মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-ফুটপাতে খাবার বেচেন মোসলেম byলিমন বাসার
১৯৭১ সালে পাশাপাশি থেকে শত্রুর মোকাবিলা করার সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া গুলি মাথায় লেগে শহীদ হয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল ওয়াহেদ। সহযোদ্ধাকে হারানোর সেই শোক আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন। চার দশক ধরে তিনি কালো পোশাক ছাড়া অন্য কিছু পরছেন না।
যেকোনো আনন্দ-উৎসবেও তাঁর পরনে থাকে কালো পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি।
মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনকে চেনেন না, এমন লোক বগুড়ার চেলোপাড়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এলাকার তরুণ সাইদুর বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি কখনো অন্যের মুখাপেক্ষী হননি। রাত-দিন পরিশ্রম করেন। এই বয়সেও সড়কের পাশে ডাল-ভাত বিক্রি করে কোনো রকমে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। আমরা কখনো এ মানুষটিকে কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। এ কারণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করি না।
চেলোপাড়া রেলব্রিজ ঘেঁষে সারি সারি ঝুপড়িঘর। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি কোনটা, জানতে চাইলে ৯ বছরের শিশু মুকিত হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, 'ওই যে দেখেন রেললাইনের নিচে টিনের ঘরের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের সাইনবোর্ড ঝুলছে। ওখানেই তার বাড়ি।' কিছুদূর হেঁটে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা, 'মুক্তিযোদ্ধা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, দেশ ও জনগণের অতন্দ্রপ্রহরী ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোসলেম উদ্দিন...।' বগুড়া শহরের উত্তর চেলোপাড়া রেলওয়ে বস্তিতে থাকেন তিনি। রেললাইনের নিচে বাড়িতে নামতে গেলে মনে হয় গুহার মতো। টিনের চালের ভাঙা অংশ দিয়ে দেখা যায় সূর্যের আলো। চারদিকে ঘিঞ্জি স্যাঁতসেঁতে আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ঘরের মধ্যে দাঁড়ালে চালে মাথা লেগে যায়। এ বাড়িতেই মোসলেম উদ্দিনের ১৫ সদস্যের বিরাট সংসার। তাঁর স্ত্রী সাজেদা ও মেয়ে রেশমা সাত-আট বছর ধরে অসুস্থ।
বগুড়ার শহীদ খোকন পার্কের পশ্চিম পাশে রাস্তার দেয়াল ঘেঁষে ড্রেনের ওপর বসে ডাল-ভাত বিক্রি করেন মোসলেম। মেয়েরা বাড়িতে রান্না করে দেন। আর প্রতিদিন সকালে ভারে করে সেই খাবার নিয়ে আসেন ফুটপাতের দোকানে। তাঁর হোটেলে পাঁচ থেকে ১০ টাকায় পেটভরে খাওয়া যায়। মোটা চালের ভাত, ডাল, আলুভর্তা, কচুভর্তা, পেঁয়াজু ও মাছভাজা বিক্রি করেন তিনি। ভাত প্রতি প্লেট দুই টাকা, আলু অথবা কচুভর্তা তিন টাকা, মাছভাজা পাঁচ টাকা। সঙ্গে ডাল ফ্রি। তিনি জানান, মূলত রিকশা ও ভ্যানের চালকরাই তাঁর হোটেলের খদ্দের। কখনো কখনো পথশিশুরাও আসে। তবে টাকা না থাকলেও কাউকে তিনি ফিরিয়ে দেন না, যার কাছে যা আছে সেই টাকার মধ্যেই পেট পুরে খেতে দেন। মোসলেম উদ্দিন জানান, তিনি এক বেলা অনাহারে থাকতে রাজি আছেন; কিন্তু কাউকে অনাহারী দেখতে চান না।
এত অল্প রোজগারে সংসার চলে কিভাবে, জানতে চাইলে মোসলেম বলেন, 'হামি কুনু সময় লিরাশ (নিরাশ) হই না। ছোলপোল মাঝেমধ্যে লিরাশ হয়, তখন হামি তারকোরোক কই পরের ধন না লিবে, (নিবে) চিরদিন সুকে অবে (রবে)। হামার একফোঁটা অক্তও বৃথা যাবার পারে না। হামি ভাঙা ঘরোত থাকলেও অনেক সুকি মানুষ। দিন আনি দিন খাই। খালি কষ্ট একটাই। ট্যাকার অভাবে ছোটপোলক পড়ালেকা শিকাবার পারনু না। তবে এখন অল্প অজগারের মধ্যেই লাতিগুলাক পড়াচ্চি। হামার এক লাতি (নাতি) ফাইবে মেধা লিয়া বৃত্তি পাছে। আর আরেক লাতিও জেএসসি পরীক্ষা দিচ্চে। অন্য লাতিগুলো একুনো ছোট।'
মোসলেমের বড় ছেলে মুকুল প্রামাণিক নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ান। মেজ ছেলে হোসেন বাজারে তরকারি বিক্রি করেন আর ছোট ছেলে আমির ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। তাঁরাও সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন বাবাকে।
মোসলেম জানান, কখনো কোথাও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাননি; সংবর্ধনা তো দূরে থাক। এটা নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপও নেই। সংবর্ধনা পাওয়ার আশায় তো যুদ্ধ করেননি। তবে একবার স্বাধীনতা দিবসে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডাকা হয়েছিল তাঁকে। দোকান বন্ধ রেখে গিয়েছিলেন। রাতে ভালো খাবার খেয়ে এসে বাড়ি ফিরে দেখেন ছেলেমেয়েরা না খেয়ে বসে আছে। সেই থেকে এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এক দিন না খাটলে যে পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত জুটবে না।
মোসলেমের ছেলে হোসেন বলেন, 'আব্বা হামাকোরোক যুদ্ধের গপ্প করে। হামাকেরে বুক ভরে যায় তার গপ্প শুনে। আব্বা কয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করিচি বাবারা। তোমরাও দেশেক ভালোবাসো।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় ২২-২৩ বছরের টগবগে যুবক ছিলেন মোসলেম উদ্দিন। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। বাবার নাম রহিম উদ্দিন প্রামাণিক। পড়ালেখা খুব একটা করেননি। সে সময় ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজও করতেন। একদিন গরু বিক্রি করতে নারুয়ামালা হাটে যান। একসময় তিনি লক্ষ করেন চলন্ত ট্রেন থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ করছে। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যায়। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সেখানেই মোসলেম উদ্দিন প্রতিজ্ঞা করেন এভাবে বসে থেকে আর নয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকেই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। মোসলেম উদ্দিনসহ ২৫-২৬ জনের একটি দল প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায় ভারতে। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেয় ৭ নম্বর সেক্টরে। গ্রুপ কমান্ডার সোনাতলার চরপাড়া গ্রামের আবদুল ওয়ারেসের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন তিনি। বগুড়ার ভেলুরপাড়ায় হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন মোসলেম ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনকে চেনেন না, এমন লোক বগুড়ার চেলোপাড়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এলাকার তরুণ সাইদুর বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি কখনো অন্যের মুখাপেক্ষী হননি। রাত-দিন পরিশ্রম করেন। এই বয়সেও সড়কের পাশে ডাল-ভাত বিক্রি করে কোনো রকমে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। আমরা কখনো এ মানুষটিকে কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি। এ কারণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করি না।
চেলোপাড়া রেলব্রিজ ঘেঁষে সারি সারি ঝুপড়িঘর। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি কোনটা, জানতে চাইলে ৯ বছরের শিশু মুকিত হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, 'ওই যে দেখেন রেললাইনের নিচে টিনের ঘরের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিনের সাইনবোর্ড ঝুলছে। ওখানেই তার বাড়ি।' কিছুদূর হেঁটে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা, 'মুক্তিযোদ্ধা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, দেশ ও জনগণের অতন্দ্রপ্রহরী ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোসলেম উদ্দিন...।' বগুড়া শহরের উত্তর চেলোপাড়া রেলওয়ে বস্তিতে থাকেন তিনি। রেললাইনের নিচে বাড়িতে নামতে গেলে মনে হয় গুহার মতো। টিনের চালের ভাঙা অংশ দিয়ে দেখা যায় সূর্যের আলো। চারদিকে ঘিঞ্জি স্যাঁতসেঁতে আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ঘরের মধ্যে দাঁড়ালে চালে মাথা লেগে যায়। এ বাড়িতেই মোসলেম উদ্দিনের ১৫ সদস্যের বিরাট সংসার। তাঁর স্ত্রী সাজেদা ও মেয়ে রেশমা সাত-আট বছর ধরে অসুস্থ।
বগুড়ার শহীদ খোকন পার্কের পশ্চিম পাশে রাস্তার দেয়াল ঘেঁষে ড্রেনের ওপর বসে ডাল-ভাত বিক্রি করেন মোসলেম। মেয়েরা বাড়িতে রান্না করে দেন। আর প্রতিদিন সকালে ভারে করে সেই খাবার নিয়ে আসেন ফুটপাতের দোকানে। তাঁর হোটেলে পাঁচ থেকে ১০ টাকায় পেটভরে খাওয়া যায়। মোটা চালের ভাত, ডাল, আলুভর্তা, কচুভর্তা, পেঁয়াজু ও মাছভাজা বিক্রি করেন তিনি। ভাত প্রতি প্লেট দুই টাকা, আলু অথবা কচুভর্তা তিন টাকা, মাছভাজা পাঁচ টাকা। সঙ্গে ডাল ফ্রি। তিনি জানান, মূলত রিকশা ও ভ্যানের চালকরাই তাঁর হোটেলের খদ্দের। কখনো কখনো পথশিশুরাও আসে। তবে টাকা না থাকলেও কাউকে তিনি ফিরিয়ে দেন না, যার কাছে যা আছে সেই টাকার মধ্যেই পেট পুরে খেতে দেন। মোসলেম উদ্দিন জানান, তিনি এক বেলা অনাহারে থাকতে রাজি আছেন; কিন্তু কাউকে অনাহারী দেখতে চান না।
এত অল্প রোজগারে সংসার চলে কিভাবে, জানতে চাইলে মোসলেম বলেন, 'হামি কুনু সময় লিরাশ (নিরাশ) হই না। ছোলপোল মাঝেমধ্যে লিরাশ হয়, তখন হামি তারকোরোক কই পরের ধন না লিবে, (নিবে) চিরদিন সুকে অবে (রবে)। হামার একফোঁটা অক্তও বৃথা যাবার পারে না। হামি ভাঙা ঘরোত থাকলেও অনেক সুকি মানুষ। দিন আনি দিন খাই। খালি কষ্ট একটাই। ট্যাকার অভাবে ছোটপোলক পড়ালেকা শিকাবার পারনু না। তবে এখন অল্প অজগারের মধ্যেই লাতিগুলাক পড়াচ্চি। হামার এক লাতি (নাতি) ফাইবে মেধা লিয়া বৃত্তি পাছে। আর আরেক লাতিও জেএসসি পরীক্ষা দিচ্চে। অন্য লাতিগুলো একুনো ছোট।'
মোসলেমের বড় ছেলে মুকুল প্রামাণিক নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ান। মেজ ছেলে হোসেন বাজারে তরকারি বিক্রি করেন আর ছোট ছেলে আমির ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। তাঁরাও সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন বাবাকে।
মোসলেম জানান, কখনো কোথাও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাননি; সংবর্ধনা তো দূরে থাক। এটা নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপও নেই। সংবর্ধনা পাওয়ার আশায় তো যুদ্ধ করেননি। তবে একবার স্বাধীনতা দিবসে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ডাকা হয়েছিল তাঁকে। দোকান বন্ধ রেখে গিয়েছিলেন। রাতে ভালো খাবার খেয়ে এসে বাড়ি ফিরে দেখেন ছেলেমেয়েরা না খেয়ে বসে আছে। সেই থেকে এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। এক দিন না খাটলে যে পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত জুটবে না।
মোসলেমের ছেলে হোসেন বলেন, 'আব্বা হামাকোরোক যুদ্ধের গপ্প করে। হামাকেরে বুক ভরে যায় তার গপ্প শুনে। আব্বা কয়, দেশের জন্য যুদ্ধ করিচি বাবারা। তোমরাও দেশেক ভালোবাসো।'
মুক্তিযুদ্ধের সময় ২২-২৩ বছরের টগবগে যুবক ছিলেন মোসলেম উদ্দিন। বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। বাবার নাম রহিম উদ্দিন প্রামাণিক। পড়ালেখা খুব একটা করেননি। সে সময় ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজও করতেন। একদিন গরু বিক্রি করতে নারুয়ামালা হাটে যান। একসময় তিনি লক্ষ করেন চলন্ত ট্রেন থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলিবর্ষণ করছে। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যায়। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সেখানেই মোসলেম উদ্দিন প্রতিজ্ঞা করেন এভাবে বসে থেকে আর নয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। বাড়ি ফিরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেন। অনেকেই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। মোসলেম উদ্দিনসহ ২৫-২৬ জনের একটি দল প্রশিক্ষণ নিতে চলে যায় ভারতে। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেয় ৭ নম্বর সেক্টরে। গ্রুপ কমান্ডার সোনাতলার চরপাড়া গ্রামের আবদুল ওয়ারেসের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন তিনি। বগুড়ার ভেলুরপাড়ায় হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন মোসলেম ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
No comments