রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধের দায়মুক্তি ন্যায়বিচারের হুমকিস্বরূপ by ডক্টর তুহিন মালিক
আইন ও বিচারব্যবস্থায় দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলার কথা থাকলেও 'রাজনৈতিক মামলা' বলতে কোনো কিছু নেই। অথচ প্রতিটি সরকারের আমলেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ নিয়ে আসছে।
এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাদের একান্ত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক মামলাগুলোকেও রাজনৈতিক মামলা বলে প্রত্যাহারের নজির রয়েছে। জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও দুর্নীতির মামলাগুলোকে 'রাজনৈতিক মামলা' বলে পাইকারিহারে বাতিল প্রক্রিয়া যদি এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে, তাহলে দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে। গণতন্ত্রের অন্যতম মূল স্তম্ভ হচ্ছে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কখনোই সুদৃঢ় হবে না। একটি দেশের বিচার বিভাগকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে হলে তাকে রাজনীতি ও দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা যেন মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের দলীয় নেতা-কর্মী পরিচয়ে কথিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমান মহাজোট সরকারও বিগত সরকারের অনেক বিষয়ে প্রবল ভিন্নমত পোষণ করলেও ক্ষমতায় এসে দ্বিগুণ উৎসাহে এ কাজটি কিন্তু ঠিকই করে চলেছে। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের অনেক অপরাধী পার পেয়ে গেছে। খুন-ধর্ষণ, অস্ত্রবাজি ও নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধ করেও তারা দিব্যি পার পেয়ে গেছে। এমনকি সরকারি দলের নয়- এমন অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসীকেও মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির নাম রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি হলেও বাস্তবে দেখা গেছে, মামলা প্রত্যাহারের তালিকার ৯৯ শতাংশই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। এতে বিরোধী দলের আবেদন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বললেই চলে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি অবশ্য বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়নি। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এরূপ একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং তখন প্রায় ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে প্রত্যাহারকৃত মামলার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। আর এভাবে সব সরকারই হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের নামে দলীয় নেতা-কর্মীদের অপরাধের দায়মুক্তি ঘটাচ্ছে। এ এক অতি অশুভ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির এটাও অন্যতম কারণ বটে। আমাদের সমাজে সংঘটিত অপরাধগুলোর একটা বড় অংশ ঘটিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা। অথচ শুধু সরকারি দলের নেতা-কর্মী এই পরিচয়ের সুবাদে তাঁদের কৃতকর্মের কোনো বিচার হয় না। আইনের শাসনের এই বিচ্যুতি প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে কমিটি করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই।
সেই সঙ্গে আরো উদ্বেগজনক আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান। দলীয় লোকদের দিয়ে কমিটি করে তথাকথিত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সঙ্গে এই ক্ষমতার অপব্যবহারটিও একই সুতায় বাঁধা। বিএনপির আমলে সুইডেন প্রবাসী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জিন্টুকে নিতান্ত দলীয় বিবেচনায় ক্ষমা করা হয়েছিল। ওই সময় এ ঘটনা প্রকাশিত হলে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা এর প্রতিবাদ করেছিলেন, এবার ক্ষমতায় এসে তাঁরা সেটাই জায়েজ করলেন। বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি একাধিক মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রেহাই দেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এটা সাংবিধানিক ক্ষমতা অপব্যবহারের গুরুতর দৃষ্টান্তও বটে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকার কোনো সাধারণ অধিকার নয়। ইংলিশ কমন ল-এর যে 'রয়্যাল প্রিরোগেটিভ', সেটাই আমাদের ৪৯ অনুচ্ছেদ ধারণ করেছে। সে কারণেই সংবিধানে বাংলায় 'অধিকার' লেখা হলেও এর ইংরেজি কিন্তু সঠিক অর্থেই 'প্রিরোগেটিভ'। এটা একটি বিশেষ অধিকার। যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত ও সংরক্ষিত অধিকার। আমাদের নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত জনপ্রশাসন রাষ্ট্রপতির 'প্রিরোগেটিভ'কে যেভাবে খোলামকুচি করে ফেলছে, তাতে দেশের বিচারব্যবস্থা বড় ধরনের হোঁচট খেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অপরাধের রাজনৈতিক দায়মুক্তি মানুষকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মারাত্মক ব্যাধিতে সংক্রমিত করছে। এই প্রেক্ষাপটে তথাকথিত রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার ও দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমরা এর আগে সংসদ উপনেতার ছেলেকে আইনের কাছে নিজেকে সোপর্দ না করে পলাতক অবস্থায় দণ্ড মওকুফ পেতে দেখেছি। একটি লোমহর্ষক খুনের দণ্ডিত আসামি ১০ বছরের বেশি সময় পালিয়ে থেকে আদালতে আত্মসমর্পণের চার মাস না যেতেই ক্ষমা লাভের ঘটনাও জাতি এই সরকারের আমলে প্রত্যক্ষ করেছে। উপরন্তু এই হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিকভাবেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এটা পরিষ্কার যে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে দেওয়া রাষ্ট্রপতির অধিকারের অপরিণামদর্শী প্রয়োগ আইনের শাসনের সর্বনাশ ডেকে আনছে। এর আশু প্রতিকারের জন্য আমি দুটি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। প্রথমত, গত দুই দশকে ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হোক। জাতীয় সংসদে বিষয়টি আলোচনা হোক। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, দণ্ড মওকুফে প্রকৃত যুক্তি থাকতে হবে। ভারতীয় আদালতের এক নির্দেশে হরিয়ানার স্বরাষ্ট্রসচিবকে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে দণ্ড মওকুফের সব তথ্য হলফনামা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশেও এ-সংক্রান্ত তথ্য জানানো জরুরি বলে মনে করি। আমাদের সংবিধান একটি বিশেষ ও অত্যন্ত বিরল ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ৪৯ অনুচ্ছেদে যে অধিকার দিয়েছে, তার মর্যাদা ও যথাপ্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার রোধে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি গাইডলাইন বেঁধে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন জরুরি বলে আমি মনে করি।
আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকলে জনগণ আদালতের দ্বারস্থ হবে না। দল-মত, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আইন অনুযায়ী সব অপরাধের সঠিক বিচার হবে- এমনটিই কাম্য। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে আবেগের যত গুরুত্ব থাকুক না কেন বিচার ও দণ্ডদানের ক্ষেত্রে আবেগের দ্বারা তাড়িত হলে সেখানে ন্যায়বিচার উপেক্ষার শিকার হতে পারে। দেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হলেও এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্বাধীনতাটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ স্বাধীনতা সক্রিয় না থাকলে এবং তা নির্জীব হয়ে পড়লে সে স্বাধীনতা কোনো কিছু দিয়েই পুনরুদ্ধার করা সম্ভবপর হয় না। যে দেশে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত সে দেশ আর যা-ই হোক নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারে না।
আমাদের মতো দেশে রাজনৈতিক কারণে দলীয় লোকজন বিভিন্নভাবে মামলা-হামলার শিকার হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজনৈতিক লোকজনের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে যথাযথ নজর না দিলে তা বড় ধরনের কোনো সংকটেরও জন্ম দিতে পারে। মামলার উপাদান ও গুণাগুণ বিচার না করেই এভাবে পাইকারিহারে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার ও দণ্ডিতের শাস্তি মওকুফ ব্যবস্থাটি অপরাধ সংঘটনকে আরো উৎসাহিত করে তুলবে। এভাবে অপরাধীরা দায়মুক্তির লোভে রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে। আর এ অবৈধ সুযোগটি স্বয়ং রাষ্ট্রই করে দিচ্ছে। এতে দেশের ক্ষতির পাশাপাশি রাজনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে অপরাধের রাজনৈতিকীকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের দলীয় নেতা-কর্মী পরিচয়ে কথিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমান মহাজোট সরকারও বিগত সরকারের অনেক বিষয়ে প্রবল ভিন্নমত পোষণ করলেও ক্ষমতায় এসে দ্বিগুণ উৎসাহে এ কাজটি কিন্তু ঠিকই করে চলেছে। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের অনেক অপরাধী পার পেয়ে গেছে। খুন-ধর্ষণ, অস্ত্রবাজি ও নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধ করেও তারা দিব্যি পার পেয়ে গেছে। এমনকি সরকারি দলের নয়- এমন অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসীকেও মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির নাম রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি হলেও বাস্তবে দেখা গেছে, মামলা প্রত্যাহারের তালিকার ৯৯ শতাংশই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। এতে বিরোধী দলের আবেদন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি বললেই চলে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সংস্কৃতি অবশ্য বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়নি। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এরূপ একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং তখন প্রায় ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। বর্তমান সরকারের আমলে প্রত্যাহারকৃত মামলার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। আর এভাবে সব সরকারই হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের নামে দলীয় নেতা-কর্মীদের অপরাধের দায়মুক্তি ঘটাচ্ছে। এ এক অতি অশুভ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির এটাও অন্যতম কারণ বটে। আমাদের সমাজে সংঘটিত অপরাধগুলোর একটা বড় অংশ ঘটিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা। অথচ শুধু সরকারি দলের নেতা-কর্মী এই পরিচয়ের সুবাদে তাঁদের কৃতকর্মের কোনো বিচার হয় না। আইনের শাসনের এই বিচ্যুতি প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে কমিটি করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ থেকে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে আমাদের জানা নেই।
সেই সঙ্গে আরো উদ্বেগজনক আরেকটি বিষয় হচ্ছে আমাদের সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদান। দলীয় লোকদের দিয়ে কমিটি করে তথাকথিত রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সঙ্গে এই ক্ষমতার অপব্যবহারটিও একই সুতায় বাঁধা। বিএনপির আমলে সুইডেন প্রবাসী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জিন্টুকে নিতান্ত দলীয় বিবেচনায় ক্ষমা করা হয়েছিল। ওই সময় এ ঘটনা প্রকাশিত হলে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা এর প্রতিবাদ করেছিলেন, এবার ক্ষমতায় এসে তাঁরা সেটাই জায়েজ করলেন। বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি একাধিক মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রেহাই দেওয়ার সিদ্ধান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হীনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এটা সাংবিধানিক ক্ষমতা অপব্যবহারের গুরুতর দৃষ্টান্তও বটে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার অধিকার কোনো সাধারণ অধিকার নয়। ইংলিশ কমন ল-এর যে 'রয়্যাল প্রিরোগেটিভ', সেটাই আমাদের ৪৯ অনুচ্ছেদ ধারণ করেছে। সে কারণেই সংবিধানে বাংলায় 'অধিকার' লেখা হলেও এর ইংরেজি কিন্তু সঠিক অর্থেই 'প্রিরোগেটিভ'। এটা একটি বিশেষ অধিকার। যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত ও সংরক্ষিত অধিকার। আমাদের নীতিনৈতিকতা-বিবর্জিত জনপ্রশাসন রাষ্ট্রপতির 'প্রিরোগেটিভ'কে যেভাবে খোলামকুচি করে ফেলছে, তাতে দেশের বিচারব্যবস্থা বড় ধরনের হোঁচট খেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অপরাধের রাজনৈতিক দায়মুক্তি মানুষকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার মারাত্মক ব্যাধিতে সংক্রমিত করছে। এই প্রেক্ষাপটে তথাকথিত রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার ও দণ্ডিত অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়ার প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমরা এর আগে সংসদ উপনেতার ছেলেকে আইনের কাছে নিজেকে সোপর্দ না করে পলাতক অবস্থায় দণ্ড মওকুফ পেতে দেখেছি। একটি লোমহর্ষক খুনের দণ্ডিত আসামি ১০ বছরের বেশি সময় পালিয়ে থেকে আদালতে আত্মসমর্পণের চার মাস না যেতেই ক্ষমা লাভের ঘটনাও জাতি এই সরকারের আমলে প্রত্যক্ষ করেছে। উপরন্তু এই হত্যাকাণ্ডটি রাজনৈতিকভাবেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এটা পরিষ্কার যে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে দেওয়া রাষ্ট্রপতির অধিকারের অপরিণামদর্শী প্রয়োগ আইনের শাসনের সর্বনাশ ডেকে আনছে। এর আশু প্রতিকারের জন্য আমি দুটি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই। প্রথমত, গত দুই দশকে ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হোক। জাতীয় সংসদে বিষয়টি আলোচনা হোক। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, দণ্ড মওকুফে প্রকৃত যুক্তি থাকতে হবে। ভারতীয় আদালতের এক নির্দেশে হরিয়ানার স্বরাষ্ট্রসচিবকে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে দণ্ড মওকুফের সব তথ্য হলফনামা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছিল। বাংলাদেশেও এ-সংক্রান্ত তথ্য জানানো জরুরি বলে মনে করি। আমাদের সংবিধান একটি বিশেষ ও অত্যন্ত বিরল ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ৪৯ অনুচ্ছেদে যে অধিকার দিয়েছে, তার মর্যাদা ও যথাপ্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার রোধে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি গাইডলাইন বেঁধে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও এ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন জরুরি বলে আমি মনে করি।
আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকলে জনগণ আদালতের দ্বারস্থ হবে না। দল-মত, শ্রেণী-পেশা, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আইন অনুযায়ী সব অপরাধের সঠিক বিচার হবে- এমনটিই কাম্য। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে আবেগের যত গুরুত্ব থাকুক না কেন বিচার ও দণ্ডদানের ক্ষেত্রে আবেগের দ্বারা তাড়িত হলে সেখানে ন্যায়বিচার উপেক্ষার শিকার হতে পারে। দেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হলেও এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্বাধীনতাটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ স্বাধীনতা সক্রিয় না থাকলে এবং তা নির্জীব হয়ে পড়লে সে স্বাধীনতা কোনো কিছু দিয়েই পুনরুদ্ধার করা সম্ভবপর হয় না। যে দেশে ন্যায়বিচার উপেক্ষিত সে দেশ আর যা-ই হোক নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারে না।
আমাদের মতো দেশে রাজনৈতিক কারণে দলীয় লোকজন বিভিন্নভাবে মামলা-হামলার শিকার হতে পারে। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজনৈতিক লোকজনের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানে যথাযথ নজর না দিলে তা বড় ধরনের কোনো সংকটেরও জন্ম দিতে পারে। মামলার উপাদান ও গুণাগুণ বিচার না করেই এভাবে পাইকারিহারে রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার ও দণ্ডিতের শাস্তি মওকুফ ব্যবস্থাটি অপরাধ সংঘটনকে আরো উৎসাহিত করে তুলবে। এভাবে অপরাধীরা দায়মুক্তির লোভে রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে। আর এ অবৈধ সুযোগটি স্বয়ং রাষ্ট্রই করে দিচ্ছে। এতে দেশের ক্ষতির পাশাপাশি রাজনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে অপরাধের রাজনৈতিকীকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
No comments