হৃদয়নন্দন বনে-সঠিক পথের দিশা by আলী যাকের

এবার ঈদের ছুটিতে দেশে থাকতে মন চাইল না। সাম্প্রতিককালে ছুটিছাটায় ঢাকা শহরে থাকতে আমার একদম ভালো লাগে না। খুব ইচ্ছে হয় গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। কিন্তু আজকাল রাস্তাঘাটে যানবাহনের যেরকম ভিড় আর যেমন অরাজকতা, তা সড়কপথে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য আদৌ উপযোগী নয়।


রাস্তাঘাটে কয়েক মাইল লম্বা যানজট, এমনকি জলপথ এবং রেলপথেও টিকিটের জন্য হাহাকার। আজকাল আবার অনেক বাংলাদেশি কাছেপিঠের বিদেশে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন অহরহ। সে জন্য বড় উৎসবগুলোর সময় উড়োজাহাজের টিকিট পাওয়াও বড় দুষ্কর। তবে এবার বেশ আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল আমি ও আমার স্ত্রী ঈদের ছুটিতে বাইরে যাব। অতএব, সেমতো ভিসা, পাসপোর্ট এবং বিমানের টিকিটও জোগাড় করা হয়ে গিয়েছিল। এবার আমাদের গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড। আমরা ব্যাংকক হয়ে যাব দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি দ্বীপে। নাম 'কোহ সামুই'। ঢাকা থেকে রাত ৩টায় ব্যাংকক এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে রওনা হয়ে অতি প্রত্যুষে ব্যাংককে গিয়ে পেঁৗছলাম তখনও সূর্য ওঠেনি। কিন্তু ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। ঢাকা থেকে আমাদের স্যুটকেসগুলো সরাসরি কোহ সামুইয়ের জন্য বুক করে দেওয়া হয়েছে। অতএব, এক ইমিগ্রেশন ছাড়া এ বিমানবন্দরে বিশেষ কিছু করার ছিল না। ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে সারা ও আমি উভয়েই চা কিংবা কফির তেষ্টায় কাতর হয়ে পড়লাম। করণীয় সবকিছু শেষে সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে গিয়ে আমরা গরম গরম চা এবং কফি ঢেলে একটি সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছি। ব্যাংকক থেকে কোহ সামুইয়ের বিমান ছাড়বে সকাল ৯টায়। হাতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে। সম্প্রতি নানা কাজে আমাকে প্রায়ই থাইল্যান্ডে আসতে হয়। বস্তুতপক্ষে এই দেশে আসা আমার শুরু হয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকে। তারপর চলছেই। ওইদিন বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে নানা কথা ভিড় করে এলো মাথায়।
আশির দশকে যখন আসতাম ব্যাংককে তখন এই শহরে এক চরম অরাজক অবস্থা বিরাজ করত। বিমানবন্দর থেকে শহরে যেতে কিংবা ফেরার সময় নিদেনপক্ষে ২ ঘণ্টা সময় খরচ হতো। শহরের ভেতরে সব রাস্তায় সর্বদাই যানজট লেগে থাকত। এ শহরে চাকরিরত আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শুনেছি, তারা তাদের বাচ্চাদের সকাল ৮টার স্কুল ধরানোর জন্য ভোর ৫টায় বাসে তুলে দিত। নিজেরা ৯টায় অফিসে পেঁৗছার জন্য ৬টা থেকে সাড়ে ৬টায় বাড়ি থেকে বের হতো। ব্যাংককের যানজট বিশ্বময় সর্বত্রই আলোচিত হতো। এখন সেই ব্যাংককের চেহারা একেবারে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। বিমানবন্দর থেকে শহরের ভেতরে যেতে দীর্ঘপথ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রায় উড়ে আসা যায়। যদিও ক্রমবর্ধমান যানবাহনের চাপ এখনও পরিলক্ষিত হয়, তবুও কোথাও সারি সারি গাড়ি কখনোই দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকে না। সুবর্ণভূমি ব্যাংককের নতুন বিমানবন্দর। ব্যাংককের পুরনো বিমানবন্দরের নাম ছিল ডন মুয়াং। সেটি ২০০৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়। তার বদলে আসে এই নতুন সুবর্ণভূমি। বিমানবন্দরটি স্থাপত্যকলা ও আকৃতিতে কিংবা সেবায় বিশ্বের যে কোনো প্রথম শ্রেণীর বিমানবন্দরের সঙ্গে তুলনীয়। এর ভেতরকার সব প্রয়োজনীয় বিভাগ ভারি সুন্দরভাবে বিন্যস্ত। শহরের ভেতরে চারদিকে তাকালে সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। মানুষের মুখে সর্বদাই হাসি লেগে আছে। দোকানগুলো পশ্চিমা দেশের যে কোনো বড় শহরের সুপারমলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ ব্যাংককের সর্বত্র প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। সেই আশির দশকে ব্যাংকককে ঢাকার সমতুল্য মনে হতো। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ, ডাস্টবিনে ময়লার আধিক্য, এ সবই তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত একটি শহরের পরিচয় বহন করত। সেখান থেকে ব্যাংকক প্রায় সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে একটি উন্নত ইউরোপীয় জনপদের রূপ নিয়েছে।
এক ঘণ্টার একটা ফ্লাইট নিয়ে সকাল ১০টার দিকে কোহ সামুইয়ে পেঁৗছানো গেল। কোহ সামুই বিমানবন্দরটি ছোট হলেও ভারি সুন্দর। আমাদের বাংলাদেশে এরকম ছোটখাটো বিমানবন্দর অনেক রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়া বাকি সবগুলোই বলতে গেলে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র। কিন্তু কোহ সামুইয়ের বিশেষত্ব হলো এই বিমানবন্দরের নকশায়। বিমান থেকে নেমে মনে হলো, অনেকগুলো কাঠ এবং বাঁশের তৈরি কুটিরাচ্ছন্ন একটি বিশাল বাগানে যেন এলাম। নানারকম ফুল গাছের সমারোহ। রঙ-বেরংয়ের নানা ফুল হাতছানি দিয়ে আমাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছে। আমাদের ছোট বিমানবন্দরগুলো দেখতে অতি কুরূপা। ইট-পাথরের হলুদ হলুদ ভবন, যা কি-না বৃষ্টির প্রকোপে শেওলাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ কোহ সামুইয়ের বন্দরের কী অপরূপ শোভা। আমরা মুগ্ধ হয়ে সবকিছু দেখছিলাম এবং ভাবছিলাম কেউ কেন উদ্যোগ গ্রহণ করে নিদেনপক্ষে আমাদের কক্সবাজার বিমানবন্দরটিকে এমন সুন্দর করে পুনর্নির্মাণ করে না! এই পর্যটন-শহরটিও ভারি সুন্দরভাবে বিন্যস্ত। কোথাও এক ফোঁটা ময়লা নেই। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। ওইখানে ঈদের ছুটি কাটিয়ে আমরা দেশে ফিরলাম।
দেশে ফিরে এসে আমি ভাবলাম, কী এমন বিশেষত্ব আছে থাইল্যান্ডে, যাতে করে ওই দেশটি গত ২০-২৫ বছরে এমন খোলনলচে পাল্টে ফেলল? হয়ে গেল একটি অতি চিত্তাকর্ষক এবং সফল দেশ। অনেকেই হয়তো বলবেন, আমাদের দুর্গতির পেছনে একমাত্র কারণ আমাদের রাজনীতি। আমাদের এখানে দলাদলি, রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং খেয়োখেয়ির প্রাদুর্ভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সদাই হচ্ছে ব্যাহত। আমি এমত ধারণাকে বাহুল্য কথা বলেই মনে করি। থাইল্যান্ডে অন্তর্ঘাতী রাজনীতি, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলা নিত্যদৃষ্ট। বস্তুতপক্ষে সেখানে এখন যে নারী প্রধানমন্ত্রী, তার আপন ভাই থাকসিন সিনাওয়াত্রা স্বদেশে ফিরতে পারছেন না, কেননা তিনি দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত এক আসামি। যে দল এখন ক্ষমতায়, তার বিরোধী একটি গোষ্ঠী, যার নাম লাল পিরান, তারা ক'দিন আগেও ব্যাংককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের একাধিক রানওয়ে দখল করে বিমান চলাচল তিন-চারদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই সময় থাইল্যান্ড ভ্রমণকারী সব পর্যটক এবং বহিরাগতরা প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েছিলেন। এবার আমাদের চোখের সামনেই একদিন এ দলটি ব্যাংককের ব্যস্ততম শপিং এলাকা অচল করে দিয়েছিল তাদের সমাবেশের ডাক দিয়ে। অতএব, তৃতীয় বিশ্বের মেঠো রাজনীতির সব অপসংস্কৃতিই থাইল্যান্ডে সাড়ম্বরে চলছে। সরকার বদল হচ্ছে অতি দ্রুত, কিন্তু থাইল্যান্ডের উন্নয়ন এত ব্যাহত হচ্ছে না। ক্ষমতায় যে-ই অধিষ্ঠিত হোক না কেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ঠিকই বজায় থাকছে।
এসব দেখে মনটা বড় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল আমার অভাগা দেশের জন্য। এবং কিছুতেই আমি আমার প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সত্ত্বেও থাইল্যান্ড কী করে এতদূর এগিয়ে যেতে পারে। আমি জানি না থাইল্যান্ডের অগ্রাভিযানের যে মডেল, সেটি কী। আমাদের দেশের বিদগ্ধজন ও সুশীল সমাজ যদি এ বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে এবং আমাদের দেশের মানুষকে, অপরাজনীতি সত্ত্বেও, সঠিক পথনির্দেশ দিতে এগিয়ে আসে, তাতেই আমাদের মঙ্গল। কেবল আর্মচেয়ার বিপ্লবী হওয়া নয়, হওয়া নয় নির্বীর্য সমালোচক, আমাদের শিক্ষিত সমাজকে হতে হবে সত্যিকার অর্থে কল্যাণকামী পথপ্রদর্শক, যেন আমরা সঠিক পথের দিশা খুঁজে পাই।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.