চলে গেলেন, কিন্তু থাকবেনও by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ড. খান সারওয়ার মুরশিদ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আপনজনদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও একাংশের মৃত্যু ঘটে- এটা বাস্তব সত্য। সান্ত্বনা এটুকুই যে ড. খান সারওয়ার মুরশিদ আমাদের জীবনধারায় প্রবহমান থাকবেন।
ড. মুরশিদ আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। পরে অবশ্য আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সহকর্মী হওয়ার। সহকর্মী থাকার সময় অনেকটা অভিভাবকের দায়িত্বই পালন করেছেন তিনি। তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার অনেক আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার অপ্রত্যক্ষ একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল তাঁর সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা 'নিউ ভ্যালুজ'-এর মাধ্যমে।
১৯৪৮ সালে খান সারওয়ার মুরশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র যোগ দেওয়া একজন তরুণ শিক্ষক এবং সে বছরই তিনি পত্রিকাটি বের করেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রায় মফস্বলীয় ঢাকা শহরে এমন একটি পত্রিকা ছিল অপ্রত্যাশিত। আমরা তখনো স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। তবু এ পত্রিকাটি আমাদের আকর্ষণ করত এর বক্তব্যের কারণে। নিউ ভ্যালুজ আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলত। এ পত্রিকা পাঠে তাঁর সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ জন্মায়। পরে জানতে পারি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ১৯৫২ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন তাঁকে পাই ক্লাসরুমে। শিক্ষক হিসেবে তিনি সব সময় আমাদের সাহিত্যপাঠে উদ্বুদ্ধ করতেন। নিউ ভ্যালুজের সম্পাদক হিসেবে তাঁর প্রতি জন্মানো কৌতূহল অনেকটাই মিটে যায় তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে। সেই পত্রিকাটির কথা বিশেষ করে মনে পড়ে এ জন্য যে একক প্রচেষ্টায় তিনি এটিকে জীবিত রেখেছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। পত্রিকা সম্পাদনার প্রতি আমারও আগ্রহ ছিল কৈশোর থেকে, যখন হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। অধ্যাপক মুরশীদকে সম্পাদক হিসেবে আমি ১৯৬৬ সাল পর্যন্তই দেখেছি। পত্রিকাটির একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল চিত্রকলা সম্পর্কে। তখন চিত্রকলার প্রতি ঢাকাবাসীর আগ্রহ ছিল খুবই সীমিত। ঢাকায় যে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শিক্ষক হিসেবে বিশিষ্ট কয়েকজন শিল্পী যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক। তাঁদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহী রূপে পাঠকদের অবহিত করা হয়েছিল সংখ্যাটিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে আমরা পাইনি। তাঁদের একজন হলেন এ জি স্টার্ক, অন্যজন অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী। তবে তাঁদের কথা অনেক শুনেছি এবং নানাভাবে জেনেছি। উভয়ের সঙ্গেই খান সারওয়ার মুরশিদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁরা দুজনই নিউ ভ্যালুজের ব্যাপারে মুরশীদ স্যারকে উৎসাহ দিতেন এবং লিখতেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর কথা। তিনি সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় নিজের মত প্রকাশের সুযোগ পেতেন না। নিউ ভ্যালুজে তিনি নিজের নামে লিখতেন না। সম্পাদকীয় এবং কোনো কোনো প্রবন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা যেত। অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে পারেননি। শুনেছি পঞ্চাশের দাঙ্গার পর তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। না গেলেই তাঁর বিপদ হতো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি গ্রেপ্তার হতেন। ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ইংরেজি বিভাগের তরুণ শিক্ষক মুনীর চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আমরা শুনেছি, মুরশীদ স্যারকেও পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তাঁর সন্ধান পায়নি।
ড. মুরশীদ স্যারের বাবা আলী আহমেদ খান পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি 'পূর্ব বাংলা' নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকায় মুরশীদ স্যারও সময় দিতেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুরশীদ স্যার ছিলেন সেই সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
প্রথম দিকে স্যারকে আমরা বেশিদিন পাইনি। আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই তিনি চলে যান নটিংহামে উচ্চশিক্ষার জন্য। ১৯৫৫ সালে যখন তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন, তখন আমরা এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল ডাবি্লউ বি ইয়েটসে। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা ইয়েটসের কবিতার গভীরতা ও নান্দনিক সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হই।
ছাত্রজীবন শেষ করে ১৯৫৭ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগ দিই, তখন তাঁকে আমার অভিভাবকের মতো মনে হতো। কেবল অভিভাবক নন, একজন বন্ধুও মনে হতো। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে আলাপ হয়েছে। নিউ ভ্যালুজে আমি লিখেছিও। তাঁর সঙ্গে পত্রিকার প্রুফ দেখা এবং বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজেও যোগ দিয়েছি। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা স্যারকে দেখেছি একজন সংগঠক হিসেবে। দেশে তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিদ্যমান। স্থানীয় প্রশাসন তখন এ আয়োজন সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিল। কিন্তু উদ্যাপন কমিটির সভাপতি বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ও সাধারণ সম্পাদক খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন অনমনীয়। তাঁদের দৃঢ়তার কারণেই উদ্যাপন কমিটি এ আয়োজন থেকে পিছপা হয়নি।
১৯৫৮ সালে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে মোট ৯টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এর একটিতে ড. মুরশীদ অত্যন্ত গবেষণাপূর্ণ এবং চিন্তা-উদ্রেককারী প্রবন্ধ পড়েন। নিউ ভ্যালুজের বিশেষ সংখ্যায় সেমিনারগুলোতে পঠিত সব প্রবন্ধই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংখ্যাটিও ছিল উল্লেখযোগ্য।
ড. মুরশীদকে চেনা যেত তাঁর রুচি ও সংস্কৃতির প্রতি সহজাত আকর্ষণের কারণে। সেকালে তাঁর মতো রুচিমান মানুষ ছিল অত্যন্ত বিরল। ক্লাসের ভেতর ও বাইরেও তিনি কথা বলতেন অত্যন্ত যত্ন ও চিন্তা সহকারে। তাঁকে কখনোই হৈচৈ করে উঠতে দেখিনি। অথচ পুরান ঢাকার সংস্কৃতি থেকে যে তিনি নিজেকে দূরে রাখতে চাইতেন, তাও নয়। সেকালে সদরঘাট ছিল চলাফেরার প্রধান এলাকা। আমাদের এক সহপাঠী একদিন রূপমহল সিনেমা হলের পাশে একটি পুরনো ধরনের রেস্টুরেন্টে ড. মুরশীদকে কাসুন্দি দিয়ে আলুর চপ খেতে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছিল। সেই রেস্টুরেন্টে আমরাও যেতাম। ছাপাখানাগুলোও তখন ছিল পুরনো শহরেই। সেখানে গিয়ে ড. মুরশীদ তাঁর পত্রিকা ছাপার কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবতেন। ওই উদ্দেশ্য থেকেই তাঁর নিউ ভ্যালুজ প্রকাশ করা। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশীদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে ড. মুরশীদ তাঁর স্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ড. মুরশীদের বাবাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় আমরা সবাই অস্থির সময় কাটিয়েছি। সে সময় ড. মুরশীদকেও দেখেছি অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও রাজনীতিতে অংশ নিতে। সত্তরের নির্বাচনে নূরজাহান মুরশীদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তাঁর পুরো পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এর সঙ্গে যুক্ত হন। ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে সেদিন তাঁদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাদের একটা বড় ক্ষোভ ছিল আইয়ুব খান প্রবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বিরুদ্ধে। এ আইনকে আমরা কালাকানুন বলতাম। এর বিরুদ্ধে শিক্ষকরা আন্দোলন করেছেন। তখন ড. মুরশীদকে আমরা একেবারে সামনের সারিতে পেয়েছিলাম।
ড. মুরশীদ শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ববান। অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁর কোনো আলস্য ছিল না। বিদেশ থেকে কোনো নতুন বই সংগ্রহ করতে পারলে তিনি যতটা খুশি হতেন, অতটা খুশি আমি তাঁকে খুব কম ব্যাপারেই হতে দেখেছি। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের একটা অভিযোগ ছিল- তিনি লিখতেন কম। আমরা যারা লেখার ব্যাপারে কোনো রকম দ্বিধা করতাম না, তাদের তুলনায় তিনি বিপরীত প্রান্তে ছিলেন। এর কারণ, তিনি যা লিখতেন তার ভেতরে যেমন চিন্তার গভীরতা থাকত, তেমনি থাকত প্রকাশের অনন্যতা। তাঁর রচনা যে তাঁরই মতো গভীর ও সুসংবদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ থাকত না। কর্মজীবনে তাঁকে অনেক বিঘ্ন পার হতে হয়েছে; কিন্তু তিনি সব সময় ছিলেন অসম্ভব দৃঢ় ও অনমনীয়।
আমরা যারা তাঁর ছাত্র, তাদের জীবনের ওপর তিনি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছেন। আমি নিজে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, আমার ছাত্র ও কর্মজীবনে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সাহচর্য পেয়েছি এবং তাঁর কাছ থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থা রাখার শিক্ষাও লাভ করেছি। তাঁর রুচির কথা আগেও বলেছি, সেটি ছিল দৃষ্টান্তমূলক; কিন্তু অননুকরণীয়। তাঁর মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব আমরা খুব কমই পেয়েছি। সেদিক থেকে আমরা অনেক সৌভাগ্যবান এবং অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তাঁর প্রভাবটা স্থূলভাবে চিহ্নিত করা অসম্ভব। কিন্তু আমাদের অনেকের মতো আমার মধ্যেও তা অন্তঃসলিল ধারার মতো প্রবাহিত রয়েছে এবং থাকবে। ক্লাসে যেমন, তেমনি ক্লাসের বাইরেও তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আপনজনদের ব্যক্তিগত জীবনেই শুধু নয়, সমষ্টিগত জীবনেও তিনি অম্লান হয়ে থাকবেন।
১৯৪৮ সালে খান সারওয়ার মুরশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র যোগ দেওয়া একজন তরুণ শিক্ষক এবং সে বছরই তিনি পত্রিকাটি বের করেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রায় মফস্বলীয় ঢাকা শহরে এমন একটি পত্রিকা ছিল অপ্রত্যাশিত। আমরা তখনো স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। তবু এ পত্রিকাটি আমাদের আকর্ষণ করত এর বক্তব্যের কারণে। নিউ ভ্যালুজ আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা বলত। এ পত্রিকা পাঠে তাঁর সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ জন্মায়। পরে জানতে পারি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তাঁর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ১৯৫২ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন তাঁকে পাই ক্লাসরুমে। শিক্ষক হিসেবে তিনি সব সময় আমাদের সাহিত্যপাঠে উদ্বুদ্ধ করতেন। নিউ ভ্যালুজের সম্পাদক হিসেবে তাঁর প্রতি জন্মানো কৌতূহল অনেকটাই মিটে যায় তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে। সেই পত্রিকাটির কথা বিশেষ করে মনে পড়ে এ জন্য যে একক প্রচেষ্টায় তিনি এটিকে জীবিত রেখেছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। পত্রিকা সম্পাদনার প্রতি আমারও আগ্রহ ছিল কৈশোর থেকে, যখন হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। অধ্যাপক মুরশীদকে সম্পাদক হিসেবে আমি ১৯৬৬ সাল পর্যন্তই দেখেছি। পত্রিকাটির একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল চিত্রকলা সম্পর্কে। তখন চিত্রকলার প্রতি ঢাকাবাসীর আগ্রহ ছিল খুবই সীমিত। ঢাকায় যে আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শিক্ষক হিসেবে বিশিষ্ট কয়েকজন শিল্পী যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক। তাঁদের শিল্পকর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহী রূপে পাঠকদের অবহিত করা হয়েছিল সংখ্যাটিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে আমরা পাইনি। তাঁদের একজন হলেন এ জি স্টার্ক, অন্যজন অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী। তবে তাঁদের কথা অনেক শুনেছি এবং নানাভাবে জেনেছি। উভয়ের সঙ্গেই খান সারওয়ার মুরশিদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাঁরা দুজনই নিউ ভ্যালুজের ব্যাপারে মুরশীদ স্যারকে উৎসাহ দিতেন এবং লিখতেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় অমিয়ভূষণ চক্রবর্তীর কথা। তিনি সে সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় নিজের মত প্রকাশের সুযোগ পেতেন না। নিউ ভ্যালুজে তিনি নিজের নামে লিখতেন না। সম্পাদকীয় এবং কোনো কোনো প্রবন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দেখা যেত। অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে পারেননি। শুনেছি পঞ্চাশের দাঙ্গার পর তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। না গেলেই তাঁর বিপদ হতো। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি গ্রেপ্তার হতেন। ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে ইংরেজি বিভাগের তরুণ শিক্ষক মুনীর চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আমরা শুনেছি, মুরশীদ স্যারকেও পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিল; কিন্তু তাঁর সন্ধান পায়নি।
ড. মুরশীদ স্যারের বাবা আলী আহমেদ খান পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি 'পূর্ব বাংলা' নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকায় মুরশীদ স্যারও সময় দিতেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুরশীদ স্যার ছিলেন সেই সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
প্রথম দিকে স্যারকে আমরা বেশিদিন পাইনি। আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরই তিনি চলে যান নটিংহামে উচ্চশিক্ষার জন্য। ১৯৫৫ সালে যখন তিনি পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসেন, তখন আমরা এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র। তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল ডাবি্লউ বি ইয়েটসে। তাঁর বক্তব্য থেকে আমরা ইয়েটসের কবিতার গভীরতা ও নান্দনিক সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হই।
ছাত্রজীবন শেষ করে ১৯৫৭ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগ দিই, তখন তাঁকে আমার অভিভাবকের মতো মনে হতো। কেবল অভিভাবক নন, একজন বন্ধুও মনে হতো। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক বিষয়ে আলাপ হয়েছে। নিউ ভ্যালুজে আমি লিখেছিও। তাঁর সঙ্গে পত্রিকার প্রুফ দেখা এবং বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজেও যোগ দিয়েছি। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা স্যারকে দেখেছি একজন সংগঠক হিসেবে। দেশে তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিদ্যমান। স্থানীয় প্রশাসন তখন এ আয়োজন সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিল। কিন্তু উদ্যাপন কমিটির সভাপতি বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ও সাধারণ সম্পাদক খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন অনমনীয়। তাঁদের দৃঢ়তার কারণেই উদ্যাপন কমিটি এ আয়োজন থেকে পিছপা হয়নি।
১৯৫৮ সালে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে মোট ৯টি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এর একটিতে ড. মুরশীদ অত্যন্ত গবেষণাপূর্ণ এবং চিন্তা-উদ্রেককারী প্রবন্ধ পড়েন। নিউ ভ্যালুজের বিশেষ সংখ্যায় সেমিনারগুলোতে পঠিত সব প্রবন্ধই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংখ্যাটিও ছিল উল্লেখযোগ্য।
ড. মুরশীদকে চেনা যেত তাঁর রুচি ও সংস্কৃতির প্রতি সহজাত আকর্ষণের কারণে। সেকালে তাঁর মতো রুচিমান মানুষ ছিল অত্যন্ত বিরল। ক্লাসের ভেতর ও বাইরেও তিনি কথা বলতেন অত্যন্ত যত্ন ও চিন্তা সহকারে। তাঁকে কখনোই হৈচৈ করে উঠতে দেখিনি। অথচ পুরান ঢাকার সংস্কৃতি থেকে যে তিনি নিজেকে দূরে রাখতে চাইতেন, তাও নয়। সেকালে সদরঘাট ছিল চলাফেরার প্রধান এলাকা। আমাদের এক সহপাঠী একদিন রূপমহল সিনেমা হলের পাশে একটি পুরনো ধরনের রেস্টুরেন্টে ড. মুরশীদকে কাসুন্দি দিয়ে আলুর চপ খেতে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছিল। সেই রেস্টুরেন্টে আমরাও যেতাম। ছাপাখানাগুলোও তখন ছিল পুরনো শহরেই। সেখানে গিয়ে ড. মুরশীদ তাঁর পত্রিকা ছাপার কাজ তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবতেন। ওই উদ্দেশ্য থেকেই তাঁর নিউ ভ্যালুজ প্রকাশ করা। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশীদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে ড. মুরশীদ তাঁর স্ত্রীকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ড. মুরশীদের বাবাও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় আমরা সবাই অস্থির সময় কাটিয়েছি। সে সময় ড. মুরশীদকেও দেখেছি অপ্রত্যক্ষভাবে হলেও রাজনীতিতে অংশ নিতে। সত্তরের নির্বাচনে নূরজাহান মুরশীদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তাঁর পুরো পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হওয়ার পর স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এর সঙ্গে যুক্ত হন। ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে সেদিন তাঁদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাদের একটা বড় ক্ষোভ ছিল আইয়ুব খান প্রবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বিরুদ্ধে। এ আইনকে আমরা কালাকানুন বলতাম। এর বিরুদ্ধে শিক্ষকরা আন্দোলন করেছেন। তখন ড. মুরশীদকে আমরা একেবারে সামনের সারিতে পেয়েছিলাম।
ড. মুরশীদ শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্ববান। অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁর কোনো আলস্য ছিল না। বিদেশ থেকে কোনো নতুন বই সংগ্রহ করতে পারলে তিনি যতটা খুশি হতেন, অতটা খুশি আমি তাঁকে খুব কম ব্যাপারেই হতে দেখেছি। তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের একটা অভিযোগ ছিল- তিনি লিখতেন কম। আমরা যারা লেখার ব্যাপারে কোনো রকম দ্বিধা করতাম না, তাদের তুলনায় তিনি বিপরীত প্রান্তে ছিলেন। এর কারণ, তিনি যা লিখতেন তার ভেতরে যেমন চিন্তার গভীরতা থাকত, তেমনি থাকত প্রকাশের অনন্যতা। তাঁর রচনা যে তাঁরই মতো গভীর ও সুসংবদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ থাকত না। কর্মজীবনে তাঁকে অনেক বিঘ্ন পার হতে হয়েছে; কিন্তু তিনি সব সময় ছিলেন অসম্ভব দৃঢ় ও অনমনীয়।
আমরা যারা তাঁর ছাত্র, তাদের জীবনের ওপর তিনি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলেছেন। আমি নিজে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, আমার ছাত্র ও কর্মজীবনে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সাহচর্য পেয়েছি এবং তাঁর কাছ থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আস্থা রাখার শিক্ষাও লাভ করেছি। তাঁর রুচির কথা আগেও বলেছি, সেটি ছিল দৃষ্টান্তমূলক; কিন্তু অননুকরণীয়। তাঁর মতো দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব আমরা খুব কমই পেয়েছি। সেদিক থেকে আমরা অনেক সৌভাগ্যবান এবং অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তাঁর প্রভাবটা স্থূলভাবে চিহ্নিত করা অসম্ভব। কিন্তু আমাদের অনেকের মতো আমার মধ্যেও তা অন্তঃসলিল ধারার মতো প্রবাহিত রয়েছে এবং থাকবে। ক্লাসে যেমন, তেমনি ক্লাসের বাইরেও তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আপনজনদের ব্যক্তিগত জীবনেই শুধু নয়, সমষ্টিগত জীবনেও তিনি অম্লান হয়ে থাকবেন।
No comments