বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক-ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ by হুমায়ুন কবির
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ৪১ বছর পূর্ণ হবে। একাত্তরজুড়েই ছিল স্বপ্ন ও সাহসের সময়। নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। দেশের প্রতিটি প্রান্তে কারও জীবন তাদের হাতে নিরাপদ ছিল না।
হত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ প্রতিদিন অসংখ্য স্থানে ঘটেছে, সেটা প্রকাশ্যেই। এমন কঠিন সময় মোকাবেলা করেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এর পেছনে ছিল বাঙালির ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প_ স্বাধীনতা আনবোই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নানাভাবে চেষ্টা করেও তাদের পক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের হাতেগোনা কিছু নেতাকর্মীর বাইরে কোনো সমর্থন পায়নি।
বিশ্ব জনমতও ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। প্রতিবেশী ভারত এবং সে সময়ের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাত্মক সমর্থন-সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি নারী-পুরুষের জন্য ছিল বড় ভরসা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি ছিল পাকিস্তানকে রক্ষার পক্ষে। সে সময়ে ওই দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের ওপর। পরে যাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়। ২৫ মার্চের পরপরই তারা ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে গণহত্যার নিশ্চিত খবর পাচ্ছিলেন। এর প্রধান সূত্র ছিল ঢাকাস্থ কনস্যুলেট থেকে পাঠানো অসংখ্য বার্তা। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে আর্চার ব্লাড যে বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠান তাতে বলা হয় :'আমাদের সরকার গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।' এর আগে ২৭ মার্চেই তিনি 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' শিরোনামে বার্তা পাঠান। তিনি লিখেছেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে অবাঙালি মুসলিমরা দরিদ্রদের বস্তি ও বাসগৃহে হামলা পরিচালনা করছে এবং বাঙালি ও হিন্দুদের হত্যা করছে।'
যুক্তরাষ্ট্র্রের এসব গোপন বার্তা নির্দিষ্ট কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমরা জানতে পারছি নিক্সন প্রশাসনের ভুলগুলো। কিন্তু সে সময়েও পাকিস্তান সরকারকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেভাবে চেষ্টা করেছিল অনেক সাহসী সাংবাদিক তা ফাঁস করে দেন। এ প্রসঙ্গে আমরা এন্ডারসন পেপার্সের কথা উল্লেখ করতে পারি।
২৫ মার্চ রাতে যা ছিল নির্দিষ্ট কিছু স্থানে গণহত্যা, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশজুড়ে। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ হত্যাকাণ্ড বন্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে থামাতে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনই বরং পেয়েছে ইয়াহিয়া সরকার। কেন এই দ্বৈততা? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি যে রাজনৈতিক পর্যায়ে তারা প্রাতিষ্ঠানিকতাকে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। এর একটি কারণ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সিয়াটা ও সেন্টো সামরিক চুক্তি। ভারতের প্রতি বৈরী মনোভাবও ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার তখন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছিল, যাকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ঝুঁকে থাকা। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পাকিস্তানের প্রতি অনুকূল অবস্থানের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল এবং বলা যায় যার লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী_ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানকে কাজে লাগানো। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়াও ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল বেইজিংয়ের সক্রিয় সমর্থন।
সরকারের পাকিস্তান প্রীতির পাশাপাশি আমরা দেখি যে সে দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম শুরু থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিল। তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্যক অনুধাবন করতে পারে। শুধু ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেই তারা নিবৃত্ত থাকেনি, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনেও কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট সদস্যরা যাতে ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার নিন্দা জানান এবং পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে প্রশাসনকে বাধ্য করেন সে জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়। সে সময়ের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিসহ আরও অনেকের অবদান আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি নিক্সন প্রশাসনের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবির তিনি পরিদর্শন করেন এবং সে খবর গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফর করেন। এ সময়ে তিনি শত সংগ্রামের পীঠস্থান এবং স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলনের গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল ছাত্র-গণসমাবেশে ভাষণ দেন। তার মঞ্চ সাজানো হয়েছিল ঐতিহাসিক বটতলায়, পাকিস্তানি জান্তার প্রবল রোষের কারণে যেটিকে একাত্তরের কোনো এক সময়ে সমূলে উৎপাটিত করা হয়। কেনেডি সেই একই স্থানে একটি বটের চারা রোপণ করেন, যা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ছাত্র সমাজের সাহস ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবল সামরিক শক্তিধর দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সে দেশের সামরিক চেহারা সহজেই নজরে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটির সামাজিক শক্তিও লক্ষ্য করার মতো। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সামঞ্জস্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তির ক্ষমতা এতই প্রবল যে, তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি গৃহীত সিদ্ধান্তও তাদের কারণে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সত্তা প্রায়শই ভিন্ন থাকে। আমরা এ বিষয়টির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি না। সব সময় বুঝে উঠতেও পারি না এবং এ কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রবল শক্তিধর দেশটি থেকে যেসব সুযোগ আসে তা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। আমরা তাকে পাশে পেতে চাই, সম্পর্কের যে বিস্তৃতি তাকে আরও গভীর করতে চাই। কিন্তু কোন পথে এগোতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ কীভাবে ফেলতে হবে সেটা সব সময় স্পষ্ট থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই একটি সমাজ নিয়ন্ত্রিত দেশ এবং এটি আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সঙ্গে তাদের সাযুজ্যের একটি কারণ হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য পরিচালিত সুমহান সংগ্রামের মধ্যে মিল থাকা। জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি। তার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন হয়েছিল। বাংলাদেশকেও স্বাধীনতার জন্য একই পথে চলতে হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে দমন করার জন্য নিষ্ঠুর গণহত্যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালি তাতে ভয় পেয়ে পিছু হটেনি, বরং প্রবল শক্তিতে রুখে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন এটি বুঝতে পারেনি কিংবা ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক লক্ষ্য বড় করে দেখার কারণে সেটা বুঝতে চায়নি। কিন্তু সমাজের যে অন্তর্নিহিত শক্তি, তাদের দৃষ্টিতে বাঙালির এ গৌরবের সংগ্রাম ঠিকই ধরা পড়েছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। এ কাজ কঠিন নয়। কারণ তারা আমাদের যে বুঝতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছি। এখন প্রয়োজন আমাদের তরফে সঠিক পদক্ষেপটি গ্রহণ করা। এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটি দেশ যেখানে সমাজের যে কোনো অবস্থানে থাকা যে কোনো নারী বা পুরুষ রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চপর্যায়ে উঠে যেতে পারে। সেখানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, আপাতভাবে তা ছোট মনে হলেও তাদের ভূমিকা হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি। এমনকি তাদের পক্ষে ক্ষমতার চেয়েও অনেক বড় কিছু করে ফেলা সম্ভব।
গত চার দশকে বাংলাদেশ তার সৃজনশীলতার অনেক নজির রেখেছে। সাধারণ মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই আমরা একাত্তরে জয়ী হয়েছি। বৈরী প্রকৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্যান্য বাধা মোকাবেলা করে আমরা নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি এবং সেটা যে অলীক নয় তা বিশ্ব সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্ক গভীরতর করা সম্ভব হলে এসব অর্জন নতুন মাত্রায় উন্নীত হতে পারে এবং তাতে আমাদেরই বেশি লাভ।
একাত্তরে নিক্সন প্রশাসন তাদের বাংলাদেশ নীতি প্রণয়নে অনেক ভুল করেছে। কিন্তু সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ভুল করেনি। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এনজিও প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জন সম্পর্কে তারা ভালোভাবেই অবহিত। বারাক ওবামার প্রশাসনও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলাম। এ নির্বাচনের ফলকে সেখানকার গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ বিপুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল। আমার প্রায় চার দশকের চাকরি জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন ইতিবাচক ভাবনা আগে কখনও দেখিনি। এটা ধরে রাখা এবং আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজে লাগানো নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ।
হুমায়ুন কবির : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
বিশ্ব জনমতও ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। প্রতিবেশী ভারত এবং সে সময়ের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে স্বীকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাত্মক সমর্থন-সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি নারী-পুরুষের জন্য ছিল বড় ভরসা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি ছিল পাকিস্তানকে রক্ষার পক্ষে। সে সময়ে ওই দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের ওপর। পরে যাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়। ২৫ মার্চের পরপরই তারা ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে গণহত্যার নিশ্চিত খবর পাচ্ছিলেন। এর প্রধান সূত্র ছিল ঢাকাস্থ কনস্যুলেট থেকে পাঠানো অসংখ্য বার্তা। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে আর্চার ব্লাড যে বার্তা ওয়াশিংটনে পাঠান তাতে বলা হয় :'আমাদের সরকার গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।' এর আগে ২৭ মার্চেই তিনি 'সিলেকটিভ জেনোসাইড' শিরোনামে বার্তা পাঠান। তিনি লিখেছেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে অবাঙালি মুসলিমরা দরিদ্রদের বস্তি ও বাসগৃহে হামলা পরিচালনা করছে এবং বাঙালি ও হিন্দুদের হত্যা করছে।'
যুক্তরাষ্ট্র্রের এসব গোপন বার্তা নির্দিষ্ট কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমরা জানতে পারছি নিক্সন প্রশাসনের ভুলগুলো। কিন্তু সে সময়েও পাকিস্তান সরকারকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন যেভাবে চেষ্টা করেছিল অনেক সাহসী সাংবাদিক তা ফাঁস করে দেন। এ প্রসঙ্গে আমরা এন্ডারসন পেপার্সের কথা উল্লেখ করতে পারি।
২৫ মার্চ রাতে যা ছিল নির্দিষ্ট কিছু স্থানে গণহত্যা, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশজুড়ে। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ হত্যাকাণ্ড বন্ধে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে থামাতে ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনই বরং পেয়েছে ইয়াহিয়া সরকার। কেন এই দ্বৈততা? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি যে রাজনৈতিক পর্যায়ে তারা প্রাতিষ্ঠানিকতাকে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। এর একটি কারণ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সিয়াটা ও সেন্টো সামরিক চুক্তি। ভারতের প্রতি বৈরী মনোভাবও ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়। পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার তখন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছিল, যাকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ঝুঁকে থাকা। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পাকিস্তানের প্রতি অনুকূল অবস্থানের আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল এবং বলা যায় যার লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী_ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানকে কাজে লাগানো। স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতির অদম্য আকাঙ্ক্ষা তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়াও ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল বেইজিংয়ের সক্রিয় সমর্থন।
সরকারের পাকিস্তান প্রীতির পাশাপাশি আমরা দেখি যে সে দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম শুরু থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিল। তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্যক অনুধাবন করতে পারে। শুধু ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করেই তারা নিবৃত্ত থাকেনি, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনেও কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট সদস্যরা যাতে ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার নিন্দা জানান এবং পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে প্রশাসনকে বাধ্য করেন সে জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়। সে সময়ের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিসহ আরও অনেকের অবদান আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি নিক্সন প্রশাসনের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবির তিনি পরিদর্শন করেন এবং সে খবর গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা সফর করেন। এ সময়ে তিনি শত সংগ্রামের পীঠস্থান এবং স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলনের গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল ছাত্র-গণসমাবেশে ভাষণ দেন। তার মঞ্চ সাজানো হয়েছিল ঐতিহাসিক বটতলায়, পাকিস্তানি জান্তার প্রবল রোষের কারণে যেটিকে একাত্তরের কোনো এক সময়ে সমূলে উৎপাটিত করা হয়। কেনেডি সেই একই স্থানে একটি বটের চারা রোপণ করেন, যা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ছাত্র সমাজের সাহস ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবল সামরিক শক্তিধর দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সে দেশের সামরিক চেহারা সহজেই নজরে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটির সামাজিক শক্তিও লক্ষ্য করার মতো। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সামঞ্জস্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তির ক্ষমতা এতই প্রবল যে, তা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি গৃহীত সিদ্ধান্তও তাদের কারণে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সত্তা প্রায়শই ভিন্ন থাকে। আমরা এ বিষয়টির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারি না। সব সময় বুঝে উঠতেও পারি না এবং এ কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রবল শক্তিধর দেশটি থেকে যেসব সুযোগ আসে তা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। আমরা তাকে পাশে পেতে চাই, সম্পর্কের যে বিস্তৃতি তাকে আরও গভীর করতে চাই। কিন্তু কোন পথে এগোতে হবে এবং সঠিক পদক্ষেপ কীভাবে ফেলতে হবে সেটা সব সময় স্পষ্ট থাকে না।
যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত অর্থেই একটি সমাজ নিয়ন্ত্রিত দেশ এবং এটি আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের সঙ্গে তাদের সাযুজ্যের একটি কারণ হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য পরিচালিত সুমহান সংগ্রামের মধ্যে মিল থাকা। জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতি। তার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন হয়েছিল। বাংলাদেশকেও স্বাধীনতার জন্য একই পথে চলতে হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে দমন করার জন্য নিষ্ঠুর গণহত্যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালি তাতে ভয় পেয়ে পিছু হটেনি, বরং প্রবল শক্তিতে রুখে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন এটি বুঝতে পারেনি কিংবা ভূ-রাজনৈতিক-সামরিক লক্ষ্য বড় করে দেখার কারণে সেটা বুঝতে চায়নি। কিন্তু সমাজের যে অন্তর্নিহিত শক্তি, তাদের দৃষ্টিতে বাঙালির এ গৌরবের সংগ্রাম ঠিকই ধরা পড়েছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। এ কাজ কঠিন নয়। কারণ তারা আমাদের যে বুঝতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছি। এখন প্রয়োজন আমাদের তরফে সঠিক পদক্ষেপটি গ্রহণ করা। এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে এমন একটি দেশ যেখানে সমাজের যে কোনো অবস্থানে থাকা যে কোনো নারী বা পুরুষ রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চপর্যায়ে উঠে যেতে পারে। সেখানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, আপাতভাবে তা ছোট মনে হলেও তাদের ভূমিকা হয়ে উঠতে পারে অনেক বেশি। এমনকি তাদের পক্ষে ক্ষমতার চেয়েও অনেক বড় কিছু করে ফেলা সম্ভব।
গত চার দশকে বাংলাদেশ তার সৃজনশীলতার অনেক নজির রেখেছে। সাধারণ মানুষের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই আমরা একাত্তরে জয়ী হয়েছি। বৈরী প্রকৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্যান্য বাধা মোকাবেলা করে আমরা নতুন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি এবং সেটা যে অলীক নয় তা বিশ্ব সমাজ স্বীকার করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্ক গভীরতর করা সম্ভব হলে এসব অর্জন নতুন মাত্রায় উন্নীত হতে পারে এবং তাতে আমাদেরই বেশি লাভ।
একাত্তরে নিক্সন প্রশাসন তাদের বাংলাদেশ নীতি প্রণয়নে অনেক ভুল করেছে। কিন্তু সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম ভুল করেনি। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এনজিও প্রভৃতি খাতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জন সম্পর্কে তারা ভালোভাবেই অবহিত। বারাক ওবামার প্রশাসনও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলাম। এ নির্বাচনের ফলকে সেখানকার গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ বিপুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল। আমার প্রায় চার দশকের চাকরি জীবনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন ইতিবাচক ভাবনা আগে কখনও দেখিনি। এটা ধরে রাখা এবং আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কাজে লাগানো নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ।
হুমায়ুন কবির : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
No comments