অপেক্ষা শেষে উৎসবের দেশ by নোমান মোহাম্মদ
পরতে পরতে চোখ রাঙাচ্ছিল পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা। হলো প্রায়শ্চিত্ত। ২২ মার্চের দুঃস্বপ্ন ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন ক্রিকেট দেবতা বেছে নিলেন ৮ ডিসেম্বরকে। তাতে হয়তো এশিয়া কাপ ফাইনালে হারের ক্ষতে প্রলেপ পড়ল খানিকটা।
পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারের পর আরেকটি 'ফাইনাল'-এ যে কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই ২ উইকেটের জয়!
সেদিনও অমন আবেগে থরথর কাঁপছিল বাংলাদেশ। টইটম্বুর স্টেডিয়ামের হাজার পঁচিশেক দর্শকের সঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিল ১৬ কোটি জনতা। নিত্যদিনের টানাপড়েন, নুন আনতে পানতা ফুরানোর হাহাকার, যানজট-দুর্নীতি-রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব একপাশে সরিয়ে রেখে ক্রিকেটে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল গোটা দেশ; এক দিন, মাত্র একটি দিনের জন্য 'রাজা' হওয়ার প্রত্যাশায়। নিষ্ঠুর ক্রিকেট দেবতা সেটি হতে দেননি। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে সেই হার তাই হয়ে যায় এ দেশের চিরন্তন ট্র্যাজেডিগাথা।
কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি ফাইনাল ছিল না। কিন্তু কম কিছুও ছিল কি! প্রথম দুই ম্যাচ জয়ের পর দুই ম্যাচে হার- পঞ্চম ওয়ানডে তখন অলিখিত ফাইনাল হয়ে যায় এমনিতেই। সেখানে সব আশা, সব প্রত্যাশা নেমে আসে মাঠের ১১ ক্রিকেটযোদ্ধার কাঁধে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কাল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে তবু, যদিও মন পড়ে ছিল স্টেডিয়ামে। চোখ তাদের টেলিভিশনে, কান রেডিওতে। এশিয়া কাপের ফাইনালের দুঃস্বপ্ন তাড়াতে হবে না!
হলো। নাটকের চেয়েও নাটকীয়তায়। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ম্যাচের রং পাল্টেছে বহুবার। কিন্তু শেষটা যেমনভাবে, তেমনটি হয়তো সোয়া শ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে হয়নি কখনো। জয়ের সঙ্গে তখন মাত্র এক রানের দূরত্বে স্বাগতিকরা। আন্দ্রে রাসেলের বল নাসির হোসেন ৩০ গজের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে মারলে জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। ডাগআউট থেকে ছুটে যান সতীর্থরা। কিন্তু বলটি বাউন্ডারির ওপারে যায়নি, আর নন-স্ট্রাইকে থাকা ইলিয়াস সানিও রান পূর্ণ করেননি। উল্টো ফেরত আসা বলে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে তাঁর রান আউটের দাবি তোলেন ক্যারিবিয়ানরা। সানি ততক্ষণে ক্রিজে ফেরার কারণে সেটি হয়নি। অপেক্ষাটা আরেকটু বেড়েছে কেবল। পরের বলে নাসির একই শট খেলে অবসান ঘটান সেই অপেক্ষার। অবিস্মরণীয় জয়ের আনন্দে পাগলপারা পুরো দেশ।
দুই উইকেটের এই জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ৩-২ ব্যবধানে জিতে নিল বাংলাদেশ। বছর দুয়েক আগে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের অভিন্ন মঞ্চে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার সঙ্গেই কেবল তুলনীয় হতে পারে এই কীর্তি। এ ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয় বলতে যে খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একবার আর জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া-আয়ারল্যান্ডের মতো দলগুলোর বিপক্ষে বারকয়েক।
এবারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ তেমন দল নয়। রীতিমতো পূর্ণশক্তির। আর সদ্যই টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে আসায় আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। প্রথম দুই ওয়ানডেতে হারের পর তারা ভড়কে যায়নি। বরং পরের দুই ম্যাচে জিতে সিরিজে ফেরে দাপটের সঙ্গে। সিরিজে যেমন, কালকের ম্যাচেও তেমনি ছিল তাঁতের মাকুর দুলুনি। কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়েছে নিয়মিত বিরতিতে। কিন্তু হেমন্তের কুয়াশাভেজা রাতে ১০টা ২৫ মিনিট চূড়ান্তভাবে তা এসে গেল বাংলাদেশের মুঠোয়। মুঠোবন্দি হলো ইতিহাসও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজ জয় যে বাংলাদেশের ক্রিকেট সামর্থ্যের এক স্মারক হয়ে রইল; অনাগত ভবিষ্যতের কুঠুরিতে।
কাল পরে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের লক্ষ্যটা ছিল আগের দিনের মতোই। ২১৮ রানের পিছু তাড়া করতে নেমে চতুর্থ ম্যাচের বিভীষিকাও অবশ্য আসছিল ফিরে ফিরে। কেমার রোচ প্রথম ওভারে তামিম ইকবালকে রীতিমতো ঘোল খাওয়ালেন। পরের ওভারে উড়িয়েই দিলেন স্ট্যাম্প। প্রথম ওয়ানডেতে ফিফটি করার পর ৫, ২২ ও ১ রানের ধারাবাহিকতায় তামিম কাল ফিরলেন ৮ রানে। একই ওভারে গেলেন দ্বিতীয় ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান এনামুল হক (০)। আর নাঈম ইসলামের পরিবর্তে একাদশে ঢোকা জহুরুল ইসলামকে (১০) যখন ফেরালেন রোচ, ৩০ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন রীতিমতো কাঁপছে।
তবে আগের দিনের ১৩ রানে পাঁচ উইকেট হারানোর চেয়ে তো সেটি ঢের ভালো। আরো ভালো হলো ইনফর্ম মাহমুদ উল্লাহকে ব্যাটিং অর্ডারে ওপরে উঠিয়ে আনার সিদ্ধান্ত। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভাঙা তরীকে তীরে ফেরানোর পথ দেখালেন অধিনায়ক-সহঅধিনায়কই। যথার্থ পাঞ্জেরির মতো। শুধু উইকেট আঁকড়ে পড়ে না থেকে তাঁরা হেনেছেন পাল্টা আঘাত। তবে সেটি এলোপাতাড়ি ব্যাটিংয়ে নয়, সাহসী সুন্দরের উদ্ভাসিত প্রকাশে। মাহমুদের কাভার ড্রাইভে তাই ফিরে আসছিল বিশ্বাস। মুশফিকের কাট-পুলে ভেসে আসছিল জয়ের সুবাতাস। গ্যালারির করতালির স্পন্দনে তখন ঘোষিত হচ্ছিল আগাম জয়বার্তা।
মাত্র ১২.৪ ওভারে ৯১ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশ-ক্যাম্পে স্বস্তি নিয়ে আসেন মুশফিক (৪৪) ও মাহমুদ (৪৮)। ২১ বলের মধ্যে সুনীল নারিন দুজনকে আউট করলে অস্বস্তির নড়াচড়া দিয়ে ওঠা আবার। আর তরুণ মমিনুল হক যখন ক্রিজে নেমে মাত্র তৃতীয় বলে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান, পুরো দেশের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি তখন বেড়ে যায় বহুগুণ। কিন্তু সেটি ছিল কেবলই মহান খেলাটির মহা অনিশ্চয়তার নমুনা মাত্র! কারণ এরপর নাসির-মমিনুলের ৫৩ রানের জুটিতে যে আবারও জয়ের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারি থেকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। মমিনুল আউট হলেও নাসির-সোহাগের ২৮ রানের জুটিতে জয়োল্লাস শুরু করে দেয় বাংলাদেশ। জয়ের সঙ্গে ৪ রান দূরত্বে সোহাগের আউট? কিংবা ওই শেষ সময়ের বাউন্ডারি-রানআউটজনিত জটিলতা? সেটি কেবল বাংলাদেশকে অনিশ্চয়তার ভেলায় ভাসিয়ে রোমাঞ্চটা আরো বহগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই!
রোমাঞ্চের আবাহন ছিল ম্যাচের শুরু থেকেই। সিরিজ-পূর্ব আবহ থেকে শুরু করে সিরিজজুড়ে বাংলাদেশের আতঙ্ক হয়ে ছিলেন ক্রিস গেইল। সেটি কাগজ-কলমেই। ক্রিজে গিয়ে কখনোই যে আতঙ্ক ছড়াতে পারেননি। পারলেন না কালও। ওয়ানডে সিরিজে আগের চার ম্যাচে ৩৫, ১৫, ৪ ও ১৬-র ধারাবাহিকতায় গেইল কাল ফিরলেন মাত্র ২ রান করে। ইনজুরির কারণে বিশ্রাম দেওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজার জায়গায় সুযোগ পাওয়া শফিউল ইসলাম তাঁর হন্তারক।
গেইলের আউটের ঠিক আগে-পরে বাংলাদেশ যে বোলিং করেছে, সেটি অবিশ্বাস্য! ৩ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল এক উইকেটে ১৭। ৮ ওভার শেষেও স্কোরবোর্ডে রানের ঘরে পরিবর্তন নেই। টানা পাঁচ ওভার মেডেন! গেইলের আউটের আগে মারলন স্যামুয়েলসকে মিড অন থেকে সরাসরি থ্রোতে রানআউট করেন মাহমুদ উল্লাহ। এরপর বিধ্বংসী ওই ওপেনারের আউট। ম্যাচে তখন কেবলই বাংলাদেশ। ৮ ওভারে ৩ উইকেটে ১৭ রান ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
এরপর কিয়েরন পোলার্ড নেমে শুরু করেন দানবীয় ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী। প্রথম ছয় বলে রান নেই, সপ্তম বলে প্রথম স্কোরিং শটটিই ছক্কা। পরের ১০ বলে মাত্র ২ রান, এরপর ইলিয়াস সানিকে পর পর দুই বলে ছক্কা। খুলনার প্রথম ওয়ানডের শেষে ঢাকায় বল পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশি বোলারদের হেলাফেলা কম করেননি। তবে কাল ঠিকই আসুরিক শক্তিতে অনায়াসে বলের পর বল আছড়ে ফেলেছেন মাঠের বাইরে। নিজের ষষ্ঠ ছক্কায় পূর্ণ করেছেন হাফ সেঞ্চুরি, পরের বলেই হয়ে যায় সপ্তমটি।
পোলার্ডের খুনে ব্যাটিংয়ের পরিপূরক হয়ে ছিল ড্যারেন ব্রাভোর ধৈর্যশীল ইনিংসটি। ১৭ রানে তিন উইকেট পড়ার পর ২৪.৩ ওভারে ১৩২ রানের জুটি গড়েন দুজন। ৩০ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ৩ উইকেটে ১৪৫। ২৭০-২৮০ রানের চোখরাঙানি তখন। কিন্তু মমিনুল হকের বাঁহাতি স্পিনের ফাটকায় দারুণভাবে জিতে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ম্যাচে ফেরান বাংলাদেশকে। পোলার্ডকে (৮৫) বোল্ড করার পর আগের খেলার ম্যাচসেরা ড্যারেন সামিকেও (২) ফেরান তিনি।
এর পরও আড়াই শ হওয়াটা ছিল খুব সম্ভব। শেষ ১০ ওভারে যে পাঁচ উইকেট হাতে নিয়ে ঢুকেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, রান ১৮৮। আগের খেলায় চার উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ১০ ওভারে ৮১ রান যোগ করেছিল ক্যারিবীয়রা। কাল নির্ধারিত ওভারের দুই ওভার আগেই অলআউট, স্কোরবোর্ডে আর মোটে ২৯ রান যোগ করে। পৌনে ৩০০ পেরিয়ে যাওয়ার হুংকার দেওয়া ক্যারিবীয় ইনিংস তাই থেমে যায় মাত্র ২১৭ রানে। পোলার্ডের ইনিংসটি বাদ দিলে সেটি আরো করুণ। এই হার্ডহিটার ৭৪ বলে করেছেন ৮৫। আর বাকি ১০ ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান মুখোমুখি হওয়া ২১৪ বলে করেছেন ১১৪! একসময় সেটিকেই অবশ্য মনে হচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু লাল-সবুজের ১১ জন ক্রিকেটসৈনিক ভুল প্রমাণ করে ছাড়েন তা।
দেবতাদের নাকি কোনো পাপ হয় না! তবে কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২ উইকেটের জয়ে এশিয়া কাপ ফাইনালে ২ রানে হারের 'পাপমোচন'ই করলেন যেন ক্রিকেট দেবতা! অবশেষে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৪৮ ওভারে ২১৭
বাংলাদেশ : ৪৪ ওভারে ২২১/৮
ফল : বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
সিরিজের ফল : বাংলাদেশ ৩-২ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মাহমুদ উল্লাহ
ম্যান অব দ্য সিরিজ : মুশফিকুর রহিম
সেদিনও অমন আবেগে থরথর কাঁপছিল বাংলাদেশ। টইটম্বুর স্টেডিয়ামের হাজার পঁচিশেক দর্শকের সঙ্গে প্রার্থনায় বসেছিল ১৬ কোটি জনতা। নিত্যদিনের টানাপড়েন, নুন আনতে পানতা ফুরানোর হাহাকার, যানজট-দুর্নীতি-রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব একপাশে সরিয়ে রেখে ক্রিকেটে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল গোটা দেশ; এক দিন, মাত্র একটি দিনের জন্য 'রাজা' হওয়ার প্রত্যাশায়। নিষ্ঠুর ক্রিকেট দেবতা সেটি হতে দেননি। ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে সেই হার তাই হয়ে যায় এ দেশের চিরন্তন ট্র্যাজেডিগাথা।
কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচটি ফাইনাল ছিল না। কিন্তু কম কিছুও ছিল কি! প্রথম দুই ম্যাচ জয়ের পর দুই ম্যাচে হার- পঞ্চম ওয়ানডে তখন অলিখিত ফাইনাল হয়ে যায় এমনিতেই। সেখানে সব আশা, সব প্রত্যাশা নেমে আসে মাঠের ১১ ক্রিকেটযোদ্ধার কাঁধে। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ কাল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে তবু, যদিও মন পড়ে ছিল স্টেডিয়ামে। চোখ তাদের টেলিভিশনে, কান রেডিওতে। এশিয়া কাপের ফাইনালের দুঃস্বপ্ন তাড়াতে হবে না!
হলো। নাটকের চেয়েও নাটকীয়তায়। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ম্যাচের রং পাল্টেছে বহুবার। কিন্তু শেষটা যেমনভাবে, তেমনটি হয়তো সোয়া শ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে হয়নি কখনো। জয়ের সঙ্গে তখন মাত্র এক রানের দূরত্বে স্বাগতিকরা। আন্দ্রে রাসেলের বল নাসির হোসেন ৩০ গজের ওপর দিয়ে ভাসিয়ে মারলে জয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে পুরো বাংলাদেশ। ডাগআউট থেকে ছুটে যান সতীর্থরা। কিন্তু বলটি বাউন্ডারির ওপারে যায়নি, আর নন-স্ট্রাইকে থাকা ইলিয়াস সানিও রান পূর্ণ করেননি। উল্টো ফেরত আসা বলে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে তাঁর রান আউটের দাবি তোলেন ক্যারিবিয়ানরা। সানি ততক্ষণে ক্রিজে ফেরার কারণে সেটি হয়নি। অপেক্ষাটা আরেকটু বেড়েছে কেবল। পরের বলে নাসির একই শট খেলে অবসান ঘটান সেই অপেক্ষার। অবিস্মরণীয় জয়ের আনন্দে পাগলপারা পুরো দেশ।
দুই উইকেটের এই জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ৩-২ ব্যবধানে জিতে নিল বাংলাদেশ। বছর দুয়েক আগে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের অভিন্ন মঞ্চে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার সঙ্গেই কেবল তুলনীয় হতে পারে এই কীর্তি। এ ছাড়া বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ জয় বলতে যে খর্বশক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে একবার আর জিম্বাবুয়ে-কেনিয়া-আয়ারল্যান্ডের মতো দলগুলোর বিপক্ষে বারকয়েক।
এবারের ওয়েস্ট ইন্ডিজ তেমন দল নয়। রীতিমতো পূর্ণশক্তির। আর সদ্যই টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে আসায় আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। প্রথম দুই ওয়ানডেতে হারের পর তারা ভড়কে যায়নি। বরং পরের দুই ম্যাচে জিতে সিরিজে ফেরে দাপটের সঙ্গে। সিরিজে যেমন, কালকের ম্যাচেও তেমনি ছিল তাঁতের মাকুর দুলুনি। কখনো এদিকে, কখনো ওদিকে। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়েছে নিয়মিত বিরতিতে। কিন্তু হেমন্তের কুয়াশাভেজা রাতে ১০টা ২৫ মিনিট চূড়ান্তভাবে তা এসে গেল বাংলাদেশের মুঠোয়। মুঠোবন্দি হলো ইতিহাসও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজ জয় যে বাংলাদেশের ক্রিকেট সামর্থ্যের এক স্মারক হয়ে রইল; অনাগত ভবিষ্যতের কুঠুরিতে।
কাল পরে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের লক্ষ্যটা ছিল আগের দিনের মতোই। ২১৮ রানের পিছু তাড়া করতে নেমে চতুর্থ ম্যাচের বিভীষিকাও অবশ্য আসছিল ফিরে ফিরে। কেমার রোচ প্রথম ওভারে তামিম ইকবালকে রীতিমতো ঘোল খাওয়ালেন। পরের ওভারে উড়িয়েই দিলেন স্ট্যাম্প। প্রথম ওয়ানডেতে ফিফটি করার পর ৫, ২২ ও ১ রানের ধারাবাহিকতায় তামিম কাল ফিরলেন ৮ রানে। একই ওভারে গেলেন দ্বিতীয় ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান এনামুল হক (০)। আর নাঈম ইসলামের পরিবর্তে একাদশে ঢোকা জহুরুল ইসলামকে (১০) যখন ফেরালেন রোচ, ৩০ রানে তিন উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন রীতিমতো কাঁপছে।
তবে আগের দিনের ১৩ রানে পাঁচ উইকেট হারানোর চেয়ে তো সেটি ঢের ভালো। আরো ভালো হলো ইনফর্ম মাহমুদ উল্লাহকে ব্যাটিং অর্ডারে ওপরে উঠিয়ে আনার সিদ্ধান্ত। অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ভাঙা তরীকে তীরে ফেরানোর পথ দেখালেন অধিনায়ক-সহঅধিনায়কই। যথার্থ পাঞ্জেরির মতো। শুধু উইকেট আঁকড়ে পড়ে না থেকে তাঁরা হেনেছেন পাল্টা আঘাত। তবে সেটি এলোপাতাড়ি ব্যাটিংয়ে নয়, সাহসী সুন্দরের উদ্ভাসিত প্রকাশে। মাহমুদের কাভার ড্রাইভে তাই ফিরে আসছিল বিশ্বাস। মুশফিকের কাট-পুলে ভেসে আসছিল জয়ের সুবাতাস। গ্যালারির করতালির স্পন্দনে তখন ঘোষিত হচ্ছিল আগাম জয়বার্তা।
মাত্র ১২.৪ ওভারে ৯১ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশ-ক্যাম্পে স্বস্তি নিয়ে আসেন মুশফিক (৪৪) ও মাহমুদ (৪৮)। ২১ বলের মধ্যে সুনীল নারিন দুজনকে আউট করলে অস্বস্তির নড়াচড়া দিয়ে ওঠা আবার। আর তরুণ মমিনুল হক যখন ক্রিজে নেমে মাত্র তৃতীয় বলে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান, পুরো দেশের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি তখন বেড়ে যায় বহুগুণ। কিন্তু সেটি ছিল কেবলই মহান খেলাটির মহা অনিশ্চয়তার নমুনা মাত্র! কারণ এরপর নাসির-মমিনুলের ৫৩ রানের জুটিতে যে আবারও জয়ের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারি থেকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে। মমিনুল আউট হলেও নাসির-সোহাগের ২৮ রানের জুটিতে জয়োল্লাস শুরু করে দেয় বাংলাদেশ। জয়ের সঙ্গে ৪ রান দূরত্বে সোহাগের আউট? কিংবা ওই শেষ সময়ের বাউন্ডারি-রানআউটজনিত জটিলতা? সেটি কেবল বাংলাদেশকে অনিশ্চয়তার ভেলায় ভাসিয়ে রোমাঞ্চটা আরো বহগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই!
রোমাঞ্চের আবাহন ছিল ম্যাচের শুরু থেকেই। সিরিজ-পূর্ব আবহ থেকে শুরু করে সিরিজজুড়ে বাংলাদেশের আতঙ্ক হয়ে ছিলেন ক্রিস গেইল। সেটি কাগজ-কলমেই। ক্রিজে গিয়ে কখনোই যে আতঙ্ক ছড়াতে পারেননি। পারলেন না কালও। ওয়ানডে সিরিজে আগের চার ম্যাচে ৩৫, ১৫, ৪ ও ১৬-র ধারাবাহিকতায় গেইল কাল ফিরলেন মাত্র ২ রান করে। ইনজুরির কারণে বিশ্রাম দেওয়া মাশরাফি বিন মুর্তজার জায়গায় সুযোগ পাওয়া শফিউল ইসলাম তাঁর হন্তারক।
গেইলের আউটের ঠিক আগে-পরে বাংলাদেশ যে বোলিং করেছে, সেটি অবিশ্বাস্য! ৩ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল এক উইকেটে ১৭। ৮ ওভার শেষেও স্কোরবোর্ডে রানের ঘরে পরিবর্তন নেই। টানা পাঁচ ওভার মেডেন! গেইলের আউটের আগে মারলন স্যামুয়েলসকে মিড অন থেকে সরাসরি থ্রোতে রানআউট করেন মাহমুদ উল্লাহ। এরপর বিধ্বংসী ওই ওপেনারের আউট। ম্যাচে তখন কেবলই বাংলাদেশ। ৮ ওভারে ৩ উইকেটে ১৭ রান ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
এরপর কিয়েরন পোলার্ড নেমে শুরু করেন দানবীয় ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী। প্রথম ছয় বলে রান নেই, সপ্তম বলে প্রথম স্কোরিং শটটিই ছক্কা। পরের ১০ বলে মাত্র ২ রান, এরপর ইলিয়াস সানিকে পর পর দুই বলে ছক্কা। খুলনার প্রথম ওয়ানডের শেষে ঢাকায় বল পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশি বোলারদের হেলাফেলা কম করেননি। তবে কাল ঠিকই আসুরিক শক্তিতে অনায়াসে বলের পর বল আছড়ে ফেলেছেন মাঠের বাইরে। নিজের ষষ্ঠ ছক্কায় পূর্ণ করেছেন হাফ সেঞ্চুরি, পরের বলেই হয়ে যায় সপ্তমটি।
পোলার্ডের খুনে ব্যাটিংয়ের পরিপূরক হয়ে ছিল ড্যারেন ব্রাভোর ধৈর্যশীল ইনিংসটি। ১৭ রানে তিন উইকেট পড়ার পর ২৪.৩ ওভারে ১৩২ রানের জুটি গড়েন দুজন। ৩০ ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ৩ উইকেটে ১৪৫। ২৭০-২৮০ রানের চোখরাঙানি তখন। কিন্তু মমিনুল হকের বাঁহাতি স্পিনের ফাটকায় দারুণভাবে জিতে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ম্যাচে ফেরান বাংলাদেশকে। পোলার্ডকে (৮৫) বোল্ড করার পর আগের খেলার ম্যাচসেরা ড্যারেন সামিকেও (২) ফেরান তিনি।
এর পরও আড়াই শ হওয়াটা ছিল খুব সম্ভব। শেষ ১০ ওভারে যে পাঁচ উইকেট হাতে নিয়ে ঢুকেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, রান ১৮৮। আগের খেলায় চার উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ১০ ওভারে ৮১ রান যোগ করেছিল ক্যারিবীয়রা। কাল নির্ধারিত ওভারের দুই ওভার আগেই অলআউট, স্কোরবোর্ডে আর মোটে ২৯ রান যোগ করে। পৌনে ৩০০ পেরিয়ে যাওয়ার হুংকার দেওয়া ক্যারিবীয় ইনিংস তাই থেমে যায় মাত্র ২১৭ রানে। পোলার্ডের ইনিংসটি বাদ দিলে সেটি আরো করুণ। এই হার্ডহিটার ৭৪ বলে করেছেন ৮৫। আর বাকি ১০ ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান মুখোমুখি হওয়া ২১৪ বলে করেছেন ১১৪! একসময় সেটিকেই অবশ্য মনে হচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু লাল-সবুজের ১১ জন ক্রিকেটসৈনিক ভুল প্রমাণ করে ছাড়েন তা।
দেবতাদের নাকি কোনো পাপ হয় না! তবে কাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২ উইকেটের জয়ে এশিয়া কাপ ফাইনালে ২ রানে হারের 'পাপমোচন'ই করলেন যেন ক্রিকেট দেবতা! অবশেষে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ৪৮ ওভারে ২১৭
বাংলাদেশ : ৪৪ ওভারে ২২১/৮
ফল : বাংলাদেশ ২ উইকেটে জয়ী
সিরিজের ফল : বাংলাদেশ ৩-২ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মাহমুদ উল্লাহ
ম্যান অব দ্য সিরিজ : মুশফিকুর রহিম
No comments