স্বপ্ন যেদিন সত্যি হয় by মোস্তফা মামুন
স্বপ্ন যেদিন সত্যি হয়, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শিশুতোষ উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে ওঠেন। সেদিন ভাগ্য সব বৈরিতা ভুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। সেদিন ছোট্ট মমিনুলকে দেখাতে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘদেহী মানুষের মতো উঁচু। সেদিন জীর্ণ বাংলাদেশ তার রূপের সবটা পাপড়ি মেলে হয়ে ওঠে স্বর্গেরই ছবি। সুরে সুরেলা।
রংয়ে রঙিন।
রংয়ের কৌটাটা দুই দিন খুলতে খুলতেও খোলা হয়নি। তীরে এসে তরী ডোবার আফসোস নিয়ে ফেরার দুই দিন আশঙ্কা জাগিয়েছিল, হতে হতেও না পারার আফসোসে আরেকবার পুড়তে হবে না তো! কতবার হয়েছে এমন। ভাগ্য ছলনা করেছে। কত আশা ডুবেছে অন্ধকারে। এই শেষ এশিয়া কাপের ফাইনালে শিরোপাটা এমনভাবে মুঠো গলে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, পুরো দেশের কান্না শেষ হতে চায়নি। সেই কান্নার ক্ষতিপূরণ করতে করতে কাল ক্রিকেট জানাল শেষ পর্যন্ত তার কাছে বিচার আছে। সে যেমন নেয়, তেমনি ফিরিয়ে দেয়ও। বাংলাদেশের কাছে ভাগ্য আর ক্রিকেটের দেনা শোধের এই রাতে প্রেসবক্সে বসে মনে হলো, মাঠে যা হচ্ছে তা লৌকিক দৃষ্টিতে ক্রিকেট, কিন্তু আসলে জীবনের রঙ্গমঞ্চের প্রতীকী চিত্রায়ণও। যে দেশ অঘোষিতভাবে তার জাতীয় মূলনীতির মধ্যে অঘোষিতভাবে ক্রিকেটপ্রেমকে ঢুকিয়ে বসে আছে, তাদের অবশ্যই কিছু পাওনা হয়। মাঠের খেলায় খেলোয়াড়ি শক্তি দিয়েই জিততে হয়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট শুধু খেলোয়াড়দের শক্তির ওপর নির্ভর করে আছে কে বলল! বাংলাদেশের মানুষ, তার অনন্ত ক্রিকেটপ্রেম, তার নিখাদ আবেগ, তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে অদৃশ্যে খেলে চলে। আর কোনো দেশ তো অতটা ক্রিকেটের নয়, যতটা বাংলাদেশের। সেই দেশ একটা পুরোশক্তির দলের বিপক্ষে সিরিজ জিতবে না! ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই শুধুই থেকে যায় ক্রিকেটীয় শক্তি হয়ে। আমরা ক্রিকেট আর ভালোবাসা মিলিয়ে যে স্রোত তৈরি করি তাতে শক্তির পার্থক্য তুচ্ছ হয়ে উড়ে যায়। স্বপ্ন-কল্পনা আর বাস্তবতা এমন একাকার হয় যে, মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল যা হলো তা ঠিক তো! ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যাদের দলে গেইল নামের এক প্রায় অতিমানব আছেন, পোলার্ড-স্যামুয়েলস কিসব বিস্ফোরক কীর্তিমান, তাঁদের বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ জিতে গেছে। একটা বিশ্বমাপের পুরোশক্তির দলের বিপক্ষে এই কীর্তি এই প্রথম। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শিশুতোষ উচ্ছ্বাস তো দেখাবেনই। সেদিন বাংলাদেশ তো স্বর্গের ছবি হবেই। সেদিন ভেদাভেদের বাংলাদেশ সুন্দরের বাংলাদেশ তো হবেই।
কিয়েরন পোলার্ড প্রায় দৈত্যের রূপ নেন। সব ছারখার করে দেয়ার খুনে জিঘাংসা যেন। আমরা থমকে যাই। একে ঘরপোড়া গরু, স্যামুয়েলস ও সামি দুই দিন স্বপ্ন খুন করেছেন, আজ পোলার্ড! হতে হতেও তাহলে কী হবে না! এশিয়া কাপের তিক্ততা স্মৃতি থেকে মাথা উঁচায়। আফসোসের প্যান্ডোরাটা খুলে আবার; ইশ, ওই ম্যাচে যদি ক্যাচ না পড়ত! অমুক যদি ওটা না করতেন! কিন্তু ডেভিড-গোলিয়াথ কিংবা মিথের-ইতিহাসের-নীতিকথার এমন সব লড়াইয়ে যেমন শক্তিমানরা সামান্যের কাছে হেরে যান, তেমনি কাল হার হলো পোলার্ডের। দৈত্যদের হারাতে পুরনে দৈবশক্তির দরকার হয়েছে এবং দৈবের সেই শক্তি নানারূপে নানাজনের মধ্যে ভর করে। এখানে ভর করল মমিনুলের মধ্যে। এমন কিছু বোলার নন, ঘরোয়া ক্রিকেটে হাত ঘোরালেও অনিয়মিত। অথচ কী আশ্চর্য, তাঁর বলেই পোলার্ডের স্টাম্প নেই। দৈব যার মধ্যে ভর করে সে অবশ্য এই সামান্যতেই থেমে থাকে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে সামিকেও ফিরিয়ে গতিমুখটা বদলায় এমন একজনের হাতে- যিনি বল না করলেও কেউ কিছু মনে করত না। তাঁর কাজ ব্যাটিং। সেই কাজটা প্রথম ম্যাচের পর ঠিকঠাক হচ্ছিল না। এদিন হলো। এবং হলো কিভাবে? বল তাঁকে বারবার পরাস্ত করে, তবু সেটা ব্যাটের কানা নিয়ে যায় না! শট উঠে যায় কিন্তু ফিল্ডারের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না! কেন! তাই এবারও সংকটের মুখে ঠিক একটা জুটি হয়ে যায়। তরী চলে তীরের দিকে। স্বপ্ন-বাস্তব একীভূত হতে থাকে। সম্ভাবনার নৈকট্য আমাদের শিহরিত করে। তবু এদিক-সেদিক দুর্ঘটনা কিছু ঘটে। আমরা কেঁপে উঠি। আরো কাছায় স্বপ্নতরী। এইমাত্র পৌঁছাল। কিন্তু সেখানেও নাটক! জয়টা আসার আগে, স্বপ্নটা সত্যি হওয়ার তার মূল্য বোঝাতেই যেন বারবার দোলায়। স্নায়ুর পরীক্ষা নিয়ে দেখে, এত বড় কিছুর জন্য আমরা তৈরি হয়েছি তো!
মাহমুদ উল্লাহ নামের এক বীর আছেন বাংলাদেশে। মাঝেমধ্যে লম্বা সময় ধরে ঘুমান। ইতিহাসে এমন ঘুমন্ত বীরদের কিছু কাহিনী আছে। এবং সেসব বীর যখন জেগে ওঠেন, তখন পৃথিবী দেখে বীরত্ব কাকে বলে। সেই বীরদের আধুনিক ছবি যেন তিনি। যে সিরিজে ঠিক করেন, কিছু একটা করবেন সেই পুরো সিরিজ হয়ে ওঠে তার। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অভিষেক টেস্ট সিরিজে অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্স। তারপর ২০১০ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজেও তিনি রুদ্রের মতো অপ্রতিরোধ্য। এবং তারপর এই ২০১২ সালে তিনি আবার মহানায়ক। বল হাতে তাঁর মধ্যে ভর করেন মুরালিধরন, অবিশ্বাস্য টার্নে চমকে যাই আমরা, যা দেখছি ঠিক দেখছি তো! ব্যাট হাতে চরম বিপর্যয়ে তিনি ত্রাতা। এবং অধিনায়ক মুশফিক। অধিনায়কের দায়িত্বটা কী, কিভাবে পালন করতে হয়- এ নিয়ে যদি কেউ বই লেখেন, তবে সেই বইয়ে একটা অধ্যয় হতে পারে তাঁর এই সিরিজের পারফরম্যান্স। কালও যখন ৩২ রানে ৩ উইকেটে স্বপ্নগাড়ির চাকা ভুলপথে যাওয়ার জোগাড়, তখনও দিশারী এ দুজনই। ব্যাটটা আলোর মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে চলে সেখানে, যেখানে যেতে বাংলাদেশের কত-কত দিনের অপেক্ষা! তিন দিন আগে একবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আশা শেষ হয়েছে আফসোসে। অপেক্ষা বাড়িয়েছে আক্ষেপ। শেষ দিনে এসে যখন চাওয়া-পাওয়ার অঙ্কটা মিলল তখন মনে হচ্ছে, ভালোই হয়েছে। মূল্য বুঝতে এই অপেক্ষার দরকার ছিল। এই আফসোস শিখিয়ে গেছে সিরিজ জয়ের মানেটা কত বড়!
ম্যাচ শেষ হওয়ার আধাঘণ্টা পর প্রেসবক্সে বসে যখন এ লেখা লিখছি, তখন মাঝেমধ্যেই মনে হচ্ছে, যা হয়েছে সত্যি হয়েছে তো! বাংলাদেশ গেইলদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একটা সিরিজে হারিয়ে দিল! সত্যি তো? নাকি কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে জানব আসলে ঘটনাটা হয়েছিল রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে...।
গ্যালারি এখন শূন্য। আলোগুলো নিভু নিভু। শেষ হয়ে যাওয়ার চিহ্ন যেন সব। কিন্তু শেষ তো নয়, আসলে শুরু। নতুন দিনের। নতুন যুগের। নতুন পরিভ্রমণের।
বাইরে উৎসব। রংয়ের খেলায় নীল আকাশ লাল হচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে জয়ধ্বনি। অন্ধকার যেন জ্বলছে নতুন আলোর রেখা হয়ে।
এদিনে প্রধানমন্ত্রী শিশুতাষ উৎসব তো করবেনই! এই দিনে মমিনুল-মুশফিকদের শারীরিক ক্ষুদ্রতা মুছে গিয়ে ওরা তো বিশালত্বের ছবি হয়ে উঠবেনই। এই দিনে বাংলাদেশ বিএনপি-আওয়ামী লীগের হানাহানির বাংলাদেশ না থেকে ছন্দে-রূপে-মাধুর্যে-সুরে স্বর্গীয় ছবি তো হবেই।
এ যে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন। এ দিনে যে অন্য কিছু হতে নেই!
রংয়ের কৌটাটা দুই দিন খুলতে খুলতেও খোলা হয়নি। তীরে এসে তরী ডোবার আফসোস নিয়ে ফেরার দুই দিন আশঙ্কা জাগিয়েছিল, হতে হতেও না পারার আফসোসে আরেকবার পুড়তে হবে না তো! কতবার হয়েছে এমন। ভাগ্য ছলনা করেছে। কত আশা ডুবেছে অন্ধকারে। এই শেষ এশিয়া কাপের ফাইনালে শিরোপাটা এমনভাবে মুঠো গলে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, পুরো দেশের কান্না শেষ হতে চায়নি। সেই কান্নার ক্ষতিপূরণ করতে করতে কাল ক্রিকেট জানাল শেষ পর্যন্ত তার কাছে বিচার আছে। সে যেমন নেয়, তেমনি ফিরিয়ে দেয়ও। বাংলাদেশের কাছে ভাগ্য আর ক্রিকেটের দেনা শোধের এই রাতে প্রেসবক্সে বসে মনে হলো, মাঠে যা হচ্ছে তা লৌকিক দৃষ্টিতে ক্রিকেট, কিন্তু আসলে জীবনের রঙ্গমঞ্চের প্রতীকী চিত্রায়ণও। যে দেশ অঘোষিতভাবে তার জাতীয় মূলনীতির মধ্যে অঘোষিতভাবে ক্রিকেটপ্রেমকে ঢুকিয়ে বসে আছে, তাদের অবশ্যই কিছু পাওনা হয়। মাঠের খেলায় খেলোয়াড়ি শক্তি দিয়েই জিততে হয়, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট শুধু খেলোয়াড়দের শক্তির ওপর নির্ভর করে আছে কে বলল! বাংলাদেশের মানুষ, তার অনন্ত ক্রিকেটপ্রেম, তার নিখাদ আবেগ, তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে অদৃশ্যে খেলে চলে। আর কোনো দেশ তো অতটা ক্রিকেটের নয়, যতটা বাংলাদেশের। সেই দেশ একটা পুরোশক্তির দলের বিপক্ষে সিরিজ জিতবে না! ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাই শুধুই থেকে যায় ক্রিকেটীয় শক্তি হয়ে। আমরা ক্রিকেট আর ভালোবাসা মিলিয়ে যে স্রোত তৈরি করি তাতে শক্তির পার্থক্য তুচ্ছ হয়ে উড়ে যায়। স্বপ্ন-কল্পনা আর বাস্তবতা এমন একাকার হয় যে, মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল যা হলো তা ঠিক তো! ওয়েস্ট ইন্ডিজ, যাদের দলে গেইল নামের এক প্রায় অতিমানব আছেন, পোলার্ড-স্যামুয়েলস কিসব বিস্ফোরক কীর্তিমান, তাঁদের বিপক্ষে বাংলাদেশ সিরিজ জিতে গেছে। একটা বিশ্বমাপের পুরোশক্তির দলের বিপক্ষে এই কীর্তি এই প্রথম। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শিশুতোষ উচ্ছ্বাস তো দেখাবেনই। সেদিন বাংলাদেশ তো স্বর্গের ছবি হবেই। সেদিন ভেদাভেদের বাংলাদেশ সুন্দরের বাংলাদেশ তো হবেই।
কিয়েরন পোলার্ড প্রায় দৈত্যের রূপ নেন। সব ছারখার করে দেয়ার খুনে জিঘাংসা যেন। আমরা থমকে যাই। একে ঘরপোড়া গরু, স্যামুয়েলস ও সামি দুই দিন স্বপ্ন খুন করেছেন, আজ পোলার্ড! হতে হতেও তাহলে কী হবে না! এশিয়া কাপের তিক্ততা স্মৃতি থেকে মাথা উঁচায়। আফসোসের প্যান্ডোরাটা খুলে আবার; ইশ, ওই ম্যাচে যদি ক্যাচ না পড়ত! অমুক যদি ওটা না করতেন! কিন্তু ডেভিড-গোলিয়াথ কিংবা মিথের-ইতিহাসের-নীতিকথার এমন সব লড়াইয়ে যেমন শক্তিমানরা সামান্যের কাছে হেরে যান, তেমনি কাল হার হলো পোলার্ডের। দৈত্যদের হারাতে পুরনে দৈবশক্তির দরকার হয়েছে এবং দৈবের সেই শক্তি নানারূপে নানাজনের মধ্যে ভর করে। এখানে ভর করল মমিনুলের মধ্যে। এমন কিছু বোলার নন, ঘরোয়া ক্রিকেটে হাত ঘোরালেও অনিয়মিত। অথচ কী আশ্চর্য, তাঁর বলেই পোলার্ডের স্টাম্প নেই। দৈব যার মধ্যে ভর করে সে অবশ্য এই সামান্যতেই থেমে থাকে না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যে সামিকেও ফিরিয়ে গতিমুখটা বদলায় এমন একজনের হাতে- যিনি বল না করলেও কেউ কিছু মনে করত না। তাঁর কাজ ব্যাটিং। সেই কাজটা প্রথম ম্যাচের পর ঠিকঠাক হচ্ছিল না। এদিন হলো। এবং হলো কিভাবে? বল তাঁকে বারবার পরাস্ত করে, তবু সেটা ব্যাটের কানা নিয়ে যায় না! শট উঠে যায় কিন্তু ফিল্ডারের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না! কেন! তাই এবারও সংকটের মুখে ঠিক একটা জুটি হয়ে যায়। তরী চলে তীরের দিকে। স্বপ্ন-বাস্তব একীভূত হতে থাকে। সম্ভাবনার নৈকট্য আমাদের শিহরিত করে। তবু এদিক-সেদিক দুর্ঘটনা কিছু ঘটে। আমরা কেঁপে উঠি। আরো কাছায় স্বপ্নতরী। এইমাত্র পৌঁছাল। কিন্তু সেখানেও নাটক! জয়টা আসার আগে, স্বপ্নটা সত্যি হওয়ার তার মূল্য বোঝাতেই যেন বারবার দোলায়। স্নায়ুর পরীক্ষা নিয়ে দেখে, এত বড় কিছুর জন্য আমরা তৈরি হয়েছি তো!
মাহমুদ উল্লাহ নামের এক বীর আছেন বাংলাদেশে। মাঝেমধ্যে লম্বা সময় ধরে ঘুমান। ইতিহাসে এমন ঘুমন্ত বীরদের কিছু কাহিনী আছে। এবং সেসব বীর যখন জেগে ওঠেন, তখন পৃথিবী দেখে বীরত্ব কাকে বলে। সেই বীরদের আধুনিক ছবি যেন তিনি। যে সিরিজে ঠিক করেন, কিছু একটা করবেন সেই পুরো সিরিজ হয়ে ওঠে তার। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অভিষেক টেস্ট সিরিজে অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্স। তারপর ২০১০ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজেও তিনি রুদ্রের মতো অপ্রতিরোধ্য। এবং তারপর এই ২০১২ সালে তিনি আবার মহানায়ক। বল হাতে তাঁর মধ্যে ভর করেন মুরালিধরন, অবিশ্বাস্য টার্নে চমকে যাই আমরা, যা দেখছি ঠিক দেখছি তো! ব্যাট হাতে চরম বিপর্যয়ে তিনি ত্রাতা। এবং অধিনায়ক মুশফিক। অধিনায়কের দায়িত্বটা কী, কিভাবে পালন করতে হয়- এ নিয়ে যদি কেউ বই লেখেন, তবে সেই বইয়ে একটা অধ্যয় হতে পারে তাঁর এই সিরিজের পারফরম্যান্স। কালও যখন ৩২ রানে ৩ উইকেটে স্বপ্নগাড়ির চাকা ভুলপথে যাওয়ার জোগাড়, তখনও দিশারী এ দুজনই। ব্যাটটা আলোর মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে চলে সেখানে, যেখানে যেতে বাংলাদেশের কত-কত দিনের অপেক্ষা! তিন দিন আগে একবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আশা শেষ হয়েছে আফসোসে। অপেক্ষা বাড়িয়েছে আক্ষেপ। শেষ দিনে এসে যখন চাওয়া-পাওয়ার অঙ্কটা মিলল তখন মনে হচ্ছে, ভালোই হয়েছে। মূল্য বুঝতে এই অপেক্ষার দরকার ছিল। এই আফসোস শিখিয়ে গেছে সিরিজ জয়ের মানেটা কত বড়!
ম্যাচ শেষ হওয়ার আধাঘণ্টা পর প্রেসবক্সে বসে যখন এ লেখা লিখছি, তখন মাঝেমধ্যেই মনে হচ্ছে, যা হয়েছে সত্যি হয়েছে তো! বাংলাদেশ গেইলদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে একটা সিরিজে হারিয়ে দিল! সত্যি তো? নাকি কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে জানব আসলে ঘটনাটা হয়েছিল রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে...।
গ্যালারি এখন শূন্য। আলোগুলো নিভু নিভু। শেষ হয়ে যাওয়ার চিহ্ন যেন সব। কিন্তু শেষ তো নয়, আসলে শুরু। নতুন দিনের। নতুন যুগের। নতুন পরিভ্রমণের।
বাইরে উৎসব। রংয়ের খেলায় নীল আকাশ লাল হচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে জয়ধ্বনি। অন্ধকার যেন জ্বলছে নতুন আলোর রেখা হয়ে।
এদিনে প্রধানমন্ত্রী শিশুতাষ উৎসব তো করবেনই! এই দিনে মমিনুল-মুশফিকদের শারীরিক ক্ষুদ্রতা মুছে গিয়ে ওরা তো বিশালত্বের ছবি হয়ে উঠবেনই। এই দিনে বাংলাদেশ বিএনপি-আওয়ামী লীগের হানাহানির বাংলাদেশ না থেকে ছন্দে-রূপে-মাধুর্যে-সুরে স্বর্গীয় ছবি তো হবেই।
এ যে স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন। এ দিনে যে অন্য কিছু হতে নেই!
No comments