কণ্ঠস্বর-মৃতেরা তো ফেরে না by রাহাত খান
এ মুহূর্তে বাংলাদেশজুড়ে সবচেয়ে আলোচনার বিষয় আশুলিয়া এলাকার তাজরীন গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে ১১১ কর্মরত পোশাক কর্মীর অসহায় মৃত্যু। পুরো জাতি এ ঘটনায় স্তম্ভিত ও শোক-স্তব্ধ। ঘটনার পরদিন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শোক দিবস পালন করা হয়েছে।
তবে শোক ও সম্মান প্রদর্শন যেভাবেই করা হোক, মৃতরা তো ফেরে না। এভাবে আগুনে পুড়ে মানুষ মরার কোনো সান্ত্বনাও হয় না। এ নিয়ে নানা মহলের নানা কথাবার্তা, নানা ক্ষোভ ও ক্রোধ, নানা অভিযোগ। সরকারি তরফে এবং কারখানার স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেনের মতে, কারখানায় অগি্নকাণ্ডের ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার। পোশাকশিল্প কারখানার কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ত্রুটিমুক্ত_ এসব কিছু দেখার দায়দায়িত্ব তো শেষ পর্যন্ত সরকারেরই। কাজেই তাজরীন পোশাকশিল্প কারখানায় অগি্নকাণ্ডে ১১১ জন পোশাক তৈরি কর্মীর মৃত্যুর দায় তারা এড়াতে পারে না। কোনো কোনো মহলের তর্জনী উঠেছে তাজরীনের স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেনের দিকে। তাজরীনে আগুন লেগে অসহায় মানুষ যখন পুড়ছে, বাঁচার আকুল চেষ্টায় রত, তখন বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক দেলোয়ার হোসেন সাহেব নাকি ঘুমাচ্ছিলেন।
ঘটনার আরও কিছু বৃত্তান্ত আছে, যা না বললেই নয়। দৈনিক ইত্তেফাক (২৯ নভেম্বর) লিখেছে :তাজরীন গার্মেন্টের বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য ও অনুসন্ধানে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, অগি্নকাণ্ডের পরপর কারখানার কলাপসিবল গেটে তালা না দিলে এত শ্রমিকের মৃত্যু হতো না। শ্রমিকদের কারখানার ভেতর তালা মেরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও কর্মকর্তারা দ্রুত সটকে পড়েন। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বেরোতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা বলতে থাকে_ 'ভেতরে থাকো, আগুন লাগেনি।' এই কথা বলে তারা প্রতিটি তলার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। 'গার্ড ভাই, গেট খুলে দেন, আমাদের বাঁচতে দিন বলে চিৎকার করলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।'
দৈনিক প্রথম আলোর মতে, তাজরীন পোশাক তৈরি কারখানায় অগি্নকাণ্ডে ১১১ কর্মীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকের অবহেলা। একটি গোলটেবিল বৈঠক শেষে বক্তাদের থেকে এ উপসংহার বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং সমকালের প্রতিবেদনে তাজরীনের অগি্নকাণ্ডে শ্রমিক-কর্মীর মৃত্যুর জন্য ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা এবং পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিতে চাইছে কোনো কোনো মহল। আমি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিরোধী মহলকে বেঠিক বলতে চাই না। তবে তারা যে বর্ণে বর্ণে সঠিক, তাইবা কী করে বলা যায়? আলোচ্য অগি্নকাণ্ডের পেছনে যে কোনো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নেই, ঘটনা ঘটার পরই সেটা তারা অত জোর দিয়ে, এমন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন কীভাবে? ঘটনাটি কেন ঘটেছে সেটা কি তদন্ত করে দেখার কোনোই প্রয়োজন নেই?
তাজরীনের ঘটনার পরপরই আরও কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানায় অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কিংবা ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানি খাতে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানটি দখল করতে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প খাতে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথে ছিল। পোশাকশিল্প খাতে বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশেষ একটি দেশ এবং কোনো মহল থেকে অবশ্যই হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দিতে নানাভাবে তৎপরতা চলাচ্ছে, এটা তো ভিত্তিহীন কোনো বক্তব্য নয়। অতীত ও বর্তমানে এ বক্তব্যের পক্ষে বহু ঘটনার দৃষ্টান্তই তুলে ধরা যায়। তাজরীনের অগি্নকাণ্ড ও শ্রমিক মৃত্যুর পেছনে কোনো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র থাকতে পারে না, এটা যারা অনায়াসে বলে ফেলেন, তাদের ব্যাপারে তাই খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা সন্দেহ থেকেই যায়।
বাংলাদেশ তার জন্মমুহূর্ত থেকেই নানাবিধ-নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার। স্বাধীনতার ঠিক পরপর ১৯৭২-৭৩ সালে শুরু হয়েছিল একটার পর একটা পাটের গুদামে আগুন লাগা এবং বেশিরভাগ গুদামের পাট ভস্মীভূত হওয়ার ঘটনা। এখন যেমন বাংলাদেশের সেরা সম্পদের সূত্র তৈরি পোশাকশিল্প রফতানি করা, ১৯৭২-৭৩ সালেও ঠিক তেমনি পাট ছিল বাংলাদেশের সেরা সম্পদ। পাটের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। এমন ধারাবাহিকভাবে ১৯৭২-৭৩ সালে অগি্নকাণ্ডে বাংলাদেশের পাট সম্পদ ধ্বংস হওয়া এবং ২০১২ সালে একদিনের হেরফেরে দেশের পাঁচটি তৈরি পোশাকশিল্প কারখানায় অগি্নকাণ্ড হওয়া, সম্পদের ক্ষতি এবং ১১১ জনের বেশি পোশাকশিল্প শ্রমিকের অসহায় মৃত্যুর মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল আছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে তাই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প যে সময়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান দখল করতে যাচ্ছে, আলোচ্য খাত থেকে বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে, তখন বাইরের দেশ বা ভেতরের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি খাতের ওপর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠা আর যাই হোক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট তো এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক আমদানি থেকে সরে গেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর এ ধরনের অগি্নকাণ্ড যদি একটার পর একটা ঘটে যেতে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশের সম্পদের ক্ষতিসাধন এবং রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির সূচনা তো হয়েই গেছে। দেশের প্রধান বিরোধী জোটের নির্বাচন ও রাজনীতি বিষয়ক কোনো সংলাপে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিপক্ষ সরকারের সঙ্গে এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও আলোচনায় বসবে না সেটাও তো এর মধ্যে তারা বলেই দিয়েছে। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতি নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। দেশকে অস্থির ও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা তো চলছেই। তাজরীনের কারখানায় সংঘটিত অগি্নকাণ্ডে তাই ষড়যন্ত্রমূলক কিছু হতেই পারে না_ এ রকম কথা বলেন, তাই জোর দিয়ে বলার উপায় নেই কিছুতেই। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট তো আছেই। এ ছাড়া মিডিয়ার বৃহৎ অংশের ধারণা, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি (বাংলাদেশের) ধ্বংসের নানামুখী কার্যতৎপরতা চলছে। নিকট বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও নাশকতামূলক তৎপরতা চলতেই থাকবে। গার্মেন্ট থেকে বাংলাদেশের আয় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার! সহ্য করা যায়!
যারা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস করেন না, তাদের প্রতি আমার বলার কিছু নেই। তবে বাইরের যেসব শক্তিধর দেশ বিশ্বাস করতে চায় না যে, বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে দুটি বড় স্বাধীনতাবিরোধী দল। তারা হয় সাময়িক কৌশলের অংশ হিসেবে এসব কথা বলছেন, নতুবা আমি বলব, জন্ম ও পুনর্জন্ম থেকে দল দুটির লক্ষ্য পাকিস্তান বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া_ এই বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না তারা। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই প্রায় একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে তাদের টার্গেট। এরপর এই দল দুটির রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য হচ্ছে, পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্ত থেকে ভারতের ওপর যুগপৎ সন্ত্রাসী এবং নাশকতামূলক আক্রমণ চালানো। তালেবানদের জঙ্গি জিহাদের তালিকায় রাশিয়া এবং চীনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোও আছে! কাজেই বাংলাদেশে তালেবান-মানসিকতার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিলে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো নিরাপদ থাকবে, এমন প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করা হবে আত্মঘাতীমূলক।
তবে বলতে হয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ব চুরমার করার প্রচেষ্টা তো স্বাধীনতার পর থেকেই চলছে। শুধু এই কথা উচ্চারণ করে বাংলার গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। নিজেদের গার্মেন্ট রক্ষার দায়িত্ব তো তাদের নিজেদেরই ছিল। তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি কেন। কী কারণে?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে জোয়ারের প্লাবন বয়ে এনেছে গ্রাম ও বস্তি এলাকার মেয়েরা। তাদের যত্ন এবং শ্রমেই বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ক্রমোন্নতি ঘটে তৈরি পোশাকশিল্পের। কিন্তু পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা যেন মালিকদের ক্রীতদাস! চীন যেখানে পোশাক শ্রমিকদের বেতন মাসে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজারের কম দেয় না, বাংলাদেশে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের দোহাই দিয়ে পোশাক শ্রমিকদের মাইনে দেওয়া হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে সেটা মাসে ৬০ ডলারের কাছাকাছি। চীন ও ভারত যদি পোশাক শ্রমিকদের মাসে ২৪ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানটি দখল করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক কর্মীদের মাসে অন্তত এক হাজার ডলার, টাকার হিসাবে মাসে আট হাজার টাকা মাইনে দিলে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না কেন?
হ্যাঁ, পোশাক শ্রমিকদের মাসে আট-দশ হাজার টাকা মাইনে দিলে বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানার মালিকদের বিশাল আয়-রোজগারের সামান্য কিছুটা কম পড়বে। অতীত এবং বর্তমানে আসীন সরকার পোশাকশিল্প মালিকদের এত প্রশ্রয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে যে, পোশাককর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও, বছরে অগি্নকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটলেও সরকারের যেন কিছুই করার নেই। সরকারের এ নিষ্ক্রিয়তা নিষ্ঠুরতার চেয়েও বেশি।
গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিক_ উভয়কে বাঁচতে হবে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বার্থেই। কিন্তু মাঝারি থেকে বড় তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা তো শাহেনশাহদের মতো জীবনযাপন করেন। তারা পোশাক শ্রমিকদের বঞ্চিত করে এ রকম বর্ণাঢ্য-ধনাঢ্য জীবনযাপন করবেন এমনটা মেনে নেওয়া যায় না, যেতে পারে না। পোশাক শ্রমিকদের শ্রম ও কর্মের মূল্য দিতে হবে। এটা শিল্প মালিকদের বদান্যতা নয়, বকশিশ নয়, কোনো দয়া দেখানো নয়, এটা শ্রমিকের হিসাবের পাওনা। শ্রমিকরা একবেলা, আধবেলা খাবে, বস্তির একঘরে গাদাগাদি করে আট-দশজন থাকবে আর শিল্প মালিকরা রাজপ্রাসাদে বাস করবেন, রাজকীয় জীবনযাপন করবেন, এটা নূ্যনতম ন্যায়বিচারেরও অস্বীকৃতি।
পোশাককর্মীদের জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বহুক্ষেত্রে সেটা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। শ্রমিকরা যেনবা ক্রীতদাস। কাজ চলাকালে প্রায় সব কারখানায় নির্গমন ও কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখা হয়। অগি্ননির্বাপণ সিলিন্ডার নেই বহু কারখানায়। আর থাকলেও সেটা যে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না শ্রমিকদের। পোশাকশিল্প মালিকদের নানা ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলছেই, যার প্রতিবাদ করলে হয় কর্মচ্যুতি, না হয় কারখানায় লকআউট ঘোষণা। তারা (শিল্প মালিকরা) বিলক্ষণ জানেন, লকআউটের স্নায়ুযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দুস্থ, দরিদ্র, মানবেতর জীবনযাপনকারী শ্রমিকদেরই হার মানতে হয়। কিন্তু শিল্প মালিকদের এ মানসিকতা, এ স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই।
তাজরীন তৈরি পোশাক কারখানায় যা ঘটেছে তা নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়। এখানে মালিকপক্ষের কারখানা ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য ধরা পড়েছে তা ক্ষমারও অযোগ্য। তাজরীনের ঘটনায় পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতি মিডিয়ার বৃহদাংশের পরোক্ষ সমর্থনে এবং কিছুসংখ্যক ব্যর্থ রাজনীতিক ও তথাকথিত 'সুশীল' সমাজের কল্যাণে এর মধ্যেই যে দানবের মূর্তি ধারণ করেছে! এ রকম দেশ ধ্বংসকারী, নেতিবাচক সাংবাদিকতার দাপট ইতিপূর্বে কখনও দেখা গেছে বলে আমার জানা নেই।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ঘটনার আরও কিছু বৃত্তান্ত আছে, যা না বললেই নয়। দৈনিক ইত্তেফাক (২৯ নভেম্বর) লিখেছে :তাজরীন গার্মেন্টের বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য ও অনুসন্ধানে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, অগি্নকাণ্ডের পরপর কারখানার কলাপসিবল গেটে তালা না দিলে এত শ্রমিকের মৃত্যু হতো না। শ্রমিকদের কারখানার ভেতর তালা মেরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি ও কর্মকর্তারা দ্রুত সটকে পড়েন। আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বেরোতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা বলতে থাকে_ 'ভেতরে থাকো, আগুন লাগেনি।' এই কথা বলে তারা প্রতিটি তলার কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেয়। 'গার্ড ভাই, গেট খুলে দেন, আমাদের বাঁচতে দিন বলে চিৎকার করলেও কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।'
দৈনিক প্রথম আলোর মতে, তাজরীন পোশাক তৈরি কারখানায় অগি্নকাণ্ডে ১১১ কর্মীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মালিকের অবহেলা। একটি গোলটেবিল বৈঠক শেষে বক্তাদের থেকে এ উপসংহার বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং সমকালের প্রতিবেদনে তাজরীনের অগি্নকাণ্ডে শ্রমিক-কর্মীর মৃত্যুর জন্য ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা এবং পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দিতে চাইছে কোনো কোনো মহল। আমি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিরোধী মহলকে বেঠিক বলতে চাই না। তবে তারা যে বর্ণে বর্ণে সঠিক, তাইবা কী করে বলা যায়? আলোচ্য অগি্নকাণ্ডের পেছনে যে কোনো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নেই, ঘটনা ঘটার পরই সেটা তারা অত জোর দিয়ে, এমন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন কীভাবে? ঘটনাটি কেন ঘটেছে সেটা কি তদন্ত করে দেখার কোনোই প্রয়োজন নেই?
তাজরীনের ঘটনার পরপরই আরও কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানায় অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কিংবা ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তৈরি পোশাক রফতানি খাতে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, শ্রীলংকাসহ বিশ্বের সব দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানটি দখল করতে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প খাতে বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার আয়ের পথে ছিল। পোশাকশিল্প খাতে বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশেষ একটি দেশ এবং কোনো মহল থেকে অবশ্যই হতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দিতে নানাভাবে তৎপরতা চলাচ্ছে, এটা তো ভিত্তিহীন কোনো বক্তব্য নয়। অতীত ও বর্তমানে এ বক্তব্যের পক্ষে বহু ঘটনার দৃষ্টান্তই তুলে ধরা যায়। তাজরীনের অগি্নকাণ্ড ও শ্রমিক মৃত্যুর পেছনে কোনো পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র থাকতে পারে না, এটা যারা অনায়াসে বলে ফেলেন, তাদের ব্যাপারে তাই খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা সন্দেহ থেকেই যায়।
বাংলাদেশ তার জন্মমুহূর্ত থেকেই নানাবিধ-নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার। স্বাধীনতার ঠিক পরপর ১৯৭২-৭৩ সালে শুরু হয়েছিল একটার পর একটা পাটের গুদামে আগুন লাগা এবং বেশিরভাগ গুদামের পাট ভস্মীভূত হওয়ার ঘটনা। এখন যেমন বাংলাদেশের সেরা সম্পদের সূত্র তৈরি পোশাকশিল্প রফতানি করা, ১৯৭২-৭৩ সালেও ঠিক তেমনি পাট ছিল বাংলাদেশের সেরা সম্পদ। পাটের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। এমন ধারাবাহিকভাবে ১৯৭২-৭৩ সালে অগি্নকাণ্ডে বাংলাদেশের পাট সম্পদ ধ্বংস হওয়া এবং ২০১২ সালে একদিনের হেরফেরে দেশের পাঁচটি তৈরি পোশাকশিল্প কারখানায় অগি্নকাণ্ড হওয়া, সম্পদের ক্ষতি এবং ১১১ জনের বেশি পোশাকশিল্প শ্রমিকের অসহায় মৃত্যুর মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল আছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে তাই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প যে সময়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান দখল করতে যাচ্ছে, আলোচ্য খাত থেকে বছরে ২০ মিলিয়ন ডলার আয় হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে দেখা দিচ্ছে, তখন বাইরের দেশ বা ভেতরের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে বাংলাদেশের শীর্ষ রফতানি খাতের ওপর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠা আর যাই হোক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট তো এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তার তৈরি পোশাক আমদানি থেকে সরে গেছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর এ ধরনের অগি্নকাণ্ড যদি একটার পর একটা ঘটে যেতে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশের সম্পদের ক্ষতিসাধন এবং রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টির সূচনা তো হয়েই গেছে। দেশের প্রধান বিরোধী জোটের নির্বাচন ও রাজনীতি বিষয়ক কোনো সংলাপে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। প্রতিপক্ষ সরকারের সঙ্গে এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও আলোচনায় বসবে না সেটাও তো এর মধ্যে তারা বলেই দিয়েছে। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক মহাসমাবেশের মঞ্চ থেকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতি নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। দেশকে অস্থির ও অস্থিতিশীল করার চেষ্টা তো চলছেই। তাজরীনের কারখানায় সংঘটিত অগি্নকাণ্ডে তাই ষড়যন্ত্রমূলক কিছু হতেই পারে না_ এ রকম কথা বলেন, তাই জোর দিয়ে বলার উপায় নেই কিছুতেই। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট তো আছেই। এ ছাড়া মিডিয়ার বৃহৎ অংশের ধারণা, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি (বাংলাদেশের) ধ্বংসের নানামুখী কার্যতৎপরতা চলছে। নিকট বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও নাশকতামূলক তৎপরতা চলতেই থাকবে। গার্মেন্ট থেকে বাংলাদেশের আয় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার! সহ্য করা যায়!
যারা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস করেন না, তাদের প্রতি আমার বলার কিছু নেই। তবে বাইরের যেসব শক্তিধর দেশ বিশ্বাস করতে চায় না যে, বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে দুটি বড় স্বাধীনতাবিরোধী দল। তারা হয় সাময়িক কৌশলের অংশ হিসেবে এসব কথা বলছেন, নতুবা আমি বলব, জন্ম ও পুনর্জন্ম থেকে দল দুটির লক্ষ্য পাকিস্তান বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া_ এই বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না তারা। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতোই প্রায় একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে তাদের টার্গেট। এরপর এই দল দুটির রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য হচ্ছে, পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্ত থেকে ভারতের ওপর যুগপৎ সন্ত্রাসী এবং নাশকতামূলক আক্রমণ চালানো। তালেবানদের জঙ্গি জিহাদের তালিকায় রাশিয়া এবং চীনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোও আছে! কাজেই বাংলাদেশে তালেবান-মানসিকতার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিলে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো নিরাপদ থাকবে, এমন প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করা হবে আত্মঘাতীমূলক।
তবে বলতে হয়, বাংলাদেশের অস্তিত্ব চুরমার করার প্রচেষ্টা তো স্বাধীনতার পর থেকেই চলছে। শুধু এই কথা উচ্চারণ করে বাংলার গার্মেন্ট শিল্প মালিকদের রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। নিজেদের গার্মেন্ট রক্ষার দায়িত্ব তো তাদের নিজেদেরই ছিল। তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি কেন। কী কারণে?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে জোয়ারের প্লাবন বয়ে এনেছে গ্রাম ও বস্তি এলাকার মেয়েরা। তাদের যত্ন এবং শ্রমেই বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের ক্রমোন্নতি ঘটে তৈরি পোশাকশিল্পের। কিন্তু পোশাকশিল্পে নিয়োজিত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা যেন মালিকদের ক্রীতদাস! চীন যেখানে পোশাক শ্রমিকদের বেতন মাসে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজারের কম দেয় না, বাংলাদেশে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের দোহাই দিয়ে পোশাক শ্রমিকদের মাইনে দেওয়া হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে সেটা মাসে ৬০ ডলারের কাছাকাছি। চীন ও ভারত যদি পোশাক শ্রমিকদের মাসে ২৪ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাইনে দিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানটি দখল করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের পোশাক কর্মীদের মাসে অন্তত এক হাজার ডলার, টাকার হিসাবে মাসে আট হাজার টাকা মাইনে দিলে বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না কেন?
হ্যাঁ, পোশাক শ্রমিকদের মাসে আট-দশ হাজার টাকা মাইনে দিলে বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানার মালিকদের বিশাল আয়-রোজগারের সামান্য কিছুটা কম পড়বে। অতীত এবং বর্তমানে আসীন সরকার পোশাকশিল্প মালিকদের এত প্রশ্রয় দিয়েছে এবং দিচ্ছে যে, পোশাককর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও, বছরে অগি্নকাণ্ডসহ নানা দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটলেও সরকারের যেন কিছুই করার নেই। সরকারের এ নিষ্ক্রিয়তা নিষ্ঠুরতার চেয়েও বেশি।
গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিক_ উভয়কে বাঁচতে হবে তৈরি পোশাকশিল্পের স্বার্থেই। কিন্তু মাঝারি থেকে বড় তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা তো শাহেনশাহদের মতো জীবনযাপন করেন। তারা পোশাক শ্রমিকদের বঞ্চিত করে এ রকম বর্ণাঢ্য-ধনাঢ্য জীবনযাপন করবেন এমনটা মেনে নেওয়া যায় না, যেতে পারে না। পোশাক শ্রমিকদের শ্রম ও কর্মের মূল্য দিতে হবে। এটা শিল্প মালিকদের বদান্যতা নয়, বকশিশ নয়, কোনো দয়া দেখানো নয়, এটা শ্রমিকের হিসাবের পাওনা। শ্রমিকরা একবেলা, আধবেলা খাবে, বস্তির একঘরে গাদাগাদি করে আট-দশজন থাকবে আর শিল্প মালিকরা রাজপ্রাসাদে বাস করবেন, রাজকীয় জীবনযাপন করবেন, এটা নূ্যনতম ন্যায়বিচারেরও অস্বীকৃতি।
পোশাককর্মীদের জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বহুক্ষেত্রে সেটা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। শ্রমিকরা যেনবা ক্রীতদাস। কাজ চলাকালে প্রায় সব কারখানায় নির্গমন ও কলাপসিবল গেট বন্ধ রাখা হয়। অগি্ননির্বাপণ সিলিন্ডার নেই বহু কারখানায়। আর থাকলেও সেটা যে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না শ্রমিকদের। পোশাকশিল্প মালিকদের নানা ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলছেই, যার প্রতিবাদ করলে হয় কর্মচ্যুতি, না হয় কারখানায় লকআউট ঘোষণা। তারা (শিল্প মালিকরা) বিলক্ষণ জানেন, লকআউটের স্নায়ুযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দুস্থ, দরিদ্র, মানবেতর জীবনযাপনকারী শ্রমিকদেরই হার মানতে হয়। কিন্তু শিল্প মালিকদের এ মানসিকতা, এ স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই।
তাজরীন তৈরি পোশাক কারখানায় যা ঘটেছে তা নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়। এখানে মালিকপক্ষের কারখানা ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য ধরা পড়েছে তা ক্ষমারও অযোগ্য। তাজরীনের ঘটনায় পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতি মিডিয়ার বৃহদাংশের পরোক্ষ সমর্থনে এবং কিছুসংখ্যক ব্যর্থ রাজনীতিক ও তথাকথিত 'সুশীল' সমাজের কল্যাণে এর মধ্যেই যে দানবের মূর্তি ধারণ করেছে! এ রকম দেশ ধ্বংসকারী, নেতিবাচক সাংবাদিকতার দাপট ইতিপূর্বে কখনও দেখা গেছে বলে আমার জানা নেই।
রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments