বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৮৫ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। সৈয়দ মনসুর আলী, বীর বিক্রম বিক্রমী এক মুক্তিযোদ্ধা
কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার পূর্বদিকে যাত্রাপুর। ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চল।
১৯৭১ সালে অক্টোবরের শেষ দিকে একদল (এক কোম্পানি) মুক্তিযোদ্ধা এখানে অবস্থান নেন। তাঁরা আশপাশের এলাকায় কয়েকটি অপারেশন করেন। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ মনসুর আলী।
অপারেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুরগামী ট্রেন ধ্বংস। কুড়িগ্রাম থেকে সড়ক ও রেলপথ মোগলবাছার ওপর দিয়ে উলিপুর হয়ে চিলমারী পর্যন্ত বিস্তৃত। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরাপত্তার কারণে সড়কের চেয়ে রেলপথকেই বেশি নিরাপদ মনে করত। তখন তারা নিজেদের যাতায়াত, রসদ ও অন্যান্য মালামাল পরিবহনের কাজ রেলপথেই সারত।
নভেম্বরের মাঝামাঝি মনসুর আলী সহযোদ্ধাদের নিয়ে মোগলবাছা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে যাওয়া রেলপথের অর্জুনমালায় রেলসেতুতে বিস্ফোরক স্থাপন করেন। এতে ট্রেনের কয়েকটি বগি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগী হতাহত হয়।
এখন জানা যাক সৈয়দ মনসুর আলীর নিজ বয়ানে (১৯৭৩) মুক্তিযুদ্ধকালের কিছু ঘটনা। ‘ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ (নওয়াজিশ উদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধকালে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান [বীর উত্তম] হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিত) আমাকে মুক্তিবাহিনীর বুড়াবুড়ি ও যাত্রাপুর, দুটি এলাকার কোম্পানি কমান্ডার করে পাঠান। প্রথমে নাগেশ্বরী থানার (এখন উপজেলা) মাদারগঞ্জে ক্যাম্প করা হয়। সেখান থেকে যাত্রাপুর অপারেশন করা হয়।
‘২ নভেম্বর যাত্রাপুর বাজারে তিনজন পাকিস্তানি সেনা ও নয়জন রাজাকার এলে তাদের আক্রমণ করি। তারা সবাই সংঘর্ষে নিহত হয়। এরপর ওই এলাকার সব রাজাকারকে জনগণের সহায়তায় ৯ নভেম্বর আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়। সেদিন সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
‘এদিকে যাত্রাপুরে সংঘর্ষের খবর পেয়ে কুড়িগ্রাম থানার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ রাজাকার স্বেচ্ছায় তাদের হাতিয়ারসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের খবর আশপাশ এলাকার রাজাকারদের মনে বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকাররা দলে দলে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।
‘কুড়িগ্রাম শহরের নিকটবর্তী মোগলবাছা ইউনিয়নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি ছিল। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনবার পাকিস্তানিদের আক্রমণ করি। তৃতীয়বারের সংঘর্ষের সময় উলিপুরগামী ট্রেনের দুটি বগি ডিনামাইট দিয়ে বিচ্ছিন্ন করি। এতে প্রায় ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী হতাহত হয়।
‘মোগলবাছা ইউনিয়নের অর্জুনমালায় রেলসেতুর নিচে আমরা ডিনামাইট ফিট করেছিলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহীসহ ট্রেন ওই স্থান অতিক্রম করার সময় ডিনামাইট বিস্ফোরিত হয়। এ অপারেশনে আমাদের মীর নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
‘৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যোশির নির্দেশে আমরা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে আক্রমণ করি। যৌথবাহিনীর দুরপাল্লা ও ভারী কামানের গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে আক্রমণের সূচনা হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা তেমন প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়।’
মনসুর আলী পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ফ্লাইট সার্জেন্ট পদে চাকরি করতেন। কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানে (তখন পশ্চিম পাকিস্তান)। ১৯৭১ সালের প্রথম দিক থেকে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য সৈয়দ মনসুর আলীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩৫।
মনসুর আলী স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে আর যোগ দেননি। পরে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। তিন মেয়াদে কুড়িগ্রাম পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান (এখন মেয়র) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে তিনি মারা যান। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার কুড়িগ্রাম পৌরসভার অন্তর্গত ঘোষপাড়ায়। তাঁর বাবার নাম সৈয়দ সাহাবান আলী, মা জহিরুন নেছা। স্ত্রী শাহিদা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: সৈয়দ সাজ্জাদ আলী (সৈয়দ মনসুর আলী বীর বিক্রমের ছেলে), নূরুল ইসলাম তালুকদার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.