শিক্ষা-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কতিপয় তালেব মাস্টার by তুহিন ওয়াদুদ

তালেব মাস্টার ৪০ বছর পাঠশালায় পড়িয়েছেন। পিঠ তার বেঁকে গেছে, চোখেও আর ভালো দেখেন না। তার ছাত্র ব্যারিস্টার হয়েছে, অনেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু তার বেতন দশ টাকার বেশি হয়নি
বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় যারা পাঠদান করেন তাদের সবাইকে দিনের পর দিন একটি মনোবেদনা লালন করতে হয়। যে পদে চাকরিতে যোগদান, অনেককে সেই পদে থেকেই অবসরে যেতে হয়। এর চেয়ে চাকরি জীবনে আর বড় কষ্ট কী থাকতে পারে! কলেজ শিক্ষকদের সাতজনের মধ্যে দু'জন জীবনে একবার পদোন্নতির সুযোগ পান। বাকিরা পান না। পদোন্নতি না পেলে সারাজীবনে চাকরির বয়স আট বছর হলে একবার টাইম স্কেল পান। সেই টাইম স্কেলের জন্য বেসরকারি কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষকরা অপেক্ষা করে থাকেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শিক্ষকদের জন্য টাইম স্কেল ঘোষণা শেষে আবার যখন তা বন্ধ করে দেওয়া হলো সেটি কতখানি নির্মম যে সরকার কি তা একবারও ভেবেছে?
ছয় বছর বন্ধ থাকার পর সুবিধা এবং অধিকারবঞ্চিত শিক্ষকদের গত বছরের অক্টোবরে এক হাজার আটশ' শিক্ষককে টাইম স্কেল দেওয়া হয়। তারা সেই সুবিধা পেতেও শুরু করেছেন। জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারী নন বিধাই তারা টাইম স্কেল পেতে পারেন না বলে দেওয়া বার্তা অনুযায়ী এক হাজার আটশ' শিক্ষকের টাইম স্কেলের বর্ধিত বেতন বন্ধ হয়ে যায়। এখন নিশ্চয় তাদের অবৈধভাবে গৃহীত অর্থ ফেরত দিতে হবে। তাই যদি হয় তাহলে ছয় বছর আগে যারা টাইম স্কেল পেয়েছেন তাদেরও প্রাপ্ত অর্থ অবৈধ। তাদের অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য আরেকটি প্রজ্ঞাপনের ভয়ে নিশ্চয় ওই সুবিধাভোগীরাও প্রহর গুনছেন। যাদের চাকরি এখনও আট বছর হয়নি তারা ভাবতে শুরু করেছেন, আমরা বুঝি আর কোনোদিন টাইম স্কেল পাব না।
বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি সরকারের নির্মম আচরণ সবসময়ই পীড়াদায়ক। স্বল্প বেতনে চাকরি। এক মাসের বেতন আরেক মাসে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেতন বাড়বে না, তিনবেলার খাবার দু'বেলা খেয়ে শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা, তার উপর স্বপ্নের সোনার হরিণ টাইম স্কেল হাতে দিয়ে আবার ফেরত নেওয়া। তবে শিক্ষক হওয়াটা কি পূর্ব জন্মের কোনো অপরাধের শাস্তি? এই কি তবে আদর্শ পেশা! ভূলুণ্ঠিত আদর্শ! চাকরির প্রতি ভালোবাসা তৈরির পরিবর্তে সরকার কি বিদ্বেষের বীজ রোপণ করে দিতে চায়? শিক্ষকদের শুধু টাইম স্কেল নয়, তাদের প্রতি মাসের প্রথম কার্যদিবসে বেতনের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন, আনুপাতিক হারে নয়, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর যোগ্যতার পরীক্ষা নিয়ে সবাইকে পদোন্নতির সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন, বাড়িভাড়া ও মেডিকেল ভাতার নামে যে প্রহসন করা হয়েছে তা বন্ধ করে সম্মানজনক বাড়িভাড়া ও মেডিকেল ভাতা দেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষদের আন্দোলন করতে হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কী মনে করে তাও ভাবা দরকার। ১ জুনের মধ্যে শিক্ষকদের দাবি না মানলে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যৌক্তিকভাবে শিক্ষকদের টাইম স্কেল প্রদান বহাল রাখা প্রয়োজন। যদি শিক্ষকদের টাইম স্কেল পাওয়ার অধিকার বৈধ হয় তাহলে প্রজ্ঞাপন জারিকারীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। যারা সরকারকে প্রকৃত অর্থে সহযোগিতা করতে চায় না তারাই এসব বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে দেশের আপামর জনগণ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে অনেক ভালো কাজ করেছে এবং আরও ভালো কাজের উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিতর্কিত হোক_ এটি আমাদের প্রত্যাশা নয়। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নামে গত বছর একটি বিতর্ক উঠেছিল। এবারে বেসরকারি শিক্ষকদের টাইম স্কেল নিয়ে বিতর্ক। যত দ্রুত সমাধান করা যায় ততই ভালো। কাল বিলম্ব করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না।
বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষকদের প্রতি সরকারের আচরণ দেখে আশরাফ সিদ্দিকীর 'তালেব মাস্টার' কবিতার কথা মনে পড়ল। তালেব মাস্টার ৪০ বছর পাঠশালায় পড়িয়েছেন। পিঠ তার বেঁকে গেছে, চোখেও আর ভালো দেখেন না। তার ছাত্র ব্যারিস্টার হয়েছে, অনেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কিন্তু তার বেতন দশ টাকার বেশি হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভেবেছেন, তার বুঝি সুদিন আসবে। তার সুদিন আসেনি। অর্থাভাবে একমাত্র ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে। শুধু তাই নয়, কলেরায় মারা যাওয়ার পর তার ২২ বছরের ছেলের কাফন কেনার টাকা ছিল না বলে বিনা কাফনে লাশ দাফন করা হয়। কয়েক মাস তার বেতন বন্ধ থাকার কারণে তিনি ভাবেন, মারা যাওয়ার আগে আর বুঝি বেতন পাবেন না। তবুও তিনি ছাত্রদের প্রাণপণ শেখান_ 'সব ধনের সার বিদ্যা মহাধন।'
তালেব মাস্টারের এ বাস্তবতা ছিল ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত হওয়ার সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি। স্বাধীন বাংলাদেশেও কি আমাদের শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না? আমাদের শিক্ষকরা কি একেকজন তালেব মাস্টার হয়ে থাকবেন?

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.