সুতরাং-নদ-নদীর মৃত্যুরোধ ও অভিন্ন নদীর সমস্যা সমাধান by শামসুল আরেফিন খান
ঔপনিবেশিক যুগে ভারতবর্ষের কাঁচামাল লুণ্ঠন করে ডান্ডি ও ম্যানচেস্টার শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছিল ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ। বাংলার সম্পদ লোপাট করার লক্ষ্যে নৌপথ পরিহার করে স্থলযোগাযোগ অবকাঠামো তৈরির প্রথম ধাপেই তৈরি হয়েছিল রেলপথ।
মূলত কলকাতা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে স্থলসংযোগ স্থাপনের স্বার্থেই বাংলার নদীমালার গলা টিপে ধরা হয়। কলকাতা থেকে ঈশ্বরদী রানাঘাট হয়ে পশ্চিমাঞ্চলের ফরিদপুর ও খুলনা এবং উত্তরাঞ্চলে পার্বতীপুর হয়ে দার্জিলিং-শিলিগুড়ির দিকে রেলপথ প্রসারিত হয়। যমুনা তীরের বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে পূর্বাঞ্চলের দিকে রেলের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ময়মনসিংহ ও সিলেট এবং নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। অন্যদিকে সিলেটের সঙ্গে আসাম ও ত্রিপুরা সংযুক্ত হয় বিভিন্ন ধারায়।
এ পর্যায়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী কাঠামোর ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ ও তার অশুভ প্রতিক্রিয়ার বিষয় নিয়ে এর আগে প্রকাশিত এই নিবন্ধের শুরুর দিকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। উপাত্ত এনেছি ইতিহাস ঘেঁটে। মোদ্দাকথা যেটা এ ব্যাপারে তা হলো, এই যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ভারতবর্ষের অনন্য ঐতিহ্য মসলিনের সৃজনশীল কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল, নীলকুঠি স্থাপন ও নীলচাষ চালু করে খাদ্য উৎপাদনে বন্ধ্যত্ব এনেছিল, এক কোটি মানুষকে অনাহারে মেরেছিল যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায়, সেই অভিন্ন স্বার্থেই তারা রেলপথও গড়েছিল। আধুনিক যুগের সঙ্গে ভারতবাসীর সংযোগ ঘটানো কিংবা পদানত উপমহাদেশে নতুন সভ্যতার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো সদিচ্ছা সাম্রাজ্যবাদীদের মনে ঠাঁই পেয়েছিল- এমন ভাবার কোনো সংগত কারণ দেখি না।
সে যা-ই হোক, মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে আসা যাক। বহু দিন ধরে এমনটি প্রচারিত ও আলোচিত হয়ে আসছিল যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ক্রমেই সমুদ্রস্ফীতি ঘটতে থাকায় অদূর ভবিষ্যতেই উপকূলাঞ্চলসহ বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা লোনা সাগরজলে তলিয়ে যাওয়া অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী হবে। কিন্তু ঐতিহাসিক উপাত্ত ও বিভিন্ন গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, কেবল সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিই নয়, ভূ-কাঠামোর কৃত্রিম পরিবর্তন ঘটানোর কারণেও জলমগ্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। প্রথমে খৰ চালিয়েছিলেন উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসকরা। বিশ্বব্যাংকের পশ্চিমা উপদেষ্টারা ক্রুগ মিশনের সদস্য হয়ে এসে পূর্ব বাংলার বিপন্ন নদীমালার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন। চার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৭৮২টি স্লুইসগেট ও ৯২টি পোল্ডার নির্মিত হওয়ায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে। উপকূলাঞ্চলসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার নদ-নদী সামষ্টিকভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ক্রমে। সেই করুণ পরিণতির দৃশ্যমান তাজা আলামত হলো ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের পরিসর ৪১ বছরে মাত্র তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটারে সংকুচিত হওয়ার জাজ্বল্যমান ঘটনা।
বাংলাদেশে প্রায় ৭১১ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ রয়েছে। এটাকে ১. ফেনী নদী থেকে সর্বদক্ষিণে বদর মোকাম পর্যন্ত উপকূলীয় ভূ-ভাগকে পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল, ২. সুন্দরবনের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ সীমানায় তার শেষ অংশ পর্যন্ত ভূখণ্ডকে কেন্দ্রীয় উপকূলীয় অঞ্চল, ৩. দুই অংশের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকে পশ্চিম উপকূলীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই হিসাব অনুযায়ী- ১. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৩০টি উপজেলা এবং ২. যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার ১৭টি উপজেলা কেন্দ্রীয় উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলগুলোর প্রায় সর্বত্র এখনই গ্রিন হাউস আলামত দৃশ্যমান হয়েছে।
বাংলাদেশের নদ-নদী বছরে ২০৪ বিলিয়ন টন পলি বহন করে। অবরোধ বা কর্ডন আরোপের পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ারে উঠে আসা পলিমাটি প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। কেবল নদীতে পতিত হওয়ায় নদীবক্ষ ভরাট হয়েছে। অবনয়ন বেশি হওয়ায় ভূমির নিম্নগামিতা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীর তলদেশ প্লাবন ভূমির উচ্চতায় উঠে এসেছে। এর মারাত্মক পরিণতিতে 'ম্যাচুয়োর ডেল্টা' এলাকায় জলাবদ্ধতার সূত্রপাত হয়েছে। ক্রমে দক্ষিণ উপকূলীয় বাঁধের দিকে জলাবদ্ধতার প্রসার ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৯৬৭ সালে ক্রুগ মিশনের প্রেসক্রিপশনের ধারায় কর্ডন আরোপের পরবর্তী চার দশকে ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া বিঘি্নত হওয়ায় প্রাকৃতিক উপায়ে পলি সন্নিবেশিত হয়ে ভূমির উচ্চতা বাড়েনি। পক্ষান্তরে সামুদ্রিক জলস্ফীতি অব্যাহত থেকেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিল, হাওর, বাঁওড় ও নিম্নভূমিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও কোনো কোনো সময় বন্যার পানি নিষ্কাশিত হতে পারেনি মরা নদীর ভরাট বুক বেয়ে।
ব্যাপক জলাবদ্ধতা তারই পরিণাম। এসব ইতিহাস চেপে রেখে মহলবিশেষ এ যাবৎকাল বৈশ্বিক উষ্ণায়নকেই একমাত্র আসামি করেছে উপকূলীয় জনজীবনে নেমে আসা জলাবদ্ধতাজনিত দুর্বিষহ দুর্গতির জন্য।
এ কথা অনস্বীকার্য, যান্ত্রিক বলয় থেকে উৎসারিত মিথেন বা গ্রিনহাউস গ্যাস ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যার অনভিপ্রেত পরিণাম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে দুই থেকে তিন মিলিমিটার বৃদ্ধি। কোনো কোনো গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলে সাগরের সেই উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে চার থেকে আট মিলিমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম ও আরব সাগরের সীমানায় অবস্থিত বিশাখা পত্তনম, চেন্নাই, মুম্বাই, করাচি ও এডেনে দীর্ঘমেয়াদি (৪০ বছর) জোয়ার-ভাটার তথ্য সাগরজলের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে দুই মিলিমিটারের কম দেখাচ্ছে। অন্যদিকে জোয়ারের অপর এক তথ্য পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর মোহনায় ডায়মন্ড হারবারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হার দেখাচ্ছে ছয় মিলিমিটারের কাছাকাছি। এসব গবেষণা থেকে যদিও ধরে নেওয়া হয় যে বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হার নিকটবর্তী অন্য অঞ্চল থেকে বেশি, তাহলে এর জন্য দায়ী করতে হবে স্থলভূমির ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়া বা অবনয়নকে। অনেক গবেষক মনে করেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বিরাট অংশ বছরে এক থেকে পাঁচ মিলিমিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে।
হাজার হাজার বছর ধরে হিমালয় থেকে নেমে আসা যে জলধারা ও পলিস্রোত বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হচ্ছে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার খ্যাতিমান গবেষক ড. দীপেন ভট্টাচার্য একে সব শৃঙ্খল মুক্ত করে মুক্ত ছন্দে বইতে দেওয়ার জন্য জোর সুপারিশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ওই জলধারা বাহিত ২০৫ বিলিয়ন টন পলির বহুলাংশ প্লাবন অববাহিকা ও উপকূলাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে সাগরজলের ক্রমবর্ধমান উচ্চতার বিপরীতে ভূমির উচ্চতা স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পাবে। আমরা শ্বাস নেওয়ার কিছুটা বাড়তি সময় পাব। আরো কিছুকাল নিরাপদ থাকব ও চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকার অবকাশ মিলবে। সে জন্য বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট ও পোল্ডার-জাতীয় বাধাগুলো অপসারণ করে নদ-নদীর সঙ্গে প্লাবন অববাহিকার সাবেক যোগসূত্র পুনঃস্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে মরা নদী পুনঃখনন ও বহতা নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধিও জরুরি হবে। এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও অভিমতের কথা এর আগেই ১১ অক্টোবর প্রকাশিত এক নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি।
উপসংহার : বিষয়টি মাটি ও মানুষের নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিরাজমান জলাবদ্ধতা সংকট নিরসন সহজসাধ্য নয়। কোনো দলীয় সরকারের এক মেয়াদে সমাধানযোগ্য নয় শত বছরের পুঞ্জীভূত এই মৌলিক সমস্যা। স্বার্থান্বেষী সুবিধাভোগী প্রভাবশালী মহলের বাধাও দুর্লঙ্ঘ। চর দখল, মরা নদীর উপকূল এমনকি বুকজুড়ে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ ও চিংড়িচাষসহ নানাভাবে প্রসারিত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই জেতাটাও কোনো সহজ কাজ নয়। মুক্তচিন্তার কিছু আদর্শনিষ্ঠ সাহসী মানুষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সে লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। কিন্তু সামনে বাড়তে পারছেন না বাধার বিন্ধাচল ডিঙিয়ে। তাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সব মতের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং পর্যাপ্ত গণসচেতনতা সৃষ্টি করেই দৃপ্ত পায়ে এগোতে হবে সরকারি ক্ষমতার সতর্ক ও যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়ে। সব মতের জনগণকে সম্পৃক্ত না করে বিচ্ছিন্ন ও এককভাবে পা ফেলার পরিণতি কী হতে পারে তা সাম্প্রতিককালে জনস্বার্থে যশোরের মণিরামপুর থানাধীন ভবদহ বিলে জোয়ার আধার প্রকল্প উদ্বোধনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। গণবিচ্ছিন্ন হুইপ আবদুল ওহাব এমপি ও সরকারের লোকলস্কর বেজায় নাকাল ও নাজেহাল হয়ে ফিরে এসেছেন। একশ্রেণীর মতলববাজ মানুষ মারমুখী হয়ে, ভাঙচুর করে এবং কপট আত্মহত্যার নাটক করে তাদের প্রতিরোধ করেছে। সংকট নিরসনের দাবিতে আন্দোলনরত সচেতন মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন তেমন কোনো কাজে আসেনি।
এর আগে অন্য রকম খণ্ডিত সমাধানের লক্ষ্যে নেওয়া কেজেডিআরপি (খুলনা যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) নামের ৬২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা এক প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এর জন্য অনুদানবহির্ভূত ৩২.৬ মিলিয়ন এডিবির ঋণ বাংলাদেশ সরকারকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিছু কিছু সম্ভাবনাময় প্রকল্প আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় বন্দি থেকে বহুকাল ধরে গুমরে মরছে। বর্তমান বাস্তবতায় মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত জাতির শীর্ষ নেতৃত্ব কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পদ রক্ষায় যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসেন বৃহত্তম জাতির স্বার্থে, কেবল তবেই ধাবমান বিপর্যয়ের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতে পারে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনজনিত সমস্যার আশু সমাধানও প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে সংকট মোকাবিলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলারও কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
muk isakhan@yahoo.com
এ পর্যায়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী কাঠামোর ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ ও তার অশুভ প্রতিক্রিয়ার বিষয় নিয়ে এর আগে প্রকাশিত এই নিবন্ধের শুরুর দিকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। উপাত্ত এনেছি ইতিহাস ঘেঁটে। মোদ্দাকথা যেটা এ ব্যাপারে তা হলো, এই যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ভারতবর্ষের অনন্য ঐতিহ্য মসলিনের সৃজনশীল কারিগরদের আঙুল কেটে দিয়েছিল, নীলকুঠি স্থাপন ও নীলচাষ চালু করে খাদ্য উৎপাদনে বন্ধ্যত্ব এনেছিল, এক কোটি মানুষকে অনাহারে মেরেছিল যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায়, সেই অভিন্ন স্বার্থেই তারা রেলপথও গড়েছিল। আধুনিক যুগের সঙ্গে ভারতবাসীর সংযোগ ঘটানো কিংবা পদানত উপমহাদেশে নতুন সভ্যতার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো সদিচ্ছা সাম্রাজ্যবাদীদের মনে ঠাঁই পেয়েছিল- এমন ভাবার কোনো সংগত কারণ দেখি না।
সে যা-ই হোক, মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে আসা যাক। বহু দিন ধরে এমনটি প্রচারিত ও আলোচিত হয়ে আসছিল যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ক্রমেই সমুদ্রস্ফীতি ঘটতে থাকায় অদূর ভবিষ্যতেই উপকূলাঞ্চলসহ বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা লোনা সাগরজলে তলিয়ে যাওয়া অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী হবে। কিন্তু ঐতিহাসিক উপাত্ত ও বিভিন্ন গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, কেবল সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিই নয়, ভূ-কাঠামোর কৃত্রিম পরিবর্তন ঘটানোর কারণেও জলমগ্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। প্রথমে খৰ চালিয়েছিলেন উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসকরা। বিশ্বব্যাংকের পশ্চিমা উপদেষ্টারা ক্রুগ মিশনের সদস্য হয়ে এসে পূর্ব বাংলার বিপন্ন নদীমালার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন। চার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৭৮২টি স্লুইসগেট ও ৯২টি পোল্ডার নির্মিত হওয়ায় মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে। উপকূলাঞ্চলসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার নদ-নদী সামষ্টিকভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে ক্রমে। সেই করুণ পরিণতির দৃশ্যমান তাজা আলামত হলো ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথের পরিসর ৪১ বছরে মাত্র তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটারে সংকুচিত হওয়ার জাজ্বল্যমান ঘটনা।
বাংলাদেশে প্রায় ৭১১ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ রয়েছে। এটাকে ১. ফেনী নদী থেকে সর্বদক্ষিণে বদর মোকাম পর্যন্ত উপকূলীয় ভূ-ভাগকে পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল, ২. সুন্দরবনের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ সীমানায় তার শেষ অংশ পর্যন্ত ভূখণ্ডকে কেন্দ্রীয় উপকূলীয় অঞ্চল, ৩. দুই অংশের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকে পশ্চিম উপকূলীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই হিসাব অনুযায়ী- ১. দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৩০টি উপজেলা এবং ২. যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলার ১৭টি উপজেলা কেন্দ্রীয় উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলগুলোর প্রায় সর্বত্র এখনই গ্রিন হাউস আলামত দৃশ্যমান হয়েছে।
বাংলাদেশের নদ-নদী বছরে ২০৪ বিলিয়ন টন পলি বহন করে। অবরোধ বা কর্ডন আরোপের পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জোয়ারে উঠে আসা পলিমাটি প্লাবন ভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। কেবল নদীতে পতিত হওয়ায় নদীবক্ষ ভরাট হয়েছে। অবনয়ন বেশি হওয়ায় ভূমির নিম্নগামিতা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীর তলদেশ প্লাবন ভূমির উচ্চতায় উঠে এসেছে। এর মারাত্মক পরিণতিতে 'ম্যাচুয়োর ডেল্টা' এলাকায় জলাবদ্ধতার সূত্রপাত হয়েছে। ক্রমে দক্ষিণ উপকূলীয় বাঁধের দিকে জলাবদ্ধতার প্রসার ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৯৬৭ সালে ক্রুগ মিশনের প্রেসক্রিপশনের ধারায় কর্ডন আরোপের পরবর্তী চার দশকে ভূমি গঠনপ্রক্রিয়া বিঘি্নত হওয়ায় প্রাকৃতিক উপায়ে পলি সন্নিবেশিত হয়ে ভূমির উচ্চতা বাড়েনি। পক্ষান্তরে সামুদ্রিক জলস্ফীতি অব্যাহত থেকেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিল, হাওর, বাঁওড় ও নিম্নভূমিতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও কোনো কোনো সময় বন্যার পানি নিষ্কাশিত হতে পারেনি মরা নদীর ভরাট বুক বেয়ে।
ব্যাপক জলাবদ্ধতা তারই পরিণাম। এসব ইতিহাস চেপে রেখে মহলবিশেষ এ যাবৎকাল বৈশ্বিক উষ্ণায়নকেই একমাত্র আসামি করেছে উপকূলীয় জনজীবনে নেমে আসা জলাবদ্ধতাজনিত দুর্বিষহ দুর্গতির জন্য।
এ কথা অনস্বীকার্য, যান্ত্রিক বলয় থেকে উৎসারিত মিথেন বা গ্রিনহাউস গ্যাস ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। যার অনভিপ্রেত পরিণাম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে দুই থেকে তিন মিলিমিটার বৃদ্ধি। কোনো কোনো গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলে সাগরের সেই উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে চার থেকে আট মিলিমিটার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম ও আরব সাগরের সীমানায় অবস্থিত বিশাখা পত্তনম, চেন্নাই, মুম্বাই, করাচি ও এডেনে দীর্ঘমেয়াদি (৪০ বছর) জোয়ার-ভাটার তথ্য সাগরজলের উচ্চতা বৃদ্ধির হার বছরে দুই মিলিমিটারের কম দেখাচ্ছে। অন্যদিকে জোয়ারের অপর এক তথ্য পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর মোহনায় ডায়মন্ড হারবারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হার দেখাচ্ছে ছয় মিলিমিটারের কাছাকাছি। এসব গবেষণা থেকে যদিও ধরে নেওয়া হয় যে বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির হার নিকটবর্তী অন্য অঞ্চল থেকে বেশি, তাহলে এর জন্য দায়ী করতে হবে স্থলভূমির ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়া বা অবনয়নকে। অনেক গবেষক মনে করেন, বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বিরাট অংশ বছরে এক থেকে পাঁচ মিলিমিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে।
হাজার হাজার বছর ধরে হিমালয় থেকে নেমে আসা যে জলধারা ও পলিস্রোত বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হচ্ছে, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার খ্যাতিমান গবেষক ড. দীপেন ভট্টাচার্য একে সব শৃঙ্খল মুক্ত করে মুক্ত ছন্দে বইতে দেওয়ার জন্য জোর সুপারিশ করেছেন। তিনি মনে করেন, ওই জলধারা বাহিত ২০৫ বিলিয়ন টন পলির বহুলাংশ প্লাবন অববাহিকা ও উপকূলাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে সাগরজলের ক্রমবর্ধমান উচ্চতার বিপরীতে ভূমির উচ্চতা স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পাবে। আমরা শ্বাস নেওয়ার কিছুটা বাড়তি সময় পাব। আরো কিছুকাল নিরাপদ থাকব ও চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে মুক্ত থাকার অবকাশ মিলবে। সে জন্য বেড়িবাঁধ, স্লুইসগেট ও পোল্ডার-জাতীয় বাধাগুলো অপসারণ করে নদ-নদীর সঙ্গে প্লাবন অববাহিকার সাবেক যোগসূত্র পুনঃস্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে মরা নদী পুনঃখনন ও বহতা নদ-নদীর নাব্য বৃদ্ধিও জরুরি হবে। এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও অভিমতের কথা এর আগেই ১১ অক্টোবর প্রকাশিত এক নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি।
উপসংহার : বিষয়টি মাটি ও মানুষের নাড়ির স্পন্দনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিরাজমান জলাবদ্ধতা সংকট নিরসন সহজসাধ্য নয়। কোনো দলীয় সরকারের এক মেয়াদে সমাধানযোগ্য নয় শত বছরের পুঞ্জীভূত এই মৌলিক সমস্যা। স্বার্থান্বেষী সুবিধাভোগী প্রভাবশালী মহলের বাধাও দুর্লঙ্ঘ। চর দখল, মরা নদীর উপকূল এমনকি বুকজুড়ে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ ও চিংড়িচাষসহ নানাভাবে প্রসারিত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই জেতাটাও কোনো সহজ কাজ নয়। মুক্তচিন্তার কিছু আদর্শনিষ্ঠ সাহসী মানুষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই সে লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন। কিন্তু সামনে বাড়তে পারছেন না বাধার বিন্ধাচল ডিঙিয়ে। তাই দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সব মতের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং পর্যাপ্ত গণসচেতনতা সৃষ্টি করেই দৃপ্ত পায়ে এগোতে হবে সরকারি ক্ষমতার সতর্ক ও যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়ে। সব মতের জনগণকে সম্পৃক্ত না করে বিচ্ছিন্ন ও এককভাবে পা ফেলার পরিণতি কী হতে পারে তা সাম্প্রতিককালে জনস্বার্থে যশোরের মণিরামপুর থানাধীন ভবদহ বিলে জোয়ার আধার প্রকল্প উদ্বোধনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। গণবিচ্ছিন্ন হুইপ আবদুল ওহাব এমপি ও সরকারের লোকলস্কর বেজায় নাকাল ও নাজেহাল হয়ে ফিরে এসেছেন। একশ্রেণীর মতলববাজ মানুষ মারমুখী হয়ে, ভাঙচুর করে এবং কপট আত্মহত্যার নাটক করে তাদের প্রতিরোধ করেছে। সংকট নিরসনের দাবিতে আন্দোলনরত সচেতন মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থন তেমন কোনো কাজে আসেনি।
এর আগে অন্য রকম খণ্ডিত সমাধানের লক্ষ্যে নেওয়া কেজেডিআরপি (খুলনা যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) নামের ৬২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা এক প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এর জন্য অনুদানবহির্ভূত ৩২.৬ মিলিয়ন এডিবির ঋণ বাংলাদেশ সরকারকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিছু কিছু সম্ভাবনাময় প্রকল্প আমলাতন্ত্রের লাল ফিতায় বন্দি থেকে বহুকাল ধরে গুমরে মরছে। বর্তমান বাস্তবতায় মতাদর্শগতভাবে বিভক্ত জাতির শীর্ষ নেতৃত্ব কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও সহায়-সম্পদ রক্ষায় যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসেন বৃহত্তম জাতির স্বার্থে, কেবল তবেই ধাবমান বিপর্যয়ের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতে পারে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টনজনিত সমস্যার আশু সমাধানও প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে সংকট মোকাবিলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলারও কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা
muk isakhan@yahoo.com
No comments