কচিকাঁচার মেলার দাদাভাই by স ম শামসুল আলম
দেশের প্রথিতযশা শিশুসাহিত্যিক, শিশু সংগঠক ও সাংবাদিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের আজ ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি দিনটি। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ছিলেন একটি ছায়াবৃক্ষ।
এই বিশাল বৃক্ষের বিস্তৃত ছায়ায় দীর্ঘ বিশ্রাম নিতে পেরে অনেকে ধন্য হয়েছেন। কেউ কেউ নিজেকেই একটি বৃক্ষরূপে দাঁড় করাতে পেরেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে দাদাভাই পরিচালিত কচিকাঁচার মেলা নামক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে। এই মেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল শিশুই আদর্শের মূলমন্ত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে। দাদাভাই নিরলস পরিশ্রম করে ৪২ বছর ধরে কচিকাঁচার মেলার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হিসেবে রোকনুজ্জামান খানের পরিচিতি বড় নাকি ছড়াকার হিসেবে? দৈনিক ইত্তেফাকের ফিচার সম্পাদক ও কচিকাঁচার আসরের পরিচালক হিসেবে যে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি, সেটাকেই-বা কতটুকু খাটো করে দেখতে পারি? এত গুণের অধিকারী দাদাভাইকে নিয়ে আরও দুটি বিষয়ে আমাকে অবাক হতে হয়। প্রথমত, আমি, আমার মা, স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে উভয়েই তাঁকে 'দাদাভাই' ডেকেছি (একটি পরিবারের সবাই একই ব্যক্তিকে একই সম্বোধন করার মতো আশ্চর্যের আর কী আছে!)। দ্বিতীয়ত, এ দেশের একটি শিশুকে প্রথমেই যে ছড়াটি শেখানো হয় তা হলো_ 'বাক বাকুম পায়রা/মাথায় দিয়ে টায়রা' (এ থেকে বোঝা যায় কবি-ছড়াকার হিসেবে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, কিন্তু কেউ-ই বাক বাকুম পায়রাকে অতিক্রম করতে পারেননি)।
দাদাভাইকে অতি কাছ থেকে দেখেছি। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি তার সততা, ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাস দেখে। সম্পাদক হিসেবে কোনো লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি প্রতিটি বাক্যই নয়, প্রতিটি শব্দের প্রতিও যত্নশীল ছিলেন। নিজের মনের মতো করে লেখা ছেপেছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের যত্ন, একটি শিশুর যত্ন এবং একটি সংসারের যত্ন তার কাছে ছিল সমান। সবক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান। তিনি ছড়া লেখা অব্যাহত রাখলে বাংলাভাষায় মানসম্মত ছড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেত, আমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ছড়া লেখার চেয়ে লেখক তৈরি করার দায়িত্বটাও কম কিসে? কাউকে না কাউকে এমন দায়িত্ব নিতেই হয়। দাদাভাই কখনও পুরস্কারের লোভ করেননি এবং নিজেকে প্রচারের ব্যাপারে হৈচৈয়ের মধ্যে থাকেননি। তিনি একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৯৮ সালে। অবশ্য শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে। দাদাভাইয়ের লেখার পরিমাণ কম হলেও তিনি ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে 'দাদাভাই-এর কথা' শিরোনামে যে চিঠিগুলো লিখেছেন তা দিয়েও হতে পারে একটি গ্রন্থ।
দাদাভাই প্রায়ই জোর দিয়ে একটি কথা বলেছেন, তার সংগঠন থেকে কোনো অসৎ বা চোরাচালানি লোক গড়ে ওঠেনি, ড্রাগ অ্যাডিকটেড কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এক সময় কচিকাঁচার মেলার সদস্য ছিল।
দাদাভাইকে নিয়ে অসংখ্য ছড়া-কবিতা রচিত হয়েছে, তার প্রতি কবিদের ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে সেসব ছড়া-কবিতায়। মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রপত্রিকায়। এ থেকে বোঝা যায় তিনি যে ভালোবাসা বিলিয়েছিলেন তা ছিল শুধুই অর্জন।
মানুষ হিসেবে দাদাভাই কেমন ছিলেন, যারা তার সঙ্গে মিশেছেন বা ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করেছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। এমন সৌভাগ্য আমারও হয়েছে, তবে কারও ৪২ বছর আর আমার মাত্র ৬ বছর। এই ৬ বছরে যতটুকু জেনেছি, শুধু বড়মনের মানুষই নয়, বর্ণনা দিতে পারব না দাদাভাই মানুষ হিসেবে কতটা মহৎ, কতটা পরিশ্রমী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন।
এই বড়মাপের মানুষটি আজ নেই। এরকম দু'একজন মানুষ এখন বাংলাদেশের বড় প্রয়োজন।
samo.alam@gmail.com
এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হিসেবে রোকনুজ্জামান খানের পরিচিতি বড় নাকি ছড়াকার হিসেবে? দৈনিক ইত্তেফাকের ফিচার সম্পাদক ও কচিকাঁচার আসরের পরিচালক হিসেবে যে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি, সেটাকেই-বা কতটুকু খাটো করে দেখতে পারি? এত গুণের অধিকারী দাদাভাইকে নিয়ে আরও দুটি বিষয়ে আমাকে অবাক হতে হয়। প্রথমত, আমি, আমার মা, স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে উভয়েই তাঁকে 'দাদাভাই' ডেকেছি (একটি পরিবারের সবাই একই ব্যক্তিকে একই সম্বোধন করার মতো আশ্চর্যের আর কী আছে!)। দ্বিতীয়ত, এ দেশের একটি শিশুকে প্রথমেই যে ছড়াটি শেখানো হয় তা হলো_ 'বাক বাকুম পায়রা/মাথায় দিয়ে টায়রা' (এ থেকে বোঝা যায় কবি-ছড়াকার হিসেবে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, কিন্তু কেউ-ই বাক বাকুম পায়রাকে অতিক্রম করতে পারেননি)।
দাদাভাইকে অতি কাছ থেকে দেখেছি। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি তার সততা, ব্যক্তিত্ব আর আত্মবিশ্বাস দেখে। সম্পাদক হিসেবে কোনো লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি প্রতিটি বাক্যই নয়, প্রতিটি শব্দের প্রতিও যত্নশীল ছিলেন। নিজের মনের মতো করে লেখা ছেপেছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের যত্ন, একটি শিশুর যত্ন এবং একটি সংসারের যত্ন তার কাছে ছিল সমান। সবক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান। তিনি ছড়া লেখা অব্যাহত রাখলে বাংলাভাষায় মানসম্মত ছড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেত, আমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ছড়া লেখার চেয়ে লেখক তৈরি করার দায়িত্বটাও কম কিসে? কাউকে না কাউকে এমন দায়িত্ব নিতেই হয়। দাদাভাই কখনও পুরস্কারের লোভ করেননি এবং নিজেকে প্রচারের ব্যাপারে হৈচৈয়ের মধ্যে থাকেননি। তিনি একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৯৮ সালে। অবশ্য শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে। দাদাভাইয়ের লেখার পরিমাণ কম হলেও তিনি ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে 'দাদাভাই-এর কথা' শিরোনামে যে চিঠিগুলো লিখেছেন তা দিয়েও হতে পারে একটি গ্রন্থ।
দাদাভাই প্রায়ই জোর দিয়ে একটি কথা বলেছেন, তার সংগঠন থেকে কোনো অসৎ বা চোরাচালানি লোক গড়ে ওঠেনি, ড্রাগ অ্যাডিকটেড কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এক সময় কচিকাঁচার মেলার সদস্য ছিল।
দাদাভাইকে নিয়ে অসংখ্য ছড়া-কবিতা রচিত হয়েছে, তার প্রতি কবিদের ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে সেসব ছড়া-কবিতায়। মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রপত্রিকায়। এ থেকে বোঝা যায় তিনি যে ভালোবাসা বিলিয়েছিলেন তা ছিল শুধুই অর্জন।
মানুষ হিসেবে দাদাভাই কেমন ছিলেন, যারা তার সঙ্গে মিশেছেন বা ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করেছেন তারা ভালো বলতে পারবেন। এমন সৌভাগ্য আমারও হয়েছে, তবে কারও ৪২ বছর আর আমার মাত্র ৬ বছর। এই ৬ বছরে যতটুকু জেনেছি, শুধু বড়মনের মানুষই নয়, বর্ণনা দিতে পারব না দাদাভাই মানুষ হিসেবে কতটা মহৎ, কতটা পরিশ্রমী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন।
এই বড়মাপের মানুষটি আজ নেই। এরকম দু'একজন মানুষ এখন বাংলাদেশের বড় প্রয়োজন।
samo.alam@gmail.com
No comments