সাক্ষাৎকার-পরাশক্তি ভারত :রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধন্যবাদ পেতে পারে by ড. সাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরাইশি
ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. সাহাবুদ্দিন ইয়াকুব কুরাইশি গত বছর জুলাই মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাস আগে জন্মগ্রহণকারী মি. কুরাইশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বছর হরিয়ানা ক্যাডার থেকে আমলাতন্ত্রে যোগ দেন।
নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইয়াকুব কুরাইশি গণযোগাযোগ ও সামাজিক বিপণনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রধান সম্পাদক শেখর গুপ্ত তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর সুভাষ সাহা
শেখর গুপ্ত : নির্বাচন সংক্রান্ত দুর্নীতি সব রাজনৈতিক দুর্নীতি বা এর অনেকটারই উৎস। আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অবস্থা এখন কেমন বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আপনি মনে করেন?
এস ওয়াই কুরাইশি : হ্যাঁ, সঠিকভাবেই আপনি বিষয়টি ধরেছেন। বস্তুত কয়েকটি সংসদীয় কমিটি এই একই কথা উচ্চারণ করেছে_ এটা শুরু হয় যখন লোকেরা নির্বাচনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে এবং নির্বাচনের পর অতিদ্রুত সেই অর্থ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালায়। অবশ্যই সেখানে একটা বিনিময় শর্ত থাকবে, যে অর্থটা অপরাধী বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া হলো তার বিনিময়ে কিছু দেওয়ার শর্ত থাকে এবং দেশে দুর্নীতির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এটা একটা বড় বিড়ম্বনা যে, এভাবে নির্বাচন দেশে দুর্নীতির উৎস হয়ে উঠছে। একইসঙ্গে কিছুটা উন্নতি যোগও আছে। আপনি জানেন যে, একটা সময়ে বুথ দখলটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
শেখর গুপ্ত : বুথ দখল, নির্বাচনী সহিংসতা, ব্যালট বাক্স ভর্তি করা... সর্বত্রই দেখা যায়।
কুরাইশি : আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি যে, বছরের পর বছর ধরে এটাই চলে আসছিল। এক্ষেত্রে আমাদের হাতে একটা সহজ অস্ত্র হলো এ ধরনের পরিস্থিতি হলে আমরা পুনরায় ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিই। এরপর তাদের নয়ছয় করার সাধারণত পথ থাকে না। তারপরও কোথাও যদি তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাহলে আমরা যতক্ষণ না নির্বাচনের যথার্থতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হবো ততক্ষণ পর্যন্ত পুনর্নির্বাচন চলতেই থাকবে। এভাবেই এসব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। এখন দুটি বিষয় আমাদের তকলিফ দিচ্ছে। তা হচ্ছে_ এক. অবশ্যই এর একটি হলো অর্থ ক্ষমতা, কালো টাকা। সেখানে দু'ধরনের অর্থ দেখা যায়। এর একটি হলো দেখানো হিসাব_ যেটা পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিন্তু সেখানে এনভেলপে করে নগদ ও বস্তুগত আরও অনেক ব্যয় হয়, যেটার হিসাব করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
শেখর গুপ্ত : সুটকেস বলুন, এনভেলপ তো কোন ছার।
কুরাইশি : হ্যাঁ আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এটা যখন খুচরা পর্যায়ে যায়, ভোটারদের কাছে যায়_ হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজারে তখন সেটা আমাদের গণতন্ত্রের কাঠামোটাই ধ্বংস করে দিচ্ছে।
শেখর গুপ্ত : এটা কি কেবল কতিপয় নির্দিষ্ট রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নাকি এটা দেশের বিশাল অংশে বিস্তৃত?
কুরাইশি : না, এটা দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট রাজ্যে এর প্রকোপটা বেশি। উদাহরণ হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠানরত পাঁচটি রাজ্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। তামিলনাড়ূ এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা। অথচ এর প্রতিবেশী রাজ্য কেরালায় কিন্তু একেবারেই এ সমস্যা নেই।
শেখর গুপ্ত : একেবারেই নির্বাচনী দুর্নীতি নেই?
কুরাইশি : হ্যাঁ। আমরা যখন সেখানে গেলাম তখন রাজ্যটির সব রাজনৈতিক নেতাকেই আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে, তাদের রাজ্যে এ ধরনের নির্বাচনী দুর্নীতি রয়েছে কি-না। তারা সবাই একবাক্যে বললেন, তাদের রাজ্যে এ ধরনের কোনো সমস্যাই নেই। কেন নেই, আপনাদের রাজ্যে তো মানুষের হাতে অনেক নগদ অর্থ, আপনাদের রয়েছে পেট্রোডলার, অনাবাসীদের পাঠানো অর্থ, এসব অর্থ কেন কেরালার নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখে না? তারা আমাদের বলল, কেরালার ভোটাররা এতটাই আলোকপ্রাপ্ত যে, তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনেক আগেই কোন প্রার্থীকে ভোট দেবে তা ঠিক করে ফেলে। এক্ষেত্রে অর্থ কোনো কাজেই আসে না। অতএব টাকা পানিতে ফেলতে যাওয়া কোন দুঃখে?
শেখর গুপ্ত : তামিলনাড়ূর ভোটের ক্ষেত্রে এই অর্থ কি অল্পস্বল্প পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে, নাকি এটা এই রাজ্যে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে?
কুরাইশি : সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা মনে করি, ভোটের ক্ষেত্রে এই অর্থ কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করে। সেখানে নির্বাচনী আচরণবিধি থাকা সত্ত্বেও আমাদের বারবার ভোটারদের ঘুষ দেওয়ার কাহিনী শুনতে হচ্ছে। যারা অর্থ নেয় তাদের একটা প্রবণতা থাকে, তারা বা সে যে দল বা ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করল সে দল বা ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া। আর যারা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল বা প্রার্থীর কাছ থেকেই অর্থ নেয় তাদের প্রবণতা থাকে যে বেশি অর্থ দিল তার পক্ষে ভোটটা দেওয়ার।
শেখর গুপ্ত : মদের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
কুরাইশি : সর্বত্রই মদ একটা সমস্যা। বস্তুত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য যেমন_ উত্তর প্রদেশ, বিহারে মদ গুরুতর সসস্যা হিসেবে বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে মদের সমস্যাটি সারাদেশেই অর্থ প্রভাবের চেয়ে অধিকতর সর্বজনীন রূপ পেয়েছে।
শেখর গুপ্ত : বিগত বিহার নির্বাচনেও কি মদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে?
কুরাইশি : বস্তুত তা নয়, কারণ সেটা একমাত্র রাজ্য নির্বাচন ছিল এবং এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলাম। আমরা রাজ্য সীমান্ত বন্ধ করে দিই। আমরা নির্বাচনের দু'তিন মাস আগে থেকে মদ উৎপাদন, ওয়্যার হাউস পরীক্ষা করা শুরু করি। সুতরাং এটা তখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
শেখর গুপ্ত : আমি কোথায় পেঁৗছাতে চাই আপনি তা জানেন। আন্না হাজারি বলেছেন ভোটাররা সচেতন নয় বলে আপনি ঐকান্তিকভাবে নির্বাচনী ব্যাপারে সাফল্য পুরোপুরি পাবেন না। তারা একটা শাড়ি, এক বোতল মদ বা কিছু অর্থের বিনিময়ে ভোট প্রদান করে।
কুরাইশি : এটা আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু একইসঙ্গে সব প্রার্থীই যখন একই উপায় অবলম্বন করে এটা তখন প্রশমিত হয়ে যায় এবং আমাদের নজরদারি ও নাগরিকদের সচেতনতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত আমরা এখন ভোটার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছি।
শেখর গুপ্ত : এটা আসলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শ্রেণীর ওপর অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করে এবং সমস্ত উল্টাপাল্টার জন্য রাজনীতিকরা দায়ী এটাকে প্রতিপন্ন করে।
কুরাইশি : হ্যাঁ, রাজনৈতিক শ্রেণীর যে কুখ্যাতি রয়েছে সেটা আপনি ভালোই জানেন, আর সেটা খুবই বিদঘুটে।
শেখর গুপ্ত : সেটা কি উচিত?
কুরাইশি :অংশত উচিত, অংশত অনুচিত।
শেখর গুপ্ত : এটা কি ফিফটি ফিফটি_ যেমন, কিছু অনুপাতে অত্যন্ত উচিত বা অনুচিত অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচিত?
কুরাইশি : আমি আগ্রহের সঙ্গে ফিফটি ফিফটি বলব। সব সত্ত্বেও সব রাজনীতিবিদই অসৎ নয়, বস্তুত আজকে ভারত যে সুপারপাওয়ার হয়ে উঠেছে সেজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধন্যবাদ পাওয়া উচিত। আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে তাকান। আমরা যেটা করতে পেরেছি তারা সে পর্যন্ত যেতেই পারেনি। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল। এখন রাজনৈতিক দলের কলঙ্কজনক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রধানত তাদের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
শেখর গুপ্ত : আপনি কিছুদিন এই দায়িত্বে থাকবেন। আপনি আপনার সারাজীবন রাজনৈতিক শ্রেণীর সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। রাজনৈতিক শ্রেণীর অবস্থা কি উন্নত হবে নাকি আরও খারাপ হবে বলে আপনি মনে করেন?
কুরাইশি : অবস্থা আরও খারাপের দিকেই যে যাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতি দিয়ে শুরু হয়েছে। আমি পাঞ্জাবের এক বিধায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে আমি নির্বাচনী ব্যয়ের কথা বলতেই তিনি কমিশন নির্ধারিত সীমার কথা উল্লেখ করলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বললেন তার খরচ কমিশনে প্রদত্ত হিসাবের কয়েক গুণ বেশি হয়েছে। এটাই হলো বাস্তবতা। সুতরাং এর মধ্যেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের পক্ষে তো আর আগামী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। আমাদের কাছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নেই যে, রাতারাতি সবকিছু ঠিক করে ফেলব। আমরা যদি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা শুরু করি তাহলে অভিযোগ করা হবে যে, আমরা জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছি। তাহলে এটা নির্মূলের উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নির্বাচনী সংস্কার এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ১৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সংস্কারের বিষয়টি পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কমিটি এসেছে-গেছে কিন্তু সংস্কার আর আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
শেখর গুপ্ত : কিছুই যদি না করা হয় তাহলে আরেক আন্না হাজারির আন্দোলন দেখা দেবে। আবার এই আন্দোলনে রাস্তা প্রকম্পিত হবে এবং আরও কঠিন ব্যবস্থার দাবি উচ্চকিত হবে।
কুরাইশি : যে কোনো সাংবিধানিক গণতন্ত্রে যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান সেখানে আপনি রাস্তার আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আশা করতে পারেন না।
শেখর গুপ্ত : হ্যাঁ, আপনি যদি সব সময় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করতেই থাকেন....
কুরাইশি : ...ওটাই পরিণতি হবে। আমি আপনাকে প্রেসার কুকারের উদাহরণ দিতে পারি। এর সেফটি বাল্ব যদি কোনো কারণে বাধার মধ্যে পড়ে তাহলে এটা বিস্ফোরিত হবে। অতএব আমরা এটার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছি বলা যায়।
শেখর গুপ্ত : লোকপাল বিল নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
কুরাইশি : হ্যাঁ। এমনকি এ পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়, সন্দেহ নেই এখানে দুর্নীতি রয়েছে, তবে লোকপাল সম্পর্কে আমি বলব, এর ভূমিকাও এক অর্থে সীমিত। কারণ লোকপাল কেবল দুর্নীতিবাজকেই শাস্তি দিতে পারবে। আমাদের বক্তব্য হলো দুর্নীতিবাজরা যাতে কোনোক্রমেই ক্ষমতায় আসতে না পারে তার ব্যবস্থা করা বা তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া। এখনকার পরিস্থিতি হলো অপরাধী, ধর্ষক, খুনি, ডাকাতরা বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায়, তারা মন্ত্রী পর্যন্ত হতে পারে। এভাবেই আইন ভঙ্গকারীরাই হয়ে পড়ে আইন প্রণয়নকারী। এ কারণেই এরা চাইবে না এর কোনো সংশোধনী সংসদে পাস হোক।
শেখর গুপ্ত : সুতরাং এখন নির্বাচনী সংস্কারের যে বিল টেবিলে রয়েছে তার মূল কথা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
কুরাইশি : আমি আপনাকে কিছু ইতিবাচক বিষয় বলতে পারি। ১৫ থেকে ১৮ বছর পর ছয় মাস আগে আইন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইনমন্ত্রী নিজেই নির্বাচন কমিশনে আসেন এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা সময় ধরে সংস্কারের প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং আমরা যৌথভাবে দেশব্যাপী এ ব্যাপারে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করার ব্যাপারে একমত হই। সাতটি আঞ্চলিক আলোচনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় এবং ইতিমধ্যে ছয়টি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শেখর গুপ্ত : এটা কতটা জরুরি? সরকার কি এটা বন্ধ করে দিতে পারে?
কুরাইশি : সরকার এটা এতদিন বন্ধ করে রেখেছিল। তাই এটা এখন বন্ধ করা হতে পারে এবং এটাই হলো উদ্বেগের বিষয়।
শেখর গুপ্ত : তারা লোকপাল বিল স্থগিত করেছে। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে লোকপাল বিল কিছুটা উপকার দিত।
কুরাইশি : এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হতে পারে যে, নির্বাচন সংস্কার বিল তো কেবল নির্বাচনী দুর্নীতি রোধ করার জন্যই। এটা তো আর আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য দুর্নীতি নিয়ে কিছু করবে না। এ ব্যাপারে লোকপাল বিলের সংস্রব রয়েছে। তবে রাজনৈতিক দুর্নীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি দুর্নীতিবাজ হয় তাহলে আমলতন্ত্রও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভোরা কমিটি অপরাধী-আমলা-রাজনীতিবিদ আঁতাতের ব্যাপারে কথা বলেছে। অথচ এই অশুভ আঁতাত ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবগুলো কী সে ব্যাপারে আলোকপাত করব।
শেখর গুপ্ত : কোন প্রস্তাব সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়.. কোন প্রস্তাব টেবিলে রয়েছে?
কুরাইশি : টেবিলে যে প্রস্তাব রয়েছে সেটি হচ্ছে অপরাধীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা। এ ব্যাপারে আপত্তি দেখানো হচ্ছে যে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হতে পারে। আমরা গত অক্টোবরে এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলকে বৈঠকে ডেকেছিলাম। তখনও তারা এই যুক্তিতে আমাদের প্রস্তাবটি খারিজ করে দিয়েছিল।
শেখর গুপ্ত : আইনের সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে কি?
কুরাইশি : আইনের মধ্যেই সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা মনে করি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যে সাংবিধানিক স্বীকৃত অধিকার রয়েছে, সেটা কমিশনের সব সদস্যের বেলায় সম্প্রসারিত করা আবশ্যক। এটাই যৌক্তিক। যতক্ষণ পর্যন্ত কেবল প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয় ততক্ষণ এটা এক সদস্যের কমিশনই থাকে। এখানে সুরক্ষাটা ব্যক্তির নয়, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। কমিশনের তিন সদস্যকেই একই সাংবিধানিক সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। বাকি দুই সদস্য যদি সরকারের চাপের মধ্যে পড়ে যেত তাহলে তারা আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারত। এই পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হয়েছে। কমিশনের সদস্যরা নিঃশঙ্ক।
শেখর গুপ্ত : আপনি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে নয়, সাধারণ অর্থে এটা বলছেন...
কুরাইশি : কমিশন বস্তুত সেটুকু পর্যন্তই করতে সক্ষম যেটুকু পর্যন্ত তাকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা দেওয়া আছে। এক্ষেত্রে আমি রাজনীতিবিদদের কৃতিত্ব দেব। এমনকি মডেল আচরণবিধি যেটাকে আপনি অদ্বিতীয় বলতে পারেন, সেটা রাজনীতিবিদদেরই সৃষ্টি।
শেখর গুপ্ত : রাজনীতিবিদরা বস্তুতই এই মডেল আচরণবিধিকে ভয় পায়। কেউই এখানে ফেঁসে যেতে চায় না।
কুরাইশি : কোনো সিনিয়র নেতাকে নির্বাচন কমিশন থেকে উত্তর দেওয়ার জন্য পরের দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলে দেখা যায় ৪টার মধ্যেই উত্তর এসে গেছে। এখানে ভয়টা এরকমই... অথচ এটা তাদেরই সৃষ্টি।
শেখর গুপ্ত : এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?
কুরাইশি : আসলে রাজনীতিবিদরা মনে করে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নিলে তাদের ভোটার জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণেই তারা এতটা ভয় পায় নির্বাচন কমিশনকে।
শেখর গুপ্ত : আমাদের উপমহাদেশে সারাবিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাস। এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও গণতন্ত্রীকরণ দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার সাফল্য এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে কি? ভারতীয় মুসলমানরা জনসংখ্যার দিক থেকে ক্রমবর্ধমান। তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কতটা প্রেরণাদায়ী হতে পারে। এটা কি বাংলাদেশ, পাকিস্তানকে যেমন সাহায্য করছে, তেমনিভাবে অন্য মুসলিম দেশের ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণামূলক হতে পারে?
কুরাইশি : হ্যাঁ, আমি মনে করি ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পাকিস্তানসহ এসব দেশের প্রতিনিধি দলকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। গত ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভারত সফর করেন। সে সময় তিনি আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান। আমরা কীভাবে এতটা কার্যকর সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছি তিনি সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে যা কিছু জানি তার সবটাই পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা এ ব্যাপারে যে কারও সঙ্গেই শেয়ার করতে প্রস্তুত। আপনি মুসলিম দেশগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। আসলে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ধর্ম। কিন্তু আমাদের মুসলিম দেশগুলো খুব কমই গণতান্ত্রিক। আপনি বলেছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশন এখন বিশ্ব ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তবে এরা যখন আমাদের বিধানসভা ও সংসদে অপরাধী থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করে, অর্থ ক্ষমতা সম্পর্কে যখন তারা সব অবগত হয়, তখন সেটা আমাদের কাছে খুবই বিব্রতকর ঠেকে। এ বিষয়ে কিছু করার রয়েছে।
শেখর গুপ্ত : নির্বাচন সংক্রান্ত দুর্নীতি সব রাজনৈতিক দুর্নীতি বা এর অনেকটারই উৎস। আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অবস্থা এখন কেমন বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আপনি মনে করেন?
এস ওয়াই কুরাইশি : হ্যাঁ, সঠিকভাবেই আপনি বিষয়টি ধরেছেন। বস্তুত কয়েকটি সংসদীয় কমিটি এই একই কথা উচ্চারণ করেছে_ এটা শুরু হয় যখন লোকেরা নির্বাচনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে এবং নির্বাচনের পর অতিদ্রুত সেই অর্থ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালায়। অবশ্যই সেখানে একটা বিনিময় শর্ত থাকবে, যে অর্থটা অপরাধী বা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া হলো তার বিনিময়ে কিছু দেওয়ার শর্ত থাকে এবং দেশে দুর্নীতির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এটা একটা বড় বিড়ম্বনা যে, এভাবে নির্বাচন দেশে দুর্নীতির উৎস হয়ে উঠছে। একইসঙ্গে কিছুটা উন্নতি যোগও আছে। আপনি জানেন যে, একটা সময়ে বুথ দখলটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
শেখর গুপ্ত : বুথ দখল, নির্বাচনী সহিংসতা, ব্যালট বাক্স ভর্তি করা... সর্বত্রই দেখা যায়।
কুরাইশি : আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখি যে, বছরের পর বছর ধরে এটাই চলে আসছিল। এক্ষেত্রে আমাদের হাতে একটা সহজ অস্ত্র হলো এ ধরনের পরিস্থিতি হলে আমরা পুনরায় ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিই। এরপর তাদের নয়ছয় করার সাধারণত পথ থাকে না। তারপরও কোথাও যদি তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তাহলে আমরা যতক্ষণ না নির্বাচনের যথার্থতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হবো ততক্ষণ পর্যন্ত পুনর্নির্বাচন চলতেই থাকবে। এভাবেই এসব ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। এখন দুটি বিষয় আমাদের তকলিফ দিচ্ছে। তা হচ্ছে_ এক. অবশ্যই এর একটি হলো অর্থ ক্ষমতা, কালো টাকা। সেখানে দু'ধরনের অর্থ দেখা যায়। এর একটি হলো দেখানো হিসাব_ যেটা পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিন্তু সেখানে এনভেলপে করে নগদ ও বস্তুগত আরও অনেক ব্যয় হয়, যেটার হিসাব করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
শেখর গুপ্ত : সুটকেস বলুন, এনভেলপ তো কোন ছার।
কুরাইশি : হ্যাঁ আপনার কথা ঠিক। কিন্তু এটা যখন খুচরা পর্যায়ে যায়, ভোটারদের কাছে যায়_ হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজারে তখন সেটা আমাদের গণতন্ত্রের কাঠামোটাই ধ্বংস করে দিচ্ছে।
শেখর গুপ্ত : এটা কি কেবল কতিপয় নির্দিষ্ট রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নাকি এটা দেশের বিশাল অংশে বিস্তৃত?
কুরাইশি : না, এটা দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই রয়েছে। তবে কিছু নির্দিষ্ট রাজ্যে এর প্রকোপটা বেশি। উদাহরণ হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠানরত পাঁচটি রাজ্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। তামিলনাড়ূ এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা। অথচ এর প্রতিবেশী রাজ্য কেরালায় কিন্তু একেবারেই এ সমস্যা নেই।
শেখর গুপ্ত : একেবারেই নির্বাচনী দুর্নীতি নেই?
কুরাইশি : হ্যাঁ। আমরা যখন সেখানে গেলাম তখন রাজ্যটির সব রাজনৈতিক নেতাকেই আমরা জিজ্ঞেস করলাম যে, তাদের রাজ্যে এ ধরনের নির্বাচনী দুর্নীতি রয়েছে কি-না। তারা সবাই একবাক্যে বললেন, তাদের রাজ্যে এ ধরনের কোনো সমস্যাই নেই। কেন নেই, আপনাদের রাজ্যে তো মানুষের হাতে অনেক নগদ অর্থ, আপনাদের রয়েছে পেট্রোডলার, অনাবাসীদের পাঠানো অর্থ, এসব অর্থ কেন কেরালার নির্বাচনে কোনো ভূমিকা রাখে না? তারা আমাদের বলল, কেরালার ভোটাররা এতটাই আলোকপ্রাপ্ত যে, তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনেক আগেই কোন প্রার্থীকে ভোট দেবে তা ঠিক করে ফেলে। এক্ষেত্রে অর্থ কোনো কাজেই আসে না। অতএব টাকা পানিতে ফেলতে যাওয়া কোন দুঃখে?
শেখর গুপ্ত : তামিলনাড়ূর ভোটের ক্ষেত্রে এই অর্থ কি অল্পস্বল্প পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে, নাকি এটা এই রাজ্যে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে?
কুরাইশি : সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা মনে করি, ভোটের ক্ষেত্রে এই অর্থ কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করে। সেখানে নির্বাচনী আচরণবিধি থাকা সত্ত্বেও আমাদের বারবার ভোটারদের ঘুষ দেওয়ার কাহিনী শুনতে হচ্ছে। যারা অর্থ নেয় তাদের একটা প্রবণতা থাকে, তারা বা সে যে দল বা ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করল সে দল বা ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া। আর যারা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল বা প্রার্থীর কাছ থেকেই অর্থ নেয় তাদের প্রবণতা থাকে যে বেশি অর্থ দিল তার পক্ষে ভোটটা দেওয়ার।
শেখর গুপ্ত : মদের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
কুরাইশি : সর্বত্রই মদ একটা সমস্যা। বস্তুত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য যেমন_ উত্তর প্রদেশ, বিহারে মদ গুরুতর সসস্যা হিসেবে বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে মদের সমস্যাটি সারাদেশেই অর্থ প্রভাবের চেয়ে অধিকতর সর্বজনীন রূপ পেয়েছে।
শেখর গুপ্ত : বিগত বিহার নির্বাচনেও কি মদ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে?
কুরাইশি : বস্তুত তা নয়, কারণ সেটা একমাত্র রাজ্য নির্বাচন ছিল এবং এ ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ছিলাম। আমরা রাজ্য সীমান্ত বন্ধ করে দিই। আমরা নির্বাচনের দু'তিন মাস আগে থেকে মদ উৎপাদন, ওয়্যার হাউস পরীক্ষা করা শুরু করি। সুতরাং এটা তখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল।
শেখর গুপ্ত : আমি কোথায় পেঁৗছাতে চাই আপনি তা জানেন। আন্না হাজারি বলেছেন ভোটাররা সচেতন নয় বলে আপনি ঐকান্তিকভাবে নির্বাচনী ব্যাপারে সাফল্য পুরোপুরি পাবেন না। তারা একটা শাড়ি, এক বোতল মদ বা কিছু অর্থের বিনিময়ে ভোট প্রদান করে।
কুরাইশি : এটা আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু একইসঙ্গে সব প্রার্থীই যখন একই উপায় অবলম্বন করে এটা তখন প্রশমিত হয়ে যায় এবং আমাদের নজরদারি ও নাগরিকদের সচেতনতা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত আমরা এখন ভোটার শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছি।
শেখর গুপ্ত : এটা আসলে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শ্রেণীর ওপর অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করে এবং সমস্ত উল্টাপাল্টার জন্য রাজনীতিকরা দায়ী এটাকে প্রতিপন্ন করে।
কুরাইশি : হ্যাঁ, রাজনৈতিক শ্রেণীর যে কুখ্যাতি রয়েছে সেটা আপনি ভালোই জানেন, আর সেটা খুবই বিদঘুটে।
শেখর গুপ্ত : সেটা কি উচিত?
কুরাইশি :অংশত উচিত, অংশত অনুচিত।
শেখর গুপ্ত : এটা কি ফিফটি ফিফটি_ যেমন, কিছু অনুপাতে অত্যন্ত উচিত বা অনুচিত অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচিত?
কুরাইশি : আমি আগ্রহের সঙ্গে ফিফটি ফিফটি বলব। সব সত্ত্বেও সব রাজনীতিবিদই অসৎ নয়, বস্তুত আজকে ভারত যে সুপারপাওয়ার হয়ে উঠেছে সেজন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধন্যবাদ পাওয়া উচিত। আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে তাকান। আমরা যেটা করতে পেরেছি তারা সে পর্যন্ত যেতেই পারেনি। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল। এখন রাজনৈতিক দলের কলঙ্কজনক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রধানত তাদের ক্ষমতায় আসার পথ বন্ধ করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
শেখর গুপ্ত : আপনি কিছুদিন এই দায়িত্বে থাকবেন। আপনি আপনার সারাজীবন রাজনৈতিক শ্রেণীর সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। রাজনৈতিক শ্রেণীর অবস্থা কি উন্নত হবে নাকি আরও খারাপ হবে বলে আপনি মনে করেন?
কুরাইশি : অবস্থা আরও খারাপের দিকেই যে যাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতি দিয়ে শুরু হয়েছে। আমি পাঞ্জাবের এক বিধায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে আমি নির্বাচনী ব্যয়ের কথা বলতেই তিনি কমিশন নির্ধারিত সীমার কথা উল্লেখ করলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বললেন তার খরচ কমিশনে প্রদত্ত হিসাবের কয়েক গুণ বেশি হয়েছে। এটাই হলো বাস্তবতা। সুতরাং এর মধ্যেও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের পক্ষে তো আর আগামী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচনী দুর্নীতির মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। আমাদের কাছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নেই যে, রাতারাতি সবকিছু ঠিক করে ফেলব। আমরা যদি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা শুরু করি তাহলে অভিযোগ করা হবে যে, আমরা জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছি। তাহলে এটা নির্মূলের উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নির্বাচনী সংস্কার এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ১৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সংস্কারের বিষয়টি পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি কমিটি এসেছে-গেছে কিন্তু সংস্কার আর আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
শেখর গুপ্ত : কিছুই যদি না করা হয় তাহলে আরেক আন্না হাজারির আন্দোলন দেখা দেবে। আবার এই আন্দোলনে রাস্তা প্রকম্পিত হবে এবং আরও কঠিন ব্যবস্থার দাবি উচ্চকিত হবে।
কুরাইশি : যে কোনো সাংবিধানিক গণতন্ত্রে যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান সেখানে আপনি রাস্তার আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আশা করতে পারেন না।
শেখর গুপ্ত : হ্যাঁ, আপনি যদি সব সময় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করতেই থাকেন....
কুরাইশি : ...ওটাই পরিণতি হবে। আমি আপনাকে প্রেসার কুকারের উদাহরণ দিতে পারি। এর সেফটি বাল্ব যদি কোনো কারণে বাধার মধ্যে পড়ে তাহলে এটা বিস্ফোরিত হবে। অতএব আমরা এটার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছি বলা যায়।
শেখর গুপ্ত : লোকপাল বিল নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
কুরাইশি : হ্যাঁ। এমনকি এ পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়, সন্দেহ নেই এখানে দুর্নীতি রয়েছে, তবে লোকপাল সম্পর্কে আমি বলব, এর ভূমিকাও এক অর্থে সীমিত। কারণ লোকপাল কেবল দুর্নীতিবাজকেই শাস্তি দিতে পারবে। আমাদের বক্তব্য হলো দুর্নীতিবাজরা যাতে কোনোক্রমেই ক্ষমতায় আসতে না পারে তার ব্যবস্থা করা বা তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া। এখনকার পরিস্থিতি হলো অপরাধী, ধর্ষক, খুনি, ডাকাতরা বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পায়, তারা মন্ত্রী পর্যন্ত হতে পারে। এভাবেই আইন ভঙ্গকারীরাই হয়ে পড়ে আইন প্রণয়নকারী। এ কারণেই এরা চাইবে না এর কোনো সংশোধনী সংসদে পাস হোক।
শেখর গুপ্ত : সুতরাং এখন নির্বাচনী সংস্কারের যে বিল টেবিলে রয়েছে তার মূল কথা নিয়ে আলোচনা করা যায়।
কুরাইশি : আমি আপনাকে কিছু ইতিবাচক বিষয় বলতে পারি। ১৫ থেকে ১৮ বছর পর ছয় মাস আগে আইন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইনমন্ত্রী নিজেই নির্বাচন কমিশনে আসেন এবং সেখানে আমাদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা সময় ধরে সংস্কারের প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং আমরা যৌথভাবে দেশব্যাপী এ ব্যাপারে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করার ব্যাপারে একমত হই। সাতটি আঞ্চলিক আলোচনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় এবং ইতিমধ্যে ছয়টি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শেখর গুপ্ত : এটা কতটা জরুরি? সরকার কি এটা বন্ধ করে দিতে পারে?
কুরাইশি : সরকার এটা এতদিন বন্ধ করে রেখেছিল। তাই এটা এখন বন্ধ করা হতে পারে এবং এটাই হলো উদ্বেগের বিষয়।
শেখর গুপ্ত : তারা লোকপাল বিল স্থগিত করেছে। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি রোধের ক্ষেত্রে লোকপাল বিল কিছুটা উপকার দিত।
কুরাইশি : এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হতে পারে যে, নির্বাচন সংস্কার বিল তো কেবল নির্বাচনী দুর্নীতি রোধ করার জন্যই। এটা তো আর আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও অন্যান্য দুর্নীতি নিয়ে কিছু করবে না। এ ব্যাপারে লোকপাল বিলের সংস্রব রয়েছে। তবে রাজনৈতিক দুর্নীতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি দুর্নীতিবাজ হয় তাহলে আমলতন্ত্রও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভোরা কমিটি অপরাধী-আমলা-রাজনীতিবিদ আঁতাতের ব্যাপারে কথা বলেছে। অথচ এই অশুভ আঁতাত ভেঙে দেওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবগুলো কী সে ব্যাপারে আলোকপাত করব।
শেখর গুপ্ত : কোন প্রস্তাব সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়.. কোন প্রস্তাব টেবিলে রয়েছে?
কুরাইশি : টেবিলে যে প্রস্তাব রয়েছে সেটি হচ্ছে অপরাধীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা। এ ব্যাপারে আপত্তি দেখানো হচ্ছে যে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হতে পারে। আমরা গত অক্টোবরে এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলকে বৈঠকে ডেকেছিলাম। তখনও তারা এই যুক্তিতে আমাদের প্রস্তাবটি খারিজ করে দিয়েছিল।
শেখর গুপ্ত : আইনের সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে কি?
কুরাইশি : আইনের মধ্যেই সংশোধনীর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা মনে করি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যে সাংবিধানিক স্বীকৃত অধিকার রয়েছে, সেটা কমিশনের সব সদস্যের বেলায় সম্প্রসারিত করা আবশ্যক। এটাই যৌক্তিক। যতক্ষণ পর্যন্ত কেবল প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সাংবিধানিক সুরক্ষা দেওয়া হয় ততক্ষণ এটা এক সদস্যের কমিশনই থাকে। এখানে সুরক্ষাটা ব্যক্তির নয়, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। কমিশনের তিন সদস্যকেই একই সাংবিধানিক সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। বাকি দুই সদস্য যদি সরকারের চাপের মধ্যে পড়ে যেত তাহলে তারা আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে দিতে পারত। এই পরিস্থিতি এখন পরিবর্তন হয়েছে। কমিশনের সদস্যরা নিঃশঙ্ক।
শেখর গুপ্ত : আপনি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উপলক্ষ করে নয়, সাধারণ অর্থে এটা বলছেন...
কুরাইশি : কমিশন বস্তুত সেটুকু পর্যন্তই করতে সক্ষম যেটুকু পর্যন্ত তাকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা দেওয়া আছে। এক্ষেত্রে আমি রাজনীতিবিদদের কৃতিত্ব দেব। এমনকি মডেল আচরণবিধি যেটাকে আপনি অদ্বিতীয় বলতে পারেন, সেটা রাজনীতিবিদদেরই সৃষ্টি।
শেখর গুপ্ত : রাজনীতিবিদরা বস্তুতই এই মডেল আচরণবিধিকে ভয় পায়। কেউই এখানে ফেঁসে যেতে চায় না।
কুরাইশি : কোনো সিনিয়র নেতাকে নির্বাচন কমিশন থেকে উত্তর দেওয়ার জন্য পরের দিন বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হলে দেখা যায় ৪টার মধ্যেই উত্তর এসে গেছে। এখানে ভয়টা এরকমই... অথচ এটা তাদেরই সৃষ্টি।
শেখর গুপ্ত : এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?
কুরাইশি : আসলে রাজনীতিবিদরা মনে করে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নিলে তাদের ভোটার জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণেই তারা এতটা ভয় পায় নির্বাচন কমিশনকে।
শেখর গুপ্ত : আমাদের উপমহাদেশে সারাবিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বাস। এখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও গণতন্ত্রীকরণ দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার সাফল্য এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে কি? ভারতীয় মুসলমানরা জনসংখ্যার দিক থেকে ক্রমবর্ধমান। তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কতটা প্রেরণাদায়ী হতে পারে। এটা কি বাংলাদেশ, পাকিস্তানকে যেমন সাহায্য করছে, তেমনিভাবে অন্য মুসলিম দেশের ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণামূলক হতে পারে?
কুরাইশি : হ্যাঁ, আমি মনে করি ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের অবদান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পাকিস্তানসহ এসব দেশের প্রতিনিধি দলকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। গত ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভারত সফর করেন। সে সময় তিনি আমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান। আমরা কীভাবে এতটা কার্যকর সংস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছি তিনি সে ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে যা কিছু জানি তার সবটাই পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা এ ব্যাপারে যে কারও সঙ্গেই শেয়ার করতে প্রস্তুত। আপনি মুসলিম দেশগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। আসলে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ধর্ম। কিন্তু আমাদের মুসলিম দেশগুলো খুব কমই গণতান্ত্রিক। আপনি বলেছেন, ভারতের নির্বাচন কমিশন এখন বিশ্ব ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তবে এরা যখন আমাদের বিধানসভা ও সংসদে অপরাধী থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করে, অর্থ ক্ষমতা সম্পর্কে যখন তারা সব অবগত হয়, তখন সেটা আমাদের কাছে খুবই বিব্রতকর ঠেকে। এ বিষয়ে কিছু করার রয়েছে।
No comments