পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ দুদকে! by কাজী সিরাজ

অতঃপর দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান স্বীকার করেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির চেষ্টার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। টেলিভিশনের পর্দায় গত ২৭ নভেম্বর খবরটি ব্রেকিং নিউজে ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল- 'সেই তো মল খসালি/তবে কেন লোক হাসালি?'
বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী ওয়াদা ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই এ সেতুর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং বিস্তারিত সমীক্ষার পর জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকা মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় ২০০৪ সালে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং সেতুর স্থান নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মতদ্বৈধতার কারণে এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০৭ সালে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছিল বটে, তবে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের জন্য পরামর্শক নিয়োগের প্রক্রিয়া ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি। ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল মূল সেতুর দরপত্র আহ্বানের বিসমিল্লাহতেই গলদ ধরে বিশ্বব্যাংক। তাদের আপত্তিতে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর। ২০১১ সালে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সমাপনান্তে এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় একই বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল। কিন্তু পাঁচ মাসও সময় দেয়নি সরকারের শক্তিশালী দুর্নীতিবাজরা। হাতেনাতে ধরা পড়ার মতো অবস্থা। ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক। শুধু অভিযোগ নয়, আস্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদনই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে ধরিয়ে দেয় তারা। হৈচৈ, চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় সরকারি মহলে, লীগ মহলে। ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর গর্জে উঠলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি উল্টো বিশ্বব্যাংককে অভিযুক্ত করে বলেন, ওরা মিথ্যা বলেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। কিন্তু মুহিতের কথায় কান দেয়নি বিশ্বব্যাংক। তারা বরং ঋণসহায়তা স্থগিত করে। ২৯০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তা দেওয়ার কথা ১২০ কোটি ডলার। এডিবির দেওয়ার কথা ৬১.৫ কোটি ডলার আর জাইকার ৪১.৫ কোটি ডলার। আইডিবিরও দেওয়ার কথা ১৪ কোটি ডলার। বাকি ৫৩ কোটি ডলার বাংলাদেশের। ঋণচুক্তি বাতিলের চরমপত্রের আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দুবার অভিযোগ জানায় তথ্যপ্রমাণভিত্তিক তদন্ত প্রতিবেদনসহ। কিন্তু তা আমলে না নেওয়ায় ২০১২ সালের ৩০ জুন ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক জানায়, দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা ২০১২ সালের ৩০ জুন এক বিবৃতিতে জানায়, 'পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, কানাডার এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছে রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। ঋণচুক্তি বাতিলের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে দুটি তদন্তের তথ্যপ্রমাণ প্রদান করা হয়। তাতে অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তির দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। বিশ্বব্যাংক অপেক্ষা করেছিল। ঋণচুক্তি বাতিল করার আগ পর্যন্ত তাদের আশা ছিল, শেষ পর্যন্ত সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং একটা কিছু করবে। আমরা জানি, বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে সরকারকে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলেছিল। সময়মতো পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলে ঋণচুক্তির বিষয়টি বাতিলের পর্যায় পর্যন্ত গড়াত না। তারা তিনটি বিষয়ে কথা বলেছিল- ১. 'যেসব সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে (সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে মন্ত্রীকেও বোঝানো হয়) দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটি প্রদান, ২. এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ এবং ৩. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান, যাতে এ প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে।' স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠেছিলেন লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২ জুলাই ২০১২ জাতীয় সংসদে ৩০০ ধারায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া বক্তব্য বাংলাদেশকে অপমান করেছে। তিনি বলেন, 'আমি জোর গলায় বলতে পারি, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোথাও কোনো অপচয় বা দুর্নীতি হয়নি।' সংসদকে তিনি বলেন, 'বিশ্বব্যাংক অসমর্থিত বা অসম্পূর্ণ অভিযোগের ভিত্তিতে একটি দেশকে এভাবে অপবাদ দিতে পারে না বা সে দেশের জনগণের মর্যাদাহানি করতে পারে না।' এ জন্য তিনি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিককে দোষারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় তাঁর অর্থমন্ত্রীকেও ছাড়িয়ে যান। দুর্নীতির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তিনিও নাকচ করে দেন। উল্টো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, 'যেখানে তারা এক পয়সা ছাড়ই দেয়নি সেখানে দুর্নীতি হলো কী করে? ২০১২ সালের ৪ জুলাই জাতীয় সংসদে এসব কথার সঙ্গে তিনি আরো বলেন, কারা এর পেছনে আছে, তাদের উদ্দেশ্য কী তার খোঁজ নেওয়া দরকার।' পাল্টা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, 'ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন পড়ে দেখা হোক। তাহলেই আসল দুর্নীতি কোথায় আছে তা জানা যাবে।' বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগ ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব ও সেতু প্রকল্প পরিচালক এবং আবুল হোসেনের পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান 'সাকো'র বিরুদ্ধে। সাকোর মাধ্যমেই পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পেতে আগ্রহী কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের সঙ্গে অর্থের অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। মন্ত্রী থাকাকালে আবুল হোসেন সব কিছু অস্বীকার করে বলেছিলেন, তিনি 'ফুলের মতো পবিত্র'। দুদকের চেয়ারম্যান এই গোলাম রহমান সৈয়দ আবুল হোসেনকে এই মর্মে সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন যে তিনি পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। প্রধানমন্ত্রী দিলেন আরো বড় সার্টিফিকেট। তা-ও আবার দিয়ে এলেন বিলেতের মাটিতে। বললেন, আবুল একজন 'দেশপ্রেমিক'। অথচ পদ্মা সেতুর পরামর্শক হতে আগ্রহী এসএনসি লাভালিনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে দুহাইমকে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। এ বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রেপ্তার করা হয় একই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা রমেশ সাহা ও মোহাম্মদ ইসমাইলকে। কানাডা সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা সারা দুনিয়ায় বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। অথচ সম্প্রতি জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে আমেরিকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'যা হয়নি তা স্বীকার করব কেন? এর আগে গত জুলাই মাসের ৪ তারিখে জাতীয় সংসদে তিনি বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তাতে ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা খরচ করা হবে বলে জানান। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বব্যাংকের কাছে তিনি ক্ষতিপূরণও দাবি করেন। সেদিন তিনি সংসদে বলেন, 'সামান্য ছুতো ধরে তারা দেশের সর্বনাশ করল। এটা মেনে নেওয়া যায় না। কোনো বাঙালি মেনে নিতে পারে না। সময় নষ্ট করে কেন তারা খরচ বাড়াল, তার জন্য তাদের কাছে জরিমানা চাওয়া উচিত।' অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে, বাঙালির যেন ঠেকা পড়েছে সে দায় কাঁধে নিতে।
নিয়মিত বিরতিতে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলে যেতে থাকলেন, তাঁরা দুর্নীতির কোনো আলামত খুঁজে পাননি। হঠাৎ তিনি বোমা ফাটালেন ২৭ নভেম্বর। সাংবাদিকদের স্পষ্ট করেই জানালেন, দুর্নীতি চেষ্টার প্রমাণ পাওয়া গেছে : 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।' তাহলে এত দিন কেন সাফাই গাইলেন? কেন আবুল হোসেনকে 'ধোয়া তুলসী পাতার' সার্টিফিকেট দিলেন? কী বলবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তাঁর প্রদত্ত 'দেশপ্রেমিকের' সার্টিফিকেটেরই কী হবে? পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির যে অভিযোগ তিনি এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন, দুদক চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের পর কী বলবেন তাঁরা? এখনো কি চেষ্টা চালাবেন আবুল হোসেন-মসিউর রহমান গংকে রক্ষা করতে? বিশ্বব্যাংক তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে দোষীদের শাস্তি দিতে বলেছে। ঋণ পেতে হলে এর বিকল্প নেই। সরকারের সামনে এখন হয় আবুল হোসেন-মসিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা নতুবা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণ। কঠিন পরীক্ষায় সরকার। আরো কঠিন পরীক্ষায় প্রধানমন্ত্রী। মাত্র কয়েক দিন আগে বরিশালের এক জনসভায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, বোন, মেয়ে ও মেয়ের স্বামীর জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছেন। দুদক চেয়ারম্যান কৌশলে তা নাকচ করেছিলেন। এখন তিনি এ ব্যাপারে কী বলেন? বিশ্বব্যাংক তাদের যে কাগজপত্র দুদকে পাঠিয়েছে, দুদক কি তা জনসাধারণের জানার স্বার্থে প্রকাশ করবে? আইনি বাধা না থাকলে অসুবিধা কোথায়? অভিযোগ যদি সত্য না হয়, তাহলে তো তা আরো বেশি করে এবং জলদি করে প্রকাশ করা উচিত? সত্য না হলে এ দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এমন অভিযোগ কেন করলেন তা জানার জন্য মানুষ কিন্তু উদ্গ্রীব। দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পর পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে আদ্যোপান্ত জানার আগ্রহ জনগণের মধ্যে জোরালোভাবে জাগা অস্বাভাবিক নয়। তবে কি সেতু প্রশ্নে পদ্মার ঘোলাজলেই নাকানি-চুবানি খাবে সরকার?
লেখক : সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
kazi.shiraz@yahoo.com
২৮.১১.২০১২

No comments

Powered by Blogger.