ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন-দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো
ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশটিকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আখ্যায়িত করা যথার্থ ছিল কি-না, সে প্রশ্ন চার দশক পরও সংগতভাবেই উঠছে।
সে সময়ের পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা দমনে নিষ্ঠুর গণহত্যার পাশাপাশি পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেছিল। এভাবে অপ্রতুল সম্পদ আর অন্তহীন সমস্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ নামের সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের। তদুপরি ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ আরও কোনো কোনো দেশের বৈরী আচরণ, যে কারণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অতিজরুরি কর্মসূচিগুলোর বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কালক্রমে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বুকে আজ তার গর্বিত অবস্থান এবং তা এই দেশের আপামর মানুষেরই শ্রম-মেধা-সাধনার ফসল। যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত সাময়িকী ইকোনমিস্টের 'বাংলাদেশ আউট অব দ্য বাস্কেট' এবং 'বাংলাদেশ দ্য পাথ থ্রো দ্য ফিল্ডস' শিরোনামে শনিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে মেলে তারই স্বীকৃতি। এতে বলা হয়েছে, একাত্তরে বিশ্ব মানচিত্রে আবির্ভাবের পর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে বেশ কিছু বড় অর্জন সবার নজরে পড়ছে। গড় আয়ু বাড়ছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনায় বাংলাদেশের সফলতা ধনী দেশ জাপানের সমতুল্য। পরিবার পরিকল্পনা নারীর ক্ষমতায়ন করেছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কম বরাদ্দ সত্ত্বেও বড় ধরনের সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। ইকোনমিস্ট অভিমত দিয়েছে যে প্রতিনিয়ত ঝড়-বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং উল্লেখ করার মতো কোনো খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়েছে। একই সঙ্গে প্রধান দুটি পক্ষের কলুষিত রাজনৈতিক যুদ্ধের মধ্যেও এ সাফল্য খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি ইকোনমিস্টের এ অভিমতকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। আমরা প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব চাইলেই ঘোচাতে পারব না। বৈরী প্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু জনগণের বৃহত্তর কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নিজেদের মধ্যে বিরোধ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতেই পারে। তারা জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করছেন বলে দাবি করেন এবং দেশবাসী তাদের এ কথার ওপর আস্থা রাখতে চায়। কে দেশ শাসন করবে, সেটা এই জনগণই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। জনগণের ভোটে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছে এবং সেটা সব দল মেনেও নিচ্ছে। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর ভরসা রাখাই শ্রেয়। তারা যদি 'অকার্যকর' রাজনৈতিক ধারা থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের ওপর বেশি আস্থা রাখতে পারেন, তাহলে আর্থ-সামাজিক খাতে কিছু অর্জন দ্রুতই বড় বড় সাফল্য নিয়ে আসতে পারে। 'রাজনৈতিক দুর্গতির' দুষ্টচক্র থেকে আমাদের অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে এবং সেটা করার দায় রাজনৈতিক শক্তিরই। আর্থ-সামাজিক খাতে অগ্রগতির সুফল হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের কোটি কোটি মানুষের ঘরে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য রয়েছে এবং সেটা বিশেষভাবে সামাজিক কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। এ ঐক্য আরও জোরদার হতে থাকলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত হবেই এবং তাতে সবচেয়ে বেশি লাভ জনগণের। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বলে উপহাস করার দুঃসহ স্মৃতিও এভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব।
No comments