রঙ্গব্যঙ্গ-হায় পুলিশ! by মোস্তফা কামাল
রহমত আলী পুলিশ অফিসার। তিন বছর আগে এসআই পদে যোগ দেন তিনি। ইন্টারভিউয়ে ভালো রেজাল্ট করেও তাঁকে চাকরি পেতে দুই লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের টাকা জোগাড় করতে তাঁকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়েছে।
কিন্তু চাকরির টাকা দিয়ে যে সেই ভিটেমাটি ফেরত পাবেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়! তরুণ পুলিশ অফিসার মনে মনে ভাবেন, কথায় বলে না, অভাবে স্বভাব নষ্ট- সেই অবস্থা হয়েছে আমার। কত দিন এই সৎ স্বভাব ধরে রাখতে পারি কে জানে!
রহমত আলী চাকরির শুরুতে সততা নিয়েই ছিলেন। আর সে জন্য তাঁকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নানা জন টিপ্পনি কেটে বলেছে, 'দেখব দেখব, কয়দিন সৎ থাকতে পার! প্রথম প্রথম সবাই অমন সততা দেখায়! তারপর আজান দিয়ে ঘুষ নিতে থাকে!'
এসব কথায় কান দিতেন না রহমত আলী। কিন্তু মা-বাবার কথা মনে পড়লেই রহমত আলী হাহাকার করে ওঠেন। ভিটেমাটি বিক্রি করায় রহমত আলীর মা-বাবা উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারেন না। টানে-মানে সংসার চলে তাঁদের। ফলে ধারদেনা শোধ করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। রহমত আলীর বাবা করম আলী মনে মনে ভাবেন, কী ব্যাপার! আমার ছেলে এত বড় পুলিশ অফিসার! তার পরও ঠিকমতো আমরা খেতে পাই না! ঘটনা কী! সে এত টাকা দিয়ে কী করে? নাজিরের ছেলে পুলিশ কনস্টেবল। অথচ তার টাকার কোনো কমতি নেই। আমাদের ছেলের এই করুণ অবস্থা কেন?
একদিন করম আলী কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় ছেলের কাছে চলে যান। ছেলের কাছে তিনি জানতে চান, বাবা রহমত আলী, তুমি তো নাজিরের ছেলেকে চেনো। সে একজন কনস্টেবল। আর তুমি অফিসার। নিশ্চয়ই তার চেয়ে তোমার বেতন অনেক বেশি। অথচ দুই বছরের মধ্যেই নাজিরের ছেলে বাড়িতে দোতলা ঘর করেছে। আমাদের পাশের বাড়ির কয়েক খণ্ড জমি কিনেছে। তার বাবা প্রতিদিন বাজার থেকে বড় বড় মাছ কেনে। আর আমরা ঠিকমতো খেতে পাই না। ধারদেনাও শোধ দিতে পারছি না। এভাবে আর কত দিন চলব বাবা!
রহমত আলী বাবার কাছে কী জবাব দেবেন! অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি তাঁর বাবাকে বলেন, বাবা, আমি জানি না একজন কনস্টেবল কী করে বাড়ি করে, জমি কেনে। তার যে বেতন তা দিয়ে তো নিজেরই ঠিকমতো চলার কথা নয়। বাবা, আমার মনে হয়, নাজিরের ছেলে ঘুষ নেয়। আমি পণ করেছি, আমি ঘুষ নেব না। ঘুষের টাকায় আপনাদের মুখে আহার দেব না। বাবা, কাজটা কি ভালো করছি না?
করম আলী হাসি হাসি মুখ করে বলেন, হ্যাঁ বাবা, খুব ভালো করছো। কিন্তু আমাদের যে পেট চলে না!
কিন্তু কী করব বাবা? আগেই তো বলেছিলাম, সরকারি চাকরিতে বেতন কম। উপরি ছাড়া পেট চালানো দায়। আপনি বললেন, বেতন কম তাতে কী! সম্মান তো আছে! তাই আমি সম্মান কুড়াচ্ছি।
করম আলী বললেন, বাবা, সম্মান কুড়াও ভালো কথা। কিন্তু আমাদের খেয়ে-পরে বাঁচতে তো হবে! আমরা কী করে বাঁচব! তোমার চাকরির জন্য টাকা দিতে গিয়ে আমরা ভিটেমাটি হারালাম। এক টুকরো জমিও নেই। অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকি। টাকার অভাবে ঠিকমতো বাজার করতে পারি না। এভাবে আর কত দিন চলবে বাবা!
রহমত আলী উপায়ান্তরহীন। কী করবেন, কিছুই ভেবে পান না। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বভাব নষ্ট করার সিদ্ধান্তই নিলেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, টাকা ছাড়া জীবন অচল। টাকা বানাতে হবে, সে যে করেই হোক। তারপর তিনি দুই হাতে টাকা রোজগারে মন দিলেন। অতি অল্প সময়েই তিনি অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলেন। গ্রামে অনেক জায়গা-জমি কিনলেন। তাঁর মা-বাবার জন্য তৈরি করলেন বিশাল আকারের ইমারত।
করম আলী মনে মনে বলেন, কে জানত এই ভিটিতে দালান উঠবে! আমার ছেলে মাশাআল্লাহ, বাপের ব্যাটা! থুক্কু বাপের ব্যাটা তো না! আমি কৃষক। আর ছেলে পুলিশ। ছেলের কারণে গ্রামের সবাই আমাকে পুলিশের বাপ বলে ডাকে। আমি এখন ছেলের পরিচয়ে পরিচিত। করম আলীর আনন্দ আর কে দেখে! তাঁর ছেলের জন্য বড় বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। তিনি অনেক যাচাই-বাছাই করে বড় ঘরের মেয়ে আনেন।
রহমত আলী নতুন বউ নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠবেন। তিনি বউ নিয়ে গেলেন বাড়ি ভাড়া করতে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে ঘটল মহাবিপত্তি। তিনি পুলিশের লোক, তাই বাড়ি ভাড়া দিতে নারাজ বাড়ির মালিক! স্ত্রীর সামনে নাক কাটা গেল রহমত আলীর। অথচ তাঁর গ্রামে তাঁকে নিয়ে কত গর্ব!
রহমত আলী দিশেহারা। তিনি নতুন বউকে নিয়ে এখন কোথায় উঠবেন! তিনি স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, নাদিয়া, এখন আমি কী করব! তোমাকে নিয়ে কোথায় উঠব?
নাদিয়ার মনমেজাজ ঠিক নেই। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, তোমাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় না! এটা কেমন কথা! তার মানে তুমি ঘুষখোর পুলিশ অফিসার! ঠিক কি না!
রহমত কোনো কথা বলেন না। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। নাদিয়ার রাগ তখনো পড়েনি। তিনি গলার স্বর চড়া করে বললেন, আগে যদি বুঝতাম, তুমি একটা ঘুষখোর পুলিশ অফিসার, তাহলে বিয়েই করতাম না। মা-বাবা কী বুঝে যে তোমার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিলেন!
রহমত আলী স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য বললেন, এত রাগ করছো কেন? বিয়ে যখন করেই ফেলেছি, তখন আর রাগ করে কী হবে? বুদ্ধি দাও কী করব?
আজ থেকে তুমি প্রতিজ্ঞা করো, আর কখনো ঘুষ নেবে না!
হায় হায়! তাহলে সংসার চালাব কিভাবে? মা-বাবাকে খাওয়াব কী?
সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।
তাহলে...
শোনো, আমিও চাকরি করব। দুজন মিলে যা আয় করব, তা দিয়ে আমাদের ভালোভাবে চলে যাবে। ঘুষখোর পুলিশ অফিসার, এই অপবাদ ঘোচাতেই হবে। বুঝতে পারছো?
স্ত্রীর কথায় সায় দিলেন রহমত আলী। তিনি মনে মনে বললেন, এমন স্ত্রী যদি সবার ঘরে থাকত, তাহলে দেশটাই পাল্টে যেত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
রহমত আলী চাকরির শুরুতে সততা নিয়েই ছিলেন। আর সে জন্য তাঁকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নানা জন টিপ্পনি কেটে বলেছে, 'দেখব দেখব, কয়দিন সৎ থাকতে পার! প্রথম প্রথম সবাই অমন সততা দেখায়! তারপর আজান দিয়ে ঘুষ নিতে থাকে!'
এসব কথায় কান দিতেন না রহমত আলী। কিন্তু মা-বাবার কথা মনে পড়লেই রহমত আলী হাহাকার করে ওঠেন। ভিটেমাটি বিক্রি করায় রহমত আলীর মা-বাবা উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের কাছে নিয়মিত টাকা পাঠাতে পারেন না। টানে-মানে সংসার চলে তাঁদের। ফলে ধারদেনা শোধ করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। রহমত আলীর বাবা করম আলী মনে মনে ভাবেন, কী ব্যাপার! আমার ছেলে এত বড় পুলিশ অফিসার! তার পরও ঠিকমতো আমরা খেতে পাই না! ঘটনা কী! সে এত টাকা দিয়ে কী করে? নাজিরের ছেলে পুলিশ কনস্টেবল। অথচ তার টাকার কোনো কমতি নেই। আমাদের ছেলের এই করুণ অবস্থা কেন?
একদিন করম আলী কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় ছেলের কাছে চলে যান। ছেলের কাছে তিনি জানতে চান, বাবা রহমত আলী, তুমি তো নাজিরের ছেলেকে চেনো। সে একজন কনস্টেবল। আর তুমি অফিসার। নিশ্চয়ই তার চেয়ে তোমার বেতন অনেক বেশি। অথচ দুই বছরের মধ্যেই নাজিরের ছেলে বাড়িতে দোতলা ঘর করেছে। আমাদের পাশের বাড়ির কয়েক খণ্ড জমি কিনেছে। তার বাবা প্রতিদিন বাজার থেকে বড় বড় মাছ কেনে। আর আমরা ঠিকমতো খেতে পাই না। ধারদেনাও শোধ দিতে পারছি না। এভাবে আর কত দিন চলব বাবা!
রহমত আলী বাবার কাছে কী জবাব দেবেন! অনেক চিন্তাভাবনার পর তিনি তাঁর বাবাকে বলেন, বাবা, আমি জানি না একজন কনস্টেবল কী করে বাড়ি করে, জমি কেনে। তার যে বেতন তা দিয়ে তো নিজেরই ঠিকমতো চলার কথা নয়। বাবা, আমার মনে হয়, নাজিরের ছেলে ঘুষ নেয়। আমি পণ করেছি, আমি ঘুষ নেব না। ঘুষের টাকায় আপনাদের মুখে আহার দেব না। বাবা, কাজটা কি ভালো করছি না?
করম আলী হাসি হাসি মুখ করে বলেন, হ্যাঁ বাবা, খুব ভালো করছো। কিন্তু আমাদের যে পেট চলে না!
কিন্তু কী করব বাবা? আগেই তো বলেছিলাম, সরকারি চাকরিতে বেতন কম। উপরি ছাড়া পেট চালানো দায়। আপনি বললেন, বেতন কম তাতে কী! সম্মান তো আছে! তাই আমি সম্মান কুড়াচ্ছি।
করম আলী বললেন, বাবা, সম্মান কুড়াও ভালো কথা। কিন্তু আমাদের খেয়ে-পরে বাঁচতে তো হবে! আমরা কী করে বাঁচব! তোমার চাকরির জন্য টাকা দিতে গিয়ে আমরা ভিটেমাটি হারালাম। এক টুকরো জমিও নেই। অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকি। টাকার অভাবে ঠিকমতো বাজার করতে পারি না। এভাবে আর কত দিন চলবে বাবা!
রহমত আলী উপায়ান্তরহীন। কী করবেন, কিছুই ভেবে পান না। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বভাব নষ্ট করার সিদ্ধান্তই নিলেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, টাকা ছাড়া জীবন অচল। টাকা বানাতে হবে, সে যে করেই হোক। তারপর তিনি দুই হাতে টাকা রোজগারে মন দিলেন। অতি অল্প সময়েই তিনি অনেক টাকার মালিক হয়ে গেলেন। গ্রামে অনেক জায়গা-জমি কিনলেন। তাঁর মা-বাবার জন্য তৈরি করলেন বিশাল আকারের ইমারত।
করম আলী মনে মনে বলেন, কে জানত এই ভিটিতে দালান উঠবে! আমার ছেলে মাশাআল্লাহ, বাপের ব্যাটা! থুক্কু বাপের ব্যাটা তো না! আমি কৃষক। আর ছেলে পুলিশ। ছেলের কারণে গ্রামের সবাই আমাকে পুলিশের বাপ বলে ডাকে। আমি এখন ছেলের পরিচয়ে পরিচিত। করম আলীর আনন্দ আর কে দেখে! তাঁর ছেলের জন্য বড় বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। তিনি অনেক যাচাই-বাছাই করে বড় ঘরের মেয়ে আনেন।
রহমত আলী নতুন বউ নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠবেন। তিনি বউ নিয়ে গেলেন বাড়ি ভাড়া করতে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে ঘটল মহাবিপত্তি। তিনি পুলিশের লোক, তাই বাড়ি ভাড়া দিতে নারাজ বাড়ির মালিক! স্ত্রীর সামনে নাক কাটা গেল রহমত আলীর। অথচ তাঁর গ্রামে তাঁকে নিয়ে কত গর্ব!
রহমত আলী দিশেহারা। তিনি নতুন বউকে নিয়ে এখন কোথায় উঠবেন! তিনি স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, নাদিয়া, এখন আমি কী করব! তোমাকে নিয়ে কোথায় উঠব?
নাদিয়ার মনমেজাজ ঠিক নেই। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, তোমাকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় না! এটা কেমন কথা! তার মানে তুমি ঘুষখোর পুলিশ অফিসার! ঠিক কি না!
রহমত কোনো কথা বলেন না। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। নাদিয়ার রাগ তখনো পড়েনি। তিনি গলার স্বর চড়া করে বললেন, আগে যদি বুঝতাম, তুমি একটা ঘুষখোর পুলিশ অফিসার, তাহলে বিয়েই করতাম না। মা-বাবা কী বুঝে যে তোমার সঙ্গে আমাকে বিয়ে দিলেন!
রহমত আলী স্ত্রীকে শান্ত করার জন্য বললেন, এত রাগ করছো কেন? বিয়ে যখন করেই ফেলেছি, তখন আর রাগ করে কী হবে? বুদ্ধি দাও কী করব?
আজ থেকে তুমি প্রতিজ্ঞা করো, আর কখনো ঘুষ নেবে না!
হায় হায়! তাহলে সংসার চালাব কিভাবে? মা-বাবাকে খাওয়াব কী?
সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।
তাহলে...
শোনো, আমিও চাকরি করব। দুজন মিলে যা আয় করব, তা দিয়ে আমাদের ভালোভাবে চলে যাবে। ঘুষখোর পুলিশ অফিসার, এই অপবাদ ঘোচাতেই হবে। বুঝতে পারছো?
স্ত্রীর কথায় সায় দিলেন রহমত আলী। তিনি মনে মনে বললেন, এমন স্ত্রী যদি সবার ঘরে থাকত, তাহলে দেশটাই পাল্টে যেত।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments