারতের এই গ্রহণযোগ্য, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কৃতিত্ব বর্তায় প্রথমত, ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে; দ্বিতীয়ত, স্বাধীন ও দক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলিম ভোটাররা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কোনো কোনো জেলায় মুসলিম ভোটারের সংখ্যা শতকরা ২৬ ভাগ। কয়েকটি জেলায় এই সংখ্যাটা ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি। মুসলমানদের নিরাপত্তাদানের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বামেরা একটা বিস্তৃত সময় পর্যন্ত খুবই যত্নবান এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর একটানা বামেরা যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন রয়েছে, এর পেছনে মুসলিম ভোটব্যাংকের প্রায় নিরঙ্কুশ সমর্থন একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভারতজুড়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। পশ্চিমবঙ্গের বাম-শাসনে অবশ্য মুসলিম ভোটব্যাংকের তেমন হেরফের হয়নি; বরং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সমর্থক মুসলিম ভোটাররাও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর নির্বাচনে সাইড বদলায়, তাদের সমর্থন চলে যায় বামেদের পক্ষে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতজুড়ে। বিশেষ করে হিন্দি-উর্দু ভাষাভাষী রাজ্যগুলোয়। যে রাজ্য থেকে মূলত মুসলিম ভোটারদের একচেটিয়া সমর্থনে লোকসভায় প্রায় ৮৫ ভাগ আসন পেয়ে কংগ্রেস কেন্দ্রে সরকার গঠন করে আসছিল ৩৮ বছর একনাগাড়ে, সেই উত্তর প্রদেশে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞের পর কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দশের নিচে নেমে যায়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, হরিয়ানা, পাঞ্জাব চলে যায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্বে। বিজেপিও এসব রাজ্যের লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে কেকের একটা অংশ পেয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বদৌলতে। কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। কংগ্রেস সরকার বাবরি মসজিদ রক্ষার জন্য নামকাওয়াস্তে একটা ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল, মসজিদ ধ্বংসের পেছনে অল্প্রব্দ-দেশীয় ব্রাহ্মণ নরসিমা রাওয়ের নীরব সমর্থন ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর সহানুভূতি ভোটের জোরে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার ক্ষমতাসীন হয়েছিল বটে, তবে রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরও কংগ্রেস তার প্রায় নিশ্চিত মুসলিম ভোটব্যাংক আর ফিরে পায়নি। এখন তো ভারতে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ধারা প্রায় নিয়মিত হয়ে এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গে গত ৩৪ বছর দুর্দান্ত প্রতাপে একবার ছাড়া প্রতিটি লোকসভা নির্বাচনে জিতেছে বাম কোয়ালিশন। আর রাজ্যসভা বা বিধানসভার এতদিনকার ৩৪ বছরের নির্বাচনে হারা দূরে থাক, আসন সংখ্যার দিক দিয়ে বিরোধী কোনো দল ধারেকাছেও যেতে পারেনি। না তৃণমূল কংগ্রেস, না কংগ্রেস। তবে অবস্থা এখন ভিন্ন। নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের ঘটনাবলির পর, প্রেমঘটিত কারণে জনৈক মুসলিম যুবকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও বুদ্ধদেব সরকারের নিশ্চুপতা, রাজ্যে বাম পেটোয়া বাহিনীর তাণ্ডব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের একে একে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করা এবং প্রশাসনে ভয়াবহ স্থবিরতা ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্য বামদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। অবশ্য বাম সরকারের এ ব্যর্থতা তুলে ধরার নেতৃত্ব দিয়েছেন সারা পশ্চিমবঙ্গে 'দিদি' বা বোন হিসেবে পরিচিত, রাজনীতির অগি্নকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মুসলিম ভোটব্যাংকে ধস নেমেছে বাম সরকারের ব্যর্থতার কারণেই। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা লিপ-সার্ভিসের বেশি কিছু দেয়নি। যে কারণে গোটা ভারতে শিক্ষায়, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা।
হিন্দুরাও যে পশ্চিমবঙ্গে বাম-রাজত্বে সুখে আছে, তা নয়। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রাজ্যের কৃষি খাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছিল। বাম নেতা এবং বাম বুদ্ধিজীবীরা এর নাম দিয়েছিলেন কৃষি বিপ্লব। নাম যা-ই দেওয়া হোক, বেশিদিন সেটা টেকেনি। কৃষিতে সেচের দুরবস্থা, বীজ ও সারের সংকট প্রতি বছর লেগেই আছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষককুল তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকেও অনেক সময় বঞ্চিত হয়। নির্বাচনে এই সরকারি ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটবে না, এমনটা আশা করা বৃথা।
বাম সরকার সবচেয়ে নিন্দিত ও সমালোচিত প্রশাসন, নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজসহ সবকিছু দলীয়করণের জন্য। দাদাদের (বামদের) ক্যাডার বাহিনী ছড়িয়ে আছে শহর ও গ্রামগঞ্জের সর্বত্র। বাম দল না করলে চাকরি মেলে না, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ পাওয়া যায় না, এমনকি নিম্ন আদালতে সুবিচারও পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মন থেকে বামেদের এককালীন উজ্জ্বল ভাবমূর্তি যে মুছে গেছে বা যেতে বসেছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে একটা বিশাল পরিবর্তন যে হচ্ছে, এটা প্রায় সুনিশ্চিত। নিরপেক্ষ ভোট জরিপ সংস্থার রিপোর্টেও বিশাল পরিবর্তনের কথাই বলা হচ্ছে। দেখা যাক, ১৩ মে নির্বাচনী ফলাফল কী বলে।
রাহাত খান :সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
সম্প্রতি মুফতি আমিনী কোনো এক সমাবেশে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছেন, তার ছেলে মাওলানা হাসনাতকে (সংক্ষেপে) সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা অপহরণ করেছে এবং তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আমিনী সাহেব বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে কোরআন-রক্ষা আন্দোলনে নেমেছেন, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমৃত্যু কোরআন-রক্ষা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। আর তার ছেলে হাসনাতকে যদি অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া না হয় তাহলে এর যোগ্য উত্তর দেওয়া হবে। গত একদিনের হরতালেই তো দেখিয়েছি, আমরা কী পারি। প্রয়োজন হলে এরপর আরও হরতালসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। মাত্র ১০ মিনিটে পুরো বাংলাদেশ অচল করে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের (আমিনীদের) আছে।
তর্জন-গর্জন পর্যন্ত ঘটনা থেমে থাকলে হতো; কিন্তু ঘটনাটা ইতির দিকে গড়ায়নি। এই তর্জন-গর্জনের জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেউ কেউ। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ১০ মিনিট কেন, ১০ বছরেও দেশ অচল করার ক্ষমতা নেই মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ী আমিনীর। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় মোহাম্মদ নাসিম আরও বলেছেন, যারা ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন করে না, তারা মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। (দ্রষ্টব্য : দৈনিক সমকাল, কলাম এক, পৃষ্ঠা-১৯)
একই দিনে (১৮ এপ্রিল) একই পৃষ্ঠায় চারের কলামে সমকালে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন আরও ভয়ঙ্কর কথা। মুফতি আমিনী সম্পর্কে। আমিনী সাহেব নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নিজেই নিজের ছেলেকে গুম করেছেন। তিনি বলেছেন, আমিনী যে ধরনের চালবাজ ও ধূর্ত, তাতে এমনটা করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। আমিনী এসব কাজে অভ্যস্ত বলেও তিনি জানান। আমিনীকে প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ইবলিসের (শয়তানের) সঙ্গেও তুলনা করেন। তিনি বলেন, এই সময় ইবলিস একটু বিশ্রামে আছে। এখন ফজলুল হক আমিনী বাংলাদেশে ইবলিসের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
সমকালে পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পড়ে কেউ কেউ কৌতুকছলে প্রতিবাদ জানিয়ে আমাকে বলেছেন, ইবলিসের সঙ্গে আমিনীর তুলনা করে নাকি ইবলিসকে অপমান করা হয়েছে। সকালবেলা রমনা পার্কে হাঁটতে যাই। নানাজন নানা কথা বলেন নেহাতই ঠাট্টা-বিদ্রূপের ছলে। যাহোক, বর্তমান নিবন্ধে আমিনী ও ইবলিসের এই বিতর্কে আর অধিক কিছু বলতে চাই না। এসব রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপার। রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষের এমন ধারা উক্তি হয়েই থাকে। ঢিলটি দিলে পাটকেলটি খেতে হয়। আমিনীও কিছুদিন আগে নারীনীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মিথ্যাবাদী বলেছিলেন। বলেছিলেন, বাপের যে পরিণতি হয়েছিল, মেয়েরও সেই পরিণতি হবে। আর প্রতিপক্ষের লোকদের জিহ্বা টেনে তুলে ফেলার হুমকি তো যখন-তখনই দেন।
তবে আজ আমিনী প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানি। শুধু একটি কথা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য আমিনী নিজেই নিজের ছেলেকে গুম করেছেন, নাকি আমিনী যেমন বলছেন_ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা আমিনীর ছেলেকে ধরে নিয়ে গুম করে রেখেছে, এটা আর রহস্যের মধ্যে থাকা উচিত নয়। সত্য উদ্ঘাটিত হোক, এই-ই আমাদের প্রত্যাশা। দায়িত্ব সরকার ও আমিনী_ উভয়েরই।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ১৮ এপ্রিল থেকে। ওইদিন রাজ্যের ছয়টি জেলার ৫৪টি আসনে ভোট দেওয়া পর্ব শেষ হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ। ৫৪টি আসনে ভোটপ্রার্থীর সংখ্যা ৩৮৫ জন। তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোট এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল সিপিএম তথা বাম কোয়ালিশন সবক'টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে প্রায় অচ্ছুত একটি দল। তবে এ দলটি এবার কিছুটা 'রাজনৈতিক দূরদর্শিতা' দেখিয়েছে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দার্জিলিংয়ের আদিবাসী জনগণের দাবিকে সমর্থন দিয়ে। দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি এলাকায় বিজেপির পাঁচজন থেকে সাতজন প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে বিজেপি দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি এলাকার মুসলিম ভোট পাবে না, বামদের ভোট পাবে না, তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের ভোট তো পাবেই না। আদিবাসীদের মধ্যেও বিভক্তি আছে। আদিবাসীদের অন্তত শতকরা ৩০ জনের ভোট বিজেপি পাবে না বলে নির্বাচন বিশ্লেষকদের অভিমত। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি তিনটি আসনও জিততে পারে, তাহলে সেটাও তাদের জন্য একটা বিশাল রাজনৈতিক জয় বলে গণ্য হবে। গত নির্বাচনের আগের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র একটি আসন, তপন রায় চৌধুরীর আসনটি। তপন চৌধুরীকে কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব দিয়ে পুরস্কৃতও করেছিল বিজেপি।
তবে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা কিংবা বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি কোনো ফ্যাক্টরই নয়। একে সাম্প্রদায়িক দল; চরম মুসলিমবিদ্বেষী বললে অত্যুক্তি হয় না। তারপর রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ। এই রাজ্যে বিজেপি নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বড়জোর বলা যায় নামকাওয়াস্তে বা প্রতীকী।
পশ্চিমবঙ্গে এবার নির্বাচনী লড়াই হবে মূলত বাম দলের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোটের মধ্যে। দু'দলেরই দাবি, তারা জিতবে। অ-বাম দলের লোকেরা বলছেন, পালে (নির্বাচনে) বাতাস লেগেছে মমতার। মমতা মানে তৃণমূল এবং কংগ্রেস দুই-ই। আর বাম সমর্থক এবং বাম রাজনীতি বিশ্লেষকদের মন্তব্য, যত গর্জে তত বর্ষে না। বামেরা আগের চেয়ে কিছু আসন হারাবে হয়তো। নির্বাচনে কয়েকজন বাম হেভিওয়েট রাজনীতিকের পতন হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে শেষ পর্যন্ত রাইটার বিল্ডিংয়ে যাবে সিপিএম কোয়ালিশনের বামেরাই। কাদের দাবি শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে দেখা দেয় পঞ্চম দফা নির্বাচনের শেষে_ ১৩ মের আগে সেটা জানা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২৩ এপ্রিল। তৃতীয় দফায় নির্বাচন ২৭ এপ্রিল। চতুর্থ ও সর্বশেষ পঞ্চম দফায় নির্বাচন যথাক্রমে ৭ এবং ১০ মে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবে ১৩ মে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন একদিকে যেমন স্বাধীন ও শক্তিশালী, অন্যদিকে তেমনি দক্ষ। ইতিমধ্যেই তাদের নির্দেশে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং পশ্চিমবঙ্গে সীমান্তবর্তী 'ভারতের বিহার ও উড়িষ্যার' সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য, সম্ভাব্য জাল ভোটারদের প্রতিহত করা এবং নির্বাচন ও নির্বাচনী বুথ যাতে কোনোমতেই সন্ত্রাসীদের কবলে না পড়ে, তার পূর্বাহ্নিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া। ভারতে বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে জাল ভোট একদমই যে পড়ে না, বুথকেন্দ্রে হামলা এবং ভোটের বাক্স ভাঙার ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না, তা নয়। তবে সামগ্রিক বিচারে এসব ঘটনা খুবই অকিঞ্চিৎকর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। এখানেও নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হয়, প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, ফাঁকফোকরে অনেক ফৌজদারি মামলার আসামি এবং সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মওকা পেয়ে যায়। তবে সামগ্রিক বিচারে ভারতে নির্বাচন হয় অবাধ, নিরপেক্ষ এবং বহুলাংশে শান্তিপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে ভারতের এই গ্রহণযোগ্য, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের কৃতিত্ব বর্তায় প্রথমত, ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে; দ্বিতীয়ত, স্বাধীন ও দক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতিতে মুসলিম ভোটাররা একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কোনো কোনো জেলায় মুসলিম ভোটারের সংখ্যা শতকরা ২৬ ভাগ। কয়েকটি জেলায় এই সংখ্যাটা ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি। মুসলমানদের নিরাপত্তাদানের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের বামেরা একটা বিস্তৃত সময় পর্যন্ত খুবই যত্নবান এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর একটানা বামেরা যে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন রয়েছে, এর পেছনে মুসলিম ভোটব্যাংকের প্রায় নিরঙ্কুশ সমর্থন একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ভারতজুড়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। পশ্চিমবঙ্গের বাম-শাসনে অবশ্য মুসলিম ভোটব্যাংকের তেমন হেরফের হয়নি; বরং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সমর্থক মুসলিম ভোটাররাও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর নির্বাচনে সাইড বদলায়, তাদের সমর্থন চলে যায় বামেদের পক্ষে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতজুড়ে। বিশেষ করে হিন্দি-উর্দু ভাষাভাষী রাজ্যগুলোয়। যে রাজ্য থেকে মূলত মুসলিম ভোটারদের একচেটিয়া সমর্থনে লোকসভায় প্রায় ৮৫ ভাগ আসন পেয়ে কংগ্রেস কেন্দ্রে সরকার গঠন করে আসছিল ৩৮ বছর একনাগাড়ে, সেই উত্তর প্রদেশে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞের পর কংগ্রেসের আসন সংখ্যা দশের নিচে নেমে যায়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, হরিয়ানা, পাঞ্জাব চলে যায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্বে। বিজেপিও এসব রাজ্যের লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনে কেকের একটা অংশ পেয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বদৌলতে। কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। কংগ্রেস সরকার বাবরি মসজিদ রক্ষার জন্য নামকাওয়াস্তে একটা ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল, মসজিদ ধ্বংসের পেছনে অল্প্রব্দ-দেশীয় ব্রাহ্মণ নরসিমা রাওয়ের নীরব সমর্থন ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর সহানুভূতি ভোটের জোরে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার ক্ষমতাসীন হয়েছিল বটে, তবে রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরও কংগ্রেস তার প্রায় নিশ্চিত মুসলিম ভোটব্যাংক আর ফিরে পায়নি। এখন তো ভারতে কোয়ালিশন সরকার গঠনের ধারা প্রায় নিয়মিত হয়ে এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গে গত ৩৪ বছর দুর্দান্ত প্রতাপে একবার ছাড়া প্রতিটি লোকসভা নির্বাচনে জিতেছে বাম কোয়ালিশন। আর রাজ্যসভা বা বিধানসভার এতদিনকার ৩৪ বছরের নির্বাচনে হারা দূরে থাক, আসন সংখ্যার দিক দিয়ে বিরোধী কোনো দল ধারেকাছেও যেতে পারেনি। না তৃণমূল কংগ্রেস, না কংগ্রেস। তবে অবস্থা এখন ভিন্ন। নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের ঘটনাবলির পর, প্রেমঘটিত কারণে জনৈক মুসলিম যুবকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরও বুদ্ধদেব সরকারের নিশ্চুপতা, রাজ্যে বাম পেটোয়া বাহিনীর তাণ্ডব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের একে একে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করা এবং প্রশাসনে ভয়াবহ স্থবিরতা ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্য বামদের জনপ্রিয়তায় ধস নামিয়েছে। অবশ্য বাম সরকারের এ ব্যর্থতা তুলে ধরার নেতৃত্ব দিয়েছেন সারা পশ্চিমবঙ্গে 'দিদি' বা বোন হিসেবে পরিচিত, রাজনীতির অগি্নকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মুসলিম ভোটব্যাংকে ধস নেমেছে বাম সরকারের ব্যর্থতার কারণেই। মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা লিপ-সার্ভিসের বেশি কিছু দেয়নি। যে কারণে গোটা ভারতে শিক্ষায়, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা।
হিন্দুরাও যে পশ্চিমবঙ্গে বাম-রাজত্বে সুখে আছে, তা নয়। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রাজ্যের কৃষি খাতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছিল। বাম নেতা এবং বাম বুদ্ধিজীবীরা এর নাম দিয়েছিলেন কৃষি বিপ্লব। নাম যা-ই দেওয়া হোক, বেশিদিন সেটা টেকেনি। কৃষিতে সেচের দুরবস্থা, বীজ ও সারের সংকট প্রতি বছর লেগেই আছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষককুল তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকেও অনেক সময় বঞ্চিত হয়। নির্বাচনে এই সরকারি ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটবে না, এমনটা আশা করা বৃথা।
বাম সরকার সবচেয়ে নিন্দিত ও সমালোচিত প্রশাসন, নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজসহ সবকিছু দলীয়করণের জন্য। দাদাদের (বামদের) ক্যাডার বাহিনী ছড়িয়ে আছে শহর ও গ্রামগঞ্জের সর্বত্র। বাম দল না করলে চাকরি মেলে না, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ পাওয়া যায় না, এমনকি নিম্ন আদালতে সুবিচারও পাওয়া যায় না। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের মন থেকে বামেদের এককালীন উজ্জ্বল ভাবমূর্তি যে মুছে গেছে বা যেতে বসেছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে একটা বিশাল পরিবর্তন যে হচ্ছে, এটা প্রায় সুনিশ্চিত। নিরপেক্ষ ভোট জরিপ সংস্থার রিপোর্টেও বিশাল পরিবর্তনের কথাই বলা হচ্ছে। দেখা যাক, ১৩ মে নির্বাচনী ফলাফল কী বলে।
রাহাত খান :সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments