প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও করণীয় by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি উদ্যাপন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মতভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ অনুমোদন করা হয়।
৩ মে, ২০০৮ তারিখে সনদটি একটি আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে বিশ্বব্যাপী বলবৎ হয়। বাংলাদেশ অগ্রণী রাষ্ট্র হিসেবে এই সনদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানিয়ে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থন প্রদান করে। এর আগে বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন প্রণয়ন করে এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশে এ দিবসটির গুরুত্ব বেড়ে যায়। সরকার প্রতিবন্ধীদের কল্যাণকে সামনে রেখে তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ ও আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে বিধান রেখে একটি আইন প্রণয়ন করে। সে আইনে প্রতিবন্ধী বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি জন্মগতভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে বা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায় বা অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও ওই রূপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার কারণে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম। এই সংজ্ঞার আলোকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও মানসিক প্রতিবন্ধী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু 'শিশু প্রতিবন্ধী' আলাদা হিসেবে বিবেচনা করা না হলেও সংশোধিত-২০১০ সালের বাংলাদেশ শিশু আইনে যারা শিশু হিসেবে বিবেচিত, তাদের শিশু প্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাদের কল্যাণে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও সমাজে অন্য শিশুদের মতো প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষিত, দক্ষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা কম নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধী। কিন্তু অন্যান্য দেশের মতো এ দেশের প্রতিবন্ধীরাও বছরের পর বছর সুবিধাবঞ্চিত ও অসুবিধাগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তারা তাদের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং অনেকের কাছে ঘৃণার পাত্র। তাদের প্রতিদিনকার জীবন ভয় ও অন্যদের কাছে কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। অনেকে মনে করে, সংসারে প্রতিবন্ধী শিশু একধরনের অভিশাপ। প্রতিবন্ধীরা একদিকে যেমন সমাজ কর্তৃক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নিজ পরিবারের সদস্য কর্তৃক অবহেলার পাত্র, বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীদের বঞ্চনা ও বৈষম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। কখনো কখনো অভিভাবকরা প্রতিবন্ধী শিশু থাকায় লজ্জা অনুভব করেন এবং সমাজ কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাকে প্রদর্শনেও অনীহা প্রকাশ করেন। অহরহ প্রতিবন্ধীদের অর্থনৈতিক বোঝা মনে করা হয় এবং তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
বিদ্যমান আইনের বিশেষ ধারায় প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে বিশেষায়িত প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দান, তাদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ক্ষেত্রমতো বিশেষ পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর ব্যবস্থা করা হয়। অনধিক ১৮ বছর বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টিসহ তাদের বিনা মূল্যে বা সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক শ্রেণীকক্ষে অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রতিবন্ধীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক বা অন্যান্য কর্মীকে প্রশিক্ষণদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা। প্রতিবন্ধীদের জীবনধারা ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজ পরিচিতি বিষয়ক পাঠপুস্তকে যথাযথ প্রবন্ধ ও আনুষঙ্গিক বিষয় সংযোজনের ব্যবস্থা করা এবং শিশু প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা করা। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষালাভের জন্য উপরিউক্ত ব্যবস্থা আইনে বলা থাকলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী শিশুরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুুবিধা পায় না। অনেক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করানো হয় না। শিক্ষা একটি মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষাগ্রহণে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজসচেতন মানুষসহ শিক্ষা কাণ্ডারি হিসেবে শিক্ষকদের ভূমিকা অন্যতম।
প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ তুলনামূলকভাবে সমাজের অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গ এসে যায়। শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক ও সুন্দরভাবে শিক্ষাদানের জন্য দায়বদ্ধ। আইনে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটি যথাযথভাবে পালনের জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দায়িত্বশীল, নিয়মানুবর্তী ও সচেতন। তাঁদের প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠদান, তাদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ সোবাদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দায়িত্ববোধও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেতনভুক একজন ব্যক্তি হিসেবে নয়, সমাজের একজন মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেও প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার ভালোমন্দের খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন। শুধু নির্দিষ্ট দায়িত্বটুকু নয়, পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, এর বাইরেও কখনো কখনো দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ধরনের মনোভাব আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে নিবিষ্ট করতে হবে এবং তা অনুশীলনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neazahmed_2002@yahoo.com
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধী। কিন্তু অন্যান্য দেশের মতো এ দেশের প্রতিবন্ধীরাও বছরের পর বছর সুবিধাবঞ্চিত ও অসুবিধাগ্রস্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তারা তাদের মৌলিক চাহিদা ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং অনেকের কাছে ঘৃণার পাত্র। তাদের প্রতিদিনকার জীবন ভয় ও অন্যদের কাছে কুসংস্কারে পরিপূর্ণ। অনেকে মনে করে, সংসারে প্রতিবন্ধী শিশু একধরনের অভিশাপ। প্রতিবন্ধীরা একদিকে যেমন সমাজ কর্তৃক বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে নিজ পরিবারের সদস্য কর্তৃক অবহেলার পাত্র, বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীদের বঞ্চনা ও বৈষম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। কখনো কখনো অভিভাবকরা প্রতিবন্ধী শিশু থাকায় লজ্জা অনুভব করেন এবং সমাজ কিংবা আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাকে প্রদর্শনেও অনীহা প্রকাশ করেন। অহরহ প্রতিবন্ধীদের অর্থনৈতিক বোঝা মনে করা হয় এবং তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করা হয়, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে।
বিদ্যমান আইনের বিশেষ ধারায় প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে বিশেষায়িত প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দান, তাদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ক্ষেত্রমতো বিশেষ পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর ব্যবস্থা করা হয়। অনধিক ১৮ বছর বয়স্ক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনা বেতনে শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টিসহ তাদের বিনা মূল্যে বা সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক শ্রেণীকক্ষে অধ্যয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রতিবন্ধীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কর্মসূচি গ্রহণ করা এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক বা অন্যান্য কর্মীকে প্রশিক্ষণদানের কর্মসূচি গ্রহণ করা। প্রতিবন্ধীদের জীবনধারা ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজ পরিচিতি বিষয়ক পাঠপুস্তকে যথাযথ প্রবন্ধ ও আনুষঙ্গিক বিষয় সংযোজনের ব্যবস্থা করা এবং শিশু প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা করা। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষালাভের জন্য উপরিউক্ত ব্যবস্থা আইনে বলা থাকলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী শিশুরা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুুবিধা পায় না। অনেক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তি করানো হয় না। শিক্ষা একটি মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে বিবেচিত হলেও বাস্তবে প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষাগ্রহণে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগের পাশাপাশি সমাজসচেতন মানুষসহ শিক্ষা কাণ্ডারি হিসেবে শিক্ষকদের ভূমিকা অন্যতম।
প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ তুলনামূলকভাবে সমাজের অন্য ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গ এসে যায়। শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন দ্বারা প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক ও সুন্দরভাবে শিক্ষাদানের জন্য দায়বদ্ধ। আইনে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে, তার প্রতিটি যথাযথভাবে পালনের জন্য শিক্ষকদের হতে হবে দায়িত্বশীল, নিয়মানুবর্তী ও সচেতন। তাঁদের প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধী শিশুদের পাঠদান, তাদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ সোবাদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ থেকে এ দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দায়িত্ববোধও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বেতনভুক একজন ব্যক্তি হিসেবে নয়, সমাজের একজন মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেও প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি সদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার ভালোমন্দের খোঁজখবর নেওয়া প্রয়োজন। শুধু নির্দিষ্ট দায়িত্বটুকু নয়, পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, এর বাইরেও কখনো কখনো দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ধরনের মনোভাব আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে নিবিষ্ট করতে হবে এবং তা অনুশীলনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments